পরিচ্ছেদ: আত্মশুদ্ধিমূলক মানসিক ও দৈহিক কর্ম
কুরআন-হাদীসের আলোকে আমরা দেখি যে, কিছু মানসিক বা দৈহিক কর্ম আছে যা অতি সহজে আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য ও সাওয়াব লাভে সাহায্য করে। এ সকল কর্ম পালন করলে যাকির অতি অল্প আমলে অধিক সাওয়াব অর্জন করতে পারেন। আমাদের উচিত এগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা।জাগতিক জীবনের অস্থায়িত্ব স্মরণমানব জীবনে জাগতিক, সাংসারিক কর্মকাণ্ড, ব্যস্ততা ও চিন্তাভাবনা থাকবেই। আল্লাহ মানুষকে এসকল কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। তবে এ ব্যস্ততা ও কর্ম নিজের, পরিবারের ও সমাজের সকলের পৃথিবীতে সুন্দররূপে বাঁচার ও পারলৌকিক জীবনে মুক্তি ও আল্লাহর সান্নিধ্যে অফুরন্ত নিয়ামত লাভের জন্য। কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামত ও বরকত অর্জন করে নিজে বাঁচতে হবে এবং অন্যকে বাঁচতে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু শয়তানী প্ররোচনা ও মানবীয় দুর্বলতার কারণে আমরা সৃষ্টি ও কর্মের উদ্দেশ্যের একেবারে বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করি। আমরা স্বার্থপর হয়ে যাই এবং নিজের অপ্রয়োজনীয় ও অবৈধ স্বার্থরক্ষার জন্য অন্যান্যদের অকল্যাণ, ক্ষতি বা ধ্বংস কামনা করি বা সে জন্য চেষ্টা করি। এভাবে আমরা মূলত নিজেদেরকেও ধ্বংস করি। লোভ, লালসা, হিংসা, হানাহানি আমাদের হৃদয় ও জীবনকে বিষাক্ত ও কলুষিত করে, আমাদেরকে স্রষ্টার প্রেম, করুণা ও বরকত থেকে বঞ্চিত করে, তার শাস্তির মধ্যে নিপতিত করে এবং সর্বোপরি আমাদের পারলৌকিক জীবনের কঠিন ধ্বংস ও ক্ষতি নিশ্চিত করে।এ সব ক্ষতিকর পরিণতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য যুগে যুগে অনেক মানুষ সন্যাস, বৈরাগ্য বা সমাজ বিচ্ছিন্ন জীবন বেছে নিয়েছেন। এভাবে সৃষ্টির উদ্দেশ্য ব্যাহত করেছেন। ইসলামে বৈরাগ্য বা সমাজ বিচ্ছিন্ন জীবন নিষিদ্ধ। সমাজের মধ্যে বসবাস করে, সকল কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করার সাথে সাথে নিজের হৃদয়কে মোহমুক্ত রাখা-ই ইসলামী বৈরাগ্য। আর এ অবস্থা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম প্রতিনিয়ত এ জাগতিক জীবনের অস্থায়িত্ব, মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কথা নিজেকে স্মরণ করানো। কুরআন ও হাদীসে এজন্য বারবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ পৃথিবীতে নিজেকে প্রবাসী বা পথিক হিসাবে গণ্য করতে বলা হয়েছে। এ স্মরণ আমাদের জন্য অগণিত সাওয়াব অর্জনের পাশাপাশি আমাদের হৃদয়গুলোকে লোভ, হিংসা, প্রতিহিংসা ইত্যাদির কঠিন ভার থেকে মুক্ত করবে। আমাদের জীবনকে হানাহানি ও হিংস্রতা থেকে মুক্ত করবে।দিনের বিভিন্ন অবসরে ও বিশেষ করে সকালে, সন্ধ্যা বা রাতে নির্ধারিত সময়ে নিজেকে স্মরণ করান: যে মানুষের পরবর্তী নিশ্বাসের নিশ্চয়তা নেই সে কী জন্য হানাহানিতে লিপ্ত হবে? কিজন্য সে লোভ করবে। সেতো পথিক। চলার পথের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করা ও পাথেয় সগ্রহই তো তার কাজ। চলার পথে যদি কেউ কষ্ট দেয় তাকে সম্ভব হলে ক্ষমা করে দিই না কেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই তো তাকে আর দেখব না। রাস্তায়, ফেরীতে, রেলস্টেশনে বা এয়ারপোর্টে বসার চেয়ার, ট্রলি, খাবারের প্লেট, সামান্য ধাক্কাধাক্কির জন্য কি আমরা সময় নষ্ট করে মারামারিতে লিপ্ত হই? এ জীবন তো এ সকল অস্থায়ী স্থানেরই একটু বিস্তৃত রূপ। চেষ্টা করি না কেন এ ক্ষণস্থায়ী জীবনকে ক্ষমা, ভালবাসা ও সেবায় ভরে দিতে। তাতে জীবন হবে আল্লাহর রহমতে ধন্য আর আমি অর্জন করব আখেরাতের অমূল্য পাথেয়।পার্থিব স্বার্থপরতা বা লোভের জন্য প্রভুর নির্দেশনার বাইরে কাজ করছি? কি লাভ হবে তাতে? সে লাভ কি ভোগ করতে পারব? পারলে কতদিন। তারপর তো আমাকে প্রভুর কাছেই ফিরে যেতে হবে। অমুকের খুশির জন্য, তমুকের কাছে বড় হওয়ার জন্য, আরেকজনের কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য আমি এ কাজটি করতে চাচ্ছি। কি লাভ তাতে? সে আমাকে কী দেবে? যা দেবে তা থেকে কি আমি লাভবান হতে পারব? আমাকে তো আমার প্রভুর কাছে একাকীই চলে যেতে হবে। আমার তো বাস্তববাদী হওয়া উচিত। নিজের জাগতিক ও পরকালীন জীবনের জন্য যে কাজে আমার রব খুশি সে কাজই তো আমার করা উচিত।সুপ্রিয় পাঠক, আমাদের উচিত প্রতিদিন নিজেদের বিচার করা। ক্ষণস্থায়ী প্রবাসের ও চিরস্থায়ী আবাসের জন্য যা প্রয়োজনীয় সেগুলোই করা। এ চিন্তা আমাদেরকে উপরে বর্ণিত ক্ষমাময় ও হিংসাহীন হৃদয় অর্জনেও সাহায্য করবে। এ চিন্তাগুলো বেলায়াত ও ইহসানের পথে আমাদের মহামূল্য পাথেয়।সৃষ্টির কল্যাণে রত থাকাআল্লাহর রহমত, বরকত ও সাওয়াব অর্জনের সহজতম পথ আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি, বিশেষত মানুষের প্রতি কল্যাণ ও উপকারের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। সকল জাগতিক প্রয়োজনে সাহায্য করা, সমাজের কিছু মানুষের মধ্যে পরস্পরে গোলমাল বা অশান্তি হলে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, সেবা করা, বিপদে পড়লে উদ্ধার করা, মাযম হলে সাহায্য করা, মৃত্যুবরণ করলে কাফন-দাফনে শরীক হওয়া ইত্যাদি সকল প্রকার মানব সেবামূলক কাজের জন্য অকল্পনীয় সাওয়াব ও মর্যাদার কথা অগণিত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: যতক্ষণ একজন মানুষ অন্য কোনো মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে ততক্ষণ আল্লাহ তার কল্যাণে রত থাকবেন। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় বান্দা যে মানুষের সবচেয়ে বেশি উপকার করে। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় নেক আমল কোনো মুসলিমের হৃদয়ে আনন্দ প্রবেশ করান, অথবা তার বিপদ, কষ্ট বা উৎকণ্ঠা দূর করা, অথবা তার ঋণ আদায় করে দেওয়া, অথবা তার ক্ষুধা দূর করা। আমার কোনো ভাইয়ের কাজে তার সাথে একটু হেঁটে যাওয়া আমার নিকট মসজিদে এক মাস ইতেকাফ করার চেয়েও বেশি প্রিয়। যে ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের সাথে যেয়ে তার প্রয়োজন মিটিয়ে দিবে কিয়ামতের কঠিন দিনে যেদিন সকলের পা পিছলে যাবে সেদিন আল্লাহ তার পা সুদৃঢ় রাখবেন। ... এইরূপ অগণিত হাদীস আমরা হাদীসের গ্রন্থে দেখতে পাই। [মুনযিরী, আত-তাগীব ৩/৩৪৬-৩১, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৯১, সহীহুল জামিয়িস সাগীব ১৯৭।]হিংসামুক্ত কল্যাণ কামনাহৃদয়কে বিদ্বেষ, হিংসা ও অন্যের অমঙ্গল কামনা থেকে মুক্ত রাখা এমন একটি কর্ম যা মানুষকে অতিরিক্ত নফল ইবাদত ও যিকর আযকার ছাড়াই জান্নাতের অধিকারী করে তোলে। আনাস (রা) বলেন, “একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে বসেছিলাম, এমতাবস্থায় তিনি বললেন: এখন তোমাদের এখানে একজন জান্নাতী মানুষ প্রবেশ করবেন। তখন একজন আনসারী মানুষ প্রবেশ করলেন, যাঁর দাড়ি থেকে ওযূর পানি পড়ছিল এবং তার বাম হাতে তার জুতাজোড়া ছিল। পরের দিনও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একই কথা বললেন এবং একই ব্যক্তি প্রবেশ করলেন। তৃতীয় দিনেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রথম দিনের মতোই আবারো বললেন এবং আবারো একই ব্যক্তি প্রবেশ করলেন। তৃতীয় দিনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মজলিস ভেঙ্গে চলে গেলে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) উক্ত আনসারী ব্যক্তির পিছে পিছে যেয়ে বলেন, আমি আমার পিতার সাথে মন কষাকষি করেছি এবং তিন রাত বাড়িতে যাব না বলে কসম করেছি। এ কয় রাত আপনার কাছে থাকতে দিবেন কি? তিনি রাজি হন। (আব্দুল্লাহর ইচ্ছা তিন রাত তার কাছে থেকে তাঁর ব্যক্তিগত ইবাদত জেনে অদ্রপ আমল করা, যেন তিনিও জান্নাতী হতে পারেন)তিনি তিন রাত তার সাথে থাকেন, কিন্তু তাঁকে রাত্রে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করতে বা বিশেষ কোনো নফল ইবাদত পালন করতে দেখেন না। তবে তিন দিনের মধ্যে তাকে শুধুমাত্র ভাল কথা ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোনো খারাপ কথা বলতে শোনেননি। আব্দুল্লাহ বলেন, আমার কাছে তার আমল খুবই নগণ্য মনে হতে লাগল। আমি বললাম: দেখুন, আমার সাথে আমার পিতার কোনো মনমালিন্য হয়নি। তবে আমি পরপর তিনি দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনলাম এখন একজন জান্নাতী মানুষ আসবেন এবং তিনবারই আপনি আসলেন। এজন্য আমি আপনার আমল দেখে সেইমতো আমল করার উদ্দেশ্যে আপনার কাছে তিন রাত্র কাটিয়েছি, কিন্তু আমি আপনাকে বিশেষ কোনো আমল করতে দেখলাম না! তাহলে কী কর্মের ফলে আপনাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জান্নাতী বললেন? তিনি বললেন: তুমি যা দেখেছ এর বেশি কোনো আমল আমার নেই, তবে আমি আমার অন্তরের মধ্যে কোনো মুসলমানের জন্য কোনো অমঙ্গল ইচ্ছা রাখি না এবং আমি কোনো কিছুর জন্য কাউকে হিংসা করি না। তখন আব্দুল্লাহ বলেন: এই কর্মের জন্যই আপনি এই মর্যাদায় পৌছাতে পেরেছেন।” হাদীসটি সহীহ। [মুসনাদু আহমদ ৩/১৬৬, নাসাই, আস-সুনানুল কুবরা ৬/২১৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৭৮-৭৯, মাকদিসী, আল-আহাদীসুল মুখতারাহ ৭/১৮৭, ইবনু আব্দিল বার, আত-তামহীদ ৬/১২১]পাঠক হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন যে, সংঘাতপূর্ণ জীবনে অনেক মানুষ আমাদেরকে কষ্ট দেন, হক নষ্ট করেন, ক্ষতি করেন বা শত্রুতা করেন। অনেকে অকারণেও এগুলো করেন। এদের প্রতি বিদ্বেষ ও শক্রতা থেকে হৃদয়কে কিভাবে বিরত রাখব? আসলে বিষয়টি কঠিন বলেই তো সাওয়াব বেশি। তবে চেষ্টা করলে তা কঠিন থাকে না। মানবীয় স্বভাবের কারণে আমাদের মনে বিশেষ মুহূর্তে ক্রোধ, কষ্ট বা বিরক্তি আসবেই। তবে মনটা একটু শান্ত হলেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনের মধ্য থেকে এ অনুভূতি দূর করার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহর কাছে নিজের জন্য ও যার কর্মে বা ব্যবহারে আমরা কষ্ট পেয়েছি তার জন্য ইস্তিগফার করতে হবে ও দোয়া করতে হবে।প্রয়োজনে নিজের হক রক্ষার জন্য চেষ্টা করতে হবে। তবে অধিকার আদায়ের চেষ্টা বা কর্ম আর মনের হিংসা ও শক্রতা এক নয়। এক ব্যক্তি আমার অধিকার নষ্ট করেছেন, আমি তার নিকট থেকে আমার অধিকার আদায়ের চেষ্টা করছি। কিন্তু তার সাথে আমার অন্য কোনো শত্রুতা নেই। আমি আমার অধিকার ফেরৎ পাওয়া ছাড়া তার কোনো প্রকার অমঙ্গল কামনা করি না। বরং আমি সর্বদা তার জন্য দোয়া করি। এভাবে হৃদয়কে অভ্যস্ত করলে ইনশা আল্লাহ আমরা উপরিউক্ত সাহাবীর মতো হতে পারব এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত জীবিত করার সাওয়াব অর্জন করতে পারব।আত্মনিয়ণ ও ধৈর্যধারণমন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সহজেই অত্যন্ত বেশি সাওয়াব অর্জনের অন্যতম মাধ্যম সবর বা ধৈর্যধারণের গুণ অর্জন করা। ধৈর্য মুমিনের জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধৈর্য বলতে নিষ্ক্রিয় নির্জীবতা বুঝানো হয় না, বরং সক্রিয় আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বুঝানো হয়। পারিপার্শিক অবস্থা বা অন্যের আচরণ দ্বারা নিজের আচরণ প্রভাবিত না করে নিজের স্থির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিজেকে পরিচালিত করার ক্ষমতা। এক কথায় Re-active না হয়ে Pro-active হওয়া। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:“ধৈর্য ও উদারতাই সর্বোত্তম ঈমান।” হাদীসটি সহীহ। [আলবানী, সিলসিলাতুস সাহীহাহ ৩/৪৮২, নং ১৪৯৫।]ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ধৈর্য তিন প্রকারের: ১. বিপদ-আপদ ও কষ্টে ধৈর্য, ২. পাপ ও লোভ থেকে ধৈর্য এবং ৩. ক্রোধের মধ্যে ধৈর্য।বিপদে হতাশ বা অধৈর্য হয়ে পড়া একদিকে যেমন ঈমানের পরিপন্থী, অপরদিকে তা মানবীয় ব্যক্তিত্বের চরম পরাজয়। হতাশা, অস্থিরতা বা উৎকণ্ঠা বিপদ দূর করেনা, বিপদের কষ্ট কমায় না বা বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ দেখায় না। সর্বোপরি হতাশা বা ধৈর্যহীনতা স্বয়ং একটি কঠিন বিপদ যা মানুষকে আরো অনেক কঠিন বিপদের মধ্যে নিপতিত করে। পক্ষান্তরে ধৈর্য বিপদ দূর না করলেও তা বিপদ নিয়ন্ত্রণ করে, বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য শান্তভাবে চিন্তা করার সুযোগ দেয় এবং অস্থিরতা জনিত অন্যান্য বিপদের পথরোধ করে। সর্বোপরি বিপদে কষ্টে ধৈর্যের মাধ্যমে মুমিন আল্লাহর নিকট মহান মর্যাদা, সাওয়াব, জাগতিক বরকত ও পারলৌকিক মুক্তি অর্জন করেন। কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে: “আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্য পরীক্ষা করব। আর আপনি শুভ সংবাদ প্রদান করুন ধৈর্যশীলদেরকে, যারা তাদের উপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তার দিকেই প্রত্যাবর্তণকারী। [সূরা বাকারা, ১৫৫-১৫৬]ধৈর্য হলো কর্মময় স্থিরচিত্ততা ও হতাশামুক্ত সুদৃঢ় মনোবল। মুমিন দৃঢ় মনোবল নিয়ে নিজের কল্যাণ ও স্বার্থ অর্জনের জন্য চেষ্টা করবেন। বিপদে আপদে কখনোই অতীতের ভুলভ্রান্তি নিয়ে হতাশা বা আফসোস করে সময় নষ্ট করবেন না বা মনের মধ্যে শয়তানের কুমন্ত্রণা ও হতাশার অনুপ্রবেশের দরজা খুলে দিবেন না। বরং যা ঘটার আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটেছে এ বিশ্বাস নিয়ে ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং দৃঢ় মনোবল নিয়ে কর্মের পথে এগোতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:“শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিনের চেয়ে অধিক প্রিয় ও অধিক কল্যাণময়, যদিও প্রত্যেকের ভিতরেই কল্যাণ রয়েছে। তোমার জন্য যা কল্যাণকর তা অর্জনের জন্য তুমি সুদৃঢ় মনোবল নিয়ে সচেষ্ট হও এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। কখনোই হতাশা বা অবসাদগ্রস্ত হবে না। যদি তুমি কোনো বিপদে-অসুবিধায় নিপতিত হও তবে তুমি বলবে না যে, যদি আমি এইরূপ করতাম!! বরং তুমি বলবে: আল্লাহর নির্ধারণ এবং তিনি যা ইচ্ছা করেছেন তাই করেছেন। কারণ যদি করতাম!!' বলে অতীতের কর্ম নিয়ে আফসোস শয়তানের কর্মের পথ উন্মুক্ত করে।” [মুসলিম (৪৬-কিতাবুল কদর, ৮-বাবুন ফিল আমরি বিলওয়াতি) ৪/২০৫২, নং ২৬৬৪, (ভা, ২/৩৩৮)]ক্রোধের সময় ধৈর্যধারণ ঈমানের অন্যতম দিক। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: “যে অপরকে মল্লযুদ্ধে পরাজিত করতে পারে সে প্রকৃত বীর নয়, প্রকৃত বীর যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে পারে। [বুখারী (৮১-কিতাবুল আদব, ৭৬ বাবুল হারি মিনাল গাদাব) ৫/২২৬৭, (ভা ২৯০৩); মুসলিম (৪৫| কিতাবুল বির, ৩০- বাব ফাদলি মান ইয়ামলিকু..)৪/২০১৪, নং ২৬০৯, (ভারতীয় ২৩৬)]আবু দারদা (রা) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলেন, আমাকে এমন একটি কর্ম শিখিয়ে দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তিনি বলেন:“তুমি রাগবে না; তাহলেই জান্নাত তোমার জন্য। [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৭০ হাদীসটি সহীহ]ক্রোধের সময় আত্মনিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যার প্রতি ক্রোধের উদ্রেক হয়েছে বা যে কষ্ট দিয়েছে তাকে ক্ষমা করতে ও তার সাথে উত্তম আচরণ করতে বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কুরআন ও হাদীসে। বিশেষত যাকে শাস্তি দেওয়া সম্ভব সেরূপ ব্যক্তিকে ক্ষমা করা অতীব প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন:وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ۚ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌঅর্থঃ “ভাল এবং মন্দ (আচরণ) সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। এ গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই যারা ধৈর্যশীল, এ গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই যারা মহা ভাগ্যবান। [সূরা হা মীম সাজদা (ফুসিলাত), ৩৩-৩৫ আয়াত]প্রকৃত মুমিনদের বৈশিষ্ট বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:وَالَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ وَإِذَا مَا غَضِبُوا هُمْ يَغْفِرُونَ ﴿٣٧﴾অর্থঃ “তারা কবীরা গোনাহসমূহ ও অশ্লীল কর্ম বর্জন করে এবং যখন তারা ক্রোধান্বিত হয় তখন তারা ক্ষমা করে।” [সূরা শূরা, ৩৭ আয়াত]অন্যত্র জান্নাতী মুমিনদের পরিচয়ে আল্লাহ বলেছেন:وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ﴿١٣٤﴾অর্থঃ “তারা ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানুষদেরকে ক্ষমা করে।” [সূরা আল-ইমরান, ১৩৪ আয়াত]ইবনু উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “যে ব্যক্তি ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করবে আল্লাহ তার দোষ-ক্রটি গোপন রাখবেন। বিরক্তি ও ক্রোধে উত্তেজিত অবস্থায় যদি কেউ রাগ প্রকাশের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সম্বরণ করে তবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার হৃদয়কে পরিতৃপ্তি ও সন্তুষ্টি দ্বারা পূর্ণ করবেন।” হাদীসটি হাসান। [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৯১; আলবানী, সহীহুল জামি ১৯৭]ক্রোধ সম্বরণ করা ও ক্রোধের সময় আত্ম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিভিন্ন পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন, সেগুলির মধ্যে রয়েছে, ক্রোধান্বিত হলে আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম' পাঠ করা, আল্লাহর ক্রোধের কথা স্মরণ করা, উত্তেজিত অবস্থায় কথা না বলে চুপ করে থাকা, মুখে-মাথায় ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করা, ওজু করা, দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে শয়ন করা ইত্যাদি।