০১

দোয়ার অর্থ

০২

আল্লাহর যিকরের সাধারণ ফযীলত

০৩

দোয়া ক্ববুলের সময় ও স্থান

০৪

দোয়া করার আদব বা বৈশিষ্ট্য

০৫

যে সকল স্থানে হাত তুলে দোয়া করা যায়

০৬

দোয়ার প্রকারভেদ

০৭

যেসব কারণে দোয়া কবুল হয় না

০৮

দোয়া করার নিয়মকানুন

০৯

যাদের দোয়া কবুল হয়

১০

দোয়ার মহত্ত্ব

১১

দোয়া কবুলের শর্ত ও যেসব কারণে দোয়া কবুল হয় না

১২

দোয়া কবুলের শর্তাবলি

১৩

যিকর বা আল্লাহর স্মরণের মর্মকথা

১৪

তাওয়াক্কা করে দোয়া পরিত্যাগ

১৫

আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দোয়া

১৬

মুসলিম সমাজের দোয়া কেন্দ্রিক শিরক

১৭

কুরআন আলোচনা ও গবেষণার ফযীলত

১৮

যিকর বিষয়ক কয়েকটি বিধান

১৯

তাওহীদের প্রতি ঈমান

২০

রিসালাতের প্রতি ঈমান

২১

আল্লাহর ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য ভালোবাসা

২২

ভালবাসার মাপকাঠি রাসুলের (ﷺ) অনুসরণ

২৩

আল্লাহর জন্য ভালবাসা-ই ঈমান

২৪

ঈমানী ভালোবাসার অন্তরায়

২৫

অতিরিক্ত কিছু নফল সালাত

২৬

মানুষের জীবনে দোয়ার গুরুত্ব

২৭

আল্লাহর কাছে যা চাওয়া বেশি গুরুত্বপূ

২৮

রুকিয়াহ বা ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসা

২৯

নবি (ﷺ)-এর উদ্দেশে দরুদ পড়ার মহত্ত্ব

৩০

ইস্তিগফারের মূলনীতি

৩১

তাওবা-ইস্তিগফারের ফযীলত ও নির্দেশনা

৩২

দোয়া বা প্রার্থনা জ্ঞাপক যিকর

৩৩

দোয়ার কতিপয় মাসনুন নিয়ম ও আদব

৩৪

শুধু আল্লাহর কাছেই চাওয়া

৩৫

কুরআনী যিকরের বিশেষ ফযীলত

৩৬

কুরআন তিলাওয়াতের আদব ও নিয়ম

৩৭

আত্মশুদ্ধিমূলক মানসিক ও দৈহিক কর্ম

৩৮

হতাশা বর্জন ও আল্লাহর প্রতি সু-ধারণা

৩৯

কৃতজ্ঞতা ও সন্তুষ্টি

৪০

নির্লোভ

৪১

নফল সিয়াম ও নফল দান

৪২

কিয়ামুল লাইল, তাহাজ্জুদ ও রাতের যিকর

পরিচ্ছেদ: রিসালাতের প্রতি ঈমান

ঈমানের দ্বিতীয় অংশ (মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ) অথবা (মুহাম্মাদান আবৃদুহু ওয়া রাসূলুহ) অর্থাৎ মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করা। সংক্ষেপে একে রিসালাত”-এর ঈমান বলা হয়।(আবদ) অর্থ বান্দা, দাস বা ক্রীতদাস'। আরবীতে প্রতিটি মানুষকেই আল্লাহর আবদ বা বান্দা বলা হয়। পূর্ববর্তী নবীগণের উম্মতদের ঈমান বিনষ্ট হয়ে শিরকে নিপতিত হওয়ার মূল কারণ ছিল নবীগণ বা ওলীগণের বিষয়ে অতিভক্তি করা, তাদেরকে আল্লাহ সত্তা বা যাতের অংশ, প্রকাশ, আল্লাহর সাথে একীভূত বা ফানা ও ক্ষমতা প্রাপ্ত, ইলাহীয় বা ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী ইত্যাদি মনে করা। সর্বশেষ উম্মাতকে এ সকল শিরক থেকে রক্ষা করার জন্য মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতের বিশ্বাসের সাথে তার আবদিয়্যাত’-এর বিশ্বাসকে অবিচ্ছেদ্যভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আল্লাহর রাসূল, তবে তিনি তাঁর বান্দা (দাস), মাখলূক (সৃষ্ট) ও মানুষ। তিনি কোনোভাবেই আল্লাহর যাত (সত্তা) বা সিফাত (বিশেষণ)-এর অংশ বা প্রকাশ নন। মহান আল্লাহ সৃষ্টকর্তা, মালিক ও উপাস্য। মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর মাখলূক (সৃষ্ট), বান্দা (দাস) ও উপাসক রাসূল।(রাসূল) অর্থ বার্তাবাহক (Messenger) আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান, বিবেক, স্বাধীন ইচ্ছা ও বিচার শক্তি দান করেছেন; যেন মানুষ ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণ করে ন্যায় ও ভালর পথে চলে এবং মন্দ ও অন্যায়ের পথ থেকে নিজেকে দূরে রাখে। উপরন্তু মানুষকে ন্যায়ের পথের সন্ধান ও তাকওয়ার বাস্তব মডেল দেওয়ার জন্য আল্লাহ যুগে যুগে প্রত্যেক জাতি, সমাজ বা জনগোষ্ঠির মধ্য থেকে কিছু মানুষকে মনোনীত করে তাদের কাছে ওহী বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে তার বাণী ও নির্দেশ প্রেরণ করেছেন। যেন তারা মানুষদেরকে তা শিক্ষা দান করেন এবং নিজেদের জীবনে তার বাস্তব ও পরিপূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের সামনে বাস্তব আদর্শ তুলে ধরেন। এদেরকে ইসলামের পরিভাষায় নবী ও রাসূল বলা হয়।কুরআন ও হাদীসের বিস্তারিত দিকনির্দেশনার আলোকে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আল্লাহর রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করার অর্থ অতি-সংক্ষেপে নিম্নরূপ:১. মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর মনোনীত নবী ও রাসূল। মানবজাতির মুক্তির পথের নির্দেশনা দানের জন্য তাদের ইহলৌকিক সকল কল্যাণ ও অকল্যাণের পথ শিক্ষা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাকে মনোনীত করেছেন। মানবজাতির মুক্তির পথ, কল্যাণ ও অকল্যাণের সকল বিষয় আল্লাহ তাকে জানিয়েছেন এবং তা মানুষদেরকে শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তাঁকে দান করেছেন।২. তিনি আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তার পরে আর কোনো ওহী নাযিল হবে না, কোনো নবী বা রাসূল আসবেন না।৩. মুহাম্মাদ (ﷺ) বিশ্বের সকল দেশের সকল জাতির সব মানুষের জন্য আল্লাহর মনোনীত রাসূল। তার আগমনের দ্বারা পূর্ববর্তী সকল ধর্ম রহিত হয়েছে। তার রিসালাতে বিশ্বাস ছাড়া কোনো মানুষই মুক্তির দিশা পাবে না।৪. মুহাম্মদ (ﷺ) পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর নবুয়তের ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহর সকল বাণী, শিক্ষা ও নির্দেশ তিনি পরিপূর্ণভাবে তাঁর উম্মতকে শিখিয়ে গিয়েছেন, কোন কিছুই তিনি গোপন করেননি।৫. মুহাম্মাদ (ﷺ) যা কিছু উম্মতকে জানিয়েছেন সবকিছুই তিনি সত্য বলেছেন। তার সকল শিক্ষা, সকল কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য।৬. আল্লাহকে ডাকতে, উপাসনা করতে, তাঁর নৈকট্য বা সন্তুষ্টি অর্জন করতে অবশ্যই মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর শিক্ষা অনুসরণ করতে হবে। তার শিক্ষার বাইরে ইবাদত করলে তা কখনো আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।৭. জীবনের সকল ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে তার আনুগত্য করা। জীবনের সকল বিষয়ে তাঁর শিক্ষা, বিধান ও নির্দেশ দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেওয়া। সকল মানুষের কথা ও সকল মতের উর্ধ্বে তাঁর শিক্ষা ও কথাকে স্থান দেওয়া।৮. তাঁর শিক্ষা অনুসারে সকল মতবিরোধের নিষ্পত্তি করা। মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ ঘটলে ফয়সালার জন্য তাঁর শিক্ষার, অর্থাৎ কুরআন- হাদীসের শিক্ষার আশ্রয় নিতে হবে। কুরআনের বা হাদীসে নির্দেশনভ সর্বান্তঃকরণে মেনে নিতে হবে। তার মতকে সকল মতের উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে।৯. জীবনের সকল পর্যায়ে তার অনুসরণ ও অনুকরণ করা এবং তার সুন্নাত (জীবনপদ্ধতি) অনুসারে নিজেকে পরিচালিত করা। তাঁর সুন্নাত বা জীবনাদর্শই মুসলিমের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ বলে সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা।১০. মুহাম্মদ (ﷺ)-কে সর্বোচ্চ সম্মান করা। একথা বিশ্বাস করা যে, তিনি সর্ব কালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, মানবজাতির নেতা, নবী-রাসূলদের প্রধান। তিনি আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা, তাঁর হাবীব, তাঁর সবচেয়ে সম্মানিত বান্দা, সর্বযুগের সকল মানুষের নেতা। তিনি নিস্পাপ। নবুয়ত প্রাপ্তির আগে ও নুবুওয়াতের পরে সর্ব অবস্থায় আল্লাহ তাকে সকল পাপ, অন্যায় ও অপরাধ থেকে রক্ষা করেছেন। প্রথম মানব আদম (আ)-এর সৃষ্টির সময়েই আল্লাহ তার জন্য নবুয়ত নির্ধারণ করে রাখেন এবং তাকে সর্বশেষ নবী হিসাবে মনোনীত করেন।১১. মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মর্যাদা ও সম্মানের ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস সম্মান ঈমানের মৌলিক বিষয় এবং ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলি প্রত্যেক মানুষের জন্য দ্ব্যর্থহীন ও সহজবোধ্যভাবে বর্ণনা করাই ওহীর মূল কাজ। এখানে ঘোরপ্যাচ, ব্যাখ্যা ও ইজতিহাদের অবকাশ রাখার অর্থ ঈমান ও নাজাতকে কঠিন করা।এজন্য কুরআন-হাদীসে তাঁর সম্মান, মর্যাদা, দায়িত্ব, ক্ষমতা ইত্যাদি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। মুসলিমের দায়িত্ব তার বিষয়ে কুরআন কারীম বা সহীহ হাদীসে যা বলা হয়েছে তা পরিপূর্ণভাবে বাহ্যিক ও সহজ অর্থে সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করা। নিজের থেকে কোন কিছু বাড়িয়ে বলা যাবে না, কারণ তা আমাদেরকে মিথ্যা ও বাড়াবাড়ির পথে ঠেলে দেবে, যা কুরআন ও হাদীসে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এ জাতীয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:ক. কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীসের আলোকে একজন মুমিন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, সকল মর্যাদা ও সম্মান সহ তিনি আল্লাহর একজন বান্দা (দাস) ও একজন মানুষ। সৃষ্টির উপাদানে, মানবীয় প্রকৃতি ও স্বভাবে তিনি একজন মানুষ। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তার মূল বৈশিষ্ট্য তাঁর মহান কর্মে, তার মহোত্তম চরিত্রে। উপাদানে, সৃষ্টিতে ও প্রকৃতিতে অন্য সবার মত হয়েও তিনি সকল মানবীয় দুর্বলতা জয় করেছিলেন। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ভক্তি, ভালবাসা, আস্থা, ইবাদত, বিধান পালন, ন্যয়বিচার, সেবা ইত্যাদি সকল দিকে মানবতার পূর্ণতম নিদর্শন ও আদর্শ ছিলেন তিনি। এটিই ছিল তাঁর অন্যতম মুজিজা। তিনি মানবতার পূর্ণতার শিখরে উঠেছিলেন, তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।এগুলির পাশাপাশি মহান আল্লাহ তাকে অতিরিক্ত কিছু বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন, যেগুলি কোন মানুষকে দেন নি। যেমন সাধারণ মানুষের মত তার ঘামে কোন দুর্গন্ধ ছিলনা, বরং তার শরীরের ঘাম ছিল অত্যন্ত সুগন্ধ। তার ঘুম সাধারণ মানুষের মত ছিল না; তিনি ঘুমালেও আর তার অন্তর সজাগ ও সচেতন থাকত। তিনি সালাতের মধ্যে তার পিছন দিকেও দেখতে পেতেন। অনুরূপ যত বৈশিষ্ট সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে সবই মুমিন কোনরূপ অপব্যাখ্যা, বাড়াবাড়ি, তুলনা বা সন্দেহ ছাড়া বিশ্বাস করেন।খ. আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের অতীত-ভবিষ্যৎ অনেক কিছু জানিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের জ্ঞানের ঊর্ধ্বে অনেক গোপনীয় ও ভবিষ্যতের জ্ঞান তাকে আল্লাহ দান করেন। সাথেসাথে কুরআন ও হাদীসে বারবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, সার্বিক গাইব ও ভবিষ্যতের কথা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। আল্লাহর জানানো বিষয় ছাড়া কোন ভবিষ্যৎ কথা, মনের গোপন কথা, বর্তমানের লুক্কায়িত কথা, গোপনকৃত তথ্য ইত্যাদি তিনি জানতেন না বলে তিনি আমাদেরকে কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে বারবার জানিয়েছেন। আমরা তার সকল কথা সরলভাবে বিশ্বাস করি। এক আয়াত দ্বারা আরেক আয়াতকে বা এক হাদীস দ্বারা অন্য হাদীসকে বাতিল বা অপব্যাখ্যা করি না, কোন একটির জন্য বাড়াবাড়ি করি না বা অতিভক্তি করি না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সকল কথা সরলভাবে হুবহু মেনে নেওয়াই সর্বোচ্চ ভক্তি।গ. আল্লাহর আবদ (দাস) ও রাসূল হিসাবে তাঁকে আল্লাহ। মানবজাতিকে সতর্ক করা ও সুসংবাদ প্রদান করার দায়িত্ব দান করেন। বিশ্ব জগতের পরিচালনা, কারো মঙ্গল বা অমঙ্গল করার দায়িত্ব বা ক্ষমতা আল্লাহ তাঁকে দেন নি। তাঁকে আল্লাহ অনেক মুজিযা বা অলৌকিক নিদর্শন দান করেছেন। তার দোয়ায় আল্লাহ অগণিত অলৌকিক কর্ম সম্পন্ন করেছেন। এসকল আয়াত (অলৌকিক নিদর্শন) বা মুজিযা সবই আল্লাহর ইচ্ছায় ও ক্ষমতায় সংঘটিত হয়েছে। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, আর দোয়া কবুল করা বা না করা পুরোপুরিই আল্লাহর এখতিয়ার। তিনি আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা। তার অনেক দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন। আবার কখনো কখনো কবুল করেননি। তিনি বদদোয়া করলে আল্লাহ তাঁকে নিষেধ করেছেন। তাঁর দোয়ায় আল্লাহ অসংখ্য মানুষের গোনাহ মাফ করেছেন। আল্লাহর অনুমতিতে তিনি শাফায়াত করবেন এবং তার শাফায়াতে অসংখ্য পাপী মুসলিমকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। তবে তাঁর দোয়া ও শাফায়াত কবুল করা আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহর রহমত ও তাঁর রাসূলের দোয়ার কল্যাণ পাওয়ার যোগ্য কে তা আল্লাহ জাল্লা জালালুহ-ই ভাল জানেন।ঘ. তিনি অন্যান্য সকল মানুষের মত মরণশীল। তিনি যথা সময়ে মৃত্যু বরণ করেছেন। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাঁকে মৃত্যুর পরে বিশেষ বারযাখী হায়াত বা জীবন দিবেন যাতে তিনি নামায পড়বেন, উম্মতের দরুদ সালাম ফিরিশতাগণ তার কাছে পেীছাবেন, তিনি জবাব দিবেন ও দোয়া করবেন। হাদীসে বর্ণিত এসকল বিষয় আমরা সরলভাবে বিশ্বাস করি। এগুলির উপর নির্ভর করে বাড়িয়ে অন্য কিছু বলি না। আমরা বলি না যে, যেহেতু তার বিশেষ জীবন আছে, সেহেতু তিনি খাওয়া দাওয়া করেন, অথবা ঘুরে বেড়ান, ইত্যদি। তিনি আমাদের যতটুকু জানার প্রয়োজন তা জানিয়ে দিয়েছেন, তার বেশি বলার অর্থ তার নামে আন্দাযে মিথ্যা কথা বলা, যা কঠিনতম পাপ ও জাহান্নামের কারণ।ঙ. তিনি নিজে তার বিষয়ে বাড়াবাড়ি অপছন্দ করতেন। তিনি বলেন: “তোমরা আমার প্রশংসায়-ভক্তিতে বাড়াবাড়ি করবে না, যেমনভাবে খৃষ্টানরা ঈসা (আ)-কে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিলে। আমি তো একজন বান্দা (দাস) মাত্র, কাজেই তোমরা বলবে: আল্লাহর দাস (বান্দা) ও রাসূল।” [সহীহ বুখারী, ফাতহুল বারী ৬/৪৭৮, নং ১৩৪৪৫, মুসনাদে আহমাদ ১/২৩, ২৪, ৪৭, ৫৫, ৬০] একদা এক ব্যক্তি তাঁকে বলেন: “আল্লাহর মর্জিতে এবং আপনার মর্জিতে ..।” [মুসনাদে আহমাদ ১/২১৪, ২৮৩] তিনি তাকে ধমক দিয়ে বলেন: “তুমি আমাকে আল্লাহর সমতুল্য বানিয়ে দিচ্ছ? বরং একমাত্র আল্লাহর মর্জিতেই।” এক ব্যক্তি বলে: ইয়া মুহাম্মাদ, ইয়া সাইয়েদানা, ইবনা সাইয়েদানা, খাইরানা, ইবনা খাইরান: হে মুহাম্মাদ, হে আমাদের নেতা, আমাদের নেতার পুত্র, আমাদের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি ও শ্রেষ্ঠ মানুষের সন্তান। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: “হে মানুষেরা, তোমরা তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) অবলম্বন কর। শয়তান যেন তোমাদেরকে বিপথগামী না করে। আমি মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ, আল্লাহর বান্দা (দাসচাকর) ও রাসূল। আল্লাহর কসম! আল্লাহ জাল্লা শানুহু আমাকে যে স্থানে রেখেছেন, যে মর্যাদা প্রদান করেছেন তোমরা আমাকে তার উপরে উঠাবে তা আমি পছন্দ করি না।” [মুসনাদে আহমদ, নং ১২১৪১, ১৩১১৭, ১৩১৮৪]১২. “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে সকল মানুষের উর্ধ্বে, নিজের সম্পদ, সন্তান, পিতামাতা ও নিজের জীবনের চেয়ে অধিক ভালবাসা। তাঁর মহান সাহাবীগণ ও তার আত্মীয় স্বজনকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা করা তার ভালবাসার অবিচ্ছেদ্য অংশ।রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ভালবাসা মুখের দাবীর ব্যাপার নয়। তার নির্দেশিত পথে চলা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলা, তার শরীয়তকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করা এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে দূরে থাকাই তার মহব্বতের প্রকাশ। তাঁর আনুগত্য, অনুসরণ ও শরীয়ত পালন ব্যতিরেকে যদি কেউ তার ভালবাসার দাবি করেন তবে তিনি মিথ্যাবাদি অথবা তিনি আবু তালিব-এর মত তাকে ভালবাসেন। এরূপ ভালবাসা মুক্তির পথ নয়।ভালোবাসা বা ভালবাসার স্বাভাবিক প্রকাশ কোনোভাবে ‘ভালোবাসাকৃতকে’ কষ্ট না দেওয়া; প্রাণপনে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা। এজন্য প্রকৃত ভালবাসা পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুকরণে ধাবিত করে। আর আনুগত্য ও অনুকরণ ভালবাসাকে গভীর থেকে গভীরতর করে। যে যত বেশী তাঁর শরীয়তকে মেনে চলবেন এবং তাঁর সুন্নাত মত জীবন যাপন করবেন, তার ভালবাসা তত বেশী অর্জন করবেন। সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও বুজুর্গগণ কর্ম ও অনুসরণের মাধ্যমেই তাকে ভালবেসেছেন।এভাবেই মুসলিমের অন্তরে তাঁর প্রতি ভালবাসা গভীর হতে থাকে, তখন জীবনের সবকিছুর ঊর্ধ্বে, সকল মানুষের উর্ধ্বে, এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও তাকে ভালবাসতে সক্ষম হয় একজন মুসলিম। আমার আল্লাহর দরবারে সকাতরে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রকৃত অনুসরণের ও প্রকৃত ভালবাসার তাওফীক দান করেন। আমীন।

সেটিংস

বর্তমান ভাষা