পরিচ্ছেদ: রুকিয়াহ বা ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসা
কুরআন ও সুন্নাহ'র মাধ্যমে চিকিৎসা করার গুরুত্বএ নিয়ে কোনও সন্দেহ-সংশয় নেই যে, মহিমান্বিত কুরআন ও নবি (ﷺ) থেকে প্রমাণিত ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসা হলো একটি উপকারী চিকিৎসা-পদ্ধতি; এতে রয়েছে। পরিপূর্ণ রোগমুক্তি। আল্লাহ তাআলা বলেন—قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ ءَامَنُوا هُدًى وَشِفَآءٌ ﴿٤٤﴾অর্থঃ “বলো, এ কুরআন মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রোগ মুক্তি বটে।” (সূরা ফুসসিলাত ৪১:৪৪)وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْءَانِ مَا هُوَ شِفَآءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَঅর্থঃ “আমি এ কুরআনে এমন কিছু অবতীর্ণ করছি, যা মুমিনদের জন্য নিরাময় ও রহমত।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৮২)উপরিউক্ত আয়াত থেকে মনে হতে পারে, কুরআনের কিছু অংশে নিরাময় রয়েছে; বিষয়টি এমন নয়, বরং এখানে সামগ্রিকভাবে নিরাময়ের বিষয়টি এসেছে; মূলত সমগ্র কুরআনই হলো নিরাময়, যেমনটি সূরা ফুসসিলাত-এর ৪৪ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।يٰٓأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَآءٌ لِّمَا فِى الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ ﴿٥٧﴾অর্থঃ “হে লোকেরা! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নসীহত এসে গেছে৷ এটি এমন জিনিস যা অন্তরের রোগের নিরাময় এবং যে তা গ্রহণ করে নেয় তার জন্য পথনির্দেশনা ও রহমত”। (সূরা ইউনুস ১০:৫৭)সুতরাং কুরআন হলো সকল প্রকার রোগের নিরাময়—হোক তা মানসিক বা শারীরিক, দুনিয়া-ভিত্তিক কিংবা পরকাল-কেন্দ্রিক। অবশ্য প্রত্যেক ব্যক্তি কুরআনের মাধ্যমে নিরাময় লাভের যোগ্য নয়। অসুস্থ ব্যক্তি যদি কুরআনের চিকিৎসা উত্তমভাবে গ্রহণ করে এবং সত্যবাদিতা, ঈমান, (ইসলামের বিধানাবলি) পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ, দৃঢ়বিশ্বাস ও যাবতীয় শর্ত পূরণ করে কুরআন দ্বারা নিজের ব্যাধির উপশম ঘটানোর চেষ্টা করে—তা হলে ব্যাধি কখনও তাকে পরাভূত করতে পারবে না। আর রোগ-ব্যাধি কেমন করেই বা আসমানজমিনের অধিপতির কথাকে পরাভূত করবে, যা পাহাড়ের উপর নাযিল হলে পাহাড়ে ফাটল সৃষ্টি করত কিংবা ভূমিতে নাযিল হলে ভূমিকে বিদীর্ণ করে দিত? সুতরাং দেহ ও মনের এমন কোনও ব্যাধি নেই, যার উপশম-পদ্ধতি, কার্যকারণ ও সুরক্ষা-কৌশলের ব্যাপারে কুরআনে দিকনির্দেশনা নেই; তবে সেসব দিকনির্দেশনা কেবল তাদের জন্য প্রযোজ্য, আল্লাহ যাদেরকে তাঁর গ্রন্থ বোঝার সামর্থ্য দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে দেহ ও মনের রোগ-ব্যাধি এবং সেসবের প্রতিকার উল্লেখ করেছেন।মনের রোগ দু' ধরনের: ১. সন্দেহ-সংশয়ের রোগ এবং ২. লোভ-লালসার রোগ।আল্লাহ তাআলা মনের রোগ-ব্যাধিসমূহ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে, সেসব রোগের কার্যকারণ ও প্রতিকার তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:أَوَلَمْ يَكْفِهِمْ أَنَّآ أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتٰبَ يُتْلٰى عَلَيْهِمْ ۚ إِنَّ فِى ذٰلِكَ لَرَحْمَةً وَذِكْرٰى لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ﴿٥١﴾অর্থঃ “আর এদের জন্য কি এ (নিদর্শন) যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদেরকে পড়ে শুনানো হয়? আসলে যারা ঈমান আনে তাদের জন্য এর মধ্যে রয়েছে রহমত ও নসিহত৷” (সূরা আল-আনকাবূত ২৯:৫১)আল্লামা ইবনুল ক্বয়্যিম (রহ) বলেন, “কুরআন দিয়ে যার রোগ-ব্যাধির উপশম হয় না, তাকে আল্লাহ আর রোগমুক্তি দেবেন না; কুরআন যার জন্য পর্যাপ্ত হয় না, তার পর্যাপ্ত হওয়ার জন্য আল্লাহ তাকে আর কিছুই দেবেন না। [যাদুল মাআদ, ৪/৩৫২]দেহের রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা সংক্রান্ত মূলনীতিগুলোর ব্যাপারে কুরআনে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মহিমান্বিত কুরআনে সমগ্র দেহের চিকিৎসা সংক্রান্ত তিনটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে: ১. সুস্থতা বজায় রাখা, ২. কষ্টদায়ক বস্তু থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা, এবং ৩. কষ্টদায়ক ও খারাপ উপকরণ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেওয়া। [প্রাগুক্ত, ৪/৬ ও ৪/৩৫২]বান্দা যদি যথাযথভাবে কুরআন দিয়ে চিকিৎসা করে, তা হলে সে দ্রুত আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে এর চমকপ্রদ প্রভাব দেখতে পাবে। ইমাম ইবনুল ক্বয়্যিম (রহ) বলেন, “মক্কাতে আমার কিছু সময় কেটেছে, যখন আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কোনও ডাক্তার বা ঔষধপত্র—কিছুই পাচ্ছিলাম না। এর পরিপ্রেক্ষিতে সূরা আল-ফাতিহা দিয়ে নিজের চিকিৎসা চালাতে থাকি। ফলে এর চমকপ্রদ ফল দেখতে পাই। জমজম থেকে পানি নিয়ে তার উপর বেশ কয়েকবার সূরা আল-ফাতিহা পাঠ করি। তারপর তা পান করি। দেখি, এর ফলে আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেছি! এরপর বিভিন্ন ধরনের ব্যথার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতির উপর নির্ভর করতে শুরু করি এবং এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ পর্যায়ের উপকার লাভ করতে থাকি। কেউ ব্যথার ব্যাপারে অনুযোগ করলে, তাকে এ পরামর্শ দিতাম। এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের অনেকে খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠত।” [যাদুল মাআদ, ৪/১৭৮; আল-জাওয়াবুল কাফী, ২২]তেমনিভাবে, সর্বাধিক উপকারী প্রতিকারগুলোর একটি হলো নবি (ﷺ) থেকে প্রমাণিত ঝাঁড়ফুক ভিত্তিক চিকিৎসা। যেসব কারণে দোয়া কবুল হয় না সেসব কারণ না থাকলে, অপছন্দনীয় জিনিস প্রতিরোধ ও কাঙিক্ষত জিনিস লাভের ক্ষেত্রে দোয়াও একটি উপকারী মাধ্যম, বরং তা হলো সর্বাধিক উপকারী প্রতিকারগুলোর একটি, বিশেষত যদি দোয়ার মধ্যে পর্যাপ্ত আকুতি থাকে। দোয়া হলো বিপদ-মুসিবতের শত্রু; এটি বিপদকে প্রতিহত ও উপশম করে, এর আপতিত হওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে, কিংবা বিপদ একান্ত এসেই পড়লে—তাকে দুর্বল করে দেয়। [আল-জাওয়াবুল কাফী, ২২-২৫] “যেসব বিপদ এসে গিয়েছে, আর যা এখনও আসেনি—উভয় ক্ষেত্রেই দোয়া উপকারী। তবে এখানে একটি বিষয় ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত; আর তা হলো, কুরআনের আয়াত, দোয়া, যিকর, আল্লাহর আশ্রয় লাভের বিভিন্ন বাক্য—যার মাধ্যমে (আল্লাহর কাছে) নিরাময় চাওয়া হয় এবং যা দিয়ে ঝাড়ফুক। দেওয়া হয়—স্বয়ং এগুলো হলো উপকারী এবং উপশমকারী, তবে তা কবুল হওয়া ও এর ফলাফল পাওয়া নির্ভর করে দোয়াকারীর (নৈতিক) শক্তির উপর। উপশম হতে দেরি হলে, তা হয় কর্তার দুর্বলতা বা অগ্রহণযোগ্যতার দরুন কিংবা এমন কোনও শক্তিশালী কার্যকারণের দরুন যা ঔষধের কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করে।ঝাঁড়ফুক ভিত্তিক চিকিৎসার দুটি দিক রয়েছে:১. রোগীর দিক, এবং ২. চিকিৎসকের দিক।রোগীর ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা হলো—তার নিজের (নৈতিক) শক্তি থাকা, সত্যিকার অর্থে তার মন আল্লাহ-মুখী হওয়া। এবং এ মর্মে দৃঢ় বিশ্বাস থাকা যে, কুরআন হলো মুমিনদের জন্য নিরাময় ও করুণা। আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার বিশুদ্ধ পদ্ধতি হলো—তাতে অন্তর ও জিহ্বাকে একাত্ম করে নেওয়া; কারণ এটি হলো এক ধরনের যুদ্ধ৷ দুটি বিষয় ছাড়া কোনও যোদ্ধা তার। শত্রুর বিরুদ্ধে পূর্ণ জয়লাভ করতে পারে না:১. স্বয়ং অস্ত্রটি হতে হবে ত্রুটিমুক্ত ও মানসম্মত এবং ২. বাহু হতে হবে শক্তিশালী; যেখানে কোনও একটির কমতি থাকে, সেখানে অস্ত্র কোনও কাজে আসে না। উভয়টিই অনুপস্থিত থাকলে, পরিণতি কী হতে পারে তা সহজে অনুমান করা যায়: একদিকে অন্তর। থাকছে তাওহীদ, তাওয়াক্কুল, তাকওয়া ও আল্লাহমুখিতা থেকে মুক্ত, আরেকদিকে হাতে নেই কোনও অস্ত্র!কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে যিনি চিকিৎসা করবেন, তার মধ্যেও এ দুটি গুণ থাকা চাই। [যাদুল মাআদ, ৪/৬৮; আল-জাওয়াবুল কাফী, ২১] এ জন্য ইবনুত তীন বলেছেন, “আল্লাহর কাছে আশ্রয় লাভের দোয়া পাঠ এবং আল্লাহর নাম উচ্চারণের মাধ্যমে ঝাড়ফুক হলো আত্মিক চিকিৎসা; সৃষ্টিকুলের মধ্যে ভালো লোকদের মুখে তা উচ্চারিত হলে, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় রোগ-ব্যাধির নিরাময় ঘটে।” [ফাতহুল বারী, ১০/১৯৬] এ বিষয়ে বিদ্বানবর্গ একমত যে, তিনটি শর্ত পূরণ হলে ঝাড়ফুক করা বৈধ:১. ঝাড়ফুক হতে হবে আল্লাহ তাআলার কথা অথবা তাঁর নাম ও গুণাবলি কিংবা তাঁর রাসূল (ﷺ) কথা উচ্চারণ করার মাধ্যমে;২. তা হতে হবে আরবি ভাষায় অথবা অন্য এমন কোনও ভাষায় যার অর্থ বোঝা যায়;৩. এ বিশ্বাস রাখা যে, ঝাঁড়ফুকের নিজস্ব কোনও প্রভাব নেই, বরং নিরাময় হয় কেবল আল্লাহ তাআলার শক্তি বলেই ঝাঁড়ফুক হলো একটি মাধ্যম মাত্র।ভবিষ্যদ্বক্তা অথবা গণক কিংবা জাদুকরের দ্বারস্থ হওয়াআয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘লোকজন আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে ভবিষ্যদ্বক্তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “এদের কোনও ভিত্তি নেই। তারা বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তারা মাঝে মধ্যে আমাদেরকে এমন কিছু বলে, যা পরবর্তী সময়ে সত্য প্রমাণিত হয়!” এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন, “সত্যের ওই কথাটুকু জিন ছোঁ মেরে নিয়ে আসে। তারপর সে তার মনিবের কানে তা ঠেসে দেয়। আর ভবিষ্যদ্বক্তারা এর সঙ্গে একশ'টা মিথ্যা মিশিয়ে নেয়।” [বুখারি, ৫৭৬২; মুসলিম, ২২২৮]নবি (ﷺ)-এর কোনও এক স্ত্রী থেকে বর্ণিত, নবি (ﷺ) বলেন, “যে-ব্যক্তি কোনও ভাগ্য-গণনাকারীর কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করে, চল্লিশ রাত পর্যন্ত তার সালাত কবুল। হবে না।” [মুসলিম, ২২৩০]আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবি (ﷺ) বলেন, “যে-ব্যক্তি কোনও ভবিষ্যবক্তা অথবা ভাগ্যগণনাকারীর কাছে যায় এবং সে যা বলে তা সে সত্য মনে করে, সে মুহাম্মাদ (ﷺ) এর উপর নাযিলকৃত বিষয়াদিকে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে।” [আহমাদ, ২/৪২৯, সহীহ]আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন, “যেব্যক্তি ঋতুমতী নারী গমন করে অথবা নারীর পশ্চাদ্গমন করে অথবা কোনও ভাগ্যগণনাকারীর কাছে গিয়ে তার কথাকে সত্য মনে করে—সে মুহাম্মাদ (ﷺ) এর উপর নাযিলকৃত বিষয়াদিকে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে।” [বুখারি, আত-তারীখুল কাবীর, ৩/১৬-১৭; আবু দাউদ, ৩৯০৪; তিরমিযি, ১৩৫, সহীহ]