পরিচ্ছেদ: আল্লাহর যিকরের সাধারণ ফযীলত
মোল্লা আলী কারী (রহ) (১০১৪ হি) বলেন: আল্লামা ইবনুল জাযারী (রহ) (৮০৮ হি) বলেছেন: “যিকরের ফযীলত শুধু তাসবীহ, তাহলীল, তাকবীর ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং যিনিই আল্লাহর আনুগত্যে লিপ্ত বা আল্লাহর আনুগত্যমূলক কোনো কর্মে লিপ্ত আছেন তিনিই যিকিরে লিপ্ত আছেন বা তিনিই যাকির। সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর কুরআন কারীম, তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেখানে কুরআন ছাড়া অন্য কিছুর মাধ্যমে যিকরের বিধান দিয়েছেন সেখানে সেই যিরই উত্তম, যেমন রুকু ও সাজদার অবস্থায়। অন্য সকল ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ যিকর কুরআন।” [মুল্লা আলী কারী, আল-মিরকাত ৫/৩২]মোল্লা আলী কারী (রহ) অন্যত্র বলেন: “আল্লাহর যিকর অর্থ ঐ সকল যিকর যা জপ করলে বা পাঠ করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যাবে। যেমন, কুরআন তিলাওয়াত, সালাত পাঠ, তাসবীহ-তাহলীল, পিতামাতার জন্য দোয়া বা অনুরূপ যিকরাদি। আর আল্লাহর যিকারী বলতে তাঁকে বুঝান হয় যিনি হাদীসে বর্ণিত মাসনূন যিকিরগুলো সকল সময়ে ও অবস্থায় পালন করেন।” [মুল্লা আলী কারী, আল-মিরকাত ৫/৬০, ৬৫]হাদীস শরীফে কয়েকভাবে যিকরের ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে:ক. সাধারণভাবে যিকরের ফযীলত,খ. প্রত্যেক প্রকার যিকরের জন্য বিশেষ ফযীলত এবংগ. বিশেষ সময়ের বিশেষ যিকরের ফযীলত। প্রথমে আমরা যিকরের সাধারণ ফযীলত বিষয়ক কিছু হাদীস আলোচনা করব।১. আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:“নিঃসঙ্গ একাকী মানুষেরা এগিয়ে গেল।” সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, মুফাররাদ বা একাকী মানুষেরা কারা ?” তিনি বলেন: “আল্লাহর বেশি বেশি যিকারীগণ।” [মুসলিম (৪৮-কিতাবুয যিকর.. ১.বাবুল হাসি আলা যিকরিল্লাহ) ৪/২০৬২; ভারতীয় ২/১৭৫]অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন:“একাকী অগ্রগামীগণ যারা সর্বদা বেপরোয়াভাবে আল্লাহর যিকর করেন ও যিকরে মত্ত থাকেন। যিকরের কারণে তাদের (গোনাহের) বোঝা হাল্কা হয়ে যাবে। এজন্য কিয়ামতের দিন তাঁরা হাল্কা হয়ে হাজির হবেন।” [তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাওয়াত, জামিউদ দাওয়াত, বাব ১২৯ ফিল আফবি ওয়াল আফিয়াহ) ৫/৫৩৯ (ভারতীয় ২০০) তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান গারীব]২. মুআয ইবনু জাবাল (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে আমার সর্বশেষ যে কথাটি হয়েছিল, যে কথাটি বলে আমি তার থেকে শেষ বিদায় নিয়েছিলাম তা হলো, আমি প্রশ্ন করেছিলাম: হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে প্রিয় আমল (কর্ম) কোনটি? তিনি বলেন:“আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কর্ম যে, তুমি যখন মৃত্যু বরণ করবে তখনো তোমরা জিহ্বা আল্লাহর যিক্রে আর্দ্র থাকবে।” [বুখারী, খালকু আফআলিল ইবাদ ১/৭২, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৯৯, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৪-৭৬, মুনযিরী, আত তারগীব ওয়াত তারহীব ২/৩৬৭, আলবানী, সহীহুল জামিয়িস সাগীর ১৯৫, নং ১৬৫, হাইসামী, মাওয়ারিদুষ যামআন ৭/৩১৩-৩১৫]অর্থাৎ, সদা সর্বদা মুমিন মুখে আল্লাহর যিকর করবে। এরূপ হলে তাঁর যখন মৃত্যু হবে তখনো তাঁর জবান যিকরেই ব্যস্ত থাকবে।৩. আব্দুল্লাহ ইবনু বুসর (রা) বলেন: এক ব্যক্তি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইসলামের বিধানাবলী আমার জন্য বেশি হয়ে গিয়েছে। আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা আমি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকব। তিনি বলেন:“তোমার জিহ্বা যেন সর্বদা আল্লাহর যিক্রে আর্দ্র থাকে।” হাদীসটি সহীহ। [তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাওয়াত, ৪- বাব.. ফাদলিৰ যিকর ৫/৪২৭-৪২৮ (ভারতীয় ২২০০); সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৯৬; মুসতাদরাক হাকেম ১/৪৯৫, হাইসামী, মাওয়ারিদুয় যামআন ৭/৩১২]৪. আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ৭ প্রকারের মানুষকে আল্লাহ কিয়ামতের দিনে তাঁর (আরশের) ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে এক শ্ৰেণী:“যে ব্যক্তি একাকী আল্লাহর যিকর করেছেন আর তাঁর চোখ থেকে অশ্রুর ধারা নেমেছে।” [বুখারী (১৫-কিতাবুল আযান, ৮-বাৰ মান জালাসা ফিল মাসজিদি) ১/২৩৪ (ভারতীয়: ১ম খণ্ড, পৃ. ৯১)]৫. আবু মূসা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:“যে ঘরে আল্লাহর যিকর হয় আর যে ঘরে আল্লাহর যিকর হয় না তাদের তুলনা জীবিত ও মৃতের ন্যায়।” [মুসলিম (৬-সালাতিল মুসাফিরীন, ২৯-বাব ইসতিহবফী বাইতিহী) ১/৫৩৯ (ভারতীয় ১/২৬৫)]৬. আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:“যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতে আদায় করবে, এরপর বসে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর যিক্রে রত থাকবে। এরপর সে দুই রাকআত সালাত আদায় করবে, সে একটি হজ্ব ও একটি ওমরার সাওয়াব পাবে, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ (হজ্ব ও ওমরার সাওয়াব)” [হাদীসটি হাসান। তিরমিযী (আবওয়াবুস সাফার, ৪১২-বাৰ... জুসি ফিল মাসজিদি) ২৪৮১ (ভারতীয় ১১৩০); আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১১১। তিরমিযী, আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে হাসান বলেছেন]৭. আবু দারদা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:“আমি কি তোমাদেরকে বলব না তোমাদের জন্য সর্বোত্তম কর্ম কোনটি? তোমাদের প্রভুর নিকট সবচেয়ে পবিত্র, তোমাদের জন্য সবচেয়ে উঁচু মর্যাদার কারণ, স্বর্ণ ও রৌপ্য দান করার চেয়েও উত্তম, জিহাদের ময়দানে শক্রর মুখোমুখি হয়ে শত্রু নিধন করতে করতে শাহাদত বরণ করার থেকেও উত্তম কর্ম কি তা-কি তোমাদেরকে বলব? সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, সেই কর্মটি কী? তিনি বললেন: আল্লাহর যিকর। মুআয ইবনু জাবাল (রা) বলেন: “আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর যিকর থেকে উত্তম কোনো আমল কোনো মানুষ করে নি।” [হাদীসটি সহীহ। তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাওয়াত, ৬-বাব..) ৫/৪২৮ (ভারতীয় ১৭৫); মুসনাদ আহমদ (আরনাউত) মত সাভারন প্রমুখ মুহা ৫/১৯৫; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৩, ৭৪; মুসতাদরাক হাকিম ১/৬৭৩; আলবানী, সাহীহু সুনানি ইবনি মাজাহ ২/৩১৬]দুটি ভুল ধারণা:এ হাদীসটি সমাজে অতি পরিচিত। এখানে দুটি বিষয় ভুল বুঝা হয়:ক. আল্লাহর যিকর’ বলতে আল্লাহ, আল্লাহ...' যিকর বুঝা।আমরা দেখলাম যে, কুরআন-হাদীসে আল্লাহর যিকর বলতে শুধু আল্লাহর নাম জপ করা বা আল্লাহ আল্লাহ যিকর করা বুঝানো হয় নি। বরং আল্লাহর নামের মর্যাদা জপ করা বুঝানো হয়েছে। শুধু আল্লাহ নামটি জপ করলে আঙ্খিানিকভাবে তা ‘যিকর বলে গণ্য হতে পারে, তবে তা মাননূন বা সুন্নাত পদ্ধতি নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কি কখনোই সকালে, সন্ধ্যায়, অন্য কোনো সময়ে, নির্দিষ্ট সংখ্যায় বা বেশি বেশি করে শুধু ‘আল্লাহ’ নামটি জপ করেন নি বা করতে শিক্ষা দেন নি। সাহাবীগণও অনুরূপ কিছু করেন নি। এখন যদি কেউ মনে করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আল্লাহর যিক্রের জন্য যে সকল বাক্যাদি শেখালেন ও পালন করলেন সেসকল যিকর কলব সাফ হবে না, আল্লাহর নামের মহিমা, মর্যাদা, গুণগান ইত্যাদি জপ করলে কলব সাফ হবে না বরং সকল মর্যাদা, প্রশংসা, স্তুতি, মহিমা ও গুণগান জ্ঞাপক শব্দ বাদ দিয়ে শুধু তাঁর নামটি’ জপ করলেই কলব সাফ হবে, তবে ধারণাটি ঠিক হবে না। দুনিয়াতে আমরা কোনো সম্মানিত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করলে ন্যাংটো নাম” বা “শুধু নাম” না বলে তার আগে বা পরে সম্মান প্রকাশক কোনো “সিফাত” বা বিশেষণ উল্লেখ করি। সুন্নাতের নির্দেশনা হলো, মহান আল্লাহর নামটি শুধু” উচ্চারণ না করে “আল্লাহ” নামটির সাথে তার মর্যাদা বা প্রশংসা জ্ঞাপক কোনো শব্দ যোগ করে যিকর করতে হবে।মহা মহিমান্বিত আল্লাহর পবিত্র নাম মুমিনের হৃদয়ে সবচেয়ে বড় সম্পদ। তার নামেরই যিকর করতে হবে। তার মহান আল্লাহ” নামে বা যে কোনো নামে যে কোনো ভাষায় তাঁর স্মরণ করলেই তাঁর যিক্রের সাওয়াব মিলবে, ইনশা আল্লাহ। তবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে মাসনূন-ভাবে বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শেখানো পদ্ধতিতে আল্লাহর যিকর করার। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিক্ষা থেকে আমরা জানতে পরি যে, শুধু নাম জপ করে নয়, বরং তার নামের মহিমা প্রকাশ করে যিকর করতে হবে। তিনি উম্মতকে শত শত প্রকারের যিকর শিক্ষা দিয়েছেন এবং নিজেও পালন করেছেন। কিন্তু শুধু “আল্লাহ” নাম জপ করতে হবে একথা তিনি কোথাও শেখাননি। তাঁর শিক্ষা থেকে আমরা জানতে পারি যে, দোয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর নাম ধরে তাকে ডাকতে হবে, দোয়া করতে হবে, তার সকল মহান নাম ও বিশেষ করে ইসমে আযম ধরে তার কাছে দোয়া করতে হবে। আর যিক্রে তাঁর নামের মহিমা, মর্যাদা, গুণগান, স্তুতি প্রকাশক বাক্যাদি জপ করে তার যিকর করতে হবে।খ. অনেকে মনে করেন, কলব সাফ করতে হলে যিকরের শব্দ দিয়ে জোরে জোরে কলবে ধাক্কা মারা বা আঘাত করার কল্পনা করতে হবেএ ধারণাটিও ভুল ও সুন্নাত পরিপন্থী। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মতকে অগণিত যিকর শিক্ষা দিয়েছেন। কখনো কোথাও যিক্রের সময় এ ধরনের শব্দ করতে বা আঘাত করতে শেখাননি। বরং নীরবে ও অনুচ্চস্বরে যিকর করতে শিখিয়েছেন। একেবারে শেষ যুগের কোনো কোনো যাকির মনোযোগ অর্জনের জন্য এ সকল পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। আবার অনেকে তার বিরোধিতা করেছেন। মুজাদ্দিদ আলফ সানী (রাহ) কোনো প্রকার যিক্রের সময় কোনো প্রকার শব্দ করতে বা শরীর, মাথা ইত্যাদি নাড়াতে নিষেধ করেছেন। সর্বাবস্থায় এ সকল কাজের সাথে যিকরের কোনো সম্পর্ক নেই। যে কোনো মাসনূন পদ্ধতিতে আল্লাহর স্মরণ করলে মুমিন আল্লাহর যিকরের উপরে বর্ণিত মর্যাদা, ফযীলত, উপকার সবই অর্জন করবেন।