পরিচ্ছেদ: দোয়ার কতিপয় মাসনুন নিয়ম ও আদব
সুন্নাতের অনুসরণসুন্নাতের গুরুত্ব ও বিদআতের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি “এহইয়াউস সুনান গ্রন্থে। আমরা দেখেছি যে, সুন্নাত অনুসারে সামান্য ইবাদত বিদআত মিশ্রিত অনেক ইবাদতের চেয়ে উত্তম। সুন্নাতের বাইরে বা সুন্নাতের অতিরিক্ত কোনো ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না, ইবাদতকারী যত ইখলাস ও আবেগসহ তা পালন করুন না কেন। যিকর, দোয়া ইত্যাদিও এই সাধারণ বিধানের অন্তর্ভুক্ত। আর সুন্নাতের অনুসরণ দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ কারণ। আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:“কোনো বয়স্ক মুসলিম যদি সৎকর্মশীল এবং সুন্নাতের কঠোর অনুসারী হন তাহলে তিনি কোনো কিছু আল্লাহর কাছে চাইলে আল্লাহ তাঁর প্রার্থিত বস্তু না দিতে লজ্জা পান।” হাদীসটির সনদ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৪৯]সর্বদা দোয়া করামানব প্রকৃতির একটি বিশেষ দিক আনন্দের সময়ে আল্লাহকে ভুলে থাকা কিন্তু বিপদে পড়লে বেশি বেশি দোয়া করা। নিঃসন্দেহে এ আচরণ মহান প্রতিপালকের প্রকৃত দাসত্বের অনুভূতির সাথে সাংঘর্ষিক। কুরআনে বিভিন্ন স্থানে এ স্বভাবের নিন্দা করা হয়েছে। এক স্থানে আল্লাহ বলেন:وَإِذَا أَنْعَمْنَا عَلَى الْإِنسَانِ أَعْرَضَ وَنَأَىٰ بِجَانِبِهِ وَإِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ فَذُو دُعَاءٍ عَرِيضٍঅর্থঃ “যখন আমি মানুষকে নিয়ামত প্রদান করি তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও দূরে সরে যায়। আর যখন কোনো অমঙ্গল বা কষ্ট তাকে স্পর্শ করে তখন সে লম্বা চওড়া দোয়া করে।” [সূরা (৪১) ফুসসিলাত: ৫১]মুমিনের উচিত সকল অবস্থায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। নিয়ামতের মধ্যে থাকলে তার স্থায়িত্ব প্রার্থনা করা ও সকল অকল্যাণ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া। কোনো অসুবিধা থাকলে তার কাছে আশ্রয় ও মুক্তি চাওয়া। এ মুমিনের চরিত্র। মুমিনের অন্তর এভাবে শান্তি পায়। আর এরূপ অন্তরের দোয়াই আল্লাহ কবুল করেন। আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বলেছেন:“যে ব্যক্তি চায় যে কঠিন বিপদ ও যন্ত্রণা-দুর্দশার সময় আল্লাহ তার প্রার্থনায় সাড়া দিবেন, সে যেন সুখশান্তির ও সচ্ছলতার সময় বেশি বেশি আল্লাহর কাছে দোয়া করে।” হাদীসটি সহীহ। [তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাওয়াত, বাব..দাওয়াতাল মুসলিমি..) ৫/৪৩১ (৪৬২), নং ৩৩৮২ (ভারতীয় ২১৭৫), মুসতাদরাক হাকিম ১/৭২৯]বেশি করে চাওয়াদুনিয়া ও আখেরাতের সবকিছুই আল্লাহর কাছে চাইতে হবে এবং বেশি করে চাইতে হবে। আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:“তোমাদের কেউ যখন কামনা বা প্রার্থনা করবে তখন সে যেন বেশি করে চায়; কারণ সে তো তার মালিকের কাছে চাচ্ছে (কাজেই, কম চাইবে কেন, তিনি তো অপারগ নন কৃপণও নন)” হাদীসটির সনদ সহীহ। [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫০]শুধুই মঙ্গল কামনাঅনেক সময় আমরা আবেগ, বিরক্তি, রাগ, কষ্ট ইত্যাদির কারণে মনে মনে নিজের বা অন্যের ক্ষতিকর কোনো কিছু কামনা করি। বিষয়টি খুবই অন্যায়। অন্তরকে নিয়ন্ত্রিত করুন। সর্বদা কল্যাণময় বিষয় কামনা করুন। কষ্ট বা রাগের কারণে অকল্যাণজনক কিছু কামনা না করে এমন কল্যাণময় কিছু কামনা করুন যা কষ্ট, বেদনা বা রাগের কারণ চিরতরে দূর করবে।আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “যখন তোমাদের কেউ কামনা বা প্রার্থনা করে তখন সে যেন কি চাচ্ছে তা ভাল করে চিন্তা করে দেখে; কারণ তার কোন্ কামনা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যাচ্ছে তা সে জানে না। (এমন কিছু যেন কেউ কামনা বা প্রার্থনা না করে যার জন্য পরে আফসোস করতে হয়)” হাদীসটি সহীহ। [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫১]অন্য হাদীসে উম্মু সালামাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “তোমরা নিজেদের উপর কখনো ভাল ছাড়া খারাপ দোয়া করবে না; কারণ ফিরিশতাগণ তোমাদের দোয়ার সাথে আমীন’ বলেন।” [মুসলিম (১১-কিতাবুল জানায়িয, বাব ফী ইমাদিল মাইয়্যিতি) ২/৬৩৪, নং ৯২০ (ভার, ১/৩০১)]আরেক হাদীসে জাবির (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “তোমরা কখনো নিজেদের বা তোমাদের সন্তানদের বা তোমাদের মালসম্পদের অমঙ্গল বা ক্ষতি চেয়ে বদদোয়া করবে না। কারণ, হয়ত এমন হতে পারে যে, যে সময়ে তোমরা বদদোয়া করলে, সে সময়টি এমন সময় যখন আল্লাহ বান্দার সকল প্রার্থনা কবুল করেন এবং যে যা চায় তাকে তা প্রদান করেন। এভাবে তোমাদের বদদোয়াও তিনি কবুল করে নেবেন।” [মুসলিম (৫৩-কিতাবুয যুহদ, ১৮-বাব হাদীস জাবির) ৪/২৩০৪, নং ৩০০৯ (ভারতীয় ২/৪১৬)]ফলাফলের জন্য ব্যস্ত না হওয়াদোয়ার ফল লাভে ব্যস্ত হওয়া মানবীয় প্রকৃতির একটি ক্ষতিকারক দিক। বিশেষত বিপদে, সমস্যায় বা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে আমরা যখন দোয়া করি তখন তৎক্ষণাৎ ফল আশা করি। দুচার দিন দোয়া করে ফল না পেলে আমরা হতাশ হয়ে দোয়া করা ছেড়ে দি। এ হতাশা ও ব্যস্ততা ক্ষতি ও গোনাহের কারণ। কখনোই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। আমাদের বুঝতে হবে যে, দোয়া করা একটি ইবাদত ও অপরিমেয় সাওয়াবের কাজ। আমি যত দোয়া করব ততই লাভবান হব। আমার সাওয়াব বৃদ্ধি পাবে, আল্লাহর সাথে আমার একান্ত রহমতের সম্পর্ক তৈরি হবে। সর্বোপরি আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেনই। তবে তিনিই ভাল জানেন কিভাবে ফল দিলে আমার বেশি লাভ হবে।আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “বান্দা যতক্ষণ পাপ বা আত্মীয়তার ক্ষতিকারক কোনো কিছু প্রার্থনা করে ততক্ষণ তার দোয়া কবুল করা হয়, যদি না সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।” বলা হলো: “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ব্যস্ততা কিরূপ?” তিনি বলেন: “প্রার্থনাকারী বলতে থাকে - দোয়া তো করলাম, দোয়া তো করলাম ; মনে হয় আমার দোয়া কবুল হলো না। এভাবে সে হতাশ হয়ে পড়ে এবং তখন দোয়া করা ছেড়ে দেয়।” [মুসলিম (৪৮-কিতাৰু যিকর ২৫-বাৰ.. ইউসতায়াবুদ দায়ী) ৪/২০৯৫, নং ২৭৫ (ভার, ২/৩৫২)]আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “বান্দা যতক্ষণ না ব্যস্ত ও অস্থির হয়ে পড়ে ততক্ষণ সে কল্যাণের মধ্যে থাকে।” সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: ব্যস্ত হওয়া কিরূপ? তিনি বলেন: সে বলে - আমি তো দোয়া করলাম কিন্তু দোয়া কবুল হলো না।” হাদীসটি হাসান। [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইহ ১০/১৪৭]মনোযোগ ও কবুলের দৃঢ় আশাআমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে, বান্দা যেভাবে তার প্রভুর প্রতি ধারণা পোষণ করবে, তাকে ঠিক সেভাবেই পাবে। কাজেই প্রত্যেক মুমিনের উপর দায়িত্ব, আল্লাহর রহমত, ক্ষমা ও ভালবাসার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় রাখা। আল্লাহ আমাকে ভালবাসেন, তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন এবং তিনি আমাকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। এ দৃঢ় প্রত্যয় মুমিনের অন্যতম সম্বল ও মহোত্তম সম্পদ।প্রার্থনার ক্ষেত্রেও এ প্রত্যয় রাখতে হবে। অন্তরের গভীর থেকে মনের আকুতি ও সমর্পণ মিশিয়ে নিজের সবকিছু আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। সাথে সাথে সুদৃঢ় প্রত্যয় রাখতে হবে, আল্লাহ অবশ্যই আমার প্রার্থনা শুনবেন।ইবনু উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “হে মানুষেরা, তোমরা যখন আল্লাহর কাছে চাইবে, তখন কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে চাইবে; কারণ কোনো বান্দা অমনোষেগী অন্তরে দোয়া করলে আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন না।” হাদীসটি হাসান। [হাইসামী, মাজমাউয সাওয়াইদ ১০/১৪৮; আলবানী, সহীহুত তারগীব ২/১৩৩]অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “তোমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করার সময় দৃঢ়ভাবে (একীন) বিশ্বাস রাখবে যে, আল্লাহ নিশ্চয় কবুল করবেন। আর জেনে রাখ, আল্লাহ কোনো অমনোযোগী বা অন্য বাজে চিন্তায় রত মনের প্রার্থনা কবুল করেন না।” [তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাওয়াত, ৬৪-বাব জামিউদ দাওয়াত ৫/৪৮৩ (৫১৭) নং ৩৪৭৯ (ভারতীয় ২/১৮৬), আলবানী, সহীহুত তারগীব ২১৩৩। আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন]নিজের জন্য নিজে দোয়া করাঅনেকে নিজের জন্য নিজে আল্লাহর দরবারে দোয়া চাওয়ার চেয়ে অন্য কোনো বুজুর্গের কাছে দোয়া চাওয়াকেই বেশি উপকারী বলে মনে করেন। পিতামাতা, উস্তাদ, আলিম বা নেককার কোনো জীবিত মানুষের কাছে দোয়া চাওয়া জায়েয। তবে নিজের দোয়া নিজে করাই সর্বোত্তম। আমরা অনেক সময় মনে করি, আমরা গোনাহগার, আমাদের দোয়া কি আল্লাহ শুনবেন? আসলে গোনাহগারের দোয়াই তো তিনি শুনেন। আমার মনের বেদনা, আকুতি আমি নিজে আমার প্রেমময় মালিকের নিকট যেভাবে জানাতে পারব সেভাবে কি অন্য কেউ তা পারবেন। এছাড়া এ দোয়া আমার জন্য সাওয়াব বয়ে আনবে এবং আমাকে আল্লাহর প্রেম ও করুণার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আয়েশা (রা) বলেন: আমি প্রশ্ন করলাম, “হে আল্লাহর রাসূল, সর্বোত্তম দোয়া কি?” তিনি উত্তরে বলেন:“মানুষের নিজের জন্য নিজের দোয়া।” [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫২। হাইসামী বলেন, হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য। তবে আলবানী সনদ দুর্বল বলেছেন। দেখুন: যয়ীফুল আদাৰিল মুফরাদ, পৃ. ৯০; যায়ীফাহ ৪/৬৬]অন্যের জন্য দোয়ার শুরুতে নিজের জন্য দোয়ামুমিন সর্বদা নিজের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। অন্য কারো জন্য দোয়া করলে তখন সে সুযোগে নিজের জন্য দোয়া করা উচিত। যেমন, কারো রোগমুক্তির জন্য দোয়া করতে হলে বলা উচিত: আল্লাহ আমাকে সুস্থতা দান করুন এবং তাঁকেও সুস্থতা দান করুন। অথবা, কেউ বললেন: আমরা জন্য দোয়া করুন।' তখন বলা উচিত: আল্লাহ আমার কল্যাণ করুন ও আপনার কল্যাণ করুন।' রাসূলাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত কারো জন্য দোয়া করলে প্রথমে নিজের জন্য দোয়া করা। আবু আইউব আনসারী (রা) বলেন:“নবী (ﷺ) যখন দোয়া করতেন তখন নিজেকে দিয়ে শুরু করতেন।” [মুসনাদ আহমদ ৫/১২১, ১২২; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫২। হাদীসটি হাসান]কোনো নবীর কথা উল্লেখ করলে তিনি প্রথমে নিজের জন্য দোয়া করে এরপর সেই নবীর জন্য দোয়া করতেন। বলতেন: “আমাদের উপর আল্লাহর রহমত এবং আমাদের অমুক ভাইয়ের উপর।” যেমন, বলতেন: “আমাদের উপর আল্লাহর রহমত এবং মূসার উপর।” [মুসলিম (৪৩-কিতাবুল ফাযায়িল, ৪৬-বাব ফাদয়িলিল খাদির) ৪/১৮৫১-১৮৫২ (ভারতীয় ২২৭১)]অনুপস্থিতদের জন্য দোয়া করাপ্রত্যেক মুমিনের উচিত, আল্লাহর কাছে দোয়া করার সময় শুধু নিজের জন্য দোয়া না করে অন্যান্য মুসলিম ভাইবোনের জন্যও দোয়া করা। বিশেষ করে যাদেরকে তিনি আল্লাহর জন্য মহব্বত করেন, যারা কোনো সমস্যা বা বিপদে আছে বলে তিনি জানেন বা যারা তার কাছে দোয়া চেয়েছেন। সকল বিশ্বের নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য দোয়া করা প্রয়োজন। কারো অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোয়া করলে উক্ত দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন এবং প্রার্থনাকারীকেও উক্ত নিয়ামত দান করবেন বলে বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে।তাবেয়ী সাফওয়ান ইবনু আব্দুল্লাহ বলেন, আমি সিরিয়ায় গিয়ে (আমার শ্বশুর) আবু দারদার (রা) বাসায় দেখা করতে গেলাম। তিনি বাসায় ছিলেন না। (আমার শাশুড়ি) উম্মু দারদা আমাকে বললেন: তুমি কি এ বছর হজ্ব করতে যাচ্ছ? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বললেন: তাহলে আমাদের জন্য দোয়া করবে।একথা বলে তিনি বলেন, আবু দারদা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “কোনো মুসলিম যখন তার কোনো অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দোয়া করে তখন আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেন। তার মাথার কাছে একজন ফিরিশতা নিয়োজিত থাকেন। যখনই সে মুসলিম তার অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য কোনো কল্যাণ বা মঙ্গল চায়, তখনই ফিরিশতা বলেন: আমীন, এবং আপনার জন্যও অনুরূপ (আল্লাহ আপনাকেও প্রাথিত বিষয়ের অনুরূপ দান করুন)” [মুসলিম (৪৮-কিতাবুয যিকর, ২৩-দোয়া লিলমুসলিমীন..) ৪/২০৯৪, নং ২৭৩২,২৭৩৩ (জ, ২/৩৫২)]আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “যখন কোনো মানুষ যখন তার কোনো অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দোয়া করে, তখন ফিরিশতাগণ বলেন: আমীন, এবং আপনার জন্যও অনুরূপ।” [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫২। হাদীসটির সনদ সহীহ]রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নির্যাতিত মুসলমিদের জন্য মাঝে মাঝে ফজর, মাগরিব বা অন্য সালাতের শেষ রাকাতের রুকুর পরে দোয়া করতেন। আবু হুরাইরা (রা) বলেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন রুকু থেকে মাথা উঠাতেন তখন সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ’, ‘রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ’ বলে নাম উল্লেখ করে করে অনেকের জন্য দোয়া করতেন। তিনি বলতেন: আল্লাহ, আপনি ওলীদ ইবনুল ওলীদ, সালামাহ ইবনু হিশাম, আইয়াশ ইবনু আবী রাবীআহ এবং দুর্বল মুমিনদেরকে রক্ষা করুন। হে আল্লাহ আপনি মুদার গোত্রকে কঠিনভাবে পাকড়াও করুন এবং ইউসূফ (আ)এর দুভিক্ষের ন্যায় দুর্ভিক্ষের মধ্যে নিপতিত করুন। [বুখারী (১৬-সিফাতিস সালাত, ৫২১-বাৰ ইয়াহৰী বিত-তাকবীর..) ১৩৭৬ (ভা:১/১১০); মুসলিম (৫-কিতাবুল মাসাজিদ, ৫৪-বাৰ ইতিহাবুল কুদৃত) ১৪৬৬, ৪৬৭, নং ৬৭৫ (ভা, ১/২৩৭)]বুখারী-মুসলিমের এ বর্ণনার বিপরীতে অন্য বর্ণনা নিম্নরূপ: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাতের সালাম ফেরানোর পরে কিবলামুখী বসা অবস্থায় মাথা উঠিয়ে বলেন: আল্লাহ সালামাহ ইবনু হিশাম, আইয়াশ ইবনু আবী রাবিয়াহ, ওলীদ ইবনু ওলীদ ও দুর্বল মুসলমানদেরকে রক্ষা করুন, যারা থেকে বেরিয়ে চলে আসার কোনো পথ পাচ্ছে না।” এ বর্ণনার বিষয়ে হাইসামী বলেন: “রাবী ইবনু জাদআন বিতর্কিত। অন্যান্য রাবী নির্ভরযোগ্য। [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫২]আল্লাহর নাম ও ইসম আযমের ওসীলায় দোয়ামুমিনের উচিত যে কোনো দোয়ার আগে বেশি বেশি করে আল্লাহর প্রশংসা ও হামদ-সানা করা, মহান আল্লাহর পবিত্র নামসমূহ ধরে তাকে ডেকে এবং তাঁর পবিত্র নাম ও গুণাবলির ওসীলা দিয়ে দোয়া করা। এ বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। দোয়ার আগে এভাবে হামদ সানা ও আল্লাহর মহান নামসমূহ ধরে দোয়া করলে একদিকে যেমন মনে আল্লাহর প্রতি আবেগ, ভালবাসা আসে, তেমনি দোয়াতে আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়। এভাবে দোয়া করলে দোয়া কবুল হবে বলে বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:“এবং আল্লাহর আছে সুন্দরতম নামসমূহ; কাজেই তোমরা তাঁকে সে সকল নামে ডাকবে। যারা তার নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করবে। তাদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই তাদেরকে প্রদান করা হবে।” [সূরা আরাফ: ১৮০]সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে সংকলিত হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “আল্লাহর ৯৯টি নাম আছে, ১০০-র একটি কম, যে এ নামগুলোর হিসাব রাখবে (মুখস্থ রাখবে) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [বুখারী (৫৮-কিতাবুশ গুরুত, ১৮-বাব মা ইয়াজুখু মিনাল ইশতিরাত..) ২৯৮১, নং ২৫৮৫ (ভারতীয় ১/৩৮২); মুসলিম (৪৮-কিতাবুয যিকর, বাৰ ফী আসমাইল্লাহ) ৪/২০৬৩, (ভা, ২/৩৪২)]এ হাদীসে নামগুলোর বিবরণ দেওয়া হয়নি। ৯৯ টি নাম সম্বলিত একটি হাদীস ইমাম তিরমিযী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। [তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাআওয়াত, ৮৩-বাব) ৫/৪৯৬ (৫৩০), নং ৩৫০৭ (ভারতীয় ২১৮৮); ইবন মাজাহ ৩৪-কিতাবুদ দোয়া, ১০-বাব আসময়িল্লাহ) ২১২৬৯, নং ৩৮৬১ (ভার, ২/২৭৪)] কিন্তু অধিকাংশ মুহাদ্দিস উক্ত বিবরণকে যয়ীফ বলেছেন। ইমাম তিরমিযী নিজেই হাদীসটি সংকলন করে তার সনদের দুর্বলতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেন, ৯৯ টি নামের তালিকা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত নয়। পরবর্তী রাবী এগুলো কুরআনের আলোকে বিভিন্ন আলিমের মুখ থেকে সংকলিত করে হাদীসের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। কুরআনে উল্লেখিত অনেক নামই এ তালিকায় নেই। কুরআনে মহান আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ডাকা হয়েছে রাব্ব' নামে। এ নামটিও এ তালিকায় নেই। [ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১১/২১৭।] কেউ কেউ তিরমিযী সংকলিত তালিকাটিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন। [নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১৫১, মাওয়ারিদুয় যামআন ৮/১৪-১৬, জামিউল উসূল ৪/১৭৩-১৭৫]রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ৯৯টি নাম হিসাব রাখতে নির্দেশনা দিলেন কিন্তু নামগুলির নির্ধারিত তালিকা দিলেন না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে আলিমগণ বলেন যে, কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আংশিক গোপন রাখা হয়, মুমিনের কর্মোদ্দীপনা বৃদ্ধির জন্য। যেমন, লাইলাতুল কদর, জুম'আর দিনের দোয়া কবুলের সময়, ইত্যাদি। অনুরূপভাবে নামের নির্ধারিত তালিকা না বলে আল্লাহর নাম সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেন বান্দা আগ্রহের সাথে কুরআনে আল্লাহর যত নাম আছে সবই পাঠ করে, সংরক্ষণ করে এবং সেসকল নামে আল্লাহকে ডাকতে থাকে ও সেগুলির ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে। [ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১১/২১৭-২১৮, ১১২২১, নাবাবী, শারহু সহীহ মুসলিম ১৭/৫]‘ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম’ বলাيَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِউচ্চারণঃ ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম।অর্থঃ হে মর্যাদা ও উদারতার অধিকারী।আল্লাহর নাম নিয়ে দোয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ একটি নাম যুল জালালি ওয়াল ইকরাম'। দোয়ার মধ্যে এ নাম বেশি বেশি বলতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নির্দেশ দিয়েছেন। রাবীয়া ইবনু আমের (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:“তোমরা ‘ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম’-কে সর্বদা আঁকড়ে ধরে থাকবে (দোয়ায় বেশি বেশি বলবে)” [হাদীসটি সহীহ। তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাওয়াত, ৯২-বাব) ৫৫০৪ (নং ৫২৪, ২৫) (ভারতীয় ২১৯২); মুসতাদরাক হাকিম ১/৬৭৬, মুসনাদ আবী ইয়ালা ৬/৪৪৫, আলবানী, সহীহুল জামিয়িস সাগীর ১/২৬৯, নং ১২৫০, সিলসিলাতুস সাহীহাহ ৪/৪৯-৫১]মুনাজাত শেষে নির্দিষ্ট বাক্য সর্বদা বলাএ হাদীস থেকে দোয়ার মধ্যে বা শেষে ‘ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম’ বলার ফযীলত জানতে পারছি। এজন্য অনেকে সর্বদা দোয়া বা মুনাজাতের শেষে ‘ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম’ বলেন।এ বাক্য দ্বারা মুনাজাত শেষ করা ভাল ও ফযীলতের কাজ। তবে ‘আল্লহুম্মা আনতাস সালাম ...'ছাড়া অন্য সকল দোয়া ও মুনাজাতের শেষে সর্বদা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম” বাক্যটি বলা উচিত হবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণ সর্বদা এ বাক্য দিয়ে দোয়া শেষ করতেন না। সুন্নাতের নির্দেশ ছাড়া কোনো কিছুকে সর্বদা করণীয়-রীতি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়। অনেকে সর্বদা আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ বলে দোয়া শেষ করেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, 'আল-হামদু লিল্লাহ’ সর্বোত্তম দোয়া। এছাড়া কুরআন করীমে জান্নাতের অধিবাসীগণের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তাদের শেষ দোয়া আল-হামদু লিল্লাহ। এ সকল আয়াত ও হাদীসের আলোকে দোয়ার মধ্যে ও শেষে আল-হামদু লিল্লাহ’ বা ‘আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন' - বলা ভাল ও ফযীলতের। তবে সর্বদা বলা উচিত নয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণ সর্বদা এভাবে সকল দোয়া বা মুনাজাত এ বাক্য দ্বারা শেষ করেননি।আমরা “এহইয়াউস সুনান” গ্রন্থে আলোচনা করেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ), যা অধিকাংশ সময় করেছেন তাও সবসময় করতে নিষেধ করেছেন ইমাম আবু হানীফাসহ সাহাবী-তাবেয়ী যুগের ইমাম ও ফকীহগণ (রাহ) কারণ, এতে খেলাফে সুন্নাত হবে এবং মাঝে মাঝে যা করেছেন সে সুন্নাত বাদ দেওয়া হবে। এজন্য আমাদের উচিত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাসনূন বাক্য, দোয়া ও মুনাজাত ব্যবহার করে দোয়া করা।আমাদের দেশে অত্যন্ত প্রচলিত অভ্যাস দোয়ার শেষে কালেমাহ তাইয়্যেবাহ “লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)” বলে দোয়া বা মুনাজাত শেষ করা। কালেমাহ তাইয়্যেবাহ আমাদের ঈমানের ভিত্তি। “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু” সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির। তবে দোয়ার শেষে এ কালেমাহ পাঠের কোনো ভিত্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা তাঁর সাহাবীগণের শিক্ষা বা কর্মের মধ্যে অর্থাৎ সুন্নাতে নববী বা সুন্নাতে সাহাবার মধ্যে নেই। দোয়া বা মুনাজাতের শেষে বা অন্য কোনো সময়ে এগুলো পাঠ করা কখনই না-জায়েয নয়। কিন্তু সুন্নাতের বাইরে কোনো কিছুকে রীতি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়। কখন কোন্ কালেমা, যিকর ও দোয়া পড়তে হবে তারও সুন্নাত রয়েছে। সাধারণ ফযীলত বিষয়ক হাদীসের উপর নির্ভর করে কোনো নিয়মিত ইবাদত বা রীতি তৈরি করলে তা সুন্নাত অবহেলা করার মতো অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে।রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণ আজীবন অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সর্বদা দোয়া ও মুনাজাত করেছেন। তাঁদের দোয়া বা মুনাজাতের সকল খুঁটিনাটি শব্দ, বাক্য, সময়, অবস্থা ইত্যাদি আমরা জানতে পারছি। আমরা দেখছি যে, নিয়মিত তো দূরের কথা, কখনোই তারা কালেমা তাইয়্যেবা দিয়ে মুনাজাত শেষ করেননি। এর ফযীলতেও কোনো হাদীস বর্ণিত হয়নি। কালেমাহ তাইয়্যেবা'-র ফযীলত তাদের চেয়ে বেশি কেউ জানত না। মুনাজাতের গুরুত্বও তাদের চেয়ে কেউ বেশি দেননি। তা সত্ত্বেও তারা এভাবে মুনাজাত করেননি। আমাদের উচিত তাঁদের সুন্নাতের মধ্যে থাকা।তাবিয়ী আমাশ (রহ) (১৪৮ হি) বলেন, প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ইবরাহীম নাখ’য়ীকে (রহ) (৯৬হি) জিজ্ঞাসা করা হলো, ইমাম যদি সালাতের সালাম ফেরানোর পরে বলে:صَلَّى اللَّهُ عَلَى مُحَمَّدٍ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ“আল্লাহর সালাত মুহাম্মাদের উপর, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।” তবে তার বিধান কি? তিনি বলেন: “এদের পূর্ববর্তীগণ (নবী (ﷺ) ও সাহাবীগণ) এভাবে বলতেন না।” [মুসান্নাফ ইবনি আবী শাইবা ১/২৭০]সুবহানাল্লাহ! মুমিনের জীবনের শ্রেষ্ঠতম দুটি যিকর - লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ ও সালাত পাঠ। এ দুটি যিকরের ফযীলতের বিষয়ে ইবরাহীম নাখ’য়ী (রহ) ও সকল তাবেয়ী একমত। কিন্তু সালতের সালামের পরে তা বলতে তাদের আপত্তি। কারণ সুন্নাতের বাইরে কোনো রীতি বা কাজে তাদের আগ্রহ ছিল না। তাদের একমাত্র আদর্শ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তার সাহাবীগণ। যেহেতু তারা সালামের পরে এ যিকর দুটি এভাবে বলতেন না এজন্য তিনি এতে আপত্তি করেছেন।দোয়া কবুলের অবস্থাগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখাযে সকল অবস্থায় দোয়া করলে আল্লাহ কবুল করবেন বলে বর্ণিত হয়েছে সে সকল অবস্থায় বেশি বেশি দোয়া করা উচিত। যেমন,- সফর, হজ্ব, সিয়াম, ইফতার ইত্যাদি অবস্থার দোয়া। ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক, মাজলুম, মুসাফির, পিতামাতা, প্রমুখের দোয়া কবুল হবে বলে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। [মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫১-১৫৩]বারবার চাওয়া বা তিনবার চাওয়াদোয়ার একটি মাসনূন আদব আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চাইলে অনেকটা নাছোড়বান্দা করুণাপ্রার্থীর মতোই একই সময়ে বারবার চাওয়া, বিশেষত তিনবার চাওয়া। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বলেন:“নবীজী (ﷺ) যখন দোয়া করতেন তখন তিনবার দোয়া করতেন এবং তিনি যখন চাইতেন বা প্রার্থনা করতেন তখন ৩ বার করতেন।” [মুসলিম (৩২-কিতাবুল জিহাদ, ৩৯-বাব মা লাকিয়ান নাবিউ ৩/১৪১৮, নং ১৭৯৪ (ভা ২/১০৮)]দোয়ার সময় কিবলামুখী হওয়াওযু বা ওযুহীন অবস্থায়, যে কোনো দিকে মুখ করে বা দাঁড়ানো, বসা বা শোয়া অবস্থায় মুমিন যিকর ও দোয়া করতে পারেন। তবে কিবলার দিকে মুখ করে দোয়া করা উত্তম, বিশেষত যখন বিশেষভাবে আগ্রহ সহকারে দোয়া করা হয়। হাদীসে কিবলামুখী হয়ে দোয়া করার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে দোয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিবলামুখী হয়েছেন বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বৃষ্টির জন্য দোয়ার সময়, যুদ্ধের ময়দানের আল্লাহর সাহায্যের জন্য দোয়ার সময়, আরাফা, মুদালিফা ও অন্যান্য স্থানে দোয়ার সময়, বিশেষ আবেগ ও বেদনার সময়, কখনো কখনো কোনো কোনো সাহাবীর জন্য দোয়া করার সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অন্য অবস্থা থেকে ঘুরে বিশেষভাবে কিবলামুখী হয়ে দোয়া করেছেন। [দেখুন: মুসলিম ২৬১১, নং ৮৯৪, মুসতাদরাক হাকিম ৩৫৭১, মুসনাদ আবী উওয়ানা ১/৪/২২০, ২৮৭-২৮৮, বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/৫০, সুনানু আবী দাউদ ১৩০৩, নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ২/৩৮৯, সুনানুন নাসই ৫/২১৩, মুসান্নাফু ইবন আবী শাইবা ৬/৪৯, মুসনাদ আহমদ ১/৩০, ৩২, ২/২৩৪]এছাড়া সাধারণভাবে সর্বাবস্থায় কিবলামুখী হয়ে বসার জন্য হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:“প্রত্যেক বিষয়ের সাইয়্যেদ বা নেতা আছে। বসার নেতা কিবলামুখী হয়ে বসা।” হাদীসটির সনদ হাসান। [তাবারানী, আল-মু'জামুল আউসাত ৩/২৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৫৯]এ সকল হাদীসের আলোকে যাকিরের জন্য সম্ভব হলে যিকর ও দোয়ার জন্য কিবলামুখী হওয়া উত্তম। তবে যে কোনো ফযীলতের হাদীস পালনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণ কিভাবে তা পালন করেছেন তা লক্ষ্য রাখতে হবে। ফযীলতের হাদীসের উপর ভিত্তি করে নিজেদের মনমত আমল বা রীতি তৈরি করে নিলে বিদআতে নিপতিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।দোয়ার অন্যান্য আদব ও কিবলামুখী হয়ে দোয়ার ক্ষেত্রেও বিষয়টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিবলামুখী হয়ে দোয়া করা উত্তম হলেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সর্বদা দোয়ার সময় কিবলামুখী হতেন না। অনেক সময় যে অবস্থায় রয়েছেন ঐ অবস্থায় দোয়া করতেন। অনেক সময় তিনি ইচ্ছাপূর্বক কিবলা থেকে মুখ ফিরিয়ে দোয়া করেছেন। এথেকে আমরা কয়েকটি বিষয় বুঝতে পারি: প্রথমত, যে সকল দোয়ার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিবলামুখী হয়ে দোয়া করেছেন, সে সময় কিবলামুখী হয়ে দোয়া করা সুন্নাত। দ্বিতীয়ত, যে সময় ইচ্ছাপূর্বক কিবলা থেকে ঘুরে দোয়া করেছেন, সে সময়ে ঘুরে দোয়া সুন্নাত। অন্য সময়ে কিবলামুখী হওয়া উত্তম, কিন্তু মুস্তাহাব পর্যায়ের উত্তম।রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাতের সালাম ফেরানোর পরে কিবলা থেকে ঘুরে বা কিবলার দিকে পিছন ফিরে যিকর ও দোয়া করতেন। এজন্য ইমাম আবু হানীফা (রহ) সালাম ফেরানেরা পরে ইমামের কিবলামুখী হয়ে বসে থাকা বা দোয়া করা মাকরুহ’ বলেছেন। [ইমাম মুহাম্মাদ, আল-মাবসূত ১১৭-১৮] হানাফী মাযহাবের অন্যতম ফকীহ আল্লামা সারাখসী (রহ) লিখেছেনঃ যদিও কিবলামুখী হয়ে বসা শ্রেষ্ঠতম বসা বা সকল বৈঠকের নেতা, কিন্তু সালাতের সালাম ফেরনোর পরে কিবলামুখী হয়ে বসা ইমামের জন্য মাকরুহ, কারণ সাহাবী-তাবেয়ীগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমামের জন্য সালাতের সালাম ফেরানোর পরে কিবলামুখী হয়ে বসে থাকা বিদআত। [সারাখসী, আল-মাবসূত ১/৩৮।]দোয়ার সময় হাত উঠানোআমরা দেখেছি যে, মুমিন বসে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে বা যে কোনো অবস্থায় দোয়া করতে পারেন। তবে দোয়ার একটি বিশেষ আদব দুই হাত বুক পর্যন্ত বা আরো উপরে ও আরো বেশি এগিয়ে দিয়ে, হাতের তালু উপরের দিকে বা মুখের দিকে রেখে, অসহায় করুণাপ্রার্থীর ন্যায় কাকুতি মিনতির সাথে দোয়া করা। দোয়ার সময় হাত উঠানোর বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিছু হাদীস হাত উঠানোর ফযীলত সম্পর্কিত। অন্য হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ কখনো কখনো দোয়ার জন্য হাত উঠাতেন।ইতোপূর্বে একটি হাদীসে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, কোনো বান্দা হাত তুলে দোয়া করলে আল্লাহ সে হাত খালি ফিরিয়ে দিতে চান। অন্য হাদীসে মালিক ইবনু ইয়াসার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কি বলেছেন:“তোমরা যখন আল্লাহর কাছে চাইবে, তখন হাতের পেট বা ভিতরের দিক দিয়ে চাইবে, হাতের পিঠ দিয়ে চাইবে না।” হাদীসটি হাসান। [আবু দাউদ (৮-কিতাবুল বিতর, ২৩-বাবুদ দূজা ২/৭৯, নং ১৪৮৬, (ভারতীয় ১/২০৯) সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ ২/১৪২-১৪৪, নং ৫৭৫]সালমান ফারিসী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “যখনই কিছু মানুষ আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার জন্য তাদের হাতগুলোকে উঠাবে, তখনই আল্লাহর উপর হক বা নির্ধারিত হয়ে যাবে যে তিনি তারা যা চেয়েছে তা তাদের হাতে প্রদান করবেন।” [তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর ৬/২৫৪, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬৯, মুনাবী, ফাইদুল কাদীর ৫/৪৪৭, আলবানী, যায়ীফুল জামিয়, পৃ. ৭৩৩, নং ৫০৭০; যায়ীফাহ ১২৮৮৬, নং ৫৯৪৮। হাইসামী হাদীসটির সনদ সহীহ বলেছেন এবং আলবানী হাদীসটিকে যয়ীফ বলে উল্লেখ করেছেন]এছাড়া কয়েকটি হাদীসে আমরা দেখি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণ কোনো কোনো সময়ে দোয়া করতে দুই হাত তুলে দোয়া করতেন।আয়েশা (রা) বলেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার হস্তদ্বয় উঠিয়ে দোয়া করতেন, এমনকি আমি তাঁর (বেশি বেশি) হাত উঠিয়ে দোয়া করাতে ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে পড়তাম। [মুসনাদ আহমদ ৬/১৬০, ২২৫, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬৮। হাইসাম বলেন: রাবীগণ নির্ভরযোগ্য, তবে শুআইব আরনাউত ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেন: হাদীসটি ইদতিরাবের জন্য দুর্বল]অনুরূপ বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, বৃষ্টির জন্য দোয়ার সময়, আরাফাতের মাঠে দোয়ার সময়, যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার সময় ও অন্যান্য কোনো কোনো সময়ে দোয়ার জন্য তিনি হাত তুলেছেন। ইমাম বুখারী (রহ) তার সহীহ গ্রন্থে ইসতিসকা’ বা ‘বৃষ্টি প্রার্থনা' অধ্যায়ে আনাস ইবনু মালিক (রা) থেকে জুমার খুতবার সময় বৃষ্টির জন্য দোয়া বিষয়ক একটি হাদীস কয়েকটি পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন। [সুয়ূতী, ফাল বি’আ... পৃ. ৪১-১০২, হাইসামী, মাজমউয যাওয়াইদ ১০/১৬৮-১৬৯]এ হাদীসে আনাস (রা) বলেন: “মরুভূমির এক বেদুঈন শুক্রবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করে। তখন তিনি দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। লোকটি বলে: হে আল্লাহর রাসূল, (অনাবৃষ্টিতে) জীবজন্তুগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, পরিবার পরিজন ও মানুষেরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, কাজেই আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যেন তিনি বৃষ্টি দেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার হস্তদ্বয় উঠিয়ে দোয়া করলেন এবং মানুষেরাও তার সাথে তাদের হাতগুলো তুলে দোয়া করল। আনাস (রা) বলেন, ফলে মসজিদ থেকে বেরোনোর আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।” [বুখারী (২১-কিতাবুল ইসতিসকা, ২০-বাব রফউন নাস আইদিয়াহুম) ১/৩৪৮ (ভারতীয় ১১৪০)]এভাবে আমরা দোয়ার সময় হস্তদ্বয় উঠানোর ফযীলত ও সুন্নাত জানতে পারছি। এক্ষেত্রেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এ ফযীলত পালনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণই পূর্ণতম আদর্শ। তাঁদের সুন্নাতের আলোকেই আমাদের এ ফযীলত পালন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাত তুলে দোয়া করার ফযীলত বর্ণনা করেছেন। এ ফযীলত পালনের ক্ষেত্রে তার ও তার সাহাবীগণের কর্ম ছিল কখনো কখনো হাত তুলে দোয়া করা এবং সাধারণ ক্ষেত্রে হাত না তুলে শুধুমাত্র মুখে দোয়া করা। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, হাত উঠানো দোয়ার আদব এবং একান্ত মুস্তাহাব পর্যায়ের সুন্নাত, অর্থাৎ পালন করলে ভাল, করলে কোনো দোষ নেই। একে বেশি গুরুত্ব দিলে, হাত না উঠালে কিছু খারাপ হলো মনে করলে – তা খেলাফে সুন্নাত হবে।যেখানে ও যে দোয়ায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)হাত উঠিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে সেখানে হাত উঠানো সুন্নাত। যেখানে উঠাননি বলে জানা গিয়েছে সেখানে হাত না উঠানো সুন্নাত। চলাফেরা, উঠাবসা, খাওয়াদাওয়া, মসজিদে প্রবেশ, মসজিদ থেকে বের হওয়া, ওযুর পরে, খাওয়ার পরে, আযানের পরে, সালাতের পরে ইত্যাদি দৈনন্দিন মাসনূন দোয়ার ক্ষেত্রে হাত না তুলে স্বাভাবিক অবস্থায় মুখে দোয়া করাই সুন্নাত। যে সকল দোয়া মাসনূন, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা তার সাহাবীগণ যে সকল দোয়া বা যে সকল সময়ে দোয়া করেছেন, অথচ তারা হাত উঠিয়েছেন বলে বর্ণিত নেই, সেসকল স্থানে নিয়মিত হাত উঠনোকে রীতি বানিয়ে নেয়া বা হাত উঠানোকে উত্তম মনে করা আমাদেরকে বিদআতে নিপতিত করবে। বাকি সকল ক্ষেত্রে হাত উঠানো ও না উঠানো উভয়ই জায়েয। আবেগ, আগ্রহ ও বিশেষ দোয়ার সময় হাত তুলে আকুতির সাথে দোয়া করা উত্তম।উল্লেখ্য যে, আমরা সর্বদা দুই হাত তুলে প্রার্থনা করাকে মুনাজাত বলে মনে করি। মুখে কোনো দোয়া পাঠ বা মুখে মুখে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করাকে কখনই মুনাজাত বলে মনে করি না। এটি একেবারেই ভিত্তিহীন বরং সত্যের বিপরীত। আমরা উপরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারি যে, মুনাজাত অর্থ সকল প্রকার যিকর দোয়া, প্রার্থনা। হাত উঠানো হোক বা না হোক, শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, হাঁটতে চলতে বা যে কোনো সময় বান্দা যখন আল্লাহর কথা স্মরণ করে, তাঁকে ডাকে, তাঁর কাছে কিছু চায় বা এক কথায় তার সাথে সঙ্গোপনে কথা বলে তখন বান্দা মুনাজাতে রত থাকে। তেমনি হাত উঠানো হোক বা না হোক, শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে বা যে কোনো অবস্থায় বান্দা যখন আল্লাহকে ডাকে বা তার কাছে কিছু চায় সে তখন দোয়ায় রত থাকে। মুনাজাত ও দোয়া মূলত একই বিষয়। আর হাত উঠানো, কিবলামুখী হওয়া, বসা, ইত্যাদি দোয়া বা মুনাজাতের বিজ্ঞি আদব। এগুলোসহ বা এগুলো ব্যতিরেকে বান্দা মুনাজাতে’ রত থাকবেন।দোয়ার শেষে মুখমণ্ডল মোছাদোয়া বা মুনাজাতের সময় হাত উঠানোর বিষয়ে যেরূপ অনেকগুলি সহীহ হাদীস পাওয়া যায়, দোয়া শেষে হাত দু'টি দ্বারা মুখমণ্ডল মোছার বিষয়ে তদ্রুপ কোনো হাদীস পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে দুই একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে অত্যন্ত দুর্বল সনদে। একটি হাদীসে বলা হয়েছে:“দোয়া শেষ হলে তোমরা হাত দু'টি দিয়ে তোমদের মুখ মুছবে।” হাদীসটি আবু দাউদ (রহ) সংকলিত করে বলেন: “এ হাদীসটি কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, সবগুলোই অত্যন্ত দুর্বল ও একেবারেই অচল। এ সনদটিও দুর্বল।” [আবু দাউদ (৮-কিতাবুল বিতর, ২৩-বাবুদ দোয়া) ২/৭৮, (ভারতীয় ১/২০৯), মুসতাদরাক হাকিম ১/৭১৯]অন্য হাদীসে উমার ইবনু খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন দোয়ায় হস্তদ্বয় তুলতেন তখন হস্তদ্বয় দ্বারা মুখ না মুছে তা নামাতেন না।” [তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাওয়াত, ১১-বাব..রাফইল আইদী) ৫/৪৩২, নং ৩৩৮৬, (ভা, ২/১৭৬)]তৃতীয় হিজরীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবু যুর’আ (রহ) (মৃ. ২৬৪ হি) বলেন: হাদীসটি মুনকার বা একেবারেই দুর্বল। আমার ভয় হয় হাদীসটি ভিত্তিহীন বা বানোয়াট। একারণে কোনো কোনো আলিম দোয়ার পরে হাত দুটি দিয়ে মুখ মোছাকে বিদ’আত বলেছেন। কারণ এ বিষয়ে একটিও সহীহ, হাসান বা অল্প দুর্বল কোনো হাদীস নেই। এছাড়া দোয়ার সময় হাত উঠানো সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগে পরিচিত ও প্রচলিত ছিল, কিন্তু দোয়া শেষে হাত দিয়ে মুখ মোছার কোনো প্রকার উল্লেখ পাওয়া যায় না। [সুয়ূতী, ফাল বিয়া, পৃ. ৫২-৫৩; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ১৭৮; সাহীহাহ ২/১৪৪-১৪৫]অপরদিকে ইবনু হাজার আসকালানী (রহ) (৮৫২ হি) বলেন, হাদীসটির সনদ দুর্বল হলেও অনেকগুলো সূত্রে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে মূল বিষয়টিকে গ্রহণযোগ্য বা হাসান বলা উচিত। [ইবনু হাজার, বুলুগুল মারাম, পৃ. ২৮৪।] সুনানে তিরমিযীর কোনো কেননা পাণ্ডুলিপিতে দেখা যায় যে ইমাম তিরিমিযী (রহ) হাদীসটি হাসান বা সহীহ বলেছেন। কিন্তু ইমাম নববী (রহ) (৬৭৬ হি) বলেন যে, সুনানে তিরমিযীর সকল নির্ভরযোগ্য ও প্রচলিত কপি ও পাণ্ডুলিপিতে ইমাম তিরমিযীর (রহ) মতামত হিসেবে উল্লেখ আছে যে, হাদীসটি গরীব। ইমাম নববীও (রহ) এ বিষয়ক সকল হাদীস যয়ীফ বলে উল্লেখ করেছেন। [নাবাবী, অল-আযকার,পৃ. ৫৬৯] ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম বাইহাকী (রহ) (৫৬৮ হি) বলেন: দোয়া শেষে দু হাত দিয়ে মুখ মোছার বিষয়ে হাদীস যয়ীফ, তবে কেউ কেউ সে হাদীসের উপর আমল করে থাকে।” [বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ২/২১২]ইমাম আব্দুর রাজ্জাক সান’আনী (রহ) (২১১ হি) তার উস্তাদ ইমাম মামার ইবনু রাশিদ ১৫৪ হি) থেকে ইমাম ইবনু শিহাব যুহরী (১২৫ হি) থেকে বিষয়টি বর্ণনা করে বলেন: কখনো কখনো আমার উস্তাদ মামার এভাবে দোয়ার শেষে মুখ মুছতেন এবং আমিও কখনো কখনো তা করি।২২৫ এ থেকে বুঝা যায় যে তাবিয়ীগণের যুগে কেউ কেউ দোয়া শেষে এভাবে মুখ মুছতেন।এভাবে আমরা দেখি যে, দোয়ার সময় হাত উঠানো যেরূপ প্রমাণিত সুন্নাত, দোয়া শেষে হাত দুটি দিয়ে মুখমণ্ডল মুছা অনুরূপ প্রমাণিত বিষয় নয়। এ বিষয়ে দু'একটি দুর্বল হাদীস আছে, যার সম্মিলিত রূপ থেকে কোনো কোনো আলিমের মতে এভাবে মুখ মোছা জায়েয বা মুস্তাহাব। আল্লাহই ভাল জানেন। [আব্দুর রাজ্জাক সানা’আনী, আল-মুসান্নাফ ২/২৪৭]দোয়ার সময় শাহাদত আঙ্গুলির ইশারাদোয়ার আরেকটি মাসনূন পদ্ধতি দোয়ার সময় ডান হাতের শাহাদত আঙ্গুলি উঠিয়ে কিবলার দিকে ইশারা করা। সালাতের মধ্যে ও সালাতের বাইরে দোয়ার সময় এভাবে ইশারা করার বিষয়ে কতগুলো হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে ইবনু আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:“প্রার্থনা করা এই যে, তুমি তোমার দুই হাত তোমার দুই কাঁধ বরাবর বা কাছাকাছি উঠাবে। আর ইস্তিগফার এই যে, তুমি তোমার একটি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করবে। আর ইবতিহাল বা কাকুতি মিনতি করে প্রার্থনা করা এই যে, তুমি তোমার দু হাতই সামনে এগিয়ে দেবে।” হাদীসটি সহীহ। [আবু দাউদ (৮-কিতাবুল বিতর, ২৩-বারুদ দোয়া) ২৭৯, নং ১৪৮৯, (ভারতীয় ১/২০৯), ইবনুল আসীর, জামিউল উসূল ৪/১২৭-১২৮; আলবানী, সহীহু আবী দাউদ ৫/২২৭]বিভিন্ন হাদীসে শুধু একটি আঙ্গুল, ডান হাতের শাহাদত আঙ্গুল দিয়ে কিবলার দিকে ইশারা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইশারার সময়, বিশেষত সালাতের মধ্যে দোয়ার সময় আঙ্গুলটি সোজা কিবলামুখী করে রাখতেন এবং নিজের দৃষ্টিকে আঙ্গুলের উপরে রাখতেন। তিনি এ সময় আঙ্গুল নাড়াতেন না। [বিস্তারতি দেখুন: মুসনাদু আবী উওয়ানাহ ১১/৫৩৯, মুসতাদরাক হাকিম ১৭১৯, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬৭-১৬৮, আউনুল মা'বুদ ২৩০৫, ৪/২৫২, মুনাৰী, ফাইদুল কাদীর ১৮৪]দোয়ার সময় দৃষ্টি নত রাখাদোয়ার মধ্যে বিনয়ের একটি দিক দৃষ্টি নত রাখা। বেয়াদবের মতো উপরের দিকে তাকিয়ে দোয়া করতে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। বিশেষত সালাতের মধ্যে দোয়ার সময় উপরের দিকে নজর করতে হাদীসে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:“যে সমস্ত মানুষেরা সালাতের মধ্যে দোয়ার সময় উপরের দিকে দৃষ্টি দেয় তারা যেন অবশ্যই এ কাজ বন্ধ করে, নাহলে তাদের দৃষ্টিশক্তি হরণ করা হবে।” [মুসলিম (৪-কিতাবুস সালাত, ২৬বাবুন নাহয়ি আন রফইল বাসরি) ১/২১, নং ৪২৯, (জ. ১৮১)] অন্য বর্ণনায় ‘সালাতের মধ্যে কথাটি নেই, সব দোয়াতেই দৃষ্টি ঊর্ধ্বে উঠাতে নিষেধ করা হয়েছে। [মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬৭-১৬৮।]দোয়ার সাথে আমীন বলা“আমীন” অর্থঃ “হে আল্লাহ, কবুল করুন। কেউ দোয়া করলে তার দোয়ার সাথে “আমীন” বলা একটি সুন্নাত রীতি। আমরা সালাতের মধ্যে সূরা ফাতিহার পরে এভাবে আমীন বলি। সূরা ফাতিহা ছাড়াও সালাতের মধ্যে কুনুতে এবং সালাতের বাইরে দোয়ার সময় শ্রোতাদের আমীন বলা একটি মাসনূন রীতি। হাবীব ইবনু মাসলামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:“কিছু মানুষ একত্রিত হলে যদি তাদের কেউ দোয়া করে এবং অন্যরা আমীন’ বলে তবে আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন।” হাদীসটি দুর্বল। [তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর ৪/১২; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৩৯০; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৭০; আলবানী, যায়ীকাহ ১৯৪০, নং ৫৯৬৮। হাদীসটির সনদে দুর্বলতা আছে]