পরিচ্ছেদ: যিকর বিষয়ক কয়েকটি বিধান
যিকর গণনা ও তাসবীহ-মালা প্রসঙ্গআমরা বিভিন্ন হাদীসে দেখলাম যে, যিকর দু’ভাবে আদায় করা যায়: বেশি বেশি পাঠ করে এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক পাঠ করে। নির্দিষ্ট সংখ্যক যিক্রের জন্য গণনার প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দেখি যে, কোনো কোনো সাহাবী ও পরবর্তী ইমাম যিকর গণনা করতে নিষেধ করেছেন। তারা বলতেন, আল্লাহই তো গণনা করছেন, তুমি কেন গণনা করবে। তুমি কি আল্লাহর কাছে যেয়ে গুণে হিসেব বুঝে নেবে?ইমাম আবু হানীফা (রহ) ও হানাফী ইমামগণ যিকর ও তাসবীহতাহলীল গণনা মাকরুহ বলে জেনেছেন। ইমাম তাহাবী ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম আবু ইউসূফের সনদে ইমাম আবু হানীফা থেকে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। [ইমাম তাহাবী, শারহু মুশকিলিল আসার ১০/২৯১]ইবনু মাসউদ (রা) যিকর গণনা করতে দেখলে বলতেন, তোমাদের গোনাহগুলো গণনা করে হিসেব করে রাখ, সাওয়াব গণনার প্রয়োজন নেই। [বিস্তারিত দেখুন: লেখকের “এহইয়াউস সুনান” পৃ: ৬৬-৬৭]উকবা ইবনু সুবহান নামক একজন তাবেয়ী বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু উমারকে প্রশ্ন করলাম, যদি কেউ যিকরের সময় তার তাসবীহ-তাহলীল হিসাব করে রাখে তাহলে কী হবে? তিনি বললেন: “সুবহানাল্লাহ! তোমরা কি আল্লাহর হিসাব নেবে?” [হাদীসটির সনদ সহীহ। ইমাম তাহাবী, শারহু মুশকিলিল আসার ১০/২৯১]এ সকল হাদীসের আলোকে ইমাম আবু হানীফা (রাহ) তাসবীহ তাহলীল গণনা মাকরুহ মনে করেছেন। ইমাম তাহাবী (রহ) বলেন, যে সকল যিকর হাদীস শরীফে নির্দিষ্ট সংখ্যায় আদায়ের নির্দেশনা রয়েছে, সে সকল যিকরের ক্ষেত্রে মুমিনের উচিত তা গণনা করে পাঠ করা। কারণ গণনা ছাড়া নির্দিষ্ট সংখ্যা পূরণ হয়েছে কিনা এবং আল্লাহর ওয়াদাকৃত সাওয়াবের পরিমাণ যিকর পালিত হয়েছে কিনা তা জানার উপায় নেই। এজন্য এ সকল যিকর গণনা করে পালন করতে হবে। আর যেসকল যিকর সাধারণভাবে পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বিশেষ সংখ্যার জন্য বিশেষ সাওয়াব বর্ণনা করা হয়নি, সেসকল যিকর গণনা করা বাতুলতা। সেক্ষেত্রেই আল্লাহর হিসাব গ্রহণের প্রশ্ন আসে। নির্ধারিত সংখ্যক যিকরের অতিরিক্ত সকল সাধারণ যিক্রের ক্ষেত্রে মুমিনের দায়িত্ব কোনো রকম গণনা বা হিসাব ছাড়া যথাসম্ভব বেশি বেশি এবং যথাসম্ভব মনোযোগ সহকারে এসকল যিকরের বাক্য উচ্চারণ করবেন। হিসাবপত্রের দায়িত্ব রাব্বুল আলামীনের উপর ছেড়ে দেবেন। [আবূ জাফর তাহাবী, শারহু মুশকিলিল আসার ১০/২৯১]সাহাবী ও তাবেয়ীগণের কর্ম থেকে জানা যায় যে, সালাত, সালাম, তাসবীহ, তাকবীর, তাহলীল, তাহমীদ ইত্যাদি যিকর যা সাধারণভাবে বেশি বেশি আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা অনেকে নিজের সুবিধামতো নির্দিষ্ট সংখ্যায় ওযীফা হিসাবে নির্ধারণ করে নিয়েছেন। যেমন, কেউ কেউ সারাদিনে ১০০০ বার সালাত বা তাসবীহ বা তাহলীল করবেন বলে নিজের জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছেন। এগুলো তারা গুণে আদায় করতেন। এর অতিরিক্ত অগণিত যিকর আদায় করতেন। [আব্দুর রাজ্জাক সানআনী, আল-মুসান্নাফ ২৩৮, ইবনু রাজাৰ, জামিউল উলূম ১/৪৪৬, মুবারাকপুরী, হফাতুল আহওয়াযী ৯/৩২২, শাওকানী, নাইজুল আউতার ২/৩৫৯, মুনাবী, ফাইদুল কাদীর ৪/৩৫৫]এখন প্রশ্ন: সংখ্যা নির্ধারিত যিকর কিভাবে গণনা করব? ‘তাসবীহ ব্যবহার করে? না হাতের কর গণনা করে? তাসবীহ ব্যবহার বিদআত কি না? এ প্রশ্নের উত্তর, যিকর গণনার জন্য দানা বা তাসবীহ ব্যবহার না-জায়েয বা বিদ'আত নয়। তবে হাতের আঙ্গুল দ্বারা গণনা করা উত্তম; কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে যিকর হাতে গণনা করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা) বলেন:“আমি নবীজী (ﷺ)-কে দেখলাম তিনি নিজের হাতে [ডান হাতে] তাসবীহের গিঠ দিচ্ছেন (গণনা করছেন)” হাদীসটির সনদ সহীহ। [তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাওয়াত, ৭২- বাব.. আকদীদ তাসবীহ) ৫/৪৮৬, নং ৩৪৮৬, (ভা ১৮৬); আবু দাউদ ২৮২ (ভা ১/২১০); মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৩১, ৭৩২]এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ হাতে গণনা করতে উৎসাহ দিয়েছেন। মহিলা সাহাবী ইউসাইরাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে বলেছেন:“তোমরা মহিলাগণ অবশ্যই তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ), তাহলীল (লাইলাহা ইল্লল্লাহ), তাকদীস (সুবুহুন কুদ্সুন) করবে এবং আঙ্গুলের গিটে গণনা করবে ; কারণ এদেরকে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে এবং কথা বলানো হবে। (এরা যিকরের সাক্ষ্য প্রদান করবে।)” হাদীসটির সনদ সহীহ। [তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাআওয়াত, ৭২- বাৰ.. আকদীদ তাসবীহ) ৫/৪৮৬, নং ৩৪৮৬, (ভা ১৮৬); সহীহ ইবনু হিব্বান ৩১২২, মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৩২, মাওয়ারিদ্র্য যামআন ৭/৩৩৯]পাশাপাশি দানা বা তাসবীহ-মালা দ্বারা যিকর গণনা জায়েয ও সাহাবী-তাবেয়ীগণ কর্তৃক ব্যবহৃত। বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কি কোনো কোনো সাহাবীকে দানা বা বীচির দ্বারা তাসবীহ-তাহলীল বা যিকর গণনা করতে দেখেছেন। তিনি তাদেরকে এভাবে গণনা করতে নিষেধ করেননি, তবে সংক্ষিপ্ত ও উত্তম যিকরের উপদেশ প্রদান করেছেন। এ সকল হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, কাঁকর, দানা, বীচি ইত্যাদির মাধ্যমে যিকর গণনা সুন্নাহ-সম্মত জায়েয।পরবর্তী যুগে কোনো কোনো সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে জমা করা কাঁকর, দানা, গিরা দেওয়া সুতা বা তাসবীহ’ ব্যবহারের কথা জানা যায়। আবু সাফিয়্যা (রা) নামক একজন সাহাবী পাত্র ভর্তি কাঁকর রাখতেন। ফজরের সালাতের পরে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত তিনি এগুলো দিয়ে যিকর করতেন। আবার বিকালেও অনুরূপ করতেন। সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস কাঁকর দিয়ে তাসবীহ তাহলীল ও যিকর করতেন। ইমাম হুসাইনের কন্যা ফাতিমা গিঠ দেওয়া সুতা (তাসবীহের মতো) দ্বারা গণনা করে তাসবীহ তাহলীল করতেন। আবু হুরাইরা (রা)-এর ১০০০ টি গিরা দেওয়া একটি সুতা ছিল। তিনি এ সংখ্যক তাসবিহ-তাহলীল পাঠ না করে ঘুমাতেন না। এছাড়া তিনি কাঁকর জমা করে তা দিয়ে যিকর করতেন বলে বর্ণিত আছে। আবু দারদা (রা) খেজুরের বীচি একটি থলের মধ্যে রাখতেন। ফজরের সালাতের পরে সেগুলো বাহির করে যিক্রের মাধ্যমে গণনা করে শেষ করতেন।আল্লামা শাওকানী, সয়ুতী, আব্দুর রাউফ মুনাবী প্রমুখের আলোচনায় মনে হয় ইমাম আবু হানীফা (রা) ও তার সঙ্গীগণ বা মাযহাবের ইমামগণ ছাড়া পূর্বযুগের অধিকাংশ ফকীহ ও ইমাম যিকর গণনা বা তাসবীহ ব্যবহার করতে নিষেধ করেননি। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১ হি) এ বিষয়ে একটি ছোট্ট বই লিখেছেন। [বিস্তারিত দেখুন: মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/৩২২, শাওকানী, নাইলুল আউতার ২/৩৫৯, . মুনাবী, ফাইদুল কাদীর ৪/৫৫, ইবনু রাজাব, জামিল উলূম ওয়াল হিকা, পৃ. ৪৪৬]সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত ও নির্দেশনা সংখ্যা নির্ধারিত যিকর হাতের আঙ্গুলে গণনা করা। প্রয়োজনে, বিশেষত যারা ওযীফা হিসেবে দৈনিক বেশি সংখ্যক যিকর নিজের জন্য নির্ধারিত করে নিয়েছেন তারা তাসবীহ, কাঁকর, বীচি, ছোলা, ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন।সর্বদা আল্লাহর যিকর করতে হবেমুমিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ যিকর। যিকরের এমন কোনো সময় নেই বা অবস্থা নেই যে, সে সময়ে বা অবস্থায় যিকর করতে হবে, অন্য সময় করতে হবে না। মুমিন সদা সর্বদা আল্লাহর যিক্রে রত থাকে। আয়েশা (রা) বলেছেন:“নবীজী (ﷺ) সকল অবস্থায় আল্লাহর যিকর করতেন।” [মুসলিম (৩-কিতাবুল হাই, ৩০-বাৰ যিকরিল্লাহ..) ১/২৮২, নং ৩৭৩, (ভা ১১৬২); বুখারী (৬-কিতাবুল হাই, ৭-বাব তাকদীল হায়িয়..) ১/১১৬ এবং ২২৭ (ভারতীয় ১/৮৮)]এখানে যিকর বলতে মুখের উচ্চারণের মাধ্যমে যিকর বুঝানো হয়েছে। মনের স্মরণ তো সর্বদায়ই থাকে। সকল অবস্থায় কোনো না কোনো কর্ম মুমিন করে। কিন্তু সকল অবস্থায় আল্লাহর যিকর করা যাবে কিনা? নাপাক অবস্থায়? শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, হাঁটতে, চলতে? এ প্রশ্নের উত্তরেই আয়েশা (রা) এ কথা বলেছেন। আর এ থেকে মুসলিম উম্মার ইমাম, মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ এ কথাই বুঝেছেন। এজন তাঁরা এ হাদীস থেকে প্রমাণিত করেছেন যে, নাপাক অবস্থায়, শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, রাস্তাঘাটে, মাঠে এবং সর্বাবস্থায় মুমিন বান্দা মুখে মাসনূন বাক্যাদি উচ্চারণ করে আল্লাহর যিকর করতে পারবেন। সালাত, সালাম, তাসবীহ, তাহলীল, দোয়া ও সকল প্রকার যিকরের বিষয়েই একথা প্রযোজ্য। [গোসল ফরয থাকা অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াতের যিকর করা নিষেধ] শুধুমাত্র ইস্তিঞ্জা রত অবস্থায় ও স্বামী-স্ত্রী একান্ত অবস্থায় ছাড়া সর্বদা সকল অবস্থায় মুমিনের জিহ্বা বেপরোয়াভাবে আল্লাহর যিকরে আর্দ্র থাকবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ এটি এবং এটিই তাঁর ও তাঁর সাহাবীগণের জীবনের আদর্শ ও কর্ম। [নাৰাবী, শারহ সহীহি মুসলিম ৪/৬৮, আযকার পৃ. ৩৪, ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/৪০৮, ৪৩১]কুরআন তিলাওয়াতের জন্য ওষু ও গোসলউপরের হাদীস থেকে আমরা জানলাম যে, সর্বাবস্থায় যিকর করতে হবে। কুরআন তিলাওয়াতও কি এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত? পাক-নাপাক সকল অবস্থায় কি কুরআন তিলাওয়াত করা যাবে? কুরআন হাতে নিয়ে কি পাঠ করা যাবে? এ বিষয়ে সাহাবীগণের যুগ থেকে মতভেদ বিদ্যমান। এখানে কয়েকটি বিষয় রয়েছে: ১. অযুবিহীন অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত, ২. গোসলবিহীন অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত, ৩. ওযূ বা গোসলবিহীন অবস্থায় কুরআন স্পর্শ। আমরা নিচে বিষয়গুলো সংক্ষেপে আলোচনা করছি।প্রথম ও তৃতীয় বিষয়ে তেমন কোনো মতভেদ নেই। বিভিন্ন সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে উম্মাতের সকল আলিম একমত যে, ওযূ বিহীন অবস্থায় কুরআন কারীম স্পর্শ না করে মুখস্থ বা দেখে দেখে তিলাওয়াত করা জায়েয। অনুরূপভাবে বিভিন্ন সহীহ হাদীসের আলোকে উম্মাতের প্রায় সকল ইমাম ও ফকীহ একমত যে, ওযু বা গোসল বিহীন অবস্থায় কুরআন কারীম সরাসরি স্পর্শ করা বৈধ নয়। তবে বর্তমান সময়ে কতিপয় ফকীহ ওযূ-বিহীন অবস্থায় কুরআন স্পর্শ বৈধ বলছেন। এজন্য সংক্ষেপে বিষয়টি আলোচনা করছি।নাপাক অবস্থায় বা ওযু-বিহীন অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করার নিষেধাজ্ঞায় সহীহ হাদীস বর্ণিত। ইবন উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:“পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না।” হাদীসটি সহীহ। [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১/৬১৬; আলবানী, সহীহুল জামি ২/১২৮৪, নং ৭৭৮০]অন্য হাদীসে তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবন আবু বাকর ইবন মুহাম্মাদ ইবন আমর ইবন হাযম আনসারী (৬৫-১৩৫ হি) বলেন, আমার দাদা সাহাবী আমর ইবন হাযমকে (রা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে পত্র লিখেছিলেন, তাতে তিনি লিখেছিলেন:“পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না।” এ হাদীসটি অনেককগুলো সনদে বর্ণিত। প্রত্যেক সনদেই কিছু দুর্বলতা বিদ্যমান। তবে সবগুলি সনদের ভিত্তিতে ইমাম আহমদ ইবন হাম্বাল, ইমাম ইসহাক ইবন রাহওয়াইহি, ইমাম হাকিম, ইমাম যাহাবী, শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী ও অন্যান্য প্রাচীন ও সমকালীন মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলে নিশ্চিত করেছেন। [মালিক, আল-মুআত্তা ১/১৯৯; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ১/১৫৮-১৬১, নং ১২২]উপরের হাদীসগুলোর ভিত্তিতে “অপবিত্র”- অর্থাৎ গোসল ফরয থাকা অবস্থায় অথবা অযু-বিহীন অবস্থায় কুরআন মাজীদ স্পর্শ করা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে চার মাযহাবের ইমামগণ-সহ মুসলিম উম্মাহর প্রায় সকল ফকীহ এ বিষয়ে একমত। [আল-মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাতুল কুওয়াইতিয়্যা ১৬/২৪০; ২৩/২১৬; ৫/৩৩৩; ৩৮/৬]প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ ইবন কুদামা (৬২০ হি) বলেন: “উভয় প্রকারের নাপাকি থেকে পবিত্র না হয়ে কুরআন স্পর্শ করা বৈধ নয়। ... আর এটি অন্য তিন ইমাম মালিক, শাফিয়ী ও হানাফীগণেরও মত। একমাত্র (তৃতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ফকীহ) দাউদ যাহিরী (২০১-২৭০ হি) ছাড়া আর কেউ এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। একমাত্র তিনিই অপবিত্র (ওযু বা গোসল ছাড়া) কুরআন স্পর্শ বৈধ বলেছেন।” [ইবন কুদামা, আল-মুগনী ১/২৫৬]সাহাবীগণের মধ্যে আলী, ইবন মাসউদ, সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস, সায়ীদ ইবন যাইদ, সালমান ফারিসী, আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) ও অন্যান্য ফকীহ সাহাবী ওযূ বা গোসল বিহীন অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করা নিষেধ করেছেন। [কুরতুবী, তাফসীর (জামিউ আহকামিল কুরআন) ২২৫-২২৭]ইবন তাইমিয়া (রাহ) বলেন, এদের বিপরীতে কোনো সাহাবী ওযু বিহীন অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করা বৈধ বলেছেন বলে জানা যায় না। [ইবন তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া ২১/২৬৬]উল্লেখ্য যে, ফকীহগণ শিশু-কিশোর ছাত্র-ছাত্রীর জন্য ওযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ বৈধ বলেছেন। কারণ শিক্ষার জন্য বারবার কুরআন স্পর্শ করা তাদের জন্য প্রয়োজন এবং তারা নাবালেগ হওয়ার কারণে তাদের জন্য শরীয়তের বিধান প্রযোজ্য নয়। এছাড়া কুরআনের তাফসীর, হাদীসগ্রন্থ, ও কুরআন সম্বলিত অন্যান্য সকল গ্রন্থ ওযু ও গোসলবিহীন অবস্থায় স্পর্শ করা বৈধ বলে তাঁরা একমত। [ড. ওয়াহবাহ যুহাইলী, আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু ১/৩৯৫; আল-মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাতুল কুআইতিয়্যাহ ১৬/৫৩]গোসল ফরয থাকা অবস্থায় ও মহিলাদের স্বাভাবিক রক্তস্রাব অবস্থায় কুরআন স্পর্শ না করে শুধু তিলাওয়াতের বৈধতার বিষয়ে সাহাবীগণের ফকীহগণ কিছু মতভেদ করেছেন। ইমাম শাফিয়ী, ইমাম আবু হানীফা এবং ইমাম আহমদের প্রসিদ্ধ মতে এ সকল অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত নিষিদ্ধ বলে গণ্য করেছেন। ইমাম মালিক-এর মতে ‘গোসল ফরয’ অবস্থায় তিলাওয়াত নিষিদ্ধ; তবে মহিলাদের রক্তস্রাবের সময়ে তিলাওয়াত বৈধ। হাম্বলী মাযহাবের এটি দ্বিতীয় মত। কয়েকটি হাদীসের ভিত্তিতে তাঁরা এ অভিমত পোষণ করেছেন। [নববী, আল-মাজমূ ২১৫৮]১. আলী (রা) বলেন:“রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানাবাত বা গোসলের নাপাক অবস্থা ছাড়া সকল অবস্থায় আমাদেরকে কুরআন পড়াতেন।”হাদীসটির মূল বর্ণনাকারী আব্দুল্লাহ ইবন সালিমা-এর বিষয়ে ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস আপত্তি করেছেন। এজন্য হাদীসটির গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান-সহীহ বলেছেন। [তিরমিযী, আস-সুনান (১১১ বাবুররাজুলি ইয়াকরাউল কুরআন...) ১/২৬৩ (নং ১৪৬)]ইমাম হাকিম, হাইসামী, শাইখ শুআইব আরনাউত, প্রমুখ মুহাদ্দিসও হাদীসটিকে গ্রহণযোগ্য বা হাসান বলে উল্লেখ করেছেন। [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১/৬১৫; আরনাউত, মুসনাদ আহমদ (টীকা) ১/১১০] পক্ষান্তরে ইমাম শাফিয়ী, ইমাম নবী, আলবানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন। [নববী, আল-মাজমূ ফ/১৫৯; আলবানী, যায়ীফ আবী দাউদ ১৭৯]২. ইবন উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:“নাপাক ব্যক্তি এবং ঋতুবতী মহিলা কুরআনের কিছুই পাঠ করবে না।” হাদীসটি দুর্বল। [তিরমিযী (কিতাবুস সালাত, ৯৮-বাব মা জাআফিল জুনুবি...) ১২৩৬ (নং ১৩১) (ভারতীয়: ১/৩৪); বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ১/৩০৯; যাইলাহী, নাসবুর রায়াহ ১১৯৫]৩. তাবিয়ী আবীদাহ সালমানী (রহ) বলেন:“উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) নাপাক অবস্থায় কুরআন পাঠ মাকরূহ বা অপছন্দনীয় বলে গণ্য করতেন।” হাদীসটি সহীহ। [আব্দুর রায্যাক, আল-মুসান্নাফ ১/৩৩৭; হক কিরাআতিল জুনুবি (শামিলা ৩.৫), পৃষ্ঠা ১০]৪. তাবিয়ী আবুল আরীফ (রহ) বলেন, আলী (রা) বলেন: “নাপাক ব্যক্তি কুরআনের কিছুই পাঠ করবে না।” হাদীসটি সহীহ। [বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৯; হক কিরাআতিল জুৰি (শামিলা ৩.৫), পৃ ৭ ও ১১]এর বিপরীতে কোনো কোনো সাহাবী, তাবিয়ী ও পরবর্তী ফকীহ গোসল ফরযের নাপাক অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত বৈধ বলেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা), তাবিয়ী সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব, সায়ীদ ইবনু জুবাইর, ইমাম বুখারী, ইমাম তাবারী ও অন্যান্য ফকীহ। [বুখারী, আস-সহীহ (৬-কিতাবুল হায়, ৭-বাব তাকদিল হায়িযুল মানাসিক কুন্নাহা...) ১/১১৬; ইবনুল মুনযির, আল-আউসাত ২/৯৮, ২/৩০৯-৩১৭; আব্দুর রাযযাক, আল-মূসান্নাফ ১/৩৩৭; ইবন হাম,আল-মুহাল্লা ১/৯৬; আইনী, উমদাতুল কারী, ৫/৪০৭-৪০৯]সামগ্রিক বিচারে এরূপ নাপাক অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত নিষিদ্ধ হওয়ার মতটিই সঠিক। নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- থেকে বর্ণিত দুটি হাদীসের মধ্যে একটি হাদীসকে অনেক মুহাদ্দিসই গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। এছাড়া খুলাফায়ে রাশেদীনের দু’জন থেকে সহীহ সনদে নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত। এর বিপরীতে সাহাবীগণের মধ্যে শুধু ইবন আব্বাস (রা) থেকে বৈধতার মত বর্ণিত। আর এজন্যই চার ইমাম-সহ অধিকাংশ ফকীহ এ মতটিই গ্রহণ করেছেন।নিম্নের দু'টি সহীহ হাদীস এ মত সমর্থন করে:১. আবুল জুহাইম ইবনুল হারিস আনসারী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বি’র জামাল-এর দিক থেকে আগমন করছিলেন। এমতাবস্থায় একব্যক্তি তাকে দেখে সালাম দেয়। তিনি তার সালামের উত্তর না দিয়ে একটি দেওয়ালের নিকট যেয়ে তায়াম্মুম করেন এবং তারপর সালামের উত্তর দেন। [বুখারী, (৭-কিতাবুত তায়াম্মুম, ২-বাবুত তায়াম্মুম ফিল হাদার...) ১/১২৯; মুসলিম (কিতাবুল হায়, বাবুত তায়াম্মুম (ভারতীয়: ১/১৬১)]২. মুহাজির ইবন কুনফুয (রা) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট গমন করেন। তখন তিনি প্রস্রাব করছিলেন। তিনি তাকে সালাম দেন। তিনি সালামের উত্তর না দিয়ে ওযু করেন এবং এরপর বলেন: “আমি পবিত্র অবস্থায় ছাড়া আল্লাহর যিকরকে মাকরূহ-অপছন্দনীয় বলে মনে করলাম (এজন্য তোমার সালামের উত্তর দিলাম না) হাদীসটি সহীহ। [আবু দাউদ (১-তাহারাহ, ৮-আইয়ারুস সালাম) ১/৮ (ভারতীয়.১/৪); হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২৭২]এ প্রসঙ্গে শাইখ আলবানী (রহ) বলেন, এ হাদীসটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, নাপাক ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত মাকরুহ। কারণ ও বিহীন অবস্থায় সালাম যদি মাকরুহ বা অপছন্দনীয় হয়; তবে নাপাক অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত আরো বেশি মাকরুহ বা অছন্দনীয় হওয়া উচিত...। [আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ২/২৪৫]সাজদায় কুরআনের দোয়া পাঠবিভিন্নি হাদীসে রুকু-সাজদার মধ্যে কুরআন পাঠ নিষেধ করা হয়েছে। একটি হাদীসে আলী (রা) বলেন: “আমার প্রিয়তম (ﷺ) আমাকে রুকু-রত অবস্থায় অথবা সাজদা-রত অবস্থায় কুরআন পড়তে নিষেধ করেছেন।” [মুসলিম (৪-কিতাবুস সালাত, ৪১-বাবুন নাহয়ি আন কিরাআতিল কুরআন...) (ভারতীয়: ১/১৯১)]অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে যে, সাজদায় কুরআনের কোনো বক্তব্য দোয়া হিসেবে পাঠ করা যাবে কি না? বস্তুত, দোয়া তিলাওয়াত নয়; বরং মহান আল্লাহর সাথে প্রার্থনাকারীর কথা। তিনি শুধু কুরআনের বাক্যগুলো ব্যবহার করে মহান মালিকের সাথে কথা বলছেন। এজন্যই নাপাক অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত নিষিদ্ধ হলেও এ সময়ে কুরআনের দোয়াগুলো পাঠের বৈধতার বিষয়ে ফকীহগণ একমত।আবু যার (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একরাতে (তাহাজ্জুদের) সালাত আদায় করেন। তিনি একটি আয়াতই পাঠ করছিলেন এবং রুকুতে ও সাজদায়ও আয়াতটি (সূরা মায়িদা: ১১৮) পাঠ করছিলেন: “আপনি যদি তারেদকে শাস্তি দেন তবে তারা তো আপনারই বান্দা, আর আপনি যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন তবে আপনি তো মহাপরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।”... তিনি বলেন, আমি আমার রব্বের কাছে আমার উম্মতের জন্য শাফাআত প্রার্থনা করছিলাম...। হাদীসটি হাসান। [নাসায়ী, (১১-কিতাবুল ইফতিতাহ, ৭৯-তারদীদুল আয়াত???) ২/১৭৭; আহমদ, মুসনাদ ৫/১৪৯]এ হাদীসটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, সাজদায় কুরআন তিলাওয়াত নিষিদ্ধ হলেও, কুরআনের বাক্য ব্যবহার করে মহান আল্লাহর সাথে কথোপকথন করা বা দোয়া করা নিষিদ্ধ নয়; বরং সুন্নাহ নির্দেশিত। [আরো দেখুন সৌদী আরবীয় স্থায়ী ফাতওয়া পরিষদ, ফাতওয়া সংকলন ফাতওয়াল লাজনাতিদ দায়িমাহ, ১ম ভলিউম (শামিলা ৩.৫) ৬/৪৪১]মাতৃভাষার যিকর ও দোয়া পাঠরাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শেখানো যিকর ও দোয়াগুলির অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে মূল আরবীতে পাঠ করলেই মহান আল্লাহর যিকর ও দোয়ার প্রকৃত স্বাদ, তৃপ্তি, আনন্দ ও আধ্যাতিকতা লাভ করা যায়। কারণ তার ভাষার যে অপূর্ব কাঠামো ও পূর্ণতা তা কোনোভাবে অন্যভাষায় ভাষান্তর করা যায় না। মালিকী, শাফিয়ী ও হাম্বালী মাযহাবের ফকীহগণ সাধারণভাবে আরবীতে অক্ষম ব্যক্তির জন্য অনারব ভাষায় সালাতের মধ্যে যিকর ও দোয়া পাঠ বৈধ বলেছেন। হানাফী মাযহাবের ইমামগণ আরবীতে অপারগের জন্য সালাতের মধ্যে অনারব ভাষা ব্যবহার বৈধ বললেও পরবর্তী ফকীহগণ তা মাকরুহ বলেছেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম সারাখসী বলেন:“যদি সালাতের তাকবীর ফার্সী ভাষায় বলে তবে আবূ হানীফা (রাহ)-এর মতে তা জায়েয হবে।...আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদের মতে তা জায়েয হবে না, তবে আরবীতে পারঙ্গম না হলে জায়েয হবে। সালাতের মধ্যে তাশাহহুদ ফারসীতে পাঠ করা ... ক্ষেত্রেও একই মতভেদ [আবু বাকর সারাখসী, আল-মাসূত ১/৩৬-৩৭। আরো দেখুনঃ আলাউদ্দীন সমরকন্দী, তুহফাতুল ফুকাহা ১/১৩০; আলাউদ্দীন কাসানী, বাদাইউস সানাইয় ১/১১২-১১৩]সালাতের মধ্যে অনারব ভাষায় যিকর-দোয়া প্রসঙ্গে আল্লামা শামী বলেন: “হানাফী মাযহাবের বর্ণিত মত যে তা মাকরূহ। ... বাহ্যত প্রতীয়মান হয় যে, তা অনুত্তম বা অনুচিত পর্যায়ের এবং মাকরূহ তানযীহী। ... অনারব ভাষায় দোয়া করা সালাতের মধ্যে মাকরূহ তাহরীমী এবং সালাতের বাইরে মাকরূহ তানযীহী হওয়াও অসম্ভব নয়।” [ইবন আবিদীন, আব্দুল মুহতার (হাশিয়াতু ইবন আবিদীন) ১/৫২১]সামগ্রিক বিচারে প্রত্যেক আগ্রহী মুমিনের উচিত মাসনূন দোয়া ও যিকরগুলি অর্থ-সহ আরবীতে মুখস্থ করা এবং সালাতের মধ্যে তা পাঠ করা। একান্ত অক্ষম হলে যতদিন আরবী দোয়া মুখস্থ না হয় ততদিন নফল বা তাহাজ্জুদের সালাতের মধ্যে ও সাজদায় মাসনূন দোয়াগুলির অর্থ মাতৃভাষায় পাঠ করা অনুচিত হলেও নিষিদ্ধ হবে না বলেই আমরা আশা করি। মাসনূন দোয়াগুলো মুখস্থ না হওয়া পর্যন্ত সালাতের বাইরে বই হাতে দেখে দেখে আরবী দোয়া পাঠ করা যায়। প্রয়োজনে শুধু বাংলা অর্থ পাঠ করেও দোয়া করা যায়। তবে চেষ্টা করতে হবে মাসনূন আরবী দোয়া মুখস্থ করার। আল্লাহই ভাল জানেন।