পরিচ্ছেদ: আল্লাহর ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য ভালোবাসা
মহান আল্লাহর নৈকট্য ও বেলায়াত অর্জনের জন্য সবচেয়ে সহজ ও সর্বাধিক সহায়ক বিষয় তিনটি: ১. মহব্বত বা ভালোবাসা ও ২. সুহবাত বা সাহচর্য ও ৩. যিকর। মহব্বত বা ভালোবাসা বলতে আল্লাহর ভালোবাসা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ভালোবাসা বুঝানো হয়। সুহবাত বা সাহচর্য অর্থ নেককার মানুষদের সহচর হওয়া বা তাদের সাথে কিছু সময় কাটানোনা। শেষের দুটি ইবাদত মূলত নফল পর্যায়ের; কিন্তু তা ফরয ও নফল পর্যায়ের ঈমান ও তাকওয়া অর্জনের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) ভালোবাসাআল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে অন্য সকল কিছু এবং নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসা আল্লাহর প্রিয়তম ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: “তিনটি বিষয় যার মধ্যে থাকবে সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করবে, ১. আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল অন্য সকলের চেয়ে তার নিকট বেশি প্রিয় হবেন, ২. কাউকে ভালবাসলে শুধু আল্লাহর জন্য ভালবাসবে, অন্য কোন কারণে কাউকে ভালবাসবে না এবং ৩. আল্লাহর দয়ায় কুফর থেকে রক্ষা পাওয়ার পর পুনরায় কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতই অপছন্দ করবে।”[বুখারী (২-কিতাবুল ঈমান, ৮-বাব হালাওয়াতিল ঈমান) ১/১৪, নং ১৬ (ভা ১৭); মুসলিম (১-কিতাবুল ঈমান, ১৭-বাব বায়ানু খিসালি...) ১৬৬ নং ৪৩ (ভারতীয় ১/৪৯)]অন্য হাদীসে তিনি আরো বলেছেন: “তোমাদের কেউ ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে আমাকে তার পিতা, সন্তান ও সকল মানুষের চেয়ে বেশী ভালবাসবে।” [বুখারী (২-কিতাবুল ঈমান, ৭-বাব হুব্বির রাসূল ﷺ) ১/১৪, নং ১৫ (ভারতীয় ১/৬); মুসলিম (১-কিতাবুল ঈমান, ১৮-বাব উজুবি মাহাব্বাতি...) ১/৬৭, নং ৪৪ (ভারতীয় ১/৪৯)]আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন: “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করে বলে কিয়ামত কখন? তিনি বলেন: তুমি কিয়ামতের জন্য কী প্রস্তুত করেছ? লোকটি বলেন: কিছুই নয়, আমি কিয়ামতের জন্য অনেক বেশি (নফল) সালাত, সিয়াম বা দান-সাদকা প্রস্তুত করতে পারিনি; কিন্তু আমি আল্লাহকে এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে ভালবাসি। তিনি বলেন: “তুমি যাকে ভালবাস তার সাথেই থাকবে।” আনাস (রা) বলেন: “তুমি যাকে ভালবাস তার সাথেই থাকবে' রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর এ কথায় আমরা যত খুশি হলাম এমন খুশি আর কিছুতে হই নি। আনাস বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ), আবু বাকর (রা) ও উমার (রা)-কে ভালবাসি এবং আমি আশা করি যে, আমি তাদের মত আমল করতে না পারলেও তাদেরকে ভালবাসার কারণে আমি তাদের সাথেই থাকব।” [বুখারী (৬৬-কিতাবু ফাদায়িলিস সাহাবাহ, ৬-মানাকিব উমার) ৩/১৩৪৯; (ভারতীয় ১৫২১) মুসলিম (৪৫-কিতাবুল বির, ৫০-বাবুল মারয়ি মাআ মান আহা) ৪/২০৩২]আমরা দেখেছি যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সবকিছুর উর্ধ্বে ভালবাসা তাওহীদ ও রিসালাতের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভালবাসা অর্জনের অন্যতম উপায় সাহচর্য, আনুগত্য ও অনুকরণ। সাহচর্য, আনুগত্য, অনুসরণ এবং ভালবাসা একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জাড়িত। ভালবাসা অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করে এবং অনুসরণ আরো ভালবাসা সৃষ্টি করে। প্রকৃত ভালবাসা ছাড়া প্রকৃত ইত্তিবায়ে সুন্নাত সম্ভব নয়। আবার যে ভালবাসা অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করে না তা মেকি।পাঠক, আপনি যদি নিজেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর ‘আশিক মনে করেন, কিন্তু তার হাদীস, সুন্নাত ও সীরাত পাঠের মাধ্যমে তার সাহচর্য লাভের চেয়ে অন্য কারো সাহচর্য বা অন্য কিছুর আলোচনা অধিক ভাল লাগে অথবা তার সুন্নাতের ব্যতিক্রম কর্ম করতে আপনার প্রচণ্ড কষ্ট হয় না কিন্তু অন্য কারো কথার ব্যতিক্রম করতে কষ্ট লাগে তবে আপনি নিশ্চিত থাকুন যে, আপনার ভালোবাসাের দাবি মিথ্যা। শয়তানের প্রতারণা থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করুন এবং জীবনকে সুন্নাতে নববীর অনুকরণে পরিচালিত করে সত্যিকার ভালোবাসাের স্বাদ লাভ করুন।রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রকৃত ভালোবাসা অর্জনের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সর্বদা বেশিবেশি দরুদ-সালাম পাঠ করা। মুমিনের উচিত এ বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা।আল্লাহর জন্য ভালোবাসাআল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর ভালবাসার অবিচ্ছেদ্য প্রকাশ যারা আল্লাহকে মাবুদ এবং মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে রাসূল হিসেবে বিশ্বাসের স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের সকলকে ভালবাসা। যার মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) আনুগত্য ও সুন্নাতের অনুসরণ যত বেশি তার প্রতি মুমিনের ভালোবাসাও তত বেশি। দল, মত, পাওনা, দেনা, ভাল ব্যবহার বা খারাপ ব্যবহারের কারণে তা বাড়ে না বা কমে না। বরং দ্বীনের হ্রাসবৃদ্ধির কারণে তা বাড়ে-কমে। মহান আল্লাহ বলেন:إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌঅর্থঃ “মু'মিনগণ পরস্পর ভাই ভিন্ন কিছুই নয়।” [সুরা হুজুরাত, ১০ আয়াত]এখানে মহান আল্লাহ মুসলিম না বলে মুমিন বলেছেন। উভয় শব্দ সমার্থক হলেও সাধারণত ইসলাম বলতে বাহ্যিক কর্ম ও ঈমান বলতে অন্তরের বিশ্বাস ও বিশ্বাসের সাক্ষ্য বুঝানো হয়। এথেকে জানা যায় যে, যতক্ষণ কোনো ব্যক্তি ঈমানের সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং সন্দেহাতীত কুফরী-শিরকে লিপ্ত হচ্ছেন না ততক্ষণ তিনি অন্য মুমিনের “দ্বীনী ভাই” বলে গণ্য। কুরআনে রক্ত সম্পর্কের ভ্রাতৃত্বের চেয়ে ‘ঈমানী ভ্রাতৃত্ব”-কে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।কুরআনে “ভাই” শব্দটির ব্যবহারের ব্যাপকতা লক্ষণীয়। হত্যাকারীকে নিহতের পরিজনের “ভাই” বলা হয়েছে। [সূরা বাকারা: ১৭৮ আয়াত] দুটি মুমিন গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ চলা অবস্থাতেও তাদেরকে “ভাই” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। [সূরা হুজুরাত: ৯-১০ আয়াত] অর্থাৎ মানবীয় দুর্বলতার শিকার হয়ে একজন মুমিন অন্য মুমিনকে খুন করে ফেলার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। দুজন মুমিনের পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এ কারণে তাদের কেউ কাফির হন না বা চিরশত্রুতে পরিণত হন না। তাদের যুদ্ধ আপন দু ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধের মত। যুদ্ধের পাশবিকতার মধ্যেও যেমন দু সহোদরের ভ্রাতৃত্ব মিলন ও মমতার হাতছানি দেয়, তেমনি দুজন মুমিনের যুদ্ধ। ভুল বুঝাবুঝি, হানাহানি, অশান্তি বা যুদ্ধ মিটিয়ে ফেলা এরূপ অপরাধে লিপ্ত পক্ষদ্বয় এবং মুমিন সমাজের দ্বীনী দায়িত্ব।উপরের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে, দলমত নির্বিশেষে প্রত্যেক মুমিনকে ভাই হিসেবে ভালবাসা এবং ঈমানের দাবিদার কোনো ব্যক্তির প্রতি শত্রুতা পোষণ করা ঈমানের ন্যূনতম দাবি। এটি ঈমানী ভালবাসার ন্যূনতম পর্যায়।