রুকইয়াহ পদ্ধতির সংশোধন

রুকইয়াহ পদ্ধতির সংশোধন

৮ সাবক্যাট | ৮ দোয়া

অধ্যায়: রুকইয়াহ পদ্ধতির সংশোধন

পরিচ্ছেদ: ভূমিকা

১২৪

মানুষ মহাগ্রন্থ আল কুরআনের মাধ্যমে অসুস্থতার চিকিৎসা বিষয়ে আলোচনা করছে, আর যারা এ চিকিৎসা পদ্ধতির অনুশীলন করছেন তারা এর প্রশংসা ও সমালোচনা উভয়টাই করছেন। নিম্নোক্ত দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই এ প্রশংসা ও সমালোচনা আবর্তিত হয়:১. এ বিষয়ের উপর লিখিত বইসমূহ।২. এ পদ্ধতির কিছু রক্বির দ্বারা সংঘটিত ভুল এবং তারা এ চিকিৎসা পদ্ধতিকে যেভাবে অতিরঞ্জিত করেছেন।স্বচ্ছতার জন্য এসব মন্তব্য ও ভুল থেকে কিছু যদি আমরা উল্লেখ করি, তাহলে আমরা বলব যে, তাদের মধ্যে কিছু লোক আমাদের ঈমানি ভাই-তাদের কাছ থেকে অনেক লোক উপকার লাভ করেছেন-ইসলাম ও এর আকীদাহ রক্ষায় তারা গ্যাপ পূরণ করেছেন। তারা ভণ্ড ওঝা-কবিরাজ, মিথ্যাবাদী ও গণকদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন, এদের ব্যাপারে জনসাধারণকে সতর্ক করেছেন, তারা লুপ্তপ্রায় সুন্নাহকে পুনর্জাগরিত করেছেন, পুনর্জীবন দান করেছেন। তাদের কর্ম মূলত দুটি অপরিহার্য শর্তের ওপর। একটি হল ইসলামী শরীয়াহ অনুসারে গ্রহণযোগ্যতা অর্থাৎ আন্তরিকতা, অন্যটি হল সুন্নাহ অনুসরণ করা। কারণ নিয়ত বা উদ্দেশ্য যদি আন্তরিক না হয় তাহলে তাদের কর্ম হয়ে যাবে লোক দেখানো এবং শিরক, আর কেউ যদি সঠিকভাবে সুন্নাহ অনুসরণ না করেন তাহলে তিনি নিমজ্জিত হবেন পাপ ও বিদ'আতে।শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ তাদেরকে আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: যে ব্যক্তি (জ্বিনের) বৈরিতা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সঠিক পথ অনুসরণ করবেন, ঠিক যেভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) নির্দেশ দিয়েছেন সেভাবে করবেন, তাহলে তিনি তাদের সঙ্গে ভুল বা অনৈতিক কিছু করবেন না, বরং তিনি যার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে তাকে সহায়তা করার মাধ্যমে, অভাবীকে সাহায্য করা এবং যন্ত্রণায় কাতর ব্যক্তির যন্ত্রণা লাঘব করার মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলেরই (ﷺ) আনুগত্য করছেন, আর এ কাজটি তিনি করছেন ইসলামে নির্দেশিত উপায়ে, যেখানে আল্লাহর সঙ্গে কোনো অংশিদারিত্ব (শিরক) নেই, যে পদ্ধতিতে কারো সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হয় না।“এ ধরনের একজন মানুষ কখনো জ্বিন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না, এর কারণ হল, হয় জ্বিন জানে যে এ ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণ ও সৎ অথবা জ্বিনরা এ ব্যক্তির কোনো ক্ষতি করতে সক্ষম নয়। কিন্তু জ্বিন যদি ইফরিত হয় এবং ওই ব্যক্তি যদি দুর্বল হয় তাহলে তারা ক্ষতি করতে পারবে। সেক্ষেত্রে এ দুর্বল ব্যক্তি নির্দিষ্ট কিছু আয়াত যেমন-আয়াতুল কুরসী, আল মু'আব্বিযাত (সূরা নাস ও ফালাক ও নির্দিষ্ট কিছু দোয়া তেলাওয়াত করে আল্লাহর কাছে নিজের সুরক্ষার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেন। এছাড়াও ঈমান বৃদ্ধিকারী কিছু আয়াতও তেলাওয়াত করতে পারেন এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবেন, যেগুলোর কারণে জ্বিনরা মানুষের উপর কর্তৃত্ব অর্জন করার সুযোগ পায়। কারণ তিনি এখন আল্লাহর পথে সংগ্রামরত, আর এটাই হলো সর্বোৎকৃষ্ট জিহাদ। [ইবনে তাইমিয়্যাহ, মাজমুয়া আল ফাতওয়া, আবদ আল রহমান বিন কাশেম সম্পাদিত, ১৯/৫৩]দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সংখ্যায় অনেক বেশি-আল্লাহ এদের সংখ্যা কমিয়ে দিক-তাদের উদ্দেশ্য ও অভিসন্ধি পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গেছে। তারা শরমের পর্দা সরিয়ে ফেলেছে এবং কপট শাইখের মুখোশ-পোশাক পরিধান করেছে। তারা প্রচুর সংখ্যক প্রতিকারের বই প্রকাশ অথবা চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে এ সুন্নাহকে পরিণত করেছে অশালীন বাণিজ্যে।

পরিচ্ছেদ: অশুদ্ধ বই

১২৫

এ বিষয়ের উপর আমরা কত বই দেখেছি, একটার পর একটা প্রকাশিত হচ্ছে, এসবের অধিকাংশই এখান থেকে সেখান থেকে সংগ্রহ করা উদ্ধৃতির সংকলন মাত্র। যারা এসব বই লেখেন তাদের এ বিষয়ে কোনো জ্ঞানই নেই, তারা এর মাধ্যমে নিজেদের কৃতিত্বই জাহির করতে চান। তাই তারা আরেকজনের লেখা চুরি করেন, আরেকজনের প্রচেষ্টাকে অর্থের বিনিময়ে কিনে নেন এবং বই তৈরি করেন।যে বইয়ের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় লেখা থাকে, উমুক কর্তৃক রচিত, তিনি উমুকের ছেলে ইত্যাদি, আসলে তার এ সম্পর্কিত কোনো জ্ঞানই নেই। তাদের বইগুলো বিদআতের বাজে বিবরণে পরিপূর্ণ থাকে, শরীয়াহ বিরোধী ছবি ও বিষয় দিয়ে বই তৈরি করা হয়। এতবার এসব বই পড়েছি আর এত এত এ সম্পর্কে শুনেছি যে, তার পুনরাবৃত্তি করা এখন দুঃসাধ্য মনে হয়। এসব কপটরা তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার ঝুলি দিয়ে বই রচনা করেন, আর দাবি করে বসেন, এ গ্রন্থ যাচাই-বাচাই করা হয়েছে, পাশাপাশি এর ভিত্তি সম্পর্কেও বড় বড় দাবি করে বসেন। পরবর্তীতে দেখা যায় কপটদের রচিত এসব বই লোকজ গল্পের প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়, অথচ দেখে মনে হবে পাঠকরা এমন কিছু বই পড়ছেন, যেগুলো জ্ঞানে পরিপূর্ণ।অন্য দিকে এতে করে বিদ্বান ব্যক্তিরা খুব হতাশ, কারণ এ কপটতার মাধ্যমে ফিতনার দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেছে। আমাদের সম্মানিত শায়খ বকর বিন আবদুল্লাহ আবু যায়েদ সুন্দর বাচনভঙ্গীতে এসব রক্বির ও কপট শাইখদের কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে:আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, কিছু মানুষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে ইচ্ছুক, কিন্তু তারা এ ক্ষেত্রে যোগ্যতা অর্জন করার আগেই। বিখ্যাত হতে চান, অর্থাৎ তারা হাঁটতে শাইখার আগেই দৌড়াতে চান। [ড. বকর আবদুল্লাহ আবু যায়েদ, আল-তা'লামুন]তাদের রচিত বইসমূহে যেসব অদ্ভুত বিষয় পাওয়া যায় সেগুলো হল:কাউকে কোনো একটি আয়াত নির্দিষ্ট সংখ্যক বার পড়ার নির্দেশ দেয়া, যেমন-৩৬৬ বার অথবা ১০০২ বার; রোগীর দেহের উপর কুরআনের আয়াত লেখার নির্দেশ দেয়া, যেমন রোগীর নাভির নিচে অথবা কপালে লিখতে বলা।একজনের হাতের তালুতে রেখে কুরআন তেলাওয়াত করা, অতঃপর রোগীকে তার হাতের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখছে কি না তা জিজ্ঞেস করা।তাদের মধ্যে অনেকে আবার জ্বিনের উপস্থিতি আছে কি না তা জানার জন্য রোগীকে পাঁচ মিনিট ধরে শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বিসমিল্লাহি আউয়ালুহু ওয়া আখিরিহি পাঠ করতে বলেন।কিছু লোক আবার বলেন, একটি সাদা কাগজের উপর বৃত্ত এঁকে তার মধ্যে কুরআনের আয়াত লেখার জন্য, অতঃপর আয়াত লেখা এ কাগজ জ্বিনে আক্রান্ত ব্যক্তির সামনে উপস্থাপন করার পরামর্শ দেন। এরফলে জ্বিন পালিয়ে যাবে এবং এ বৃত্তের ফাঁদে আটকা পড়বে।অনেকে বলেন, আপনি যদি কোনো অবিবাহিত মেয়ের চিকিৎসা করার চেষ্টা করেন, তাহলে আপনাকে অবশ্যই তাকে রক্ষা করতে হবে এ কথা বলে, “পরম করুণাময় আল্লাহর নামে, হে মেয়ে তোমার সম্মান ও ভবিষ্যত সুরক্ষিত হোক।” এর কারণ হিসেবে তারা বলে থাকেন জ্বিন যাতে এ মেয়ের যোনীপথ থেকে প্রস্থান করে তার সতী পর্দা ভেঙ্গে না দিতে পারে, সেজন্য তারা এটা করে থাকেন।তারা আবার অনেক নারী রোগীকে নির্দেশ দেন, তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে, আর রক্বির তাকিয়ে থাকেন রোগীর দিকে, তারা এ চোখাচোখিকে বলে থাকেন শয়তান তাড়ানোর জন্য “তাকানোর মাধ্যমে রোগ আবিষ্কার" পদ্ধতি।তাদের মধ্যে অনেকে কুরআন তেলাওয়াত করার সময় রোগীকে হাত উত্তোলন করার নির্দেশ দেন, আর বলেন, রোগীর হাত যদি ডান দিকে। নড়ে বা হেলে পড়ে তাহলে বুঝতে হবে তাকে জ্বিন স্পর্শ করেছে, আর হাত যদি বাম দিকে হেলে পড়ে তাহলে বুঝতে হবে রোগী ওঝা-কবিরাজের যাদুটোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।শায়খ ও জ্বিনদের মধ্যকার দীর্ঘ কথোপকথনও প্রকাশিত হয়েছে, আমি জানিনা আসলে কোন পয়েন্টে বা কিসের ভিত্তিতে এ ধরনের কথোপকথন প্রকাশ করা হল, এটা শায়খের কৃতিত্বের প্রচার ব্যতিত কিছু নয়, তিনি যে জ্বিনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, সেটা মানুষকে জানানোই এর উদ্দেশ্য। তাদের মধ্যে অনেকে আবার বলেন, জ্বিন ইসলাম গ্রহণ করেছে অথবা জ্বিন তওবা করেছে এবং রোগীর দেহ ত্যাগ করেছে। আমরা অনেক অনেক শুনেছি যে, জ্বিনদের রাজা ও রাণী তাদের বিশেষ দেহরক্ষীসহ মুসলিম হয়েছে, আরো শুনেছি নারীর দেহে অবস্থান নেয়া অসংখ্য জ্বিন রক্বির হাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে এবং দেহ ত্যাগ করে চলে গেছে, আর প্রস্থান করানোর সময় তাদের মধ্যকার মজার ও মুখরোচক কথোপকথনও আমরা শুনেছি।এরকম আরো অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে, এগুলো আদৌ সত্যি কি না, কারণ এসব কথোপকথন হয়েছে রোগীর ঠোঁটে, আমরা তো জ্বিনকে বা অন্য কাউকে দেখতে পাইনি। এমন হতে পারে যে, এটা এমন এক জ্বিন যে তার কণ্ঠ পরিবর্তন করতে পারে, অথবা এমনও হতে পারে, এ জ্বিন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়, অর্থাৎ রাজা বা মন্ত্রী নয়; অথবা এমনও হতে পারে যে, রোগীই মানসিকভাবে অসুস্থ।এসব শায়খরা জ্বিন থেকে প্রতিকারের বিষয়ে যা বর্ণনা করেছেন সে। ব্যাপারে বলব, একজন জ্ঞানী ব্যক্তিকে দ্বিধান্বিত ও হতাশ করার জন্য এ বর্ণনাই যথেষ্ট। তাদের মধ্যে অনেকে আবার নিজেকে ডাক্তার হিসেবে দাবি করেন এবং বিভিন্ন রোগের জন্য ওষুধের পরামর্শ দেয়াও শুরু করেছেন, যেমন-বাইল (পাচক রস), অ্যাসাফিটিডা ও “ড্রাগনের রক্ত”। [ড্রাগনের রক্ত: এক ধরনের গাঢ়ো লাল রঙের রজন সদৃশ পদার্থ যা উৎপন্ন হয় ড্রাগন গাছ থেকে, এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম হল ড্রাসিনা ড্রাকো]

পরিচ্ছেদ: জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের রুকইয়াহ করা

১২৬

অভিজাত-নীচ, জ্ঞানী ও মুখ, বিশ্বাসী ও নীতিহীন প্রত্যেকেই এ ক্ষেত্রে জ্ঞান আছে বলে দাবি করছেন এবং এ বিষয়ে কথাও বলছেন। প্রত্যেকেরই নিজস্ব উৎস রয়েছে এবং তারা নিজেকে শায়খ হিসেবেও দাবি করেন। কোনো ধরনের জ্ঞান অথবা নির্দেশনা অথবা কোন স্পষ্ট কিতাব ছাড়াই স্রেফ অনুমানের উপর ভিত্তি করে আল্লাহকে নিয়ে কথা বলার মতো স্পর্ধা দেখান। আর এ অনুমান হলো সবচেয়ে বড় মিথ্যা।তারা দাবি করেন, রোগীর দেহে কারীন অবস্থান নিয়েছে, এ কারীনই তার উপর অন্যায় অবিচার করেছে (কিন্তু তাদের এ দাবি নতুন আইডিয়া, এর জন্য স্পষ্ট প্রমাণ দরকার), তারা আরো দাবি করেন যে, এ রোগী যাদুটোনার কবলে পড়েছে এবং তার দেহে উম্মুল সুবিয়ান অবস্থান নিয়েছে। আর তাদের সকল প্রচেষ্টা যদি ব্যর্থ হয় এবং জ্বিন কথা না বলে, তাহলেই তারা বলতে শুরু করেন যে, এ লোকের ওপর কারো বদনজর পড়েছে। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, তারা অতি দ্রুতই রোগ নির্ণয় করে ফেলেন এবং পুরো কাহিনী বোঝার আগেই চিকিৎসা শুরু করে দেন, এমনকি ইসলামের খাটি শায়খগণ যেসব আলোচনা থেকে বিরত থাকতেন, তারা দিব্যি সেসব আলোচনা করছেন।তাদের অনেকেই কুরআনের আয়াতসমূহকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেন। তাই আপনি দেখবেন, অনেকেই রোগীকে সমুদ্র তীরে নিয়ে যান এবং রোগীকে সেই পানিতে নিমজ্জিত করে এ আয়াত পাঠ করছেন:ارْكُضْ بِرِجْلِكَ ۖ هَٰذَا مُغْتَسَلٌ بَارِدٌ وَشَرَابٌ ﴿٤٢﴾অর্থঃ [আমি বললাম], ‘তুমি তোমার পা দিয়ে (ভূমিতে) আঘাত কর, এ হচ্ছে গোসলের সুশীতল পানি আর পানীয়’। (সা'দ ৩৮: ৪২)আবার অনেককে দেখবেন, রোগীকে আঘাত করছেন আর নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করছেন:ذُقْ إِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْكَرِيمُ ﴿٤٩﴾অর্থঃ (বলা হবে) ‘তুমি আস্বাদন কর, নিশ্চয় তুমিই সম্মানিত, অভিজাত’। (আল দুখান ৪৪:৪৯)অনেককে আবার দেখবেন রোগীর গায়ে বরফ শীতল পানি ঢালছেন এবং নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করছেন:ثُمَّ صُبُّوا فَوْقَ رَأْسِهِ مِنْ عَذَابِ الْحَمِيمِ ﴿٤٨﴾অর্থঃ তারপর তার মাথার উপর ফুটন্ত পানির আযাব ঢেলে দাও। (আল দুখান ৪৪:৪৮)বর্তমানে সচেতন জ্ঞানী ব্যক্তিরা এসব কপটদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করেছে। এটা মুসলিমদের অধিকার যে, তাদের শায়খরা এসব ভণ্ড হাতুড়ে ওঝা-কবিরাজদের যুক্তি খণ্ডন করবেন, তাদেরকে অমূলক বলে প্রমাণ করবেন, প্রত্যেক ভুলকারী ও তার ভুল, জ্ঞানী লোকদের ভুল ও বাজে কৌশলকে যুক্তির তরবারিতে খণ্ডন করবেন, যাতে করে এ ধরনের বাতিল ও অনৈতিক অভিলাষ মুসলমানদের সাধারণ চেতনাকে কলুষিত করতে না পারে।এ ধরনের অস্বাভাবিক ও অদ্ভুত গল্পের অনুরাগী হওয়া এবং এগুলোর অনুসন্ধান করা খুবই বিপজ্জনক। জ্ঞানী ব্যক্তিরা সবসময়ই সতর্ক করেছেন। যে, শয়তান বিদ্বান ব্যক্তিদের উপরও সওয়ার হতে পারে।যিয়াদ বিন যাদির থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ওমর (রাঃ) আমাকে বলেন: “তুমি কি জান, ইসলামের অধঃপতন হবে কিভাবে? আমি বললাম: না। তিনি বললেন: ইসলামের অধঃপতন হবে স্কলার বা আলিমদের ভুলে, বকধার্মিকদের কুরআনকে ভুলের উপর ভিত্তি করে করা যুক্তি-তর্কে এবং বিপথগামী শাসকের শাসনে।” [সুনান আদ-দারিমী ১/৭১]

পরিচ্ছেদ: সালাফদের পথ আঁকড়ে ধরা ও বিদ'আত বিসর্জন

১২৭

আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত এর একটি অন্যতম প্রশংসনীয় গুণ হলো-কুরআন ও সুন্নাহ, এ উম্মাহর সালাফিদের নির্দেশিত পথে তাদের অটল থাকা। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন: আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত এর লোকেরা যেসব কাজ সাহাবা (রাঃ) থেকে প্রমাণিত নয় সেগুলোকে বিদয়াত হিসেবে গণ্য করেন, তাদের যুক্তি হল, এ কাজগুলো যদি ভালোই হত, তাহলে আমাদের আগেই সাহাবারা এ কাজগুলো করতেন। কারণ তারা ভালোর কোনো বৈশিষ্ট্য তো ছাড়তেনই না, বরং এগুলো করার জন্য তারা তাড়াহুড়ো করতেন। [ইবনে কাসীর, তাফসীরুল কুরআন, ৪/১৬৮]সে জন্যই এ উম্মাহর মধ্যে সালাফিগণ রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ-তে নতুন কোনো কিছু সংযোজন ও প্রবর্তনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বর্ণিত আছে, আবুদ দারদা (রাঃ) যখন সুন্নাহর মধ্যে নতুন কিছু প্রবর্তন খেয়াল করলেন, যেগুলো এখনো বিদয়াতের পর্যায়ে পৌঁছায়নি, তিনি বললেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যদি তোমাদের মাঝে উপস্থিত থাকতেন তাহলে তিনি ও তাঁর সাহাবাগণ যেসব কাজ করেছেন তার মধ্যে থেকে সালাত ব্যতীত তোমাদের আর কোনোটিরই স্বীকৃতি দিতেন না। আল আওযায়ী (রহ) বলেন: তিনি যদি আজ উপস্থিত থাকতেন? ঈসা বিন ইউনুস (রহ) বলেন: আল আওযায়ী (রহ) যদি আজ আমাদের মাঝে থাকতেন তাহলেই বা কী হত?আরো বর্ণিত আছে, উম্মে দারদা (রাঃ) বলেন: এরপর আবুদ দারদা (রাঃ) রাগান্বিত হয়ে গেলেন এবং আমি বললামঃ কী কারণে আপনি রাগান্বিত হলেন? তিনি বললেন: আল্লাহর শপথ, জামায়াতে সালাত আদায় করা ব্যতিত মহানবী (ﷺ) সম্পর্কিত তাদের আর কোনো বিষয়েরই আমি স্বীকৃতি দেব না।সাহল বিন মালিক (রহ) থেকে বর্ণিত, তার পিতা বলেন: সাহাবারা যেসব কাজ করতেন তার মধ্য থেকে সালাত ব্যতীত তাদের আর কোনোটিকেই আমি স্বীকৃতি দেব না।মাইমুন বিন মিহরান (রহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সালাফিদের মধ্যে কাউকে যদি তোমাদের মাঝে নিয়ে আসা হত, তাহলে তারা কিবলাহ। ব্যতিত তোমাদের আর কোনো কিছুই মেনে নিতেন না।আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি তোমাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে তোমরা যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বল এটা ব্যতীত আর কোনো কিছুই স্বীকৃতি দেব না, যেগুলোর সঙ্গে আমি রাসূল (ﷺ)-এর যুগে পরিচিত ছিলাম। আমরা বললাম: কেন হে আবু হামজা? তিনি বললেন: তোমরা সালাতকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিলম্বিত কর, আল্লাহর রাসুল (ﷺ) কি এভাবে সালাত আদায় করতেন?হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: প্রাথমিক যুগের। কোনো মানুষকে যদি বর্তমান যুগে ফিরিয়ে আনা হত, তাহলে তিনি। ইসলামের কোনো কিছুইকেই স্বীকৃতি দিতেন না। এবং তিনি আমার উরুর উপর আঙ্গুল নির্দেশ করে বললেন: “শুধু এ সালাত ব্যতীত।”অতঃপর তিনি বলেন: আল্লাহর শপথ, এমন এক ব্যক্তি যিনি সালাফিদের যুগে জন্মলাভ করেননি, তিনি যদি দেখেন বিদ’আত কারীরা তাদের প্রবর্তনের মাত্রা বাড়িয়েই চলছেন এবং তারা এ জাগতিক কাজের জন্য নিজের সব সময় ব্যয় করছেন এবং অন্যদেরকেও তার সঙ্গে এ পথে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন, কিন্তু আল্লাহ তাকে এ পথ থেকে রক্ষা করেছেন এবং সত্য পথের অনুসারী সালাফিদের জন্য তার হৃদয়কে দীর্ঘ। করে দিয়েছেন, তাই তিনি সালাফিদের অনুসৃত পথ সম্পর্কে আরো জানার চেষ্টা করেন এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন, তাহলে তাকে আল্লাহ তা'আলা উত্তম প্রতিদান দেবেন। সুতরাং এ ব্যক্তির মতো হওয়ার চেষ্টা করব আমরা, ইনশাআল্লাহ।” [আল শাতিবী, আল-মুতাওয়াফফাকাত, ১/১৪]বেশ কিছু সনদে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু রেখে যাইনি যা তোমাদেরকে আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে আসবে বা ঘনিষ্ঠ করে তুলবে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে সরিয়ে নেবে, আমি তোমাদেরকে এর সবকিছুর নির্দেশ দিয়েছি। একইভাবে, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু রেখে যাইনি যা তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুনের কাছাকাছি নিয়ে যাবে এবং আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে, আমি এর সবকিছু তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ করেছি।”সুতরাং ইসলামী শরীয়াহ্‌র নিয়ম-কানুনে কোনো ধরনের বিদ’আত ও সংযোজন-বিয়োজন করার কোনো সুযোগ কারো নেই, যতই ছোট আর অগুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন এ সংযোজন অথবা বিয়োজন। বর্ণিত আছে যে, মদীনার ইমাম ইমাম মালিক (রহঃ) যারা এ উম্মার প্রাথমিক পর্যায়ের প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাত এমন কোনো বিদ’আত করেছেন তাদেরকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন:“যে ব্যক্তি ইসলামে কোনো বিধান সংযোজন করবেন, বিদ’আত করবেন, হোক না তা ভালো মনে করেই, তার এ কাজ হবে এ দাবি করার শামিল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তার আনিত বার্তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আপনার যদি ইচ্ছা হয় তাহলে তেলাওয়াত করুন,অর্থঃ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে। (আল-মায়িদা ৫:৩)ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন: এ উম্মাহর সর্বশেষ প্রজন্ম তাদের পূর্বপুরুষ বা প্রাথমিক পর্যায়ের প্রজন্ম যে নির্দেশনা দিয়ে সঠিক পথের অনুসারী হয়েছিলেন, তা ব্যতীত অন্য কোনো নির্দেশনা দিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারবে না, সঠিক পথের দিশা লাভ করতে পারবে না। যা কখনোই ধর্মের অংশ ছিল না, তা এখনো ধর্মের অংশ হতে পারে না।এটা সর্বজন বিদিত যে, যেসব কাজ মূলত শরীয়াহ অনুসারে অনুমোদিত, সেগুলোকেও অননুমোদিত করা যেতে পারে, যদি কাজগুলোকে বিদয়াতি কায়দায় প্রবর্তন করা হয়ে থাকে। বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) এক মহিলার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলেন, ওই মহিলা তাসবীহ জপছেন, তিনি তাসবীহদানা ভেঙে দুরে ছুড়ে মারলেন। এরপর তার সঙ্গে আরেক পুরুষের দেখা হল, সেই পুরুষটি কংকরদানা দিয়ে তাসবীহ জপছিলেন, এটা দেখে ইবনে মাসউদ (রাঃ) পা দিয়ে কংকরদানাগুলোতে লাথি মারলেন এবং বললেন: “তুমি দ্বীনের মধ্যে বিদ’আত করছ। অথবা তুমি কি মনে কর আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর সাহাবাদের থেকেও তোমার বেশি জ্ঞান রয়েছে? [ইবনে ওয়াদ্দাহ, আল বিদা, পৃ-৮]সুতরাং দ্বীনের মধ্যে নব্য প্রবর্তনের অথবা দুর্বল মতামত ও প্রমাণের উপর নির্ভর করার ব্যাপারে সতর্ক হোন। ভিন্ন মতামত দুর্বল প্রমাণের উপর ভিত্তি করে হতে পারে, এটা কিছু মুজতাহিদের একটি বড় ভুল। এ ভ্রান্ত ও কলুষিত আইডিয়া, যা অনেক অজ্ঞ লোক গ্রহণও করেন, মানুষকে আল্লাহর দ্বীন পরিবর্তন, শয়তানের আনুগত্য করা এবং সারা বিশ্বজাহানের মালিকের অবাধ্য হওয়ার পথে পরিচালিত করে। যদি মিথ্যার সঙ্গে ভ্রান্ত আইডিয়া যুক্ত করা হয়, আর কারো শক্তিশালী বাতিক ও অভিলাষ দ্বারা যদি সেই আইডিয়া সমর্থিত হয়, তাহলে আর জিজ্ঞেস করবেন না যে, এর পরে দ্বীন কতটা পরিবর্তিত হবে অথবা একজন মানুষ ইসলামের বাইরে গিয়ে কতটা নিঃশেষিত হবে। [ইগাসাতুল লাহফান, ২/১৪৬]

পরিচ্ছেদ: আল্লাহ সম্পর্কে না জেনেই কিছু বলা

১২৮

পর্যাপ্ত জ্ঞান ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে কিছু বলার ব্যাপারেও সতর্ক হোন, এমন কিছু বলবেন না যার ভিত্তি হবে শিরক ও কুফরী, বিদয়াত ও পাপ। পর্যাপ্ত জ্ঞান ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে কিছু বলা সকল অনৈতিক কর্মকাণ্ড, পাপ ও নীতিভ্রষ্টতার চেয়েও মারাত্মক অপরাধ।এর প্রমাণস্বরূপ আল্লাহ তা'আলা অবতীর্ণ করলেন:قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ ﴿٣٣﴾অর্থঃ বল,‘আমার রব তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজ- যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে, আর পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে তোমাদের শরীক করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর উাপরে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না’। (আল-আ'রাফ ৭:৩৩)উপরোক্ত আয়াতে চারটি বিষয়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা ভয়াবহতার ক্রমানুসারে উপস্থাপন করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: (বল) হে মুহাম্মাদ (ﷺ), আমার প্রতিপালক যেসব বিষয় নিষিদ্ধ করেছেন। সেগুলো হল- আল ফাওয়াহিশ (বড় ধরনের ভয়ঙ্কর পাপ এবং যে কোনো ধরনের অবৈধ যৌনতা), হোক না তা প্রকাশ্যে অথবা গোপনে।” এটা হল ওই চারটি বিষয়ের প্রথমটি। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা আরেকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন, যা প্রথমটির চেয়ে আরো ভয়াবহ, আল্লাহ তা'আলা বলেন: “অনৈতিক নিপীড়ন”। অতঃপর তিনি এর চেয়েও ভয়াবহ আরেকটি অপরাধের কথা উল্লেখ করেন, এবং আল্লাহ তা'আলা বলেন: “আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থাপন করা, অথচ যার জন্য তাকে কোনো ক্ষমতা বা অধিকার দান করা হয়নি।” অতঃপর আল্লাহ এর চেয়েও ভয়ঙ্কর অপরাধের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন: “আল্লাহ সম্পর্কে এমন কিছু বলা যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই”।পর্যাপ্ত জ্ঞান ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে কিছু বলা শিরক, কুফরি, বিভ্রান্তি কর বিদয়াত ও ফিতনার ভিত্তি। [ড. বকর বিন আবদুল্লাহ আবু যায়েদ, আল তা'আলুম, পৃ-১১২]না জেনে আল্লাহ সম্পর্কে কিছু বলা থেকে বিরত থাকতে এবং এর পরিণাম থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য দরকার মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন করা, মানুষ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করা, যাতে করে আপনি বলতে পারেন, অসুস্থ দাবিকারী ব্যক্তি সত্য বলছে না মিথ্যা বলছে। এছাড়াও আপনার মানসিক অসুস্থতা এবং মানব দেহের অন্ত:ক্ষরা গ্রন্থিসমূহের (পিটুইটারী, থাইরয়েড ও অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি) কার্যাবলী সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে, কারণ এসব গ্রন্থির ভারসাম্যহীনতায় আচরণগত বিশৃংখলা ও চিত্তবৈকল্য দেখা দিতে পারে, যা দেখে কেউ মনে করতে পারে যে, তাকে শয়তানে স্পর্শ করেছে। প্রকৃতপক্ষে জ্বিন বিষয়টির উপর বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে, অবশ্য এটাই উপযুক্ত।

পরিচ্ছেদ: অনভিজ্ঞদের কাছে রুকইয়াহর পরামর্শ চাওয়া

১২৯

প্রচুর সংখ্যক মানুষ যারা চিকিৎসার জন্য রক্বির শরণাপন্ন হন, তারা আসলে মানসিকভাবে অসুস্থ। কলহে লিপ্ত সব দম্পত্তি কিন্তু যাদুটোনায় আক্রান্ত নয়। জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সকল নারী ও পুরুষই জ্বিনের কবলে পড়েনি। যে ছাত্র পড়ালেখায় অবহেলা এবং সঠিক সময়ে পড়ালেখা না করার কারণে অকৃতকার্য হয়েছে, তার উপর কারো বদনজর লাগেনি। তাই এ বিষয়টিতে দরকারের চেয়ে একটু বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কেন এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হল তা জানতে ড. আলী বিন নাফী আল আলিয়ানীর বক্তব্য শুনতে হবে, তিনি বলেন: মানুষের বিরুদ্ধে শয়তানের চক্রান্ত অনেক বড়, কিন্তু সেটা একমাত্র তারা বুঝতে পারেন যাদের আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে ভালো জানাশোনা রয়েছে। লোকেরা দল বেঁধে পাঠকের কাছে যান, তার কাছে যাওয়ার জন্য পাড়ি দেন অনেক পথ, শুধুমাত্র তাকে ঘিরে সর্বত্র প্রচলিত গল্প-কাহিনীর কারণে, যেমন-বদ জ্বিনরা কিভাবে এ পাঠকের কাছে মানসিক রোগীর ঠোটে কথা বলে, এবং এ কপট শায়খরা কিভাবে জ্বিনদের কাছ থেকে। পুনরায় ফিরে না আসার ওয়াদা আদায় করে নেন। সত্যি এটাই যদি হয় বাস্তবতা এবং এরকমভাবেই ঘটতে থাকে, সত্যিকার অর্থেই এটা যদি অলৌকিক হয়ে থাকে, তাহলে পাঠককে অবশ্যই এর পরিণামের বিষয়ে ভয় পেতে হবে। [আর রুক্বা ফি দা-, আক্বীদাতু আললি সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ- ড. আলী আল-আলাইয়ানী পৃ. ৮০-৮১]আল যাহাবি (রহঃ) বলেন: তালুত থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি। ইবরাহিম বিন আদহামকে বলতে শুনেছি: যার মধ্যে বিখ্যাত হওয়ার বাসনা রয়েছে, সে কখনোই আন্তরিক হতে পারবে না। বিখ্যাত হওয়ার বাসনা রয়েছে এমন অকৃত্রিম ব্যক্তির লক্ষণ হল, সে কখনোই বুঝতে পারবে না যে, তার মধ্যে এ বাসনা আছে, তাকে যদি কেউ এ বাসনার বিষয়টি নিয়ে গালমন্দও করে, তবু সে রাগবে না অথবা নিজের প্রতিরক্ষার চেষ্টা করবে না, বরং সে এটা স্বীকার করবে এবং বলবে: যে আমার। অনুকূলে এমন কথা বলল এবং আমার খুঁত ধরিয়ে দিল, তার উপর যেন আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। আসলে তার হৃদয় আত্মতৃপ্তিতে পরিপূর্ণ নয়। এবং সে তার দোষ-ক্রটির ব্যাপারেও অসচেতন নয়, বরং সে স্বীকার করে নেবে যে, তার মধ্যে এরকম দোষ-ত্রুটি থাকতেও পারে। এটা হল ক্রনিক বা অত্যন্ত পুরাতন ও কঠিন সমস্যা।ইনশাআল্লাহ, আমাদের ইচ্ছা আছে এ বাজে চর্চা নিয়ে আলোচনা করব এবং ধর্মের মুখোশের অন্তরালে করা এসব অশোভন ও মন্দ প্রাকটিসের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করব, কারণ যাদের সামান্য পরিমাণেও সাধারণ জ্ঞান রয়েছে এবং যুক্তি নির্ভর চিন্তা করতে অভ্যস্ত, তারা সহজাতভাবেই তাদের থেকে দূরে থাকবে। তিনি যখন দেখবেন, তাদের। এ আইডিয়ার সমর্থনে শরীয়ায় কোনো প্রমাণ খুঁজে পাবেন না, তখন স্বভাবতই তিনি বিষয়টি নিয়ে ইসলামি চিন্তাবিদ ও বিদ্বান ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হবেন, যাতে করে তারা এ বিষয়টি নিয়ে যুক্তি খণ্ডনের অভিযানে নামতে পারেন।এরপর আমরা নজর দেব অর্থ লিপ্সায় পড়ে রক্বিরদের দ্বারা সংঘটিত পাপ ও অপরাধের দিকে, কারণ যারা এ ধরনের চিকিৎসার অনুশীলন করেন তারা সকলেই মানুষ, আর মানুষের ভালো ও মন্দ উভয় দিকেই ঝোঁক থাকে, তাদের মধ্যে থাকে সকল স্বাভাবিক ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, জাগতিক ভালোবাসা ও সুখ-স্বাছন্দ্যের প্রতি অসম্ভব রকমের টান, আর এ সবই থাকে তাদের মুখোশের অন্তরালে। আল্লাহ তা'আলা বলেন:زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ۗ ذَٰلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَاللَّهُ عِندَهُ حُسْنُ الْمَآبِ ﴿١٤﴾অর্থঃ মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালবাসা- নারী, সন্তানাদি, রাশি রাশি সোনা-রূপা, চি‎‎হ্নত ঘোড়া, গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের ভোগসামগ্রী। আর আল্লাহ, তাঁর নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল। (সূরা আলে ইমরান ৩:১৪)

পরিচ্ছেদ: রুকিয়াহর বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেওয়া

১৩০

কুরআন তেলাওয়াত ও যিকির সম্পন্ন করার মাধ্যমে রুকইয়া পাঠ করার বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেয়ার ব্যাপারে কোনো বিরোধিতা নেই। এ বিষয়ে কোনো মতবিরোধ নেই, বিতর্ক নেই। তবে যিনি রুকিয়ার বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেয়ার বৈধতা সংক্রান্ত হাদীসটি পাঠ করেছেন তাকে মনে রাখতে হবে, রোগীর কিছু উপকার করার মাধ্যমেই এ পারিশ্রমিকের পালা। শেষ হবে, আর রোগীর উপকার হল তার সুস্থতা।সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর সাহাবীগণ একবার এক দীর্ঘ ভ্রমণে বের হলেন, পথ চলতে চলতে এক পর্যায়ে তারা এক আরব গোত্রের বসতির কাছে তাঁবু খাটালেন। তারা সেখানে গিয়ে ওই গোত্রের কাছে আতিথেয়তা কামনা করলেন, কিন্তু তারা সাহাবাদের এ প্রস্ত বে অস্বীকৃতি জানাল। এরপরই ওই গোত্রের নেতা বিষাক্ত পতঙ্গের হুলবিদ্ধ হল, গোত্রের লোকেরা তাকে এ যন্ত্রণা থেকে নিরাময় দান করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। তখন গোত্রের কিছু লোক বলল: “তোমরা কেন ওই লোকগুলোর কাছে যাচ্ছ না, যারা কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করছে?” তাদের কাছে কিছু থাকতেও পারে। অতঃপর তারা সাহাবাদের তাঁবুতে গেল এবং বলল: “হে লোকসকল, আমাদের গোত্রের নেতা বিষাক্ত হুল বিদ্ধ হয়েছেন, আমরা তার নিরাময়ের জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। তোমাদের কাছে কি কিছু আছে?”এ কথা শুনে সাহাবাদের একজন বললেন: “আল্লাহর শপথ। আমি এ ব্যক্তির জন্য রুকিয়া পাঠ করব। কিন্তু আল্লাহর শপথ, আমরা তোমাদের কাছে আতিথেয়তার আবেদন করেছিলাম, কিন্তু তোমরা আমাদেরকে কিছুই দাওনি। তাই আমি এ লোকের জন্য রুকিয়া পাঠ করব না, যদি না তোমরা রুকিয়ার বিনিময়ে আমাদেরকে কিছু দাও। পরে তারা ভেড়ার এক পালের শর্তে রাজি হল এবং ওই সাহাবি ওই আক্রান্ত লোকটির ক্ষতস্থানে ফুঁ দিয়ে তেলাওয়াত করলেন আল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।এ আয়াত তেলাওয়াতের কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটি সুস্থ হয়ে উঠল এবং হাটতে শুরু করল, এবং তার মধ্যে অসুস্থতার লেশ মাত্র দেখা গেল না। অতঃপর গোত্রের লোকেরা তাদের ওয়াদা অনুযায়ী ভেড়ার পাল দিয়ে দিল। কিছু সাহাবি বললেন: চল আমরা এ গুলোকে ভাগ করে নেই। কিন্তু রুকিয়া পাঠকারী সাহাবি বললেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর কাছে না যাওয়ার আগে কিছুই করা যাবে না, আগে আমরা তার কাছে সব খুলে বলি এবং তিনি আমাদেরকে করণীয় নির্ধারণ না করে দেয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। অতঃপর তারা আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর কাছে গিয়ে সব খুলে বললেন। সব শুনে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন-“তুমি কিভাবে জানলে যে এটা রুকিয়া বা ঝাড়ফুঁক।” অতঃপর তিনি বললেনঃ“তোমরা সঠিক কাজই করেছ। যাও এগুলোকে ভাগ কর এবং আমার জন্যও এক ভাগ রেখ।”এ কথা বলে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) মুচকি হাসলেন। [ফাতহুল বারি, কিতাবুল তিব্ব, বাবুল রুকা বি ফাতিহাতিল কিতাব, ৭/১৭০; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল সালাম, বাব যাওয়াজ আখ আল আযরাহ আ’লা আল রুকিয়া, ৪/১৭২৮; আবু দাউদ, আল বুইয়ু, বাব ৭৩; আত-তিরমিযী আল তিব্ব।]এ হাদীসটি ইমাম বুখারীও বর্ণনা করেছেন, আর এ প্রসংগে এটিই সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ হাদীস। আরেক বর্ণনায় এসেছে, তিনি কুরআনের সারমর্ম (সূরা ফাতিহা) তেলাওয়াত করলেন, অতঃপর মুখের লালা দিয়ে ফুঁ দিলেন। এবং এতে রোগী সুস্থ হয়ে গেল। আরেক হাদীসে এসেছে: তিনি এর বিনিময়ে ত্রিশটি ভেড়া দেয়ার নির্দেশ দিলেন।সুনানে আবু দাউদে খারিযাহ বিন আল সালত থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, তিনি তার চাচা থেকে শুনেছেন, তিনি বলেন: আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর কাছে আসলাম এবং ইসলাম গ্রহণ করলাম। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে যাওয়ার সময় পথে একদল লোকের সঙ্গে দেখা হল, তাদের মধ্যে একজন ছিল উন্মাদ, তার পা শিকল দিয়ে বাঁধা।তার লোকেরা আমাকে দেখে বলল: আমরা শুনেছি এ সাহাবি ভালো কিছু নিয়ে এসেছেন; আপনার কাছে এমন কিছু কি আছে, যা দিয়ে আপনি এ উন্মাদ লোকটির চিকিৎসা করতে পারবেন? তো আমি কুরআনের ভূমিকা (সূরা ফাতিহা) তেলাওয়াত করে রুকিয়া সম্পন্ন করলাম এবং পাগল লোকটি সুস্থ হয়ে গেল। তারা আমাকে এর বিনিময়ে একশত ভেড়া দিল, আমি এগুলো নিয়ে আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) কাছে গেলাম এবং তাকে সব খুলে বললাম।আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন:“সেখানে কি এ ছাড়া অন্য কিছু ছিল?” অন্য এক সংস্করণে এসেছে: “তুমি কি এছাড়া অন্য কিছু পাঠ করেছিলে?” আমি বললাম: না। তিনি বললেন:“ঠিক আছে এগুলোকে গ্রহণ কর, কিছু লোক আছে ভুল রুকিয়া পাঠ করে অর্থ উপার্জন করে, কিন্তু তুমি সত্য ও সঠিক রুকিয়া পাঠ করেই উপার্জন করেছ।” [সুনান আবু দাউদ, কিতাবুল তিব্ব, বাবুল কাইফা আল রুকা, ৪/১২, হাদিস নং-৩৮৯৬।]ইবনে আল সুন্নির পুস্তক অনুসারে জানা যায়, এ সংক্রান্ত আরো একটি হাদীস রয়েছে, যা আবু দাউদও বর্ণনা করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, খারিযাহ থেকে বর্ণিত, তার চাচা বলেন: “আমরা একবার আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) সঙ্গে সভা শেষ করে এক আরব গোত্রের বসতিতে ফিরে এলাম। তারা বলল: “আপনাদের কাছে কি কোনো ওষুধ আছে? আমাদের গোত্রে একজন উন্মাদ রয়েছেন, যাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তারা শিকল দিয়ে বাধা উন্মাদ লোকটিকে আমার কাছে নিয়ে আসল এবং আমি কুরআনের ভূমিকা অর্থাৎ সূরা ফাতিহা তেলাওয়াত করলাম তিন দিন ধরে, সকালে ও সন্ধ্যায়, অতঃপর আমার মুখের লালা বের করে তার শরীরের উপর ফুঁ দিয়ে বুলিয়ে দিলাম। এতে ওই লোকটি সুস্থ হয়ে উঠল। তারা আমাকে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিকের প্রস্তাব করলে আমি না বললাম। তখন তারা বলল: এ বিষয়ে আপনি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) জিজ্ঞেস করুন। আমি আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন:“ঠিক আছে এগুলোকে খাও, কিছু লোক আছে ভুল রুকিয়া পাঠ করে অর্থ উপার্জন করে, কিন্তু তুমি সত্য ও সঠিক রুকিয়া পাঠ করেই উপার্জন করেছ।” [ইবনুস সুন্নী, বাব মায়্যাকরা ‘আলা মাই ইউরিদ ফী আকলিহি পৃ. ১২৭, নোট-২ নং ৬২৪, সুনান আবূ দাউদ, কিতাবুত তিব্ব, বাব কায়ফা আর-রুকইয়াহ, ৩৮৯৭]যারা এ হাদীসগুলো অধ্যয়ন করবেন তারা লক্ষ্য করবেন যে, “অসুস্থ লোকটি তার রোগ থেকে দ্রুত সুস্থ হয়ে গেল এবং হাঁটতে শুরু করল এবং তার মধ্যে আর কোনো সমস্যা রইল না।” “লোকটি নিরাময় লাভ করল” এবং “সে লাফ দিয়ে উঠল (এবং সুস্থ হয়ে গেল)”। কিছু লোক ডাক্তারের মতো চেম্বার খুলে বসেছেন: যারা ফি নেয়ার জন্য ফাইল খোলেন, ফি’র বিনিময়ে পানির বোতলে থুথু ছিটান, ফি’র বিনিময়ে ফলো-আপ চিকিৎসা। করেন। অসুস্থ লোকটিকে হয়ত এর জন্য দশবার ফিরে আসতে হয়, হয়ত তিনি অনেক দূর থেকে আসেন, আর আসা যাওয়ার কারণে তাকে অনেক জটিলতায় পড়তে হয়, কিন্তু এতসব করার পরও অবশেষে তিনি কোনো নিরাময় লাভ করেন না। এ ধরনের লোকদের মাঝে ও উপরে বর্ণিত চিকিৎসা পদ্ধতির মাঝে আপনি কেমন করে তুলনা করবেন। তাদের মধ্যে। অনেকেই কুরআনিক এ চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে মানুষের চিকিৎসা করে লাভজনক ব্যবসা খুলে বসেছেন।তাই এ চিকিৎসা পদ্ধতির রক্বিরদের অবশ্যই অর্থ, ঔদ্ধত্য ও আত্ম-গৌরবের ক্ষেত্রে শয়তানের ফাঁদ ও ফন্দির বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।

পরিচ্ছেদ: রক্বির কিছু ভূল

১৩১

এছাড়া কিছু রক্বির আবার জ্বিন দ্বারা আক্রান্ত রোগীর লক্ষণ জিজ্ঞেস করার মাধ্যমে আরেক ধরনের ভুল করেন। এটা মারাত্মক এক ভুল। শাইখ আবদুল আযীয বিন বাযকে (রহঃ) একবার জিজ্ঞেস করা হল:প্রশ্ন: কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অসুস্থ লোকদের চিকিৎসা করেন এমন একজন শায়খের একটি নেকড়ে ছিল, শায়খের বক্তব্য মতে, নেকড়েটি জ্বিনদের খেত। তার ছোট এক মেয়ে ছিল জ্বিন দ্বারা আক্রান্ত।সেই মেয়েটি তাকে বলতে পারত, জ্বিন কোথায় অবস্থান করছে। ওই শায়খ যা করতেন তা কি জায়েয?উত্তর: এ উদ্দেশ্যে নিজের কাছে কোনো নেকড়ে রাখা বা পালন করা বৈধ নয়। এটা এক ধরনের শয়তানি ও মন্দ কাজ। আর জ্বিন দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিকে মানুষের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাও অনুমোদিত নয়। এটা অনেকটা ভবিষ্যতবক্তা ও জ্যোতিষীকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করারই মতো। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“যে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ বক্তা ও গণকের কাছে যায় এবং সে যা বলে তা বিশ্বাস করে, সে এর মাধ্যমে মুহাম্মাদের (ﷺ) কাছে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তার প্রতি অবিশ্বাস স্থাপন করে।”ভবিষ্যৎ বক্তা ও গণকদের জ্বিন বন্ধু থাকে, এ জ্বিনরা তাদেরকে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বলে দেয়। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এটা প্রত্যাখ্যান করেছেন, বাতিল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং কোনো জ্বিনকে অজানা বিষয় বলে দেয়ার জন্য আটকে রাখা অথবা কোনো নেকড়েকে জ্বিন খাওয়ার জন্য পালন করা অনুমোদিত নয়, বরং রক্বির যদি পারেন তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য কুরআন তেলাওয়াত করবেন।নেকড়ে রাখা অথবা জ্বিন দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিকে লক্ষণ জিজ্ঞেস করা বৈধ নয়, কারণ এগুলো হল জাদুকর ও গণকদের কাজ। আক্রান্ত ব্যক্তির শুধু চিকিৎসা করা যাবে এবং তার দেহে অবস্থান নেয়া জ্বিন বিতাড়িত করতে হবে, আর জ্বিন তাড়ানোর ক্ষেত্রে জ্বিনদের মধ্যে যদি কোনো ভালো গুণ থাকে, তাহলে তাদেরকে বলতে হবে তারা ভুল করছে। [শায়খ আবদুল আযীয বিন বায (রহ.) থেকে গৃহীত ফাতওয়া]হযরত রাযি (রাঃ) তার ছাত্রকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তার মাধ্যমেই আমরা উপসংহার টানতে পারি, এ উপদেশমালা তিনি তার আখলাকুল তাবিব (চিকিৎসকের দৃষ্টিভঙ্গি) নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন:জেনে রাখ, হে আমার বৎস, একজন চিকিৎসককে মানুষের প্রতি দয়ালু হতে হবে, তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের নেতিবাচক কিছু উল্লেখ করা এবং তাদের একান্ত বিষয়গুলো গোপন করা যাবে না, কারণ কিছু মানুষের এমন কোনো ব্যক্তিগত রোগ থাকতে পারে যা তার অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যেমন-তার পিতা বা মাতা অথবা ছেলের কাছেও গোপন করেছে, কিন্তু এ রোগের কথাই সে প্রয়োজনের তাগিদে ডাক্তারের কাছে খুলে বলে। ডাক্তার যদি কোনো নারী অথবা তরুণী বা বালকের চিকিৎসা করেন, তাহলে তাকে অবশ্যই তার দৃষ্টি নিম্নগামী করতে হবে, এবং শরীরের যে অংশে সমস্যা তা ব্যতীত অন্য কোনো দিকে দৃষ্টি দেয়া যাবে না। ওয়াইজ গ্যালেন তার ছাত্রদেরকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, অবশ্য তিনি সত্যই বলেছেন: ডাক্তারকে অবশ্যই তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি একনিষ্ঠ হতে হবে, তার দৃষ্টি সংযত রাখতে হবে এবং নারীর সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বিরত থাকতে হবে। তাকে অবশ্যই রোগীর দেহের যে কোনো অংশ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং তিনি যদি তার চিকিৎসা করতে চান তাহলে তার দৃষ্টি নিম্নগামী রাখতে হবে, শুধু যেখানে সমস্যা সেখানেই দৃষ্টি দিতে হবে, দেহের বাকি অংশে দৃষ্টি ঘোরানো যাবে না।এছাড়া তিনি চিকিৎসকদেরকে আত্ম-গৌরবে নিমজ্জিত হতে নিষেধ করেছেন। আমি অনেক মেডিক্যাল ছাত্রকে দেখেছি, তারা যদি কোনো রোগীর চিকিৎসা করেন এবং সেই রোগী যদি নিরাময় লাভ করেন, তাহলে আত্ম-গৌরবে উদ্বেলিত হয়ে উঠেন এবং অহঙ্কারী মানুষের মতো কথা বলতে শুরু করেন। আর সত্যি যদি ঘটনা এরকম হয়, তাহলে তারা কখনোই সফল হতে পারবে না এবং সঠিক নির্দেশনাও পাবেন না, সুতরাং তাদেরকে বিনয়ী ও নম্র হওয়ার পরামর্শ দিতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, এ পেশায় কিছু এটিকেট ও সৌন্দর্য রয়েছে, কিছু মৌলিক জ্ঞানও থাকা দরকার এ পেশায়, কিন্তু ডাক্তারকে হতে হবে নিরহঙ্কার, তার থাকতে হবে সুন্দর বাচনভঙ্গী, কথায় হতে হবে ভদ্র ও শান্ত, রোগীর প্রতি হতে হবে দয়ালু এবং রোগীদের সঙ্গে কর্কশ ব্যবহার পরিহার করতে হবে। এগুলো করতে পারলেই ওই ডাক্তার সফল হতে পারবেন এবং সঠিক পথের দিশা পাবেন। এছাড়াও তিনি ডাক্তারদেরকে দরিদ্র লোকদেরও চিকিৎসা করার পরামর্শ দিয়েছেন, তিনি বলেন: ডাক্তারকে ধনী লোকদের পাশাপাশি গরীবেরও চিকিৎসা করতে হবে। [ড. আহমেদ ত্ব-হা, আত তিব্ব আল ইসলামী, পৃ-১০৫।]

সেটিংস

বর্তমান ভাষা