পরিচ্ছেদ: রুকিয়াহর বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেওয়া

১৩০

কুরআন তেলাওয়াত ও যিকির সম্পন্ন করার মাধ্যমে রুকইয়া পাঠ করার বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেয়ার ব্যাপারে কোনো বিরোধিতা নেই। এ বিষয়ে কোনো মতবিরোধ নেই, বিতর্ক নেই। তবে যিনি রুকিয়ার বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেয়ার বৈধতা সংক্রান্ত হাদীসটি পাঠ করেছেন তাকে মনে রাখতে হবে, রোগীর কিছু উপকার করার মাধ্যমেই এ পারিশ্রমিকের পালা। শেষ হবে, আর রোগীর উপকার হল তার সুস্থতা।সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর সাহাবীগণ একবার এক দীর্ঘ ভ্রমণে বের হলেন, পথ চলতে চলতে এক পর্যায়ে তারা এক আরব গোত্রের বসতির কাছে তাঁবু খাটালেন। তারা সেখানে গিয়ে ওই গোত্রের কাছে আতিথেয়তা কামনা করলেন, কিন্তু তারা সাহাবাদের এ প্রস্ত বে অস্বীকৃতি জানাল। এরপরই ওই গোত্রের নেতা বিষাক্ত পতঙ্গের হুলবিদ্ধ হল, গোত্রের লোকেরা তাকে এ যন্ত্রণা থেকে নিরাময় দান করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। তখন গোত্রের কিছু লোক বলল: “তোমরা কেন ওই লোকগুলোর কাছে যাচ্ছ না, যারা কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করছে?” তাদের কাছে কিছু থাকতেও পারে। অতঃপর তারা সাহাবাদের তাঁবুতে গেল এবং বলল: “হে লোকসকল, আমাদের গোত্রের নেতা বিষাক্ত হুল বিদ্ধ হয়েছেন, আমরা তার নিরাময়ের জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। তোমাদের কাছে কি কিছু আছে?”এ কথা শুনে সাহাবাদের একজন বললেন: “আল্লাহর শপথ। আমি এ ব্যক্তির জন্য রুকিয়া পাঠ করব। কিন্তু আল্লাহর শপথ, আমরা তোমাদের কাছে আতিথেয়তার আবেদন করেছিলাম, কিন্তু তোমরা আমাদেরকে কিছুই দাওনি। তাই আমি এ লোকের জন্য রুকিয়া পাঠ করব না, যদি না তোমরা রুকিয়ার বিনিময়ে আমাদেরকে কিছু দাও। পরে তারা ভেড়ার এক পালের শর্তে রাজি হল এবং ওই সাহাবি ওই আক্রান্ত লোকটির ক্ষতস্থানে ফুঁ দিয়ে তেলাওয়াত করলেন আল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।এ আয়াত তেলাওয়াতের কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটি সুস্থ হয়ে উঠল এবং হাটতে শুরু করল, এবং তার মধ্যে অসুস্থতার লেশ মাত্র দেখা গেল না। অতঃপর গোত্রের লোকেরা তাদের ওয়াদা অনুযায়ী ভেড়ার পাল দিয়ে দিল। কিছু সাহাবি বললেন: চল আমরা এ গুলোকে ভাগ করে নেই। কিন্তু রুকিয়া পাঠকারী সাহাবি বললেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর কাছে না যাওয়ার আগে কিছুই করা যাবে না, আগে আমরা তার কাছে সব খুলে বলি এবং তিনি আমাদেরকে করণীয় নির্ধারণ না করে দেয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। অতঃপর তারা আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর কাছে গিয়ে সব খুলে বললেন। সব শুনে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন-“তুমি কিভাবে জানলে যে এটা রুকিয়া বা ঝাড়ফুঁক।” অতঃপর তিনি বললেনঃ“তোমরা সঠিক কাজই করেছ। যাও এগুলোকে ভাগ কর এবং আমার জন্যও এক ভাগ রেখ।”এ কথা বলে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) মুচকি হাসলেন। [ফাতহুল বারি, কিতাবুল তিব্ব, বাবুল রুকা বি ফাতিহাতিল কিতাব, ৭/১৭০; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল সালাম, বাব যাওয়াজ আখ আল আযরাহ আ’লা আল রুকিয়া, ৪/১৭২৮; আবু দাউদ, আল বুইয়ু, বাব ৭৩; আত-তিরমিযী আল তিব্ব।]এ হাদীসটি ইমাম বুখারীও বর্ণনা করেছেন, আর এ প্রসংগে এটিই সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ হাদীস। আরেক বর্ণনায় এসেছে, তিনি কুরআনের সারমর্ম (সূরা ফাতিহা) তেলাওয়াত করলেন, অতঃপর মুখের লালা দিয়ে ফুঁ দিলেন। এবং এতে রোগী সুস্থ হয়ে গেল। আরেক হাদীসে এসেছে: তিনি এর বিনিময়ে ত্রিশটি ভেড়া দেয়ার নির্দেশ দিলেন।সুনানে আবু দাউদে খারিযাহ বিন আল সালত থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, তিনি তার চাচা থেকে শুনেছেন, তিনি বলেন: আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর কাছে আসলাম এবং ইসলাম গ্রহণ করলাম। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে যাওয়ার সময় পথে একদল লোকের সঙ্গে দেখা হল, তাদের মধ্যে একজন ছিল উন্মাদ, তার পা শিকল দিয়ে বাঁধা।তার লোকেরা আমাকে দেখে বলল: আমরা শুনেছি এ সাহাবি ভালো কিছু নিয়ে এসেছেন; আপনার কাছে এমন কিছু কি আছে, যা দিয়ে আপনি এ উন্মাদ লোকটির চিকিৎসা করতে পারবেন? তো আমি কুরআনের ভূমিকা (সূরা ফাতিহা) তেলাওয়াত করে রুকিয়া সম্পন্ন করলাম এবং পাগল লোকটি সুস্থ হয়ে গেল। তারা আমাকে এর বিনিময়ে একশত ভেড়া দিল, আমি এগুলো নিয়ে আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) কাছে গেলাম এবং তাকে সব খুলে বললাম।আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন:“সেখানে কি এ ছাড়া অন্য কিছু ছিল?” অন্য এক সংস্করণে এসেছে: “তুমি কি এছাড়া অন্য কিছু পাঠ করেছিলে?” আমি বললাম: না। তিনি বললেন:“ঠিক আছে এগুলোকে গ্রহণ কর, কিছু লোক আছে ভুল রুকিয়া পাঠ করে অর্থ উপার্জন করে, কিন্তু তুমি সত্য ও সঠিক রুকিয়া পাঠ করেই উপার্জন করেছ।” [সুনান আবু দাউদ, কিতাবুল তিব্ব, বাবুল কাইফা আল রুকা, ৪/১২, হাদিস নং-৩৮৯৬।]ইবনে আল সুন্নির পুস্তক অনুসারে জানা যায়, এ সংক্রান্ত আরো একটি হাদীস রয়েছে, যা আবু দাউদও বর্ণনা করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, খারিযাহ থেকে বর্ণিত, তার চাচা বলেন: “আমরা একবার আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) সঙ্গে সভা শেষ করে এক আরব গোত্রের বসতিতে ফিরে এলাম। তারা বলল: “আপনাদের কাছে কি কোনো ওষুধ আছে? আমাদের গোত্রে একজন উন্মাদ রয়েছেন, যাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তারা শিকল দিয়ে বাধা উন্মাদ লোকটিকে আমার কাছে নিয়ে আসল এবং আমি কুরআনের ভূমিকা অর্থাৎ সূরা ফাতিহা তেলাওয়াত করলাম তিন দিন ধরে, সকালে ও সন্ধ্যায়, অতঃপর আমার মুখের লালা বের করে তার শরীরের উপর ফুঁ দিয়ে বুলিয়ে দিলাম। এতে ওই লোকটি সুস্থ হয়ে উঠল। তারা আমাকে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিকের প্রস্তাব করলে আমি না বললাম। তখন তারা বলল: এ বিষয়ে আপনি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) জিজ্ঞেস করুন। আমি আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন:“ঠিক আছে এগুলোকে খাও, কিছু লোক আছে ভুল রুকিয়া পাঠ করে অর্থ উপার্জন করে, কিন্তু তুমি সত্য ও সঠিক রুকিয়া পাঠ করেই উপার্জন করেছ।” [ইবনুস সুন্নী, বাব মায়্যাকরা ‘আলা মাই ইউরিদ ফী আকলিহি পৃ. ১২৭, নোট-২ নং ৬২৪, সুনান আবূ দাউদ, কিতাবুত তিব্ব, বাব কায়ফা আর-রুকইয়াহ, ৩৮৯৭]যারা এ হাদীসগুলো অধ্যয়ন করবেন তারা লক্ষ্য করবেন যে, “অসুস্থ লোকটি তার রোগ থেকে দ্রুত সুস্থ হয়ে গেল এবং হাঁটতে শুরু করল এবং তার মধ্যে আর কোনো সমস্যা রইল না।” “লোকটি নিরাময় লাভ করল” এবং “সে লাফ দিয়ে উঠল (এবং সুস্থ হয়ে গেল)”। কিছু লোক ডাক্তারের মতো চেম্বার খুলে বসেছেন: যারা ফি নেয়ার জন্য ফাইল খোলেন, ফি’র বিনিময়ে পানির বোতলে থুথু ছিটান, ফি’র বিনিময়ে ফলো-আপ চিকিৎসা। করেন। অসুস্থ লোকটিকে হয়ত এর জন্য দশবার ফিরে আসতে হয়, হয়ত তিনি অনেক দূর থেকে আসেন, আর আসা যাওয়ার কারণে তাকে অনেক জটিলতায় পড়তে হয়, কিন্তু এতসব করার পরও অবশেষে তিনি কোনো নিরাময় লাভ করেন না। এ ধরনের লোকদের মাঝে ও উপরে বর্ণিত চিকিৎসা পদ্ধতির মাঝে আপনি কেমন করে তুলনা করবেন। তাদের মধ্যে। অনেকেই কুরআনিক এ চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে মানুষের চিকিৎসা করে লাভজনক ব্যবসা খুলে বসেছেন।তাই এ চিকিৎসা পদ্ধতির রক্বিরদের অবশ্যই অর্থ, ঔদ্ধত্য ও আত্ম-গৌরবের ক্ষেত্রে শয়তানের ফাঁদ ও ফন্দির বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।

সেটিংস

বর্তমান ভাষা