পরিচ্ছেদ: সালাফদের পথ আঁকড়ে ধরা ও বিদ'আত বিসর্জন
১২৭
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত এর একটি অন্যতম প্রশংসনীয় গুণ হলো-কুরআন ও সুন্নাহ, এ উম্মাহর সালাফিদের নির্দেশিত পথে তাদের অটল থাকা। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন: আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত এর লোকেরা যেসব কাজ সাহাবা (রাঃ) থেকে প্রমাণিত নয় সেগুলোকে বিদয়াত হিসেবে গণ্য করেন, তাদের যুক্তি হল, এ কাজগুলো যদি ভালোই হত, তাহলে আমাদের আগেই সাহাবারা এ কাজগুলো করতেন। কারণ তারা ভালোর কোনো বৈশিষ্ট্য তো ছাড়তেনই না, বরং এগুলো করার জন্য তারা তাড়াহুড়ো করতেন। [ইবনে কাসীর, তাফসীরুল কুরআন, ৪/১৬৮]সে জন্যই এ উম্মাহর মধ্যে সালাফিগণ রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ-তে নতুন কোনো কিছু সংযোজন ও প্রবর্তনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বর্ণিত আছে, আবুদ দারদা (রাঃ) যখন সুন্নাহর মধ্যে নতুন কিছু প্রবর্তন খেয়াল করলেন, যেগুলো এখনো বিদয়াতের পর্যায়ে পৌঁছায়নি, তিনি বললেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যদি তোমাদের মাঝে উপস্থিত থাকতেন তাহলে তিনি ও তাঁর সাহাবাগণ যেসব কাজ করেছেন তার মধ্যে থেকে সালাত ব্যতীত তোমাদের আর কোনোটিরই স্বীকৃতি দিতেন না। আল আওযায়ী (রহ) বলেন: তিনি যদি আজ উপস্থিত থাকতেন? ঈসা বিন ইউনুস (রহ) বলেন: আল আওযায়ী (রহ) যদি আজ আমাদের মাঝে থাকতেন তাহলেই বা কী হত?আরো বর্ণিত আছে, উম্মে দারদা (রাঃ) বলেন: এরপর আবুদ দারদা (রাঃ) রাগান্বিত হয়ে গেলেন এবং আমি বললামঃ কী কারণে আপনি রাগান্বিত হলেন? তিনি বললেন: আল্লাহর শপথ, জামায়াতে সালাত আদায় করা ব্যতিত মহানবী (ﷺ) সম্পর্কিত তাদের আর কোনো বিষয়েরই আমি স্বীকৃতি দেব না।সাহল বিন মালিক (রহ) থেকে বর্ণিত, তার পিতা বলেন: সাহাবারা যেসব কাজ করতেন তার মধ্য থেকে সালাত ব্যতীত তাদের আর কোনোটিকেই আমি স্বীকৃতি দেব না।মাইমুন বিন মিহরান (রহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সালাফিদের মধ্যে কাউকে যদি তোমাদের মাঝে নিয়ে আসা হত, তাহলে তারা কিবলাহ। ব্যতিত তোমাদের আর কোনো কিছুই মেনে নিতেন না।আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি তোমাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে তোমরা যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বল এটা ব্যতীত আর কোনো কিছুই স্বীকৃতি দেব না, যেগুলোর সঙ্গে আমি রাসূল (ﷺ)-এর যুগে পরিচিত ছিলাম। আমরা বললাম: কেন হে আবু হামজা? তিনি বললেন: তোমরা সালাতকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিলম্বিত কর, আল্লাহর রাসুল (ﷺ) কি এভাবে সালাত আদায় করতেন?হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: প্রাথমিক যুগের। কোনো মানুষকে যদি বর্তমান যুগে ফিরিয়ে আনা হত, তাহলে তিনি। ইসলামের কোনো কিছুইকেই স্বীকৃতি দিতেন না। এবং তিনি আমার উরুর উপর আঙ্গুল নির্দেশ করে বললেন: “শুধু এ সালাত ব্যতীত।”অতঃপর তিনি বলেন: আল্লাহর শপথ, এমন এক ব্যক্তি যিনি সালাফিদের যুগে জন্মলাভ করেননি, তিনি যদি দেখেন বিদ’আত কারীরা তাদের প্রবর্তনের মাত্রা বাড়িয়েই চলছেন এবং তারা এ জাগতিক কাজের জন্য নিজের সব সময় ব্যয় করছেন এবং অন্যদেরকেও তার সঙ্গে এ পথে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন, কিন্তু আল্লাহ তাকে এ পথ থেকে রক্ষা করেছেন এবং সত্য পথের অনুসারী সালাফিদের জন্য তার হৃদয়কে দীর্ঘ। করে দিয়েছেন, তাই তিনি সালাফিদের অনুসৃত পথ সম্পর্কে আরো জানার চেষ্টা করেন এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন, তাহলে তাকে আল্লাহ তা'আলা উত্তম প্রতিদান দেবেন। সুতরাং এ ব্যক্তির মতো হওয়ার চেষ্টা করব আমরা, ইনশাআল্লাহ।” [আল শাতিবী, আল-মুতাওয়াফফাকাত, ১/১৪]বেশ কিছু সনদে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু রেখে যাইনি যা তোমাদেরকে আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে আসবে বা ঘনিষ্ঠ করে তুলবে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে সরিয়ে নেবে, আমি তোমাদেরকে এর সবকিছুর নির্দেশ দিয়েছি। একইভাবে, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু রেখে যাইনি যা তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুনের কাছাকাছি নিয়ে যাবে এবং আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে, আমি এর সবকিছু তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ করেছি।”সুতরাং ইসলামী শরীয়াহ্র নিয়ম-কানুনে কোনো ধরনের বিদ’আত ও সংযোজন-বিয়োজন করার কোনো সুযোগ কারো নেই, যতই ছোট আর অগুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন এ সংযোজন অথবা বিয়োজন। বর্ণিত আছে যে, মদীনার ইমাম ইমাম মালিক (রহঃ) যারা এ উম্মার প্রাথমিক পর্যায়ের প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাত এমন কোনো বিদ’আত করেছেন তাদেরকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন:“যে ব্যক্তি ইসলামে কোনো বিধান সংযোজন করবেন, বিদ’আত করবেন, হোক না তা ভালো মনে করেই, তার এ কাজ হবে এ দাবি করার শামিল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তার আনিত বার্তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আপনার যদি ইচ্ছা হয় তাহলে তেলাওয়াত করুন,অর্থঃ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে। (আল-মায়িদা ৫:৩)ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন: এ উম্মাহর সর্বশেষ প্রজন্ম তাদের পূর্বপুরুষ বা প্রাথমিক পর্যায়ের প্রজন্ম যে নির্দেশনা দিয়ে সঠিক পথের অনুসারী হয়েছিলেন, তা ব্যতীত অন্য কোনো নির্দেশনা দিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারবে না, সঠিক পথের দিশা লাভ করতে পারবে না। যা কখনোই ধর্মের অংশ ছিল না, তা এখনো ধর্মের অংশ হতে পারে না।এটা সর্বজন বিদিত যে, যেসব কাজ মূলত শরীয়াহ অনুসারে অনুমোদিত, সেগুলোকেও অননুমোদিত করা যেতে পারে, যদি কাজগুলোকে বিদয়াতি কায়দায় প্রবর্তন করা হয়ে থাকে। বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) এক মহিলার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলেন, ওই মহিলা তাসবীহ জপছেন, তিনি তাসবীহদানা ভেঙে দুরে ছুড়ে মারলেন। এরপর তার সঙ্গে আরেক পুরুষের দেখা হল, সেই পুরুষটি কংকরদানা দিয়ে তাসবীহ জপছিলেন, এটা দেখে ইবনে মাসউদ (রাঃ) পা দিয়ে কংকরদানাগুলোতে লাথি মারলেন এবং বললেন: “তুমি দ্বীনের মধ্যে বিদ’আত করছ। অথবা তুমি কি মনে কর আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর সাহাবাদের থেকেও তোমার বেশি জ্ঞান রয়েছে? [ইবনে ওয়াদ্দাহ, আল বিদা, পৃ-৮]সুতরাং দ্বীনের মধ্যে নব্য প্রবর্তনের অথবা দুর্বল মতামত ও প্রমাণের উপর নির্ভর করার ব্যাপারে সতর্ক হোন। ভিন্ন মতামত দুর্বল প্রমাণের উপর ভিত্তি করে হতে পারে, এটা কিছু মুজতাহিদের একটি বড় ভুল। এ ভ্রান্ত ও কলুষিত আইডিয়া, যা অনেক অজ্ঞ লোক গ্রহণও করেন, মানুষকে আল্লাহর দ্বীন পরিবর্তন, শয়তানের আনুগত্য করা এবং সারা বিশ্বজাহানের মালিকের অবাধ্য হওয়ার পথে পরিচালিত করে। যদি মিথ্যার সঙ্গে ভ্রান্ত আইডিয়া যুক্ত করা হয়, আর কারো শক্তিশালী বাতিক ও অভিলাষ দ্বারা যদি সেই আইডিয়া সমর্থিত হয়, তাহলে আর জিজ্ঞেস করবেন না যে, এর পরে দ্বীন কতটা পরিবর্তিত হবে অথবা একজন মানুষ ইসলামের বাইরে গিয়ে কতটা নিঃশেষিত হবে। [ইগাসাতুল লাহফান, ২/১৪৬]