অধ্যায়: ওয়াসওয়াসা রোগ
পরিচ্ছেদ: ভূমিকা
১৬৭
অনেক রোগীই বেশি বেশি কুমন্ত্রণার শিকার বলে অভিযোগ করেন যা আরবীতে ওয়াসওয়াসা রোগ নামে পরিচিত। এটি সরাসরি কারোও কণ্ঠ শুনা কিংবা কুচিন্তার রূপ নিতে পারে। এই চিন্তাভাবনাগুলি বেশিরভাগই নিন্দামূলক এবং রোগীর পক্ষে চরম বিরক্তিকর হতে পারে, এমনকি এতবেশি পরিমাণে কুমন্ত্রণার শিকার হতে পারে যে রোগীর ঈমান সংশয়ে পড়ে যেতে পারে।যদিও রুকিয়া চিকিত্সার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, এখনও আরও কিছু কাজ করা যেতে পারে। আল্লাহর রহমতে ও তাঁর বরকতে, নিম্নলিখিত এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে কুমন্ত্রণার চিন্তাগুলো প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে চলে যায় এবং আল্লাহর রহমতে রোগী পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।
পরিচ্ছেদ: চিন্তাভাবনাগুলো শয়তান থেকে আসে
১৬৮
কুমন্ত্রণার চিন্তাভাবনাগুলোর উৎস শয়তান - সর্বপ্রথম এই কথাটি অনুধাবন করুন। একথা ভাবেন না যে আপনিই এর জন্য দায়ী। এর প্রমাণ হ'ল নবী (ﷺ) বক্তব্য:"আমার উম্মতের মনে যা উদয় হয় বা খটকা লাগে এবং তাদের মন যে কথা বলে আল্লাহ্ তা’আলা তা ক্ষমা করে দেবেন, যতক্ষন না সে তা করে অথবা তা বলে।" [সুনান নাসাঈঃ ৩৪৩৪]
পরিচ্ছেদ: এ জাতীয় কুমন্ত্রণার এমনকি কিছু সাহাবীদেরকেও জর্জরিত করেছে
১৬৯
অনুধাবন করুন যে এ জাতীয় চিন্তাভাবনা নবীজির সাহাবীদেরকে-ও কেউ কেউ জর্জরিত করেছে।আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) এর কতিপয় সাহাবী তাঁর সমীপে এসে বললেন, আমাদের অন্তরে এমন কিছু সংশয়ের উদয় হয়, যা আমাদের কেউ মুখে উচ্চারণ করতেও মারাত্মক মনে করে। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) উত্তরে বললেনঃ সত্যই তোমাদের তা হয়? তারা জবাব দিলেন, জ্বী, হ্যাঁ। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ এটিই স্পষ্ট ঈমান। (কারণ ঈমান আছে বলেই সে সম্পর্কে ওয়াসওয়াসা ও সংশয়কে মারাত্মক মনে করা হয়।) (সহিহ মুসলিমঃ ২৪০)ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (ﷺ)-এর নিকট এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কারো মনের মধ্যে এমন কিছু উদয় হয় যা মুখে ব্যাক্ত করার চেয়ে সে জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়াকে উত্তম মরে করে। তিনি (ﷺ) বললেনঃ আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা যিনি শয়তানের এ ধোঁকাকে কল্পনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছেন। (সহিহ,আবু দাঊদঃ ৫১১২)
পরিচ্ছেদ: কুমন্ত্রণা পরিপূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করা
১৭০
রোগীকে অবশ্যই এই কুমন্ত্রণাগুলোকে অবিরামভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং প্রতিবার-ই এটি করা গুরুত্বপূর্ণ।যখন কুমন্ত্রণা উপস্থিত হয়, নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো পালন করুনঃ১. আল্লাহু আকবার বা সুবহানআল্লাহ বলে আল্লাহর মাহাত্ম্য ও তাঁর পবিত্রতার কথা স্মরণ করুন।২. আউযু বিল্লাহী মিনাশ-শায়তানির-রাজিম বা এরকম কিছু বলে শয়তানের কাছ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করুন:أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيـمِউচ্চারণঃ আউযু বিল্লা-হি মিনাশ-শাইত্বানির-রা-জিম।অর্থঃ বিতাড়িত শয়তান থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি। [মুসলিমঃ ২২০৩]৩. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আপনার বিশ্বাসের প্রমাণস্বরূপ বলে উঠুনঃآمَنْتُ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِউচ্চারণঃ আমানতু বিল্লা-হি ওয়া রাসুলিহিঅর্থঃ: আমি আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনলাম। [মুসলিমঃ ১৩৪]هُوَ الْأوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌউচ্চারণঃ হুওয়াল-আওওয়ালু ওয়াল-আখিরু ওয়ায-যাহিরু ওয়াল-বাতিনু, ওয়া হুয়া বিকুল্লি শাই-ইন 'আলিম।অর্থঃ: তিনিই প্রথম ও শেষ; প্রকাশ্য (উপরে) ও গোপন (নিকটে) আর তিনি সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত। [আবু দাউদঃ ৫১১০]৪. আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, আস্তাগাফিরুল্লাহ বা এরকম কিছু বলে:أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الْعَظِيمَ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيهِউচ্চারণঃ আসতাগফিরুল্লা-হাল 'আযীমাল্ লাযী লা- ইলা-হা ইল্লা-হুআল ‘হাইউল ক্বাইউমু ওয়া আতূবু ইলাইহিঅর্থঃ মহান আল্লাহ তাআলার নিকট আমি ক্ষমা চাই যিনি ছাড়া কোন মাবূদ নেই, যিনি চিরজীবি, চিরস্থায়ী এবং আমি তাঁর কাছে তাওবাহ করি। [আবু দাউদ: ১৫১৭, আত-তিরমিযী: ৩৫৭৭]اَللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ (لَكَ) بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَউচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা, আনতা রাব্বী, লা- ইলা-হা ইল্লা- আনতা, খালাক্বতানী, ওয়াআনা ‘আবদুকা, ওয়াআনা ‘আলা- ‘আহদিকা ওয়াওয়া‘অ্দিকা মাস তাত্বা‘অ্তু। আ‘ঊযু বিকা মিন শাররি মা- সনা’তু, আবূউ লাকা বিনি‘মাতিকা ‘আলাইয়্যা, ওয়াআবূউ (লাকা) বিযামবি। ফাগ্ফিরলী, ফাইন্নাহু লা- ইয়াগফিরুয যুনূবা ইল্লা- আনতা।অর্থঃ হে আল্লাহ্, আপনি আমার প্রভু, আপনি ছাড়া কোনো প্রকৃত মাবুদ নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমি আপনার বান্দা। আমি আপনার অঙ্গিকার ও প্রতিজ্ঞার উপরে রয়েছি যতটুকু পেরেছি। আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমি যে কাজ করেছি তার অকল্যাণ থেকে। আমি আপনার কাছে প্রত্যাবর্তন করছি আপনি আমাকে যত নিয়ামত দান করেছেন তা-সহ এবং আমি আপনার কাছে প্রত্যাবর্তন করছি আমার পাপ-সহ। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন, কারণ আপনি ছাড়া কেউ পাপ ক্ষমা করতে পারে না। [বুখারী, মুসলিম প্রমুখ]এই যিকরটি হচ্ছে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার জন্য সর্বোত্তম যিকর। যে ব্যাক্তি দিনের (সকাল) বেলায় দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এ ইস্তিগফার পড়বে আর সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সে মারা যাবে, সে জান্নাতী হবে। আর যে ব্যাক্তি রাতের (প্রথম) বেলায় দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এ দু’আ পড়ে নেবে আর সে ভোর হওয়ার আগেই মারা যাবে সে জান্নাতী হবে।
পরিচ্ছেদ: অন্যান্য উপায়
১৭১
শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করুন। ঘরে সুরা বাকারাহ তিলাওয়াত করে এবং জ্বিন/শয়তানকে আকর্ষণ করে এমন সমস্ত কিছু, যেমন টিভি, মিউজিক, টানানো ছবি এবং শরিয়াহ বিরোধী ফটোগুলো সরিয়ে ফেলার মাধ্যমে জ্বিন/শয়তান থেকে সুরক্ষিত করা যায়। এছাড়াও নিজের সুরক্ষার জন্য সকাল সন্ধ্যার যিকিরগুলো পালন করা উচিত।যদিও অন্তরের কুমন্ত্রণা গুলো পাপের কারণ না তবুও আল্লাহর কাছে এর জন্য ক্ষমা চাওয়া একটি উত্তম অভ্যাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। সাহাবীগণের থেকে বেশ কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে এমন কিছুর জন্য তারা ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন যেটা আসলে পাপ হবে কিনা তা সন্দেহপূর্ণ ছিল। যদিও তারা আসলে কোন প্রকারের গুনাহের কাজ করেনি। এছাড়াও বেশি বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এমন একটি অভ্যাস যা কিনা আপনার থেকে শয়তান কে তাড়িয়ে দেবে এবং আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে। যখন আপনি এই চিন্তাগুলোর কারনে নিজেকে পাপী অনুভব করবেন তখন এই আমল আপনার মনকে শীতলতায় পরিপূর্ণ করে দিবে। এই পদক্ষেপ গুলো যদি আপনি গ্রহণ করেন তবে এমন কোন জ্বীন/শয়তান নেই যে, এসকল আমল করার পরও ধৈর্য ধারণ করে আপনাকে কুমন্ত্রণা দিতে পারবে...যতটাই সে অবাধ্য হোক না কেন। সেই সাথে আপনি যদি রুকিয়াহ,সাতদিনের ডিটক্সিফিকেশন প্রোগ্রাম এবং সকাল সন্ধ্যার জিকির-আজকার করে নিজেকে সুরক্ষার পাশাপাশি ঘরকে রুকিয়ার মাধ্যমে সুরক্ষা চালিয়ে যান, আপনার সমস্যাগুলো অচিরেই আল্লাহর রহমতে দূরীভূত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।