জাদুটোনা কেন্দ্রিক অসুস্থতা

জাদুটোনা কেন্দ্রিক অসুস্থতা

১২ সাবক্যাট | ২০ দোয়া

অধ্যায়: জাদুটোনা কেন্দ্রিক অসুস্থতা

পরিচ্ছেদ: জাদুটোনার ব্যাপারে ইসলাম কি বলে

৬০. যাদুর পরিচয় ও যাদুর সংজ্ঞা

যাদুর পরিচয় যাদুর আভিধানিক অর্থলাইছ (রহঃ) বলেনঃ যাদু হল এমন কর্ম যার মাধ্যমে শয়তানের নিকটবর্তী হয়ে তার সাহায্য নেয়া হয়।আজহারী (রহঃ) বলেনঃ মূলতঃ যাদু হল বস্তুর বাস্তবতাকে অবাস্তবে পরিণত করা।ইবনে ফারেস (রহঃ) বলেনঃ অসত্যকে সত্য বলে দেখানোকেই যাদু বলা হয়।
শরীয়তের পরিভাষায় যাদুর সংজ্ঞা
ফখরুদ্দীন আর-রাযী বলেনঃ শরীয়তের পরিভাষায় যাদু প্রত্যেক এমন নির্ধারিত বিষয়কে বলা হয় যার কারণ গোপন রাখা হয় এবং এর বাস্তবতার বিপরীত কিছু প্রদর্শন করা হয়। আর তা থেকে ও মিথ্যার আশ্রয়ভুক্ত। (আল মিসবাহুল মুনীরঃ ২৬৮)

৬১. কুরআন ও হাদীসের আলোকে যাদু

জ্বিন ও যাদুর মাঝে গভীর সম্পর্ক রয়েছে; বরং জ্বিন ও শয়তানই হল মূলতঃ যাদুর প্রধান চালিকা শক্তি। কতিপয় লোক জ্বিনের অস্তিত্বের বিষয়টি অস্বীকার করেছে এবং যাদুও অস্বীকার করেছে। তাই আমি এখানে এসবের অস্তিত্বের প্রমাণসমূহ উপস্থাপন করবঃপ্রথমঃ কুরআন দ্বারা প্রমাণঃ১. সূরা আহকাফ (৪৬:২৯)وَإِذْ صَرَفْنَآ إِلَيْكَ نَفَرًا مِّنَ الْجِنِّ يَسْتَمِعُونَ الْقُرْءَانَঅর্থঃ আর স্মরণ কর, যখন আমি জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তারা কুরআন পাঠ শুনছিল।২. সূরা আনআম (৬:১৩০)يٰمَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ ءَايٰتِى وَيُنذِرُونَكُمْ لِقَآءَ يَوْمِكُمْ هٰذَاঅর্থঃ ‘হে জিন ও মানুষের দল, তোমাদের মধ্য থেকে কি তোমাদের নিকট রাসূলগণ আসেনি, যারা তোমাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ বর্ণনা করত এবং তোমাদের এই দিনের সাক্ষাতের ব্যাপারে তোমাদেরকে সতর্ক করত?’৩. সূরা রহমান (৫৫:৩৩)يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ إِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَن تَنفُذُوا مِنْ أَقْطَارِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ فَانفُذُوا ۚ لَا تَنفُذُونَ إِلَّا بِسُلْطَانٍ ﴿٣٣﴾অর্থঃ হে জিন ও মানবজাতি, যদি তোমরা আসমানসমূহ ও যমীনের সীমানা থেকে বের হতে পার, তাহলে বের হও। কিন্তু তোমরা তো (আল্লাহর দেয়া) শক্তি ছাড়া বের হতে পারবে না।৪. সূরা জ্বীনঃ (৭২:১)قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِّنَ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا ﴿١﴾অর্থঃ বল, ‘আমার প্রতি ওহী করা হয়েছে যে, নিশ্চয় জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শুনেছে। অতঃপর বলেছে, ‘আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি।৫. সূরা জ্বীন (৭২:৬)وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِّنَ الْإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِّنَ الْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًا ﴿٦﴾অর্থঃ আর নিশ্চয় কতিপয় মানুষ কতিপয় জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা তাদের অহংকার বাড়িয়ে দিয়েছিল।৬. সূরা আল মায়েদা (৫:৯১)إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّـهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ ﴿٩١﴾অর্থঃ শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?৭. সূরা নূর (২৪:২১)يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا لَا تَتَّبِعُوا خُطُوٰتِ الشَّيْطٰنِ ۚ وَمَن يَتَّبِعْ خُطُوٰتِ الشَّيْطٰنِ فَإِنَّهُۥ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَآءِ وَالْمُنكَرِঅর্থঃ হে মুমিনগণ, তোমরা শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করো না। আর যে শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করবে, নিশ্চয় সে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেবে।কুরআনে এ সম্পর্কে অনেক প্রমাণাদি রয়েছে। আর একথা সকলেই জানে যে, কুরআনে কারীমে একটি সূরাই সূরায়ে জ্বিন সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। আর প্রমাণের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, জ্বিন একবচন শব্দটি কুরআনে কারীমে ২২ বার উল্লেখ করা হয়েছে। আর الجان “আল-জান” বহুবচন শব্দটি সাতবার এবং الشيطان শব্দটি ৬৮ বার আর (الشياطين) বহুবচন শব্দটি সতের বার বর্ণিত হয়েছে। মূলকথা জ্বিন ও শয়তান সম্পর্কে কুরআনে বহু আয়াত রয়েছে।দ্বিতীয়তঃ হাদীস দ্বারা প্রমাণঃ১. ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ এক রাতে আমরা রাসূলের (ﷺ)-এর সাথে ছিলাম। অতঃপর আমরা রাসূল (ﷺ)-কে হারিয়ে ফেললাম। এ ব্যাপারে আমরা উপত্যকায় এবং বিভিন্ন গোত্রে খোঁজতে লাগলাম; কিন্তু না পেয়ে আমরা ধারণা করলাম যে, হয়ত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অপহরণ করা হয়েছে। এরপর সেই রাত খুব খারাপ রাত হিসেবে কাটালাম। যখন সকাল হল হঠাৎ দেখি হেরা গুহার দিক থেকে আসছেন। আমরা বললামঃ হে আল্লাহ রাসূল! আপনাকে আমরা না পেয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি তবুও আপনাকে পাইনি? এরপর রাতটি খুব খারাপ কাটিয়েছি।রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ “জ্বিনের এক আহ্বায়ক আমার কাছে আসে এরপর আমি তার সাথে চলে গেলাম এবং তাদেরকে আমি কুরআনে কারীম পড়ে শুনিয়েছি।”বর্ণনাকারী বলেনঃ রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে নিয়ে চললেন সেই স্থানে এবং সেখানে আমাদেরকে তিনি জ্বিন সম্প্রদায়ের নিদর্শনসমূহ ও তাদের আগুন জ্বালানোর চিহ্নসমূহ দেখালেন। তারা রাসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করেন তাদের খাদ্য সম্পর্কে। তিনি উত্তরে বলেনঃ তোমাদের জন্য প্রত্যেক সেই হাড় যার উপর (যবাই করার সময়) আল্লাহর নাম নেয়া হয়েছে, তোমাদের হাতের কাছে থাকে যাতে গোশত না হয় এবং তোমাদের পশুর গোবর তা তোমাদের জন্যে খাদ্য।অতঃপর রাসূল (ﷺ) বললেনঃ “সুতরাং তোমরা তা দিয়ে এস্তেঞ্জা করো না। নিশ্চয় তা হলো তোমাদের ভাই জ্বিনদের খাদ্য।” (মুসলিমঃ ৪/১৭০) ২. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেনঃ আমাকে রাসূল (ﷺ) বললেনঃ “আমি লক্ষ্য করেছি যে, তুমি ছাগল এবং মরুভূমিকে পছন্দ কর। সুতরাং তুমি যখন ছাগলের সাথে মরুভূমিতে থাকবে তখন তুমি নামাযের জন্য আযান দিবে তখন আযানের ধ্বনি খুব উঁচু করবে। কেননা নিশ্চয়ই মুয়াজ্জ্বীনের ধ্বনি জ্বিন, মানুষ এবং অন্য যারাই শুনবে কিয়ামতের দিন তার জন্যে সাক্ষ্য দিবে।” (মুয়াত্তা ইমাম মালেকঃ ১৬৮, বুখারীঃ ২/৩৪৩ ফাতহ, নাসায়ীঃ ২/১২ ও ইবনে মাজাহঃ ১২৩৯)৩. ইবনে আব্বাস (রাঃ) নিজ বর্ণনায় বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবাদের এক দলের সাথে উকাজ বাজারের দিকে রওয়ানা হন। ইতিমধ্যে শয়তানদের ও আকাশের খবরের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, তাদের উপর তারকা অগ্নিশিখা বর্ষিত হয়। যার ফলে তারা স্বীয় জাতির নিকট ফিরে আসে। উপস্থিত শয়তানরা জিজ্ঞেস করেঃ তোমাদের কি হয়েছে? তারা উত্তর দেয়ঃ আমাদের ও আকাশের সংবাদের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের প্রতি তারকা অগ্নিশিখা বর্ষণ করা হয়েছে। তারা শুনে বলেঃ তোমাদের ও আকাশ সংবাদের মাঝে স্বাভাবিক কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি; বরং বড় ধরণের কিছু ঘটে গেছে। সুতরাং তোমরা বিশ্বের পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত বিচরণ করে দেখ কি সে প্রতিবন্ধকতা যা তোমাদের ও আকাশ সংবাদের মাঝে ঘটে গেছে। অতএব তারা প্রস্থান করে তেহামা অভিমূখে নবী (ﷺ)-এর দিকে। এমতাবস্থায় তিনি উকাজ বাজার অভিমূখে যাত্রাকালে নাখলা উপত্যকায় সাহাবাদেরকে নিয়ে ফজর নামায আদায় করছেন। যখন শয়তানরা (ফজরের) কুরআন তেলাওয়াত শুনল, তখন তাঁরা তা আরো মনযোগ দিয়ে শ্রবণ করা শুরু করল। অতঃপর তারা বললঃ আল্লাহর শপথ এটিই আমাদের ও আকাশ সংবাদের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সুতরাং তারা তখন সেখান হতে স্বীয় জাতির নিকট প্রত্যাবর্তন করে বলেঃ হে আমাদের জাতি আমরা নিশ্চয়ই এমন এক আশ্চর্য কুরআন শ্রবণ করেছি, যা সরল পথের দিশারী। সুতরাং তার প্রতি আমরা ঈমান এনে ফেলেছি। আর আমরা কখনও আমাদের প্রতিপালকের সাথে কাউকে শরীক করব না। এরপর আল্লাহ তাঁর নবীর (ﷺ) প্রতি অবতীর্ণ করেনঃقُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِّنَ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا ﴿١﴾অর্থঃ বল, ‘আমার প্রতি ওহী করা হয়েছে যে, নিশ্চয় জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শুনেছে। অতঃপর বলেছে, ‘আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি। (সূরা জ্বীনঃ ১)নিশ্চয়ই তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয় জ্বিনের কথা। (বুখারীঃ ২/২৫৩ ফাতহ সহ ও মুসলিমঃ ৪/১৬৮ নববীসহ শব্দগুলি বুখারীর) ৪. আয়েশা (রাঃ) স্বীয় বর্ণনায় বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “ফেরেশতা জাতি সৃষ্টি হয় নূর হতে, আর জ্বীনকে সৃষ্টি করা হয় অগ্নিশিখা হতে এবং আদমকে সৃষ্টি করা হয় তাই দিয়ে যা তোমাদেরকে বর্ণনা দেয়া হয়েছে।” (মুসনাদে আহমদঃ ৬/১৫৩, ১৬৮ ও মুসলিমঃ ১৮/১২৩ নববীসহ)৫. সাফিয়া বিনতে হুয়াই (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, নবী (ﷺ) বলেনঃ “নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের শরীরে রক্তের মত চলাচল করে।” (বুখারীঃ ৪/২৮২ ফাতহ সহ, মুসলিমঃ ১৪/১৫৫ নববীসহ)৬. আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেনঃ “যখন তোমাদের কেউ খাবার খাবে সে যেন ডান হাতে খায় এবং যখন পান করে তখন যেন ডান হাতেই পান করে। কেননা নিশ্চয়ই শয়তান বাম হাতে খায় এবং বাম হাতেই পান করে।” (মুসলিমঃ ১৩/১৯১ নববীসহ)৭. আবু হুরাইরা (রাঃ) (রাঃ) তার বর্ণনায় বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ এমন কোন সন্তান জন্ম গ্রহণ করে না যাকে শয়তান আঘাত করে না। সুতরাং শয়তানের আঘাতের ফলে সে সন্তান জন্মের সময় চীৎকার করে। তবে ঈসা ও তাঁর মাতা ব্যতীত।” (বুখারীঃ ৮/২১২ ফাতহসহ ও মুসলিমঃ ১৫/১২০ নববীসহ)৮. আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) তাঁর বর্ণনায় বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এমন এক ব্যক্তির বর্ণনা দেয়া হল যে পূর্ণ রাত্রি সকাল পর্যন্ত ঘুমায়। তিনি বলেনঃ সে এমন ব্যক্তি যার উভয় কানে বা তার কানে শয়তান পেশাব করে ফেলে। (বুখারীঃ ৩/২৮ ফাতহসহ ও মুসলিমঃ ৬/৬৪ নববীসহ)৯. আবু কাতাদা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ সৎ স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ হতে, আর মা স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ হতে। সুতরাং যে ব্যক্তি এমন কিছু দেখে যা তার অপছন্দ হয়, সে যেন তার বাম দিকে তিনবার আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতত্বানির রাজীম বলে ফুঁক দেয়, তবে তাকে অবশ্যই তা কোন ক্ষতি করতে পারবে না। (বুখারীঃ ১২/২৮৩ ফাতহসহ ও মুসলিমঃ ১৫/১৬ নববীসহ)১০. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ তোমাদের মধ্য হতে যখন কেউ হাই তোলে, তখন সে যেন স্বীয় হাত দ্বারা মুখ বন্ধ করে। কেননা শয়তান তাতে প্রবেশ করে। (মুসলিমঃ ১৮/১২২ নববীসহ ও দারমীঃ ১/৩২১)এই বিষয়ে আরও অনেক হাদীস রয়েছে। সুতরাং এখান থেকে প্রমাণিত হল যে, জ্বিন এবং শয়তানের অস্তিত্ব বাস্তব সত্য। এর মধ্যে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

পরিচ্ছেদ: সালাফদের মতামত

৬২

উক্তি ও মতামতঃ১. খাত্তাবী (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ প্রকৃতিবাদীদের একদল যাদুকে অস্বীকার করে ও তার বাস্তবতাকে খন্ডন করে।এর উত্তরঃ নিশ্চয় যাদু প্রমাণিত ও তার বাস্তবতা রয়েছে। আরব অনারব তথা পারস, ভারত উপমহাদেশীয় দেশসমূহ, রোমানও এরূপ অধিকাংশ জাতিই একমত যে, যাদু প্রমাণিত। অথচ এরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক দিয়ে সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতির অন্তর্ভুক্ত।আর আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السَّحْرَঅর্থঃ “তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দেয়।” (সুরা বাকারাহ: ১০২)অনুরূপ আল্লাহ তায়ালা যাদু হতে আশ্রয় প্রার্থনার হুকুম দিয়ে বলেনঃوَمِن شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِঅর্থঃ আর গিরায় ফুঁ-দানকারী নারীদের অনিষ্ট থেকে। (সুরা ফালাক: ৪)তিনি আরোও বলেনঃ এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে আরো এমন অনেক খবর এসেছে, যা কেউ অস্বীকার করে একমাত্র যারা বাস্তবতাকে অস্বীকার করে তারা ব্যতীত। আর ইসলামী ফেকাহবিদগণও যাদুকরের কি শাস্তি সে ব্যাপারেও আলোকপাত করেছেন। আর যার ভিত্তি নেই তার এত চর্চা ও প্রসিদ্ধি হওয়ার কথা নয়। সুতরাং যাদুকে (অস্তিত্বকে) অস্বীকার করা একটি অজ্ঞতা ও যাদু অস্বীকার কারীদের প্রতিবাদ একটি অনার্থক বিষয়।” (শারহুস সুন্নাহঃ ১২/১৮৮)২. ইমাম নববী বলেনঃ বিশুদ্ধ মত হলো, নিশ্চয় যাদুর বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে। এটিই জমহুর উলামা ও সাধারণ উলামার মত। এ মত প্রমাণিত হয় কুরআন ও প্রসিদ্ধ বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা। (ফতহুল বারী হতে সংকলিতঃ ১০/২২২)৩. আবুল ইয হানাফী (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ যাদুর বাস্তবতা ও প্রকারের ক্ষেত্রে অনেকেই মতভেদ করেন; কিন্তু অধিকাংশই বলেনঃ নিশ্চয়ই যাদুগ্রস্তের মৃত্যু ও তার অসুস্থতায় প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কোন কিছুর প্রকাশ্য ক্রিয়া ব্যতীতই------। (শরহুল আকীদা আতাহাবিয়াঃ ৫০৫)৪. ইবনে কুদামা (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ যাদুর প্রভাবে মানুষ শারিরীক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করে এবং স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছিন্নতা ঘটে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃفَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِঅর্থঃ “তারা তাদের কাছ থেকে এমন যাদু শিক্ষা নিত যার দ্বারা তারা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করত।” (ফতহুল মজিদ হতে সংকলিতঃ ৩১৪)অতএব যাদু সম্পর্কে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এর অস্তিত্ব অবশ্যই আছে এবং রাসূল (ﷺ) যাদুকরের কাছে যেতে নিষেধ করেছেন। আর নবী (ﷺ) এমন কোন বস্তু থেকে নিষেধ করতে পারেন না যার অস্তিত্ব নেই। সুতরাং এতে বুঝা যায় যে যাদুর অস্তিত্ব আছে।

পরিচ্ছেদ: যাদুর বিভিন্ন প্রকার

৬৩. ইমাম রাযীর (রাহেমাহুল্লাহ) নিকট যাদুর প্রকারভেদ

ইমাম রাযী (রাহেমাহুল্লাহ) যাদুকে সাত ভাগে বিভক্ত করেছেন।১. তারকা পূজারীদের যাদুঃএরা সাতটি ঘূর্ণায়মান তারকার পূজা করত এবং তাদের বিশ্বাস ছিল যে, এই তারকাসমূহ বিশ্বকে পরিচালনাকারী এবং এগুলোর নির্দেশেই মানুষের মঙ্গল-অমঙ্গল হয়ে থাকে। আর এগুলোর কাছে আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীম (আঃ)-কে প্রেরণ করেছেন।২. ধারণাপ্রবণ ও কঠিন হৃদয় ওয়ালাদের যাদুঃকল্পনা ও ধারণা দ্বারা মানুষ খুবই প্রভাবিত; কেননা মানুষের স্থলে রশি অথবা বাঁশের উপর যত সহজে চলা সম্ভব তা গভীর সমুদ্রে অথবা বিপদজনক কিছুর উপরে বা ঝুলন্ত বাঁশের উপর চলা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেনঃ যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা একমত যে, নাক দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়া রুগীর কোন লাল জিনিস দেখা উচিত নয়। এটি শুধু এজন্য যে মানুষের প্রকৃতিই হলো সীমাহীন ধারণাপ্রবন।৩. জ্বিনের সহায়তায় যাদুঃজ্বীন দু'প্রকারঃ ১. মুমিন ও ২. কাফির। কাফের জ্বীনদেরকেই শয়তান বলা হয়। ইমাম রাযী বলেনঃ যাদুকররা শয়তানদের মাধ্যমে যাদু ক্রিয়া পৌছিয়ে থাকে।৪. ভেল্কিবাজী ও নজর বন্দীঃএটি এমন কলাকৌশল যার ফলে মানুষের দৃষ্টি ও মনযোগ সবদিক হতে আকর্ষণ করে কোন নির্ধারিত ক্ষেত্রে গন্ডিভূত করে তাকে আহমক বানিয়ে দেয়।৫. চমকপ্রদ কর্ম প্রদর্শনমূলকঃএটি কোন যন্ত্র সেট করে দেখানো হয়। যেমনঃ কোন অশ্বারোহীর নিকট একটি শিঙ্গা রয়েছে যা মাঝে মাঝে এমনি এমনি বেজে ওঠে বা যেমন এলার্ম ঘড়ি নির্দিষ্ট সময়ে বেজে ওঠে। এমনটি কেউ অন্যভাবে সাজিয়ে যাদু প্রকাশ করে। তিনি বলেনঃ এটি প্রকৃতপক্ষে বাস্তব বিষয়, যাদু নয়, যে এর বিদ্যা অর্জন করবে সে তা করতে সক্ষম।৬. কোন বিশেষ দ্রব্য ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করেঃযেমন খাদ্যতে বা তৈলে মিশিয়ে। তিনি বলেনঃ জেনে রাখুন বিশেষ দ্রব্যের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমনঃ ম্যাগনেট।৭. যাদুকর মানুষের অন্তরের বিশ্বাসকে জয় করে যাদু করে থাকেঃযেমন সে দাবী করল যে, সে ইসমে আজম জানে এবং জ্বিন তার অনুগত তার এই সব কথার দ্বারা যখন কোন ব্যক্তিকে প্রভাবিত করা হয় এবং সত্য মিথ্যার পার্থক্য করতে না পারে। তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করে তখন সে তার বুদ্ধিমত্তা হারিয়ে ফেলে সে মুহূর্তে যাদুকরের দ্বারা সম্ভব যা চায় তাই করতে পারে।একজনের কথা অন্যজনের নিকটে গোপন, সূক্ষ ও আকর্ষণীয় করে সাজিয়ে লাগান যা মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রচারিত। (তাফসীর ইবনে কাসীরঃ ১/১৪৮)ইবনে কাসীর (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ ইমাম রাযী উল্লেখিত অনেক প্রকারই যাদু বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কেননা সবগুলির মধ্যেই সূক্ষতা পাওয়া যায়। আর যাদুর আভিধানিক অর্থ হলো যার কারণ অতি সূক্ষ ও গোপনীয়। (ইবনে কাসীরঃ ১/১৪৭)

৬৪. ইমাম রাগেব (রাহেমাহুল্লাহ)-এর নিকট যাদুর প্রকার

ইমাম রাগেব (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ যাদুর ব্যবহার বিভিন্ন অর্থে হয়ে থাকেঃ ১. প্রত্যেক ঐ জিনিস যা অতি সূক্ষ ও গোপনীয় হয়ে থাকে। তাইতো বলা হয় سحرت الصبي অর্থাৎ আমি বাচ্চাটিকে প্রতারিত করেছি ও আকৃষ্ট করেছি। অতএব যেই কোন কিছুকে আকৃষ্ট করতে পারে সেই তাকে যেন যাদু করল। এরই অন্তর্ভুক্ত হলো কবিদের কবিতা, অন্তর কেড়ে নেয়ার জন্য। অনুরূপ আল্লাহর বাণীঃبَلْ نَحْنُ قَوْمٌ مَّسْحُورُونَঅর্থঃ আমাদের দৃষ্টির বিভ্রাট ঘটানো হয়েছে না বরং আমরা যাদুগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। (সূরা হিজরঃ ১৫)এরই অন্তর্ভুক্ত হলো হাদীসে বর্ণিতঃ إن من البيان لسحرًاনিশ্চয় কিছু বক্তব্য রয়েছে যাদুময়ী।২. যা প্রতারণার মাধ্যমে হয়ে থাকে, যার কোন বাস্তবতা নেই, যেমনঃ ভেল্কিবাজদের কর্মকান্ড, হাতের প্যাচের সূক্ষতার মাধ্যমে মানুষকে নজর বন্দী করে ফেলে।৩. শয়তানের সাহায্যে তার নৈকট্য গ্রহণ করতঃ যা কিছু অর্জন হয়। এর প্রতিই আল্লাহর বাণীর ইঙ্গিতঃوَلٰكِنَّ الشَّيٰطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَঅর্থঃ “কিন্তু শয়তানরাই কুফুরী করেছিল। তারা লোকদেরকে যাদু বিদ্যা শিক্ষা দিতো।” (সূরা বাকারাঃ ১০২)৪. তারকা পূজার মাধ্যমে জ্যোতিষীদের যাদু। (ফাতহুল বারী হতে। গৃহীতঃ ১০/২২২ ও রাগেব ইস্পাহানীর আল-মুফরাদাত এ - দ্রষ্টব্য)

৬৫. যাদুর প্রকারভেদ কেন্দ্রিক একটি প্রতিপাদন

ইমাম রাযী, রাগেব ও অন্যান্য মনীষীদের যাদুবিদ্যার প্রকারভেদ সম্পর্কে গবেষণা ও প্রতিপাদনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তারা যাদুর মধ্যে এমন কিছুও অন্তর্ভুক্ত করেছেন যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়। তার কারণ হলো তারা তা যাদুর শাব্দিক/আভিধানিক অর্থের ভিত্তিতে করেছেন। অর্থাৎ যার কারণ সূক্ষ ও গোপনীয়। এ থেকে তারা আশ্চর্যজনক সৃষ্টি বা কিছু হাতের মারপ্যাচে করা হয়ে থাকে বা মানুষের মাঝে একে অপরের গোপনে যা লাগিয়ে থাকে এ ধরণের অনেক কিছুকে যাদুর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে যার কারণ সূক্ষ, অস্পষ্ট ও গোপনীয়।উল্লেখিত বিষয়গুলি আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়; বরং আমাদের এখানে আলোচ্য বিষয় ও লক্ষ্য কেন্দ্রিকভূত হবে প্রকৃত যাদুর মধ্যে, যে যাদুর ক্ষেত্রে যাদুকর সাধারণত ভরসা ও নির্ভর করে থাকে জ্বিন, শয়তানের উপর। আরো একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য হলো, যা ইমাম রাযী ও রাগেব বর্ণনা করেছেন যার নাম দেয়া হয় তারকার আধ্যাত্মিকতা বা কীর্তি; কিন্তু এক্ষেত্রেও বাস্তব কথা হলো, তারকা আল্লাহর এক সৃষ্টি, তার হুকুমের অধীন অতএব তারকার কোন সৃষ্টির উপর আধ্যাত্মিকতা বা নিজস্ব কোন প্রভাব নেই।কেউ যদি বলেঃ আমরা তো প্রত্যক্ষ করে থাকি যে, কতিপয় যাদুকর যারা তাদের ধারণা মতে তারকার জন্য কিছু নাম উচ্চারণ করে তন্ত্রমন্ত্র পড়ে বা তার দিকে ইশারা-ইঙ্গিত করে ও সম্বোধন করে। যার ফলে দর্শকের সামনে যাদুক্রিয়াও বাস্তবরূপ নেয়?তার উত্তরঃ যদি ব্যাপারটি এমনই হয় তবে এটি প্রকৃতপক্ষে তারকার প্রভাবে নয়; বরং তা শয়তানের প্রভাবে যাদুকরকে পথভ্রষ্ট করা ও ফিতনায় পতিত করার জন্যই হয়ে থাকে। যেমন বর্ণিত আছে যে, যখন তারা পাথরের মূর্তিকে সম্বোধন করত, তখন শয়তান সে মূর্তির ভেতর থেকে সশব্দে উত্তর দিত। আর তারা মনে করে যে, তা তাদের মা’বুদ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। তাই মানুষকে পথভ্রষ্ট করার বহুপন্থা রয়েছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মানুষ ও জ্বিন শয়তানের অনিষ্ট হতে রক্ষা করুন। আমীন।

পরিচ্ছেদ: জাদুর চিকিৎসা সম্পর্কিত কিছু তথ্য

৬৬. ভূমিকা

১. কাতাদা (রাঃ) বলেনঃ আমি সাঈদ বিন মুসাইয়্যাব (রহঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম কোন ব্যক্তি অসুস্থ হলে অথবা পুরুষত্ব হীনতার জন্যে কি ঝাড়-ফুঁক করা যাবে? তিনি বললেন, তাতে কোন নিষেধ নেই। কেননা তা দ্বারা উদ্দেশ্য হল মানুষের কল্যাণ। (ফতহুল বারীঃ ১০/২৩২)২. ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেনঃ মুসলিম পন্ডিতদের এ বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। যাদু দ্বারা যাদুর দমন করে মানুষের চিকিৎসা করাকে সাঈদ বিন মুসাইয়্যিব বৈধতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইমাম মুনী (রহঃ) এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।ইমাম শা'বী (রহঃ) বলেনঃ আরবী ভাষায় ঝাড়ফুঁক হলে কোন দোষ নেই; কিন্তু হাসান বসরী (রাহেমাহুল্লাহ) তা মাকরূহ বলেছেন। (কুরতুবীঃ ২/৪৯)৩. ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেনঃ যাদুর চিকিৎসক যদি কুরআনের আয়াত অথবা কোন যিকিরের মাধ্যমে অথবা এমন বাক্য দ্বারা চিকিৎসা করে যে, যাতে কোন কুফুরির বিষয় নেই তবে কোন বাধা নেই; কিন্তু তা যদি যাদু দ্বারাই হয়ে থাকে তবে তা হতে ইমাম আহমদ (রহঃ) বিমূখ হয়েছেন। (আলমুগনীঃ ১০/১১৪)৪. হাফেয ইবনে হাজার (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ নবী (ﷺ)-এর বাণীঃالنشرة من عمل الشيطانঅর্থাৎ “ঝাড়ফুঁক শয়তানী কর্মের অন্তর্ভুক্ত।” (মুসনাদে আহমদ ও আবু দাউদ) এর উদ্দেশ্য হলো মৌলিকভাবে এটিই, তবে যার উদ্দেশ্য ভাল তাতে কোন দোষ নেই। ইবনে হাজার আরো বলেনঃ ঝাড়ফুঁক দু'ধরণেরঃপ্রথমঃ জায়েয ঝাড়ফুঁকঃ এ পদ্ধতি হলো, যা কুরআন ও শরীয়তসম্মত দোয়ার দ্বারা যাদুর চিকিৎসা করা।দ্বিতীয়ঃ হারাম ঝাড়ফুঁকঃ এ প্রকার হলো, যার মাধ্যমে যাদুকে যাদু দ্বারা নষ্ট করা হয়। অর্থাৎ যাদু নষ্ট করার জন্য শয়তানকে খুশী করা হয় এবং তার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করে তার সাহায্য কামনা করা হয়। আর রাসূল (ﷺ)-এর হাদীসঃالنشرة من عمل الشيطانঅর্থাৎ “ঝাড়ফুঁক শয়তানের কর্মের অন্তর্ভুক্ত।” সাধারণত এদিকেই ইঙ্গিত করে। এজন্যে নবী করীম (ﷺ) কয়েক হাদীসে গণক ও যাদুকরের নিকট যেতে নিষেধ করেন এবং তা কুফরী সাব্যস্ত করেন।

৬৭. যাদু শিক্ষা করা কি বৈধ?

১. হাফেয ইবনে হাজার (রাহেমাহুল্লাহ) বলেন যে, আল্লাহর বাণীঃإِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْঅর্থঃ “আমরা তোমাদের জন্যে পরীক্ষা স্বরূপ। সুতরাং তোমরা কুফুরি করো না।” (সূরা বাকারাঃ ১০২) এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যাদু শিক্ষা করা কুফর। (ফতহুল বারীঃ ১০/২২৫) ২. ইবনে কুদামা (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ যাদু শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেয়া নিষিদ্ধ এবং সকল আহলে ইলমও একথায় একমত যে, তা হারাম। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহেমাহুল্লাহ)-এর অনুসারীগণ বলেন যাদু শিখলে ও শিখালে কাফের হয়ে যায়। সে যদিও যাদুকে অবৈধ বলে বিশ্বাস করে। (আল-মুগনীঃ ১০/১০৬)৩. ইমাম আবু আব্দুল্লাহ রাযি (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ যাদুর বিষয়ে শিক্ষা নেয়া ঘৃণিতও নয় নিষিদ্ধও নয়। কেননা সকল বিজ্ঞ পন্ডিতদের এই বিষেয় ঐক্যমত রয়েছে যে, জ্ঞানার্জন সাধারণভাবে বৈধ। যেমনঃ আল্লাহর বাণীঃقُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَঅর্থঃ বলোঃ “জ্ঞানী ও মূর্খ কি এক সমান?” (সূরা যুমারঃ ৯) আরেকটি বিষয় হল যে, যদি যাদু সম্পর্কে ধারণা না থাকে তবে আমরা যাদু ও মু'জেযার মধ্যে পার্থক্য কিভাবে করতে পারব। এই পার্থক্য নির্ণয় করার জন্যে এ বিষয়ে জানা প্রয়োজন। তাই যাদুর ইলম হাসিল করা নিষিদ্ধ হতে পারে না।৪. ইবনে কাসীর (রাহেমাহুল্লাহ) উপরোক্ত ইমাম রাযীর (রহঃ) অভিমত সম্পর্কে বলেনঃ কতগুলো কারণে তা গ্রহণীয় নয়। প্রথমতঃ যদি এই অভিমতকে বুদ্ধিভিত্তিক ও যৌত্তিক হিসেবে গ্রহণ করা হয় যে, যাদু শিক্ষা কোন খারাপ বিষয় নয় তবে কথা হল যে, মু'তাযিলা যারা যুক্তিকে প্রাধান্য দেয় তাদের কাছে যাদু শিক্ষা নিষিদ্ধ। আর যদি মনে করা হয় যে, শরীয়তে কোন নিষেধ নেই তবে এর উত্তর হল যে, আল্লাহ তায়ালার বাণীঃوَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَىٰ مُلْكِ سُلَيْمَانَ ۖ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُঅর্থঃ “তারা এমন বিষয়ের আনুগত্য করল যা সুলাইমান (আঃ)-এর যুগে শয়তান পড়ত।” (সূরা বাকারাঃ ১০২) এই আয়াতে যাদু শিক্ষাকে শয়তানের বিষয় বলা হয়েছে।সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি কোন গণকের কাছে অথবা যাদুকরের কাছে যাবে সে যেন নবী (ﷺ)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করল। আল্লামা রাযীর এই কথা বলা যে যাদু নিষিদ্ধ নয় এর পক্ষে কোন সঠিক প্রমাণ নেই। আর যাদুকে মর্যাদাপূর্ণ ইলমের সাথে তুলনা করা এবং আল্লাহ তায়ালার এই বাণীঃقُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَঅর্থঃ “জ্ঞানী ও মূর্খ কি এক সমান।” (সূরা যুমারঃ ৯) প্রমাণ হিসেবে পেশ করা সঠিক নয়। কেননা এই আয়াতে শরীয়তসম্মত ইলমের বাহকদের প্রশংসা করা হয়েছে। (যাদুকরের নয়)আর এই কথা বলা যে, মুজেযাকে জানতে হলে যাদুকেও জানতে হবে সঠিক নয়, কেননা সর্বাপেক্ষা বড় মু'জেযা আমাদের নবী (ﷺ)-এর প্রতি অবতীর্ণ এই কুরআন। আর যাদু ও মু'জেযার মাঝে কোন সমঞ্জস্যতা নেই। আরও বিষয় হল যে, সাহাবা, তাবেঈন এমন সকল মুসলিমগণ মু'জেযা সম্পর্কে অবগত ছিলেন তারা যাদু সম্পর্কে ধারণা রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। (তাফসীর ইবনে কাসীরঃ ১/১৪৫)৫. আল্লামা আবু হাইয়ান স্বীয় কিতাব বাহরুল মুহীত-এ উল্লেখ করেছেন যে, যাদু যদি এমন হয় যে, তাদ্বারা শিরক করা হয় অর্থাৎ শয়তানের ও তারকার বড়ত্ব বর্ণনা ও পূজা করা হয়, তবে তা শিক্ষা করা সকলের ঐক্যমতে হারাম। তা শিক্ষা করা ও তার উপর আমল করা হারাম। অনুরূপ যদি তা দ্বারা উদ্দেশ্য করা হয় রক্তপাত, স্বামী-স্ত্রী বা বন্ধুদের মাঝে বিচিছন্ন সৃষ্টি। তা শিক্ষা করা ও তা আমল করা জায়েয নয়।আর যা কিছু ভন্ডামী ও ভেল্কিবাজী ও এ ধরণের কিছু তা শিক্ষা করাও উচিত নয়, কেননা তা ভ্রান্ত ও বাতিল যদিও তা দ্বারা খেল-তামাশা উদ্দেশ্য নেয়া হয়। (রাওয়ে বয়ানঃ ১/৮৫)উপরোক্ত সমস্ত বক্তব্যের মূল কথা হলোঃ যাদু যে প্রকারেরই হোক তার সম্পর্ক খেল-তামাশাই হোক না কেন সর্বাবস্থায় নাজায়েয।

৬৮. কেরামত, মু'জেযা ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য

আল্লামা মাযরী বলেনঃ যাদু, মুজেযা এবং কেরামতের মধ্যে পার্থক্য হল, যাদুর মধ্যে যাদুকর কিছু মন্ত্র ও কর্মের বিশেষ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বীয় স্বার্থ অর্জন করে থাকে। অন্যদিকে কেরামত হঠাৎ অলৌকিক ভাবে ঘটে থাকে। আর মুজেযা কেরামত থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের এজন্য যে, তা দ্বারা প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করা হয়।হাফেজ ইবনে হাজার (রাহেমাহুল্লাহ) ইমামুল হারামাইনের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন যে, সকলের একমত যাদু কেবলমাত্র ফাসেকের (অতি পাপী) হাত দ্বারাই প্রকাশ পায়। অন্যদিকে কেরামতের প্রকাশ কোন ফাসেকের হাতে হয় না।ইবনে হাজার (রাহেমাহুল্লাহ) আরও বলেন, সকলকেই সচেতন থাকতে হবে যে, অস্বাভাবিক ও অসাধারণ বিষয় যদি কোন শরীয়তের অনুগত কবিরা গুনাহ মুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে প্রকাশ পায় তা হবে কেরামত, অন্যথায় তা হবে যাদু। কেননা যাদু শয়তানের সাহায্যে হয়ে থাকে।নোটঃ কখনও কখনও এমনও হতে পারে যে, কোন ব্যক্তি যাদুকর নয় এমন কি যাদু সম্পর্কে কিছুই জানে না, শরীয়তের যথাযথ অনুসারীও নয় বরং বড় বড় পাপ কর্ম করে থাকে, অথবা কবর পূজারী ও বেদআতী এরপরও দেখা যায় যে, তার থেকে অলৌকিক কিছু ঘটছে।এর রহস্য হল যে, তাকে শয়তান সহযোগিতা করে থাকে যাতে সাধারণ মানুষ তার বিদআতী তরীকায় আকৃষ্ট হয়। আর লোকজন এই সুন্নাতকে ত্যাগ করে শয়তানী পদ্ধতিকে গ্রহণ করে। এ ধরণের ঘটনা অনেক, বিশেষ করে সূফী তরীকার নেতাদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।

পরিচ্ছেদ: যেসব শর্ত জাদুকরের জন্য অবশ্য পালনীয়

৬৯

১. তাকে অবশ্যই তার আত্মা, সকল সম্পত্তি, ঘর-বাড়ি ও সন্তান সন্তানাদি সবকিছু শয়তানের কাছে বিক্রি করতে হবে। ২. তাকে হতে হবে চরম ধূর্ত, অনড় ও কুশলী, যাতে করে কেউ তাকে তার এ শয়তানি বিশ্বাস থেকে টলাতে না পারে, এমনকি এসব বিশ্বাসের কারণে তাকে নানাভাবে অপমান-অপদস্ত হতে হবে।৩. তাকে বোকা হতে হবে, তার মধ্যে কোনো লজ্জা, সচেতনতা অথবা কোনো অনুভূতি, স্বীকার করার মতো দয়া, সমবেদনা অথবা অন্য যে কোনো ধরনের আবেগ অথবা মহানুভবতার অনুভূতি থাকবে না।৪. তার প্রভু শয়তান অথবা তার কোনো অনুসারী যদি তার সামনে ভয়ঙ্কর মূর্তিতে হাজির হয়, তাহলে সে ভয় পাবে না অথবা তার সামনে যদি শিরচ্ছেদ করার তলোয়ার বা জল্লাদের ফাসি দেয়ার ফাঁস আনা হয়। তাহলেও সে ভয় পাবেন না। ৫. ইবলিস যদি তাকে সাহায্য করতে দেরি করে অথবা কোনো সাহায্য প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে সে এর জন্য নালিশ করবে না অথবা বিরক্ত হবে না; সে বরং তার সকল শক্তি দিয়ে এ সাহায্য পাওয়ার জন্য। অটল থাকবে কোনো রকম নালিশ না করেই অথবা সে হাল ছেড়ে দেবে না। এমনকি তাকে যদি এমন কোনো কাজ করতে বলা হয় যা মানুষের অনুসৃত সকল ধর্ম, এটিকেট, প্রথা ও আইন অনুসারে নিষিদ্ধ তা-ও করতে পিছপা হবে না।৬. সে তার সকল শক্তি প্রয়োগ করে জাদুটোনার কাজ করে যাবে এবং এ সংক্রান্ত অধ্যয়নে লেগে থাকবে, শয়তানি প্রথা অনুসারে যা যা দরকার সব করবে এবং এসব কাজে তার অথবা সমাজের অন্য কোনো মানুষের কোনো ক্ষতি হতে পারে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই শয়তানের সভায় যোগদান করবে, এক্ষেত্রে সে নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে সকল কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সম্পাদন করবে।৭. সব সুন্দর ও মূল্যবান বিষয়ের ক্ষেত্রে তাকে স্বাভাবিকভাবে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে অবশ্যই অজ্ঞ হতে হবে।৮. তাকে অবশ্যই শয়তানের ক্ষমতা ও সামর্থ্যের প্রতি বিশ্বাস রাখতে। হবে, এবং শয়তানের আত্মাদের মধ্যে যারা তাকে সাহায্য করে তাদের ক্ষমতায়ও বিশ্বাস রাখতে হবে এবং শয়তানের আদেশের প্রতি অনুগত হতে হবে, শয়তানের শর্তাবলী ও আইন-কানুন সব মেনে নিতে হবে।৯. তাকে সব ধর্মের শপথকৃত শত্রু হতে হবে; তাকে সব ধর্ম নিয়ে ঘৃণা প্রকাশ করতে হবে, উপহাস করতে হবে এবং নাযিলকৃত সকল কিতাবকে অবজ্ঞা করতে হবে, এসব কিতাব ছিড়ে ফেলবে এবং কিতাবের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবে।১০. সে যে কোনো ধরনের অপরাধ অথবা পাপ করার জন্য প্রস্তুত থাকবে, আর সে অনৈতিকতা ও স্বেচ্ছাচারিতায় নিমজ্জিত হয়ে থাকবে।১১. তাকে অশ্লীলতা ও নীচতায় হতে হবে দৃষ্টান্ত, যার প্রতিফলন তার পোশাক-পরিচ্ছেদ ও জীবন যাপনের ধরনে থাকবে। তাকে স্থায়ীভাবে সাবান ও পানি ব্যবহার ছেড়ে দিতে হবে, যতক্ষণ না তার শরীরে নোংরা দুর্গন্ধ তৈরি হয়, এ নোংরা দুর্গন্ধ দিয়েই সে তার পীরদের মাঝে পরিচিত হবে।১২. সে অধিকাংশ সময় সম্ভব হলে পুরো সময় কাটাবে জনবিচ্ছিন্ন। দূরবর্তী ও নির্জন এলাকায়। এছাড়া জাদুর অংশ হিসেবে এবং মানুষের ক্ষতি করার জন্য তাকে না বলা পর্যন্ত সে তাদের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় অংশ নিতে অথবা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেনা।” [ইবরাহিম মুহাম্মাদ আল জামাল, আল সিহর, পৃ-৩৮-৩৯]

পরিচ্ছেদ: জাদুকর সমাজে যা যা করেন

৭০

জাদুকর সমাজে সকল ধরনের ক্ষতিকর ও কলুষিত কাজ ছড়িয়ে দিতে চান এবং এটা তিনি উপভোগ করেন। তিনি সৃষ্ট জীবের যে কোনো ক্ষতি করতে অথবা যে কোনো ভয়ঙ্কর খারাপ কাজ করতে দ্বিধাবোধ করেন না অথবা নিজেকে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখেন না। জাদুকর যেসব কাজ করেন সেগুলো হল-ফসল ও গবাদিপশু ধ্বংস করা, আগুন লাগানো, ব্যবসায়ের মালামাল নষ্ট করা, স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে বিভেদ তৈরি করা, বিবাহিত দম্পত্তির মাঝে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করা, এমন ক্রিম উৎপন্ন করা যা মানুষের আকাঙ্ক্ষা নষ্ট করে দেয়, গর্ভপাত ঘটায়, মানুষকে পাগল, দ্বিধান্বিত অথবা অমনোযোগী করে তোলে, এমন পাউডার তৈরি করা যা ভালোবাসা অথবা ঘৃণা তৈরি করে, জাদুমন্ত্র প্রয়োগ করে বাগদান ভণ্ডুল করে দেয়া এবং বিয়ের আগেই স্বামীকে নিবার্য করে দেয়া ইত্যাদি।অতঃপর এ জাদুকর জীবাণুর মতো কাজ শুরু করেন, দুর্বল না হওয়া পর্যন্ত সমাজের মেরুদণ্ড ও হাঁড় খেতে থাকেন। এ জীবাণু যদি হত্যা করা না হয়, তাহলে এক পর্যায়ে পুরো দেহ দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়ে যাবে। এ কারণেই ইসলাম জাদুটোনা ও জাদুকরের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সবচেয়ে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য আলিমদের মতে, এসব জাদুকরকে হত্যা করতে হবে এবং তাদেরকে প্রথমে তওবা করার সুযোগ না দিয়েই তাদের রক্ত ঝরানোও জায়েয।আল্লাহ তা'আলা বলেন:وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَٰكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ ۚ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْঅর্থঃ আর সুলাইমান কুফরী করেনি; বরং শয়তানরা কুফরী করেছে। তারা মানুষকে যাদু শেখাত এবং (তারা অনুসরণ করেছে) যা নাযিল করা হয়েছিল বাবেলের দুই ফেরেশতা হারূত ও মারূতের উপর। আর তারা কাউকে শেখাত না যে পর্যন্ত না বলত যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা, সুতরাং তোমরা কুফরী করো না। (আল বাকারা ২:১০২)যদি প্রশ্ন করা হয় যে: যেখানে স্বধর্মত্যাগীকে তওবা করার সুযোগ দেয়া হয়, সেখানে জাদুকরকে কেন তওবা করার সুযোগ দেয়া হবে না? মালিকি মতানুসারে এ প্রশ্নের জবাব হল-জাদু হলো বিপথগামীদের মতো এবং বিপথগামীকে তওবা করার কোনো সুযোগ দেয়া হয় না।জাদুকরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ছিল খলিফা হযরত ওমর বিন খাত্তাবের (রাঃ) দেখানো পথ। সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আছে, বাযালাহ বিন আবদাহ বলেন: আমি আল আহনাফ বিন কায়েসের চাচা যুজ বিন মুয়াবিয়ার অনুলেখক ছিলাম। একবার ওমরের (রাঃ) পক্ষ থেকে তার মৃত্যুর পূর্বে একটি চিঠি এল আমাদের কাছে, ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল: “প্রত্যেক জাদুকরকে হত্যা কর”। [সুনানে আবু দাউদ, ৩/২২৮, হাদিস নং-৩০৪৩] এবং এ হাদীসের সনদও সহীহ। [মুসনাদ আল ইমাম আহমাদ, ১/১৯০, ১৯২; আল বায়হাকি, ৮/১৩৬, বিন হাজাম, আল মুহাল্লা ১১/৩৯৭]জাদুকরদের হত্যা করার ব্যাপারে আরেকটি সহীহ হাদীস রয়েছে। মু'মিনদের মাতা হাফসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত এবং এটি মুয়াত্তা ইমাম মালিক-এ আবদুর রহমান বিন সাদ বিন যারারাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি শুনেছেন যে, আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) স্ত্রী হযরত হাফসা (রাঃ) একজন দাসীকে হত্যা করেছিলেন, কারণ ওই দাসী তাকে জাদুটোনা করেছিল। এ দাসীর সঙ্গে মুক্তির বিষয়ে হাফসার (রাঃ) একটি লিখিত চুক্তি ছিল; তিনি ওই দাসীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার নির্দেশ দিলেন। [মুয়াত্তা, পৃ-৫৪৩]জাদুকরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পক্ষে অনেক সাহাবীও সমর্থন জানিয়েছেন, তারা হলেন-ওমর বিন খাত্তাব, উসমান বিন আফফান, ইবনে ওমর, মুমিনদের মাতা হাফসা ও আবু মুসা আল-আশআরী (রাঃ) [তাফসীর আল কুরতুবি, ২/৪৮]ইমামদের মধ্যে ইমাম আবু হানীফা ও মালিক এ মতের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন, আর ইমাম আহমাদ এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

পরিচ্ছেদ: জাদুকর যেভাবে জাদুটোনা করেন

৭১

যিনি জাদুটোনা করাতে চান, নারী হোক বা পুরুষ হোক, তিনি জাদুকরের কাছে যান এবং নির্দিষ্ট একজনের ওপর জাদুটোনা করার অনুরোধ করেন। অথবা তিনি মনে করতে পারেন, এ লোক জাদুকর নন, তাই তিনি তাকে তার অথবা তার কোনো আত্মীয়ের চিকিৎসা করার অনুরোধ করে। এ পর্যায়ে জাদুকর যার ওপর জাদুটোনা করানো হবে তার ও তার মায়ের নাম জিজ্ঞেস করেন এবং তার পরিধেয় কাপড়, মাথার চুন অথবা তার ছবি নিয়ে আসতে বলেন।কিন্তু জাদুকর পিতার নামের স্থলে মায়ের নাম জিজ্ঞেস করেন কেন? এর কারণ হল, ওই জাদুকর এবং তার সঙ্গে থাকা জ্বিন হল কাফির, তারা সকল ধর্ম ও ঐশী নিয়ম-কানুন অস্বীকার করেন এবং এগুলো নিয়ে উপহাস করেন। তাই তারা বিধিসম্মত বৈবাহিক চুক্তিও স্বীকার করেন না। জাদুকরের মতে, তার কাছে যারা আসেন তারা প্রত্যেকেই অবৈধ এবং যিনার মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করেছেন-যা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। এরপর জাদুকর উভয়ের নামের অক্ষর গণনা করেন। যদি তিনি মনে করেন, তার নাম মাটির (আল-তীন) কাছাকাছি, তাহলে তিনি তার জাদুমন্ত্র মাটিতে পুঁতে দেন, আর নাম যদি হয় পানির (আল-মা') কাছাকাছি, তাহলে তিনি তার মন্ত্র পানিতে ডুবিয়ে দেন-যেমন কুপে ফেলে দেয়া। যেভাবে ইহুদি লাবিদ বিন আযাম আল্লাহর রাসূল (ﷺ) জাদুটোনা করার সময় করেছিলেন। লাবিদ যখন মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নামের অক্ষর গণনা করে পেল যে, মুহাম্মাদের ও তার মায়ের নাম আমিনায় আলিফ ও মীম বর্ণের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এবং এটা পানির (আল-মা’) কাছাকাছি, তাই সে তার জাদুমন্ত্র যারওয়ান নামক কুপে ফেলে দিল।নাম পানির কাছাকাছি হলে জাদুকর তার কবচ কুপে অথবা সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়। আর নাম যদি বাতাসের কাছাকাছি হয় তাহলে তারা এ কবচ কোনো গাছে অথবা খেজুর বৃক্ষে অথবা উঁচু দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়। এর পর সে জ্বিনের প্রতি উৎসর্গস্বরূপ ধুপ জ্বালায়, কারণ জ্বিনরা তাদের উপর উৎসর্গকৃত ধুপ খেয়ে থাকে। ধূপ জ্বালানোর পাশাপাশি জাদুকর জ্বিনদের নেতাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে কুফরি ও শিরক যুক্ত কালাম পাঠ করে। প্রত্যেক জাদুর জন্য আলাদা আলাদা ধুপ রয়েছে। এরপর জাদুকর তার মন্ত্র বা কবচ লেখা শুরু করে, এটা অনেকটা জ্বিনদের নেতাদের প্রতি দাসত্ব প্রকাশ করে এবং জ্বিনদের নেতাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং আল্লাহর বাণীর প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে লেখা চিঠির মতো। এরপর জ্বিনরা জাদুকরের কাছে তাদের শর্তাবলী তুলে ধরে, আর জাদুকর এ শর্তাবলী তার কাছে তাবিজ-কবচ নিতে আসা রোগীর ওপর চাপিয়ে দেয়, রোগীকে যর চক্রে অংশ নিতে বলা হয়, শর্তানুসারে একটি নির্দিষ্ট প্রাণী জবেহ করা, নির্দিষ্ট ধরনের খাবার খাওয়া এবং নির্দিষ্ট সময় ধরে কোনো অন্ধকার রুমে নির্জনবাস করার আদেশ দেয়া হয়। আর এ মন্ত্র বা কবচ যদি পোড়ানো হয়, অথবা নষ্ট বা বাতিল হয়ে যায় তাহলে ভিকটিমের জন্য বিষয়টি সহজ হয়ে যায়। এজন্য অনেক জাদুকর তাদের তাবিজ রক্ষার্থে তামার কৌটার ভেতরে তাবিজ রেখে সীসা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয়। এ পদ্ধতিকে অনেক সাধারণ মানুষ হিজাব বলে। এরপর জাদুকর জ্বিনকে ডাকে ভিকটিমের বিরুদ্ধে তার মিশন পরিচালনা করার জন্য। এ মিশন হল ভিকটিমকে অসুস্থ করে দেয়া, তার মধ্যে দৃষ্টিবিভ্রম সৃষ্টি করা এবং তার ও তার স্ত্রীর মাঝে বিভেদ তৈরি করা।এ জ্বিনকে বলা হয় জাদুর সেবক। এ সেবক জ্বিন আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত মালামাল, কাপড়ের ঘ্রাণ শুকে ও তার ছবি দেখে তাকে শনাক্ত করে। এরপর সে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অনুসরণ করতে থাকে এবং তার বিভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষণ করে। অনুসন্ধানে যদি সে বুঝতে পারে যে, আক্রান্ত ব্যক্তি সবসময় আল্লাহর আদেশের প্রতি অবিচল থাকে না, তখন তার মিশন সহজ হয়ে যায়; তখন জ্বিন ওই ব্যক্তির ওপর আছর করে অথবা তার মধ্যে দৃষ্টিবিভ্রম তৈরি করে ভয়ঙ্কর কিছু দেখিয়ে তাকে নিদারুণ যন্ত্রণা ও বিষন্নতায় ফেলে দেয়। কিন্তু জ্বিন যদি দেখে যে, তার আক্রান্ত ব্যক্তি সবসময় আল্লাহর আদেশের প্রতি অবিচল থাকে এবং ভিকটিম অনেক আল্লাহভীরু, তখন জ্বিন তাকে ভয় পায় এবং তাকে অনুসরণ করতে থাকে, যখনই ভিকটিম একটু আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয় অথবা খুব রাগান্বিত হয়ে যায় সেই মুহূর্তটা জ্বিন কাজে লাগায়। এ সুযোগে সে ভিকটিমের ওপর আছর করে বসে। এরপর জাদুকর তার ও সেবক জ্বিনের মধ্যবর্তী একজনের সহায়তায় তার জাদুটোনা চালিয়ে যেতে থাকে, এ মধ্যস্থতাকারী দৈনিক ফলাফলের খবর এনে দেয় এবং জাদুকরের নির্দেশাবলী সেবক জ্বিনের কাছে পৌঁছে দেয়।ভিকটিম যদি হয় আল্লাহভীরু ও ধার্মিক এবং দৈনিক যদি যিকির-আযকার পাঠ করেন, তাহলে জাদুকরের সেবক জ্বিন তাকে ভয় পায় এবং ভিকটিমের এ আল্লাহ‌ভীরুতা জ্বিনকে নিঃশেষ করে দেয়, যাতে করে জাদুটোনা তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে। মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি যদি এ চাকর জ্বিনকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ না দিত এবং শয়তানের পক্ষ থেকে পুরস্কারের লোভ না দেখাত অথবা তাকে হত্যা করার হুমকি না দিত, তাহলে এ জ্বিন পালিয়ে যেত। কিন্তু ভিকটিমের ঈমান যদি হয় দূর্বল, আল্লাহর সঙ্গে যদি সত্যিকারের কোনো সম্পর্ক না থাকে, তাহলে এটাই তার জন্য সমস্যা হয়ে যায়, কারণ এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জাদুকর তার দেহের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়, যার প্রতিফলন ভিকটিমের জীবনে দেখা যায় এবং এ জাদুটোনার সঙ্গে সে এমন দুঃসাহসিক অভিযানে জড়িয়ে পড়ে যার কোনো শেষ নাও থাকতে পারে এবং তার এ সমস্যা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এখানে আমরা দু' ধরনের মন্ত্র বা কবচের সঙ্গে পরিচিত হব; একধরনের কবচ অসুস্থ রোগীর দেহের ভিতরে প্রবেশ করানো হয় খাবার বা পানীয়ের সঙ্গে অথবা সুগন্ধির মাধ্যমে অথবা রোগীর সঙ্গে করমর্দন করার মাধ্যমে; আরেক ধরনের কবচ রাখা হয় বাইরে, হয়তো কোথাও পুতে রাখা হয়। অথবা কোনো গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

পরিচ্ছেদ: আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর জাদুটোনার প্রভাব

৭২

দু’ভাবে ভিকটিমের ওপর জাদুটোনার প্রভাব পড়ে; হয় জাদুটোনা রোগীর দেহের ভেতরে অভ্যন্তরীণ প্রভাব ফেলবে; অথবা বাহ্যিক প্রভাবও পড়তে পারে, যেমন: জাদুটোনা যদি বাহ্যিকভাবে অথবা দূর থেকে রোগীর ওপর প্রভাব ফেলে, তাহলে সেক্ষেত্রে এ জাদু রোগীর মাঝে দৃষ্টিবিভ্রম ও উদ্বিগ্নতা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ জাদুকর যেভাবে তার জাদু পরিচালনা করবে এর প্রভাবও সেভাবে হবে। জাদুটোনার কবলে পড়ে জীবন যাদের বিপর্যস্ত এ তথ্য তাদের জন্য এখানে উপস্থাপন করছি, যাতে করে তারা নিজেরাই এর চিকিৎসা করতে পারে অথবা যাতে এ তথ্য রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে রক্বিরদের উপকারে আসে।

পরিচ্ছেদ: জাদুটোনা সম্পর্কিত কার্যকর তথ্য

৭৩

জাদুটোনার চিকিৎসা ও প্রতিরোধের সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হল শরীয়াহ নির্দেশিত পদ্ধতি। কারণ চিকিৎসার জন্য কোনো ভিকটিমকে জাদুকরের কাছে পাঠানোর মানে হতে পারে তার সঙ্গে জ্বিনদের দু' গ্রুপের যুদ্ধের শামিল, যেখানে ভিকটিমের ভাগ্য নির্ভর করবে যুদ্ধের ফলাফলের উপর; জ্বিনদের দু' গ্রুপ চাকর বা সেবক জ্বিনকে কিছু সময়ের জন্য বিতাড়িত করার ব্যাপারে সমঝোতায় আসতে পারে, কিন্তু এ সময়ের পর ওই সেবক জ্বিন আবার ফিরে আসবে এবং সে তার কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখবে। কিন্তু এর বিপরীতে কুরআনে নির্দেশিত পন্থায় করা চিকিৎসাকে জ্বিন অথবা জাদুকর কেউই প্রতিরোধ করতে পারবে না।لَوْ أَنزَلْنَا هَٰذَا الْقُرْآنَ عَلَىٰ جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللَّهِঅর্থঃ এ কুরআনকে যদি আমি পাহাড়ের ওপর নাযিল করতাম তবে তুমি অবশ্যই তাকে দেখতে, আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ। (আল হাশর ৫৯:২১)জাদুটোনার প্রভাব সীমিত সময়ের জন্য, কবচ নষ্ট হয়ে গেলে কিছু সময় পরেই এর আর কোনো কার্যকারিতা থাকে না। এ কারণেই কিছু জাদুকর তাদের মন্ত্রের ফলোআপ করে এবং সময়ে সময়ে এসব কবচ নবায়ন করে।অসুস্থ ব্যক্তির জন্য একটি কর্মসূচি অনুসরণ করা এবং নিয়মিত সকাল সন্ধ্যায় আযকার তেলাওয়াতের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। এসব সুবিধা হলো—১. জাদুকর ও জ্বিনের মাঝে মধ্যস্থতাকারীর ফিরে আসার পথ বিচ্ছিন্ন করা, যা সেনাবাহিনীর পরিভাষায় সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করা হিসেবে পরিচিত।২. সেবক জ্বিনকে হত্যা করে অথবা তাকে পালাতে বাধ্য করার মাধ্যমে তাকে দুর্বল করে দেয়া।৩. জাদুকর যদি তার কবচ নবায়ন করতে ইচ্ছুক হয়, সেক্ষেত্রে তার। এ মিশন পরিচালনায় অনেক জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে।জাদুটোনার প্রতিটি কাজের জন্য দরকার একজন জাদুকর, একজন ভিকটিম, একটি কবচ, জাদুটোনার জন্য নির্দিষ্ট কিছু জিনিসপত্র এবং ভিকটিম ও জাদুকরের মাঝে কাজ করার জন্য একজন মধ্যস্থতাকারী।অনেক সময় জাদুকর তার সেবক জ্বিনের জিহ্বা বেঁধে দেয়, যার। ফলে ভিকটিম কথা বলতে পারে না। অতি সম্প্রতি এ ধরনের একটি ঘটনায় এক মহিলার কথা ছয় মাস বন্ধ ছিল।তিনি একটি মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, আর এ চিকিৎসার পরিসমাপ্তি ঘটে স্বামীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদের মাধ্যমে। জাদুকর তাকে সুস্থ করে তুলতে ব্যর্থ হয়, অবশেষে কুরআনের আলোকে তার চিকিৎসা করা হয়।জ্বিনদের মধ্যেও কিছু জাদুকর রয়েছে। জাদুকর একটি জ্বিনকেও জাদুটোনা করতে পারে এবং এর মাধ্যমে তাকে ভিকটিমের কাছে পাঠায়, এক্ষেত্রে ভিকটিমের ওপর করা জাদুটোনা অনেক জটিল হয়।

পরিচ্ছেদ: যেসব লক্ষণ দিয়ে জাদুকরকে চেনা যায়

৭৪

১. সে কারো নাম ও মায়ের নাম জানতে চাইবে।২. সে একটি প্রাণী অথবা পাখি যবেহ করতে বলবে, এ প্রাণীর বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য থাকুক বা না থাকুক অথবা এ প্রাণীর রক্ত শরীরে মালিশ করা হোক বা না হোক।৩. সে রোগীকে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল ধরে নির্দিষ্ট ধরনের খাবার। অথবা পানীয় পান করার নির্দেশ দেবে এবং এ সময়কালে তাকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকার কক্ষে বসবাস করতে বলবে।৪. সে রোগীকে কিছু কাগজ দেবে পোড়ানোর জন্য এবং তাকে এ কাগজ পোড়ানোর ধোয়ার গন্ধ শুকতে বলবে অথবা একে কোথাও ঝুলিয়ে অথবা পুতে রাখার পরামর্শ দেবে।৫. যারা নামের অক্ষর বা সংখ্যা লেখে অথবা আল্লাহর বাণী সম্বলিত কাগজ ছিড়ে ফেলেন তারা প্রত্যেকেই জাদুকর।৬. যারা দুর্বোধ্য সব শব্দ উচ্চারণ করে অথবা আরবী ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণ করে, তারা প্রত্যেকেই জাদুকর।

পরিচ্ছেদ: জাদুকরের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা

৭৫

আমরা বুঝতে পারলাম যে, জাদুকররা কাফির এবং ইসলামে তাদের জন্য শাস্তির বিধান হল তলোয়ার দিয়ে শিরচ্ছেদ। ইসলাম মুসলিমদেরকে জাদুকরের কাছে যেতে নিষেধ করেছে, আমরা এখন এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করব। হাসান সনদে আল বাযার থেকে বর্ণিত হয়েছে, ইবনে আব্বাস ভাল বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়, যারা পাখির সংকেতকে শুভ অথবা অশুভ হিসেবে মেনে চলে, অথবা যারা ভবিষ্যৎ বলে অথবা নিজের ভবিষ্যৎ কাউকে দিয়ে বলায়, যারা জাদুটোনা করে অথবা নিজের জন্য জাদুটোনা করায়। যে ব্যক্তি জাদুকরের কাছে যায় এবং তার কথা বিশ্বাস করে, সে মুহাম্মাদের (ﷺ) কাছে অবতীর্ণ হওয়া আল্লাহর কিতাবকে অস্বীকার করে।” [আল তাবারনি, আল বাজ্জার থেকে জায়িদ সনদে]সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“তোমরা সাতটি পাপ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখ, যা মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে”।তারা বললেন: হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সেই গুনাহগুলো কী কী? তিনি বললেনঃ“আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার করা, জাদুটোনা করা, ইসলামী শরীয়াহ দ্বারা অনুমোদিত হত্যা ব্যতিত এমন আত্মাকে হত্যা করা যা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা এবং নির্দোষ মু'মিন নারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া।” [ফাতহুল বারি, ৫/৯৩, মুসলিম-১/৯২]এবং তিনি বলেন:“যে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ বক্তার শরণাপন্ন হবে এবং তার কথা বিশ্বাস করবে, মুহাম্মাদের (ﷺ) প্রতি অবতীর্ণ আল্লাহর কিতাব দ্বারা তার আর ভচ করার থাকবে না, অর্থাৎ এর মাধ্যমে সে কুরআনকে অস্বীকার করবে। আর যে ব্যক্তি জাদুকরের কাছে যাবে, কিন্তু তার কথা বিশ্বাস করবে না, তার চল্লিশ দিনের ইবাদত কবুল হবে না।”অনেকে বলতে পারেন: আমি তো কারো কোনো ক্ষতি করার জন্য। জাদুকরের কাছে যাই না, আমি যাই আমার উপর যে জাদুটোনা করা হয়েছে তা নিরাময়ের জন্য। আমরা তাদেরকে বলব: আপনাদের অবস্থা ওই ব্যক্তির মতো, যে নিজেকে আগুনে নিক্ষেপ করে মরুভূমির তাপদাহ থেকে বাচার প্রার্থনা করে।অনেক সময় জ্বিনরাও জাদুকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে এবং তাকে এমন অসুস্থ বানিয়ে দেয়, যার জন্য কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না।জ্বিন ও শয়তান মিলে অনেক সময় জাদুকরকে চরম বিপদে ফেলে দেয়। এবং তাকে কোনো সাহায্য করে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন:وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنسَانِ خَذُولًاঅর্থঃ আর শয়তান তো মানুষের জন্য চরম প্রতারক’। (সূরা আল ফুরকান ২৫:২৯)জ্বিনরা অনেক সময় জাদুকরকে তার কাছে চিকিৎসার জন্য আসা। নারীর সঙ্গে অনৈতিক কাজ করতে বলে অথবা ওই নারীর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে রক্ত দিয়ে লেখতে বলে।জাদুটোনা অনেক সময় ঈপ্সিত ফলাফলের বিপরীত ফল এনে দেয়, তাই দেখা যায় অনেকে জাদুটোনা করান নিজের উপকারের জন্য, কিন্তু এর পরিসমাপ্তি ঘটে যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, সে নিজেই এর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যায়। অনেক নারী তাদের স্বামীদের ওপর জাদুটোনা করান, যাতে স্বামীরা তাদেরকে ভালোবাসেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ না করেন, কিন্তু জাদুটোনার ফল হয় বিপরীত, দেখা যায় জাদুটোনার প্রভাবে স্বামী তাকে ভালোবাসার পরিবর্তে তালাক দিয়ে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: وَلَا يَحِيقُ الْمَكْرُ السَّيِّئُ إِلَّا بِأَهْلِهِঅর্থঃ কু-চক্রান্ত তাকেই ঘিরে ধরবে যে তা করবে। (সূরা ফাতির ৩৫:৪৩)অনেক সুস্থ সবল নারী-পুরুষও জাদুকরের কাছে যান, আর তখন। জাদুকর জ্বিনকে দিয়ে তাদের মাঝে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে, যাতে করে এর মাধ্যমে সে তাদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে।জ্বিন ও শয়তানের দাবি থাকে অনেক এবং তাদের এসব দাবি মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়। অনেক সময় তারা একটি নির্দিষ্ট প্রাণী। উৎসর্গ করার দাবি করে, পোষা মোরগ অথবা কবুতর জবেহ করতে বলে, আবার এ জবেহ-র ক্ষেত্রে থাকে কঠিন কিছু শর্ত, এ প্রাণীর রক্ত রোগীর দেহে মালিশ করতে বলা হয়।অথবা তারা অসুস্থ রোগীকে এমন এক নির্জন কক্ষে জনবিচ্ছিন্ন করে রাখার দাবি করে, যেখানে চল্লিশ দিনেও সূর্যের আলো প্রবেশ করবে না অথবা নির্দিষ্ট একটি সময় ধরে রোগীকে পানি স্পর্শ না করার পরামর্শ দেয়, এভাবে তাদের চাহিদার কোনো শেষ নেই। প্রত্যেক অঞ্চলেই জ্বিন তার নিজস্ব দাবি তুলে ধরে, ওই দাবি ওই এলাকায় অদ্বিতীয়। মিশরে আবূ হাশিমাহ নামে একটি পরিত্যক্ত কুপ রয়েছে, জাদুকররা বন্ধ্যা নারীদেরকে জুমআর দিন মাগরিবের পরে এখানে গোসল করার জন্য পাঠায়। এ পরিত্যক্ত কুপে অনেক জ্বিন রয়েছে, যারা নারীদের গোসল করার দৃশ্য উপভোগ করে। এক্ষেত্রে কোনো জ্বিন কোনো নারীর দ্বারা আকৃষ্ট হতে পারে এবং তার সঙ্গে যৌন মিলনও করতে পারে। যে দরিদ্র লোকটি তার স্ত্রীকে বন্ধ্যাত্ব থেকে নিরাময়ের জন্য এ কুপে নিয়ে আসেন, তিনি আসলে ভুলে যান যে, প্রজনন ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই নিয়ন্ত্রণ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:يَهَبُ لِمَن يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَن يَشَاءُ الذُّكُورَ ﴿٤٩﴾ أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا ۖ وَيَجْعَلُ مَن يَشَاءُ عَقِيمًا ۚ إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ ﴿٥٠﴾অর্থঃ তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। (সূরা আল-শুরা ৪২:৪৯-৫০)শয়তান ও জ্বিনের চাহিদা সীমাহীন। আল্লাহ তা'আলা এ প্রসঙ্গে বলেন;وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِّنَ الْإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِّنَ الْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًا ﴿٦﴾অর্থঃ আর নিশ্চয় কতিপয় মানুষ কতিপয় জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা তাদের অহংকার বাড়িয়ে দিয়েছিল। (সূরা জ্বিন ৭২:৬)শায়খ হাফিজ আল হুকামি (রহঃ) বলেন: জাদুটোনা করে জাদুর ক্রিয়া নষ্ট করাও হারাম, কারণ এটা জাদুটোনাকে সমর্থন ও সহায়তা করার শামিল, এবং ভিকটিমের উপর থেকে শয়তানের কার্যকারিতা নষ্ট করার জন্য এভাবেই মানুষ শয়তানের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। এ কারণেই আল হাসান বলেন: জাদুকর ছাড়া আর কেউই জাদুটোনাকে সমর্থন করেন না।জাদুকররা যখন দেখল তাদেরকে বাধা দেয়ার জন্য তলোয়ার নিয়ে দাড়ানোর কেউ নেই, তখনই তারা আরো বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে মানুষকে জাদুটোনা করতে শুরু করল, মানুষ একে পছন্দ করুক বা না করুক, তাদেরকে জাদুটোনা করাতে বাধ্য করে এবং এর মাধ্যমে তাদের সম্পদ হাতিয়ে নেয়, সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। করে এবং পাশপাশি ভিকটিমকে বিপথগামী করে দেয়। [মাআরিজুল কুকূল ১/৫৩০]উপরোক্ত সব কথাবার্তার পরে, আমরা তাওহীদের উম্মাহ, কুরআনের অনুসারী উম্মাহ ও মুহাম্মাদের (ﷺ) উম্মাকে, ঈমানে অটল মু'মিনদেরকে বলতে চাই যে, জাদুকর নিজে কাফির, আর তার কর্ম কুফরি। তার কোনো। সুবিধা দেয়া বা ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই, তার জীবন দেয়া বা মৃত্যু দান। করা অথবা মৃত্যুর পরে পুনরুত্থিত করার ক্ষমতা নেই। তার অদৃশ্য সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। আর যেসব জ্বিন এ জাদুকরদের সেবা করে তারা কাফির ও বিদ্রোহি, কারণ জ্বিনদের মধ্যে যারা ঈমানদার, তারা মানুষের মধ্যে যারা ঈমানদার তাদেরকেই পছন্দ করে, তারা কারো হাতে পরাভূত ও দাস হতে চায় না।হে কুরআনের উম্মাহ, আপনারা জাদুকরদের অবস্থার দিকে একবার লক্ষ্য করুন। তারা অর্থের জন্য ভিক্ষা করে, তার অসুস্থ মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়, সুতরাং তারা আপনাকে কিভাবে ধনী বানাবে? যেহেতু ইসলাম জাদুকরের কাছে যাওয়ার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, সেহেতু এর বিকল্প কোনো পথ কি আছে? আমরা বলব: হ্যা, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের (ﷺ) হাদীসে একটি বিকল্প রয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা জাদুটোনার ক্রিয়া নষ্ট এবং জাদুটোনার চিকিৎসা করার ইসলামী পদ্ধতি আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

পরিচ্ছেদ: জাদুটোনা থেকে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন?

৭৬. ঈমানকে আরো শক্তিশালী করা

ভুমিকাচিকিৎসকরা সবসময়ই বলেন, প্রতিরোধ হল নিরাময়ের চেয়ে শ্রেয়। আমরা এক্ষেত্রে বলব: জাদুটোনার সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসা বা নিরাময় হল এটি ঘটার আগেই নিজেকে এর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা। নিকৃষ্ট জাদুকর যে তার আত্মা শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে যদি শয়তানের কাছে। তার উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য সাহায্য কামনা করেও তাতে চিন্তার কোনো কারণ নেই, কারণ ইসলাম আমাদেরকে বলে দিয়েছে কিভাবে বিতাড়িত শয়তানের হাত থেকে নিজেকে ও পরিবারকে বাঁচাতে হবে। মুসলমানরা জাদুটোনার কুপ্রভাব থেকে বাঁচার জন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করবেন।
ঈমানকে আরো শক্তিশালী করা
একজন মুসলমানকে অবশ্যই নিজেকে ও তাওহীদের প্রতি তার বিশ্বাস আরো দৃঢ় করতে হবে। একজন মুসলিম এভাবেই তার ঈমান জোরদার করেন এবং আল্লাহর ভয় ব্যতীত অন্য সব কিছুর ভয়কে হৃদয় থেকে দূর করেন এবং কারো উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে এ বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করে তোলেন। মুসলিমকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, এসব উপায় হলো বাতাসের গতিবিধির মতো, যা তাদের নিয়ন্ত্রক ও সৃষ্টিকর্তার হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়, এবং আল্লাহর আদেশ বা ইচ্ছা ব্যতিত এগুলো কারো কোনো ক্ষতি করতে পারে না।জাদুকরদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন:وَمَا هُم بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِঅর্থঃ অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোন ক্ষতি করতে পারত না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। (আল বাকারা ২:১০২)وَإِن يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ ۖ وَإِن يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلَا رَادَّ لِفَضْلِهِঅর্থঃ ‘আর আল্লাহ যদি তোমাকে কোন ক্ষতি পৌঁছান, তবে তিনি ছাড়া তা দূর করার কেউ নেই। আর তিনি যদি তোমার কল্যাণ চান, তবে তাঁর অনুগ্রহের কোন প্রতিরোধকারী নেই। (ইউনুস ১০:১০৭)যারা আল্লাহর সত্যিকারের বান্দাহ, বিপদ ও সুখ উভয় সময়েই আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলেন, যাদের সব ধরনের ভয়ের কেন্দ্রবিন্দু একমাত্র আল্লাহ তা'আলা, তাদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতে:أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُঅর্থঃ আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? (আল-যুমার ৩৯:৩৬)আল্লাহর প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য ও দাসত্ব প্রয়োগ করার মাধ্যমে আসে পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা, তাদের উপর শয়তানের কোনো ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন: إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌঅর্থঃ ‘নিশ্চয় আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। (সূরা আল হিজর ১৫:৪২) যার ঈমান শক্তিশালী, সে আল্লাহর দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে এবং তারই তত্ত্বাবধানে থাকবে এবং তার জাদুটোনা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। খুবই ক্ষীণ। আর জাদুকররা নিজেরাও একথা ভালোভাবেই জানে যে, তাদের মন্ত্র দ্বারা একমাত্র দুর্বল ঈমানের ব্যক্তিরাই আক্রান্ত হবে।

৭৭. প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় আযকার তেলাওয়াত করা

জাদুটোনা থেকে বেঁচে থাকার সর্বোকৃষ্ট ও সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় আযকার তেলাওয়াত করা। কারণ এ আযকার জাদুটোনা করার আগেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এর হাত থেকে রক্ষা করে, এর প্রভাব থেকে রোগীকে বাঁচায় এবং সকল মন্দ প্রভাব দূর করে, এবং জাদুটোনায় আক্রান্ত হয়ে গেলে তার প্রতিকার করে। ইবনে কাইয়ুম (রহঃ) বলেন:জাদুটোনার জন্য সবচেয়ে কার্যকর আল্লাহ প্রদত্ত উপায়, একটি মাত্র পদ্ধতি যা সকল মন্দ প্রভাব দূর করে এবং এগুলোকে প্রতিহত ও প্রতিরোধ করে, সেটি হল যিকির, কুরআনের আয়াত ও দোয়া, এসব তেলাওয়াতের ফলে জাদুটোনার কার্যকারিতা বাতিল হয়ে যায়। এগুলো যত শক্তিশালী হবে, তত দ্রুত এরা ছড়িয়ে পড়বে। এটা দুটি সেনাবাহিনীর। মুখোমুখি হওয়ার মত, যেভাবে উভয় বাহিনী অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সজ্জিত, উভয়েরই বিপুল ক্ষমতা রয়েছে; দুই বাহিনীর মধ্যে যারা বিপক্ষ বাহিনীকে। পরাভূত করতে পারবে, তারাই বিজয়ী ঘোষিত হবে।হৃদয় ও মন যদি আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকে, নিয়মিত যদি দোয়া, যিকির পাঠ করা হয়, ক্ষতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয় এবং পূর্ণ মনোযোগে বির পাঠ করে, তাহলে জাদুটোনা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আগে এটাই হবে জাদুটোনার প্রভাব দূর করার সর্বোৎকৃষ্ট ও শক্তিশালী উপায় এবং আক্রান্ত হওয়ার পরে এটাই হবে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিকার ব্যবস্থা।জাদুকররা জানেন যে, তাদের জাদুটোনার পূর্ণাঙ্গ প্রভাব একমাত্র তাদের উপরই পড়তে সক্ষম যাদের হৃদয় দুর্বল এবং যারা সহজেই প্রভাবিত হয়, যারা নিজ ইচ্ছা ও আকাক্ষা দ্বারা পরিচালিত হয় এবং যারা সবসময় তুচ্ছ ও সামান্য বিষয় নিয়ে মেতে থাকেন। এ কারণেই যারা জাদুটোনা দ্বারা আক্রান্ত হয় তাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, অজ্ঞ ব্যক্তিগণ এবং যারা দূরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করেন অথবা আল্লাহ ও তাওহীদের প্রতি যাদের বিশ্বাস দুর্বল তারা আক্রান্ত হন এবং যারা নিয়মিত যিকির, কুরআনের আয়াত ও দোয়া পাঠ করেন না তারাও। শেষকথা, জাদুটোনার কুপ্রভাবে তারাই আক্রান্ত হন, যারা দুর্বল, সহজেই প্রভাবিত হন এবং সবসময় তুচ্ছ বিষয় নিয়েই মেতে থাকেন।তারা বলেন: ভিকটিম নিজেই জাদুটোনার আক্রমণের সুযোগ করে দেন, কারণ আমরা জানি, কোনো মানুষ যে বিষয়ের উপর বেশি মনোযোগ দেয়, সেটির প্রতিই তার মন লেগে থাকে। সুতরাং, ব্যক্তির ঝোঁক যে দিকে, সেই দিকের তাড়নায়ই সে তার মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেসব আত্মা পরাভূত হতে আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকে, শয়তানের আত্মা কেবল সেগুলোকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কারণ তাদের হৃদয় সমূহ ইতোমধ্যেই এমন কিছুর দিকে ঝুঁকে গেছে যা মন্দ আত্মাদের কার্যসাধনে খুবই সহায়ক, তারা সহজেই শয়তান ও বদ জ্বিন দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যায়। এর কারণ হলো এসব মানুষের মধ্যে কোনো আত্মিক শক্তি নেই, তারা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত নয়। সুতরাং আপনি খেয়াল করে দেখবেন, এসব মানুষের হৃদয় অন্তঃসারশূন্য, মনে কোনো শক্তি নেই, সংগ্রাম করার ক্ষমতা নেই, তাদের মন আগেই থেকেই এমন কিছুর দিকে ঝুঁকে থাকে, যার কারণে জ্বিনরা সহজেই তাদেরকে পরাভূত করে এবং জাদুকররা জাদুটোনা করে। [যাদ আল মা'আদ, ৩/১০৫]ইমাম আহমাদ ও আত-তিরমিযী আল হারিস আল আশআরী থেকে একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন, এ হাদীসে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“...আমি তোমাদেরকে আল্লাহকে স্মরণ করার নির্দেশ দিচ্ছি, কারণ আল্লাহর যিকির হল ওই ব্যক্তির দৃষ্টান্ত যাকে শত্রু ধাওয়া করেছে, আর সে-ও বাঁচার জন্য অবশেষে একটি দূর্গের ভেতরে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে বাঁচালো। একইভাবে এক ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর যিকির ব্যতিত অন্য কোনো কিছু দিয়ে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না।” [আল মুসনাদে ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণিত, ৪০৮/২০২; আত-তিরমিযী:২৮৬৭, হাদিসটি সহীহ]

৭৮. খালি পেটে আযওয়াহ [মদিনায় উৎপাদিত এক ধরনের খেজুর] খেজুর খাওয়া

ইমাম বুখারী (রাহ) তার সহীহ হাদীস গ্রন্থে আমীর বিন সাদ থেকে বর্ণনা করেন, তার পিতা সা'দ বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“যে ব্যক্তি সকালে একটি আযওয়াহ খেজুর খাবে, রাত্রি না আসা পর্যন্ত ওই দিনে সে আর কোনো বিষ অথবা জাদুটোনা দ্বারা আক্রান্ত হবে না।” [ফাতহুল বারী, ১০/২৪৯] অন্য একজন এ সম্পর্কে বলেন, “সাতটি খেজুর”।আরেক বর্ণনায় এসেছে,“যে ব্যক্তি সকালে সাতটি আযওয়াহ খেজুর খাবে, সে ওই দিনে কোনো বিষ বা জাদুটোনা দ্বারা আক্রান্ত হবে না।”যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) কথার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে নিয়মিত খালি পেটে আযওয়াহ খেজুর খাবে, তার জন্য এ খেজুর এমন ভাবে কাজ করবে, যেন তাকে জাদুটোনার টিকা দেয়া হয়েছে, জাদুটোনা অথবা কোনো বিষই তাকে ক্ষতি করতে পারবে না। কিছু আলিম এ খেজুরের একটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন, এটি খুবই গরম এবং এটি রোগ দূর করার জন্য যথেষ্ট, তবে নবী করিম (ﷺ) জাদুটোনা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার নির্দিষ্ট পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহই ভালো জানেন, ওই খেজুরে হয়তো এমন কোনো উপাদান রয়েছে যা মানুষকে বিষ ও জাদুটোনা থেকে সুরক্ষা দান করে। আমরা আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) সব কথা বিশ্বাস করি, এমনকি আমরা যদি নাও জানি, সেটি কিভাবে কাজ করে তারপরও। মদিনার খেজুরের যে বিশেষ গুণাগুণ থাকতে পারে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, কিন্তু মদিনার খেজুর যদি পাওয়া না যায় তাহলে ইনশাআল্লাহ যে কোনো খেজুরেই কাজ হবে।

৭৯. জাদুটোনা থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায় হল জাদুকরের কাছে না যাওয়া

যেহেতু যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তার জন্য কোনো উপকার জাদুকরদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না এবং যার কোনো সমস্যা নেই, তিনিও তাদের ক্ষতি থেকে নিরাপদ নন। যেসব শয়তান ও বদ জ্বিন জাদুকরদের সঙ্গে কাজ করে, তারাও বেশ ভালো করেই জানে যে, যেসব মুসলমান জাদুকরের দরজায় কড়া নাড়ে, তাদের ঈমান দুর্বল এবং আল্লাহর উপর তাদের কোনো আস্থা নেই, সুতরাং তাদের ক্ষতি করা বা তাদের ওপর আছর করা খুবই সহজ।

সেটিংস

বর্তমান ভাষা