পরিচ্ছেদ: জাদুর চিকিৎসা সম্পর্কিত কিছু তথ্য
৬৬. ভূমিকা
১. কাতাদা (রাঃ) বলেনঃ আমি সাঈদ বিন মুসাইয়্যাব (রহঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম কোন ব্যক্তি অসুস্থ হলে অথবা পুরুষত্ব হীনতার জন্যে কি ঝাড়-ফুঁক করা যাবে? তিনি বললেন, তাতে কোন নিষেধ নেই। কেননা তা দ্বারা উদ্দেশ্য হল মানুষের কল্যাণ। (ফতহুল বারীঃ ১০/২৩২)২. ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেনঃ মুসলিম পন্ডিতদের এ বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। যাদু দ্বারা যাদুর দমন করে মানুষের চিকিৎসা করাকে সাঈদ বিন মুসাইয়্যিব বৈধতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইমাম মুনী (রহঃ) এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।ইমাম শা'বী (রহঃ) বলেনঃ আরবী ভাষায় ঝাড়ফুঁক হলে কোন দোষ নেই; কিন্তু হাসান বসরী (রাহেমাহুল্লাহ) তা মাকরূহ বলেছেন। (কুরতুবীঃ ২/৪৯)৩. ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেনঃ যাদুর চিকিৎসক যদি কুরআনের আয়াত অথবা কোন যিকিরের মাধ্যমে অথবা এমন বাক্য দ্বারা চিকিৎসা করে যে, যাতে কোন কুফুরির বিষয় নেই তবে কোন বাধা নেই; কিন্তু তা যদি যাদু দ্বারাই হয়ে থাকে তবে তা হতে ইমাম আহমদ (রহঃ) বিমূখ হয়েছেন। (আলমুগনীঃ ১০/১১৪)৪. হাফেয ইবনে হাজার (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ নবী (ﷺ)-এর বাণীঃالنشرة من عمل الشيطانঅর্থাৎ “ঝাড়ফুঁক শয়তানী কর্মের অন্তর্ভুক্ত।” (মুসনাদে আহমদ ও আবু দাউদ) এর উদ্দেশ্য হলো মৌলিকভাবে এটিই, তবে যার উদ্দেশ্য ভাল তাতে কোন দোষ নেই। ইবনে হাজার আরো বলেনঃ ঝাড়ফুঁক দু'ধরণেরঃপ্রথমঃ জায়েয ঝাড়ফুঁকঃ এ পদ্ধতি হলো, যা কুরআন ও শরীয়তসম্মত দোয়ার দ্বারা যাদুর চিকিৎসা করা।দ্বিতীয়ঃ হারাম ঝাড়ফুঁকঃ এ প্রকার হলো, যার মাধ্যমে যাদুকে যাদু দ্বারা নষ্ট করা হয়। অর্থাৎ যাদু নষ্ট করার জন্য শয়তানকে খুশী করা হয় এবং তার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করে তার সাহায্য কামনা করা হয়। আর রাসূল (ﷺ)-এর হাদীসঃالنشرة من عمل الشيطانঅর্থাৎ “ঝাড়ফুঁক শয়তানের কর্মের অন্তর্ভুক্ত।” সাধারণত এদিকেই ইঙ্গিত করে। এজন্যে নবী করীম (ﷺ) কয়েক হাদীসে গণক ও যাদুকরের নিকট যেতে নিষেধ করেন এবং তা কুফরী সাব্যস্ত করেন।
৬৭. যাদু শিক্ষা করা কি বৈধ?
১. হাফেয ইবনে হাজার (রাহেমাহুল্লাহ) বলেন যে, আল্লাহর বাণীঃإِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْঅর্থঃ “আমরা তোমাদের জন্যে পরীক্ষা স্বরূপ। সুতরাং তোমরা কুফুরি করো না।” (সূরা বাকারাঃ ১০২) এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যাদু শিক্ষা করা কুফর। (ফতহুল বারীঃ ১০/২২৫) ২. ইবনে কুদামা (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ যাদু শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেয়া নিষিদ্ধ এবং সকল আহলে ইলমও একথায় একমত যে, তা হারাম। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহেমাহুল্লাহ)-এর অনুসারীগণ বলেন যাদু শিখলে ও শিখালে কাফের হয়ে যায়। সে যদিও যাদুকে অবৈধ বলে বিশ্বাস করে। (আল-মুগনীঃ ১০/১০৬)৩. ইমাম আবু আব্দুল্লাহ রাযি (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ যাদুর বিষয়ে শিক্ষা নেয়া ঘৃণিতও নয় নিষিদ্ধও নয়। কেননা সকল বিজ্ঞ পন্ডিতদের এই বিষেয় ঐক্যমত রয়েছে যে, জ্ঞানার্জন সাধারণভাবে বৈধ। যেমনঃ আল্লাহর বাণীঃقُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَঅর্থঃ বলোঃ “জ্ঞানী ও মূর্খ কি এক সমান?” (সূরা যুমারঃ ৯) আরেকটি বিষয় হল যে, যদি যাদু সম্পর্কে ধারণা না থাকে তবে আমরা যাদু ও মু'জেযার মধ্যে পার্থক্য কিভাবে করতে পারব। এই পার্থক্য নির্ণয় করার জন্যে এ বিষয়ে জানা প্রয়োজন। তাই যাদুর ইলম হাসিল করা নিষিদ্ধ হতে পারে না।৪. ইবনে কাসীর (রাহেমাহুল্লাহ) উপরোক্ত ইমাম রাযীর (রহঃ) অভিমত সম্পর্কে বলেনঃ কতগুলো কারণে তা গ্রহণীয় নয়। প্রথমতঃ যদি এই অভিমতকে বুদ্ধিভিত্তিক ও যৌত্তিক হিসেবে গ্রহণ করা হয় যে, যাদু শিক্ষা কোন খারাপ বিষয় নয় তবে কথা হল যে, মু'তাযিলা যারা যুক্তিকে প্রাধান্য দেয় তাদের কাছে যাদু শিক্ষা নিষিদ্ধ। আর যদি মনে করা হয় যে, শরীয়তে কোন নিষেধ নেই তবে এর উত্তর হল যে, আল্লাহ তায়ালার বাণীঃوَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَىٰ مُلْكِ سُلَيْمَانَ ۖ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُঅর্থঃ “তারা এমন বিষয়ের আনুগত্য করল যা সুলাইমান (আঃ)-এর যুগে শয়তান পড়ত।” (সূরা বাকারাঃ ১০২) এই আয়াতে যাদু শিক্ষাকে শয়তানের বিষয় বলা হয়েছে।সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি কোন গণকের কাছে অথবা যাদুকরের কাছে যাবে সে যেন নবী (ﷺ)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করল। আল্লামা রাযীর এই কথা বলা যে যাদু নিষিদ্ধ নয় এর পক্ষে কোন সঠিক প্রমাণ নেই। আর যাদুকে মর্যাদাপূর্ণ ইলমের সাথে তুলনা করা এবং আল্লাহ তায়ালার এই বাণীঃقُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَঅর্থঃ “জ্ঞানী ও মূর্খ কি এক সমান।” (সূরা যুমারঃ ৯) প্রমাণ হিসেবে পেশ করা সঠিক নয়। কেননা এই আয়াতে শরীয়তসম্মত ইলমের বাহকদের প্রশংসা করা হয়েছে। (যাদুকরের নয়)আর এই কথা বলা যে, মুজেযাকে জানতে হলে যাদুকেও জানতে হবে সঠিক নয়, কেননা সর্বাপেক্ষা বড় মু'জেযা আমাদের নবী (ﷺ)-এর প্রতি অবতীর্ণ এই কুরআন। আর যাদু ও মু'জেযার মাঝে কোন সমঞ্জস্যতা নেই। আরও বিষয় হল যে, সাহাবা, তাবেঈন এমন সকল মুসলিমগণ মু'জেযা সম্পর্কে অবগত ছিলেন তারা যাদু সম্পর্কে ধারণা রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। (তাফসীর ইবনে কাসীরঃ ১/১৪৫)৫. আল্লামা আবু হাইয়ান স্বীয় কিতাব বাহরুল মুহীত-এ উল্লেখ করেছেন যে, যাদু যদি এমন হয় যে, তাদ্বারা শিরক করা হয় অর্থাৎ শয়তানের ও তারকার বড়ত্ব বর্ণনা ও পূজা করা হয়, তবে তা শিক্ষা করা সকলের ঐক্যমতে হারাম। তা শিক্ষা করা ও তার উপর আমল করা হারাম। অনুরূপ যদি তা দ্বারা উদ্দেশ্য করা হয় রক্তপাত, স্বামী-স্ত্রী বা বন্ধুদের মাঝে বিচিছন্ন সৃষ্টি। তা শিক্ষা করা ও তা আমল করা জায়েয নয়।আর যা কিছু ভন্ডামী ও ভেল্কিবাজী ও এ ধরণের কিছু তা শিক্ষা করাও উচিত নয়, কেননা তা ভ্রান্ত ও বাতিল যদিও তা দ্বারা খেল-তামাশা উদ্দেশ্য নেয়া হয়। (রাওয়ে বয়ানঃ ১/৮৫)উপরোক্ত সমস্ত বক্তব্যের মূল কথা হলোঃ যাদু যে প্রকারেরই হোক তার সম্পর্ক খেল-তামাশাই হোক না কেন সর্বাবস্থায় নাজায়েয।
৬৮. কেরামত, মু'জেযা ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য
আল্লামা মাযরী বলেনঃ যাদু, মুজেযা এবং কেরামতের মধ্যে পার্থক্য হল, যাদুর মধ্যে যাদুকর কিছু মন্ত্র ও কর্মের বিশেষ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বীয় স্বার্থ অর্জন করে থাকে। অন্যদিকে কেরামত হঠাৎ অলৌকিক ভাবে ঘটে থাকে। আর মুজেযা কেরামত থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের এজন্য যে, তা দ্বারা প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করা হয়।হাফেজ ইবনে হাজার (রাহেমাহুল্লাহ) ইমামুল হারামাইনের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন যে, সকলের একমত যাদু কেবলমাত্র ফাসেকের (অতি পাপী) হাত দ্বারাই প্রকাশ পায়। অন্যদিকে কেরামতের প্রকাশ কোন ফাসেকের হাতে হয় না।ইবনে হাজার (রাহেমাহুল্লাহ) আরও বলেন, সকলকেই সচেতন থাকতে হবে যে, অস্বাভাবিক ও অসাধারণ বিষয় যদি কোন শরীয়তের অনুগত কবিরা গুনাহ মুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে প্রকাশ পায় তা হবে কেরামত, অন্যথায় তা হবে যাদু। কেননা যাদু শয়তানের সাহায্যে হয়ে থাকে।নোটঃ কখনও কখনও এমনও হতে পারে যে, কোন ব্যক্তি যাদুকর নয় এমন কি যাদু সম্পর্কে কিছুই জানে না, শরীয়তের যথাযথ অনুসারীও নয় বরং বড় বড় পাপ কর্ম করে থাকে, অথবা কবর পূজারী ও বেদআতী এরপরও দেখা যায় যে, তার থেকে অলৌকিক কিছু ঘটছে।এর রহস্য হল যে, তাকে শয়তান সহযোগিতা করে থাকে যাতে সাধারণ মানুষ তার বিদআতী তরীকায় আকৃষ্ট হয়। আর লোকজন এই সুন্নাতকে ত্যাগ করে শয়তানী পদ্ধতিকে গ্রহণ করে। এ ধরণের ঘটনা অনেক, বিশেষ করে সূফী তরীকার নেতাদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।