পরিচ্ছেদ: জাদুকরের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা

৭৫

আমরা বুঝতে পারলাম যে, জাদুকররা কাফির এবং ইসলামে তাদের জন্য শাস্তির বিধান হল তলোয়ার দিয়ে শিরচ্ছেদ। ইসলাম মুসলিমদেরকে জাদুকরের কাছে যেতে নিষেধ করেছে, আমরা এখন এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করব। হাসান সনদে আল বাযার থেকে বর্ণিত হয়েছে, ইবনে আব্বাস ভাল বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়, যারা পাখির সংকেতকে শুভ অথবা অশুভ হিসেবে মেনে চলে, অথবা যারা ভবিষ্যৎ বলে অথবা নিজের ভবিষ্যৎ কাউকে দিয়ে বলায়, যারা জাদুটোনা করে অথবা নিজের জন্য জাদুটোনা করায়। যে ব্যক্তি জাদুকরের কাছে যায় এবং তার কথা বিশ্বাস করে, সে মুহাম্মাদের (ﷺ) কাছে অবতীর্ণ হওয়া আল্লাহর কিতাবকে অস্বীকার করে।” [আল তাবারনি, আল বাজ্জার থেকে জায়িদ সনদে]সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“তোমরা সাতটি পাপ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখ, যা মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে”।তারা বললেন: হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সেই গুনাহগুলো কী কী? তিনি বললেনঃ“আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার করা, জাদুটোনা করা, ইসলামী শরীয়াহ দ্বারা অনুমোদিত হত্যা ব্যতিত এমন আত্মাকে হত্যা করা যা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা এবং নির্দোষ মু'মিন নারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া।” [ফাতহুল বারি, ৫/৯৩, মুসলিম-১/৯২]এবং তিনি বলেন:“যে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ বক্তার শরণাপন্ন হবে এবং তার কথা বিশ্বাস করবে, মুহাম্মাদের (ﷺ) প্রতি অবতীর্ণ আল্লাহর কিতাব দ্বারা তার আর ভচ করার থাকবে না, অর্থাৎ এর মাধ্যমে সে কুরআনকে অস্বীকার করবে। আর যে ব্যক্তি জাদুকরের কাছে যাবে, কিন্তু তার কথা বিশ্বাস করবে না, তার চল্লিশ দিনের ইবাদত কবুল হবে না।”অনেকে বলতে পারেন: আমি তো কারো কোনো ক্ষতি করার জন্য। জাদুকরের কাছে যাই না, আমি যাই আমার উপর যে জাদুটোনা করা হয়েছে তা নিরাময়ের জন্য। আমরা তাদেরকে বলব: আপনাদের অবস্থা ওই ব্যক্তির মতো, যে নিজেকে আগুনে নিক্ষেপ করে মরুভূমির তাপদাহ থেকে বাচার প্রার্থনা করে।অনেক সময় জ্বিনরাও জাদুকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে এবং তাকে এমন অসুস্থ বানিয়ে দেয়, যার জন্য কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না।জ্বিন ও শয়তান মিলে অনেক সময় জাদুকরকে চরম বিপদে ফেলে দেয়। এবং তাকে কোনো সাহায্য করে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন:وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنسَانِ خَذُولًاঅর্থঃ আর শয়তান তো মানুষের জন্য চরম প্রতারক’। (সূরা আল ফুরকান ২৫:২৯)জ্বিনরা অনেক সময় জাদুকরকে তার কাছে চিকিৎসার জন্য আসা। নারীর সঙ্গে অনৈতিক কাজ করতে বলে অথবা ওই নারীর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে রক্ত দিয়ে লেখতে বলে।জাদুটোনা অনেক সময় ঈপ্সিত ফলাফলের বিপরীত ফল এনে দেয়, তাই দেখা যায় অনেকে জাদুটোনা করান নিজের উপকারের জন্য, কিন্তু এর পরিসমাপ্তি ঘটে যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, সে নিজেই এর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যায়। অনেক নারী তাদের স্বামীদের ওপর জাদুটোনা করান, যাতে স্বামীরা তাদেরকে ভালোবাসেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ না করেন, কিন্তু জাদুটোনার ফল হয় বিপরীত, দেখা যায় জাদুটোনার প্রভাবে স্বামী তাকে ভালোবাসার পরিবর্তে তালাক দিয়ে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: وَلَا يَحِيقُ الْمَكْرُ السَّيِّئُ إِلَّا بِأَهْلِهِঅর্থঃ কু-চক্রান্ত তাকেই ঘিরে ধরবে যে তা করবে। (সূরা ফাতির ৩৫:৪৩)অনেক সুস্থ সবল নারী-পুরুষও জাদুকরের কাছে যান, আর তখন। জাদুকর জ্বিনকে দিয়ে তাদের মাঝে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে, যাতে করে এর মাধ্যমে সে তাদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে।জ্বিন ও শয়তানের দাবি থাকে অনেক এবং তাদের এসব দাবি মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়। অনেক সময় তারা একটি নির্দিষ্ট প্রাণী। উৎসর্গ করার দাবি করে, পোষা মোরগ অথবা কবুতর জবেহ করতে বলে, আবার এ জবেহ-র ক্ষেত্রে থাকে কঠিন কিছু শর্ত, এ প্রাণীর রক্ত রোগীর দেহে মালিশ করতে বলা হয়।অথবা তারা অসুস্থ রোগীকে এমন এক নির্জন কক্ষে জনবিচ্ছিন্ন করে রাখার দাবি করে, যেখানে চল্লিশ দিনেও সূর্যের আলো প্রবেশ করবে না অথবা নির্দিষ্ট একটি সময় ধরে রোগীকে পানি স্পর্শ না করার পরামর্শ দেয়, এভাবে তাদের চাহিদার কোনো শেষ নেই। প্রত্যেক অঞ্চলেই জ্বিন তার নিজস্ব দাবি তুলে ধরে, ওই দাবি ওই এলাকায় অদ্বিতীয়। মিশরে আবূ হাশিমাহ নামে একটি পরিত্যক্ত কুপ রয়েছে, জাদুকররা বন্ধ্যা নারীদেরকে জুমআর দিন মাগরিবের পরে এখানে গোসল করার জন্য পাঠায়। এ পরিত্যক্ত কুপে অনেক জ্বিন রয়েছে, যারা নারীদের গোসল করার দৃশ্য উপভোগ করে। এক্ষেত্রে কোনো জ্বিন কোনো নারীর দ্বারা আকৃষ্ট হতে পারে এবং তার সঙ্গে যৌন মিলনও করতে পারে। যে দরিদ্র লোকটি তার স্ত্রীকে বন্ধ্যাত্ব থেকে নিরাময়ের জন্য এ কুপে নিয়ে আসেন, তিনি আসলে ভুলে যান যে, প্রজনন ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই নিয়ন্ত্রণ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:يَهَبُ لِمَن يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَن يَشَاءُ الذُّكُورَ ﴿٤٩﴾ أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا ۖ وَيَجْعَلُ مَن يَشَاءُ عَقِيمًا ۚ إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ ﴿٥٠﴾অর্থঃ তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। (সূরা আল-শুরা ৪২:৪৯-৫০)শয়তান ও জ্বিনের চাহিদা সীমাহীন। আল্লাহ তা'আলা এ প্রসঙ্গে বলেন;وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِّنَ الْإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِّنَ الْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًا ﴿٦﴾অর্থঃ আর নিশ্চয় কতিপয় মানুষ কতিপয় জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা তাদের অহংকার বাড়িয়ে দিয়েছিল। (সূরা জ্বিন ৭২:৬)শায়খ হাফিজ আল হুকামি (রহঃ) বলেন: জাদুটোনা করে জাদুর ক্রিয়া নষ্ট করাও হারাম, কারণ এটা জাদুটোনাকে সমর্থন ও সহায়তা করার শামিল, এবং ভিকটিমের উপর থেকে শয়তানের কার্যকারিতা নষ্ট করার জন্য এভাবেই মানুষ শয়তানের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। এ কারণেই আল হাসান বলেন: জাদুকর ছাড়া আর কেউই জাদুটোনাকে সমর্থন করেন না।জাদুকররা যখন দেখল তাদেরকে বাধা দেয়ার জন্য তলোয়ার নিয়ে দাড়ানোর কেউ নেই, তখনই তারা আরো বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে মানুষকে জাদুটোনা করতে শুরু করল, মানুষ একে পছন্দ করুক বা না করুক, তাদেরকে জাদুটোনা করাতে বাধ্য করে এবং এর মাধ্যমে তাদের সম্পদ হাতিয়ে নেয়, সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। করে এবং পাশপাশি ভিকটিমকে বিপথগামী করে দেয়। [মাআরিজুল কুকূল ১/৫৩০]উপরোক্ত সব কথাবার্তার পরে, আমরা তাওহীদের উম্মাহ, কুরআনের অনুসারী উম্মাহ ও মুহাম্মাদের (ﷺ) উম্মাকে, ঈমানে অটল মু'মিনদেরকে বলতে চাই যে, জাদুকর নিজে কাফির, আর তার কর্ম কুফরি। তার কোনো। সুবিধা দেয়া বা ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই, তার জীবন দেয়া বা মৃত্যু দান। করা অথবা মৃত্যুর পরে পুনরুত্থিত করার ক্ষমতা নেই। তার অদৃশ্য সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। আর যেসব জ্বিন এ জাদুকরদের সেবা করে তারা কাফির ও বিদ্রোহি, কারণ জ্বিনদের মধ্যে যারা ঈমানদার, তারা মানুষের মধ্যে যারা ঈমানদার তাদেরকেই পছন্দ করে, তারা কারো হাতে পরাভূত ও দাস হতে চায় না।হে কুরআনের উম্মাহ, আপনারা জাদুকরদের অবস্থার দিকে একবার লক্ষ্য করুন। তারা অর্থের জন্য ভিক্ষা করে, তার অসুস্থ মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়, সুতরাং তারা আপনাকে কিভাবে ধনী বানাবে? যেহেতু ইসলাম জাদুকরের কাছে যাওয়ার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, সেহেতু এর বিকল্প কোনো পথ কি আছে? আমরা বলব: হ্যা, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের (ﷺ) হাদীসে একটি বিকল্প রয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা জাদুটোনার ক্রিয়া নষ্ট এবং জাদুটোনার চিকিৎসা করার ইসলামী পদ্ধতি আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

সেটিংস

বর্তমান ভাষা