পরিচ্ছেদ: জ্বিন সম্পর্কে মানুষের অযৌক্তিক ভয়ের চিকিৎসা

৪৪. তাওহীদ

সকল ‌ইবাদত, ইসলামের বিভিন্ন প্রথা বা অভ্যাস পুনর্জাগরিত করা এবং সকল ভালো ও মন্দ একমাত্র আল্লাহর হাতে মানুষকে এ কথা শিক্ষা। দেয়ার মূল ভিত্তি হল মানুষকে তাওহীদের দিকে আহবান করা।আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কোন সৃষ্টি তা সে যত বড়ই হোক না কেন কারো জন্য কোনো উপকার বা ক্ষতি বয়ে আনতে পারে না, এ ক্ষমতা তার নেই। কারো ভালো করা বা ক্ষতি করার ক্ষমতা একমাত্র মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা'আলার হাতে।আল্লাহ তা'আলা বলেন:قُل لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي ضَرًّا وَلَا نَفْعًا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۗঅর্থঃ বল, ‘আমি নিজের ক্ষতি বা উপকারের অধিকার রাখি না, তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন’। (ইউনুস ১০:৪৯)قُلْ فَمَن يَمْلِكُ لَكُم مِّنَ اللَّهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ بِكُمْ ضَرًّا أَوْ أَرَادَ بِكُمْ نَفْعًا ۚঅর্থঃ ‘আল্লাহ যদি তোমাদের কোন ক্ষতি করতে চান কিংবা কোন উপকার করতে চান, তবে কে আল্লাহর মোকাবিলায় তোমাদের জন্য কোন কিছুর মালিক হবে’? (আল ফাতহ ৪৮: ১১)وَإِن يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ ۖঅর্থঃ আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোন দুর্দশা দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ছাড়া তা দূরকারী কেউ নেই। (আল আনআম ৬: ১৭)إِن يُرِدْنِ الرَّحْمَٰنُ بِضُرٍّ لَّا تُغْنِ عَنِّي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا وَلَا يُنقِذُونِ ﴿٢٣﴾অর্থঃ যদি পরম করুণাময় আমার কোন ক্ষতি করার ইচ্ছা করেন, তাহলে তাদের সুপারিশ আমার কোন কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধারও করতে পারবে না’।(ইয়াসিন ৩৬:২৩)উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা'আলার হাতে কেউ যদি পবিত্র কুরআনের এ বিশুদ্ধ ও পবিত্র শিক্ষায় বিশ্বাস করে, এ বিশ্বাস যদি তাদের মনে গভীরভাবে প্রোথিত হয়, তাহলে তার মধ্যে থেকে জ্বিন, মানুষ ও সকল সৃষ্টি সম্পর্কিত সকল ভয় দূর হয়ে যাবে।এ কারণেই কুরআন বিভিন্ন আয়াতে আমাদের একমাত্র আল্লাহ তা'আলাকেই ভয় পাওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।আল্লাহ তা'আলা বলছেন:إِنَّمَا ذَٰلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ ﴿١٧٥﴾অর্থঃ সে তো শয়তান। সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়। তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, বরং আমাকে ভয় কর, যদি তোমরা মুমিন হও। (আল ইমরান ৩:১৭৫)فَاللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَوْهُ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَঅর্থঃ তোমরা যাকে ভয় করবে তার সবচেয়ে বেশি হকদার হলেন আল্লাহ যদি তোমরা মু'মিন হয়ে থাক। (আত-তাওবাহ ৯:১৩)وَأَوْفُوا بِعَهْدِي أُوفِ بِعَهْدِكُمْ وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِঅর্থঃ তোমরা আমার অঙ্গীকার পূর্ণ কর, তাহলে আমি তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করব। আর কেবল আমাকেই ভয় কর। (আল বাকারাহ ২:৪০)এ কারণেই বিদ্বান ও ফকিহগণ বলেছেন, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় পাওয়া এক ধরনের শিরক, কুরআন ও হাদীসের আলোকে যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।মুসলিমগণ প্রতিদিন কালিমা পাঠ করেন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সুতরাং তাদের উপলব্ধি করা উচিত যে, তারা আল্লাহর সৃষ্ট জীবকে ঘিরে যে সব ভয়ের মুখোমুখি হন, তার উপর এ কালিমার একটি প্রভাব রয়েছে।যিনি তাওহীদে বিশ্বাস করেন এবং এর উদ্দেশ্য ও ফলাফল সম্পর্কে সচেতন, তিনি কখনো আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় পেতে পারেন না, কারণ যখনই তিনি বলেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য বা ইলাহ নেই, তখনই তিনি বুঝতে পারেন, আল্লাহ ব্যতীত স্বস্তির আর কোনো উৎস নেই, তিনি ব্যতীত আর কারো উপরে আস্থা রাখা যায় না, আর কারো কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা যায় না, তিনিই একমাত্র সার্বভৌম, তাঁরই আনুগত্য করতে হবে, তিনি ব্যতীত আর কারো কাছেই প্রতিরক্ষার প্রার্থনা করা যাবে না, তিনিই একমাত্র শাসক এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ‌ইবাদত করা যাবে না। এ ঘোষণা, এ বিশ্বাস থেকে বিন্দুমাত্র নড়চড় বা বিচ্যুতি ঘটলে তা শিরক বলে গণ্য হবে। আর এ শিরক্ কুরআন ও হাদীসের আলোকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, এমনকি যদি কেউ নিয়মিত সালাত ও রোযা পালনও করে। আল্লাহর কাছে (উবুদিয়াহ্‌) নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ না করা পর্যন্ত, একমাত্র তাকেই ভয় করা এবং জ্বিন অথবা মানুষ অথবা অন্য যে কোনো সৃষ্ট জীবের ভয় থেকে নিজেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত কেউ তাওহীদের প্রতি সত্যিকারের বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না।

৪৫. এ উপলব্ধি অর্জন করা যে, শয়তানের ষড়যন্ত্র খুবই দুর্বল

আল্লাহ তা’আলা বলেন:إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًاঅর্থঃ নিশ্চয় শয়তানের চক্রান্ত দুর্বল। (আন-নিসা ৪:৭৬)এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, হাদীসটির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সর্বসম্মতি রয়েছে, আবু কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“ভালো স্বপ্ন আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর খারাপ স্বপ্ন আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। কেউ যদি স্বপ্নে অপ্রীতিকর কিছু দেখে, সে যেন তার বাম দিকে তিনবার থুথু নিক্ষেপ করে এবং শয়তানের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তাহলে এটা আর তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।” [সহীহুল বুখারী ৩২৯২, ৫৭৪৭, ৬৯৮৬, ৬৯৯৫, মুসলিম ২২৬১]আত-তাবারি (রহ) বলেন: এ হাদীস অনুসারে, বাম দিকে তিনবার থুথু নিক্ষেপের মানে হল শয়তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা, কারণ যখনই কোনো ময়লা বস্তু আমরা দেখি অথবা এর কথা মনে আসে তখনই আমরা থুথু নিক্ষেপ করি, আর শয়তানের চেয়ে নিকৃষ্ট কিছু তো নেই। তাই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) খারাপ স্বপ্নের কথা মনে আসা মাত্রই শয়তানের উদ্দেশ্যে থুথু নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়েছেন। থুথু ফেলার জন্য ডান দিকের বদলে বাম দিক উল্লেখ করার কারণ হতে পারে এরকম, যে দিক থেকে মানুষকে খারাপ কাজের জন্য ডাকা হয়, শয়তান আদম সন্তানের কাছে সে দিক থেকেই আগমন করে। আল হাকীম আল তিরিমিযি (রহ) বলেন: এ থুথু গিয়ে শয়তানের মুখের উপর পড়ে এবং সেখানে ফোস্কার মতো চিহ্ন এঁকে দেয়। আপনি যখন বাম দিকে থুথু নিক্ষেপ করবেন এবং একই সঙ্গে আল্লাহর কাছে শয়তানের হাত থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবেন, তখন আপনার জন্য শয়তানের আনা ওয়াসওয়াসা বাতিল হয়ে যাবে। রাবি বিন খুসাইয়াম (রহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কেউ একজন তাঁর কাছে এসে বলল: আমি স্বপ্নে দেখেছি, কেউ একজন আমাকে বলছে, রাবিকে গিয়ে বল যে, তিনি জাহান্নামের অধিবাসী। এ কথা শুনে রাবি সঙ্গে সঙ্গে তার বাম দিকে তিনবার থুথু নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন, আমি আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।পরবর্তী রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, এক ব্যক্তি একটি কুকুর নিয়ে এসে তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল, কুকুরটির গলায় রশি লাগানো, আর কপালে ফোস্কা পড়া। ওই লোকটি বলল: এটা হল সেই শয়তান যে তোমার স্বপ্নে আল রাবিকে দেখিয়েছে এবং এর কপালে যেসব ফোস্কা দেখতে পাচ্ছ, সে গুলো আল রাবির বাম দিকে তিনবার থু থু নিক্ষেপ করার ফল। [মাসাইব আল ইনসান মিন মাকাঈদুশ শায়তান, পৃ-১৪২]ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) হল এর ছায়া দেখামাত্রই শয়তান পালিয়ে যেত এবং রাস্তাঘাটে তার সঙ্গে দেখা হলেই শয়তান ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। এ রকম পরিস্থিতিতে ওমর (রাঃ) কখনো অন্য কোনো পথে যেতেন না, বরং শয়তান নিজেই ভয় পেয়ে ভিন্ন পথ ধরত। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে এক ব্যক্তি বাইরে বের হলেন, পথে তার সঙ্গে এক জ্বিনের দেখা। জ্বিন তাকে বলল: “তুমি কি আমার সঙ্গে কুস্তি লড়বে? এ কথা শুনেই ওই ব্যক্তি জ্বিনকে ধরে মাটিতে এক আছাড় মারলেন, অতঃপর তিনি বললেন: আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি খুবই ছোট এবং তোমার কুকুরের মতো চার বাহু রয়েছে, সকল জ্বিন কি তোমার মতোই দেখতে? নাকি তুমি তাদের মতো দেখতে? সে বলল: “আপনি কি আয়াতুল কুরসী তেলাওয়াত করেন?” কারণ কেউ যখন তার ঘরে প্রবেশ করার সময় আয়াতুল কুরসি পাঠ করেন, তখন শয়তান তার প্রবেশের আগেই ঘর থেকে গাধার মতো চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে যায়। এ সময় আবদুল্লাহ বিন মাসউদকে জিজ্ঞেস করা হল: ওই ব্যক্তি কি ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) ছিলেন? তিনি বললেন: “ওমর (রাঃ) ছাড়া আর কে হতে পারে?” [পূর্বোক্ত, পৃ-৫৬]

৪৬. সকল জ্বিনই খারাপ নয়

সকল জ্বিনই দেখতে কুৎসিত ও কালো নয়, যেভাবে তাদেরকে বিভিন্ন গল্পে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে এবং এর মাধ্যমে ভয় দেখানো হয়ে থাকে। কিছু জ্বিন রয়েছে যারা মানুষের চেয়েও বেশি সৎকর্ম করে থাকে, আবার কিছু জ্বিনের মাঝে বিশ্বাস, দয়া এবং অন্যদেরকে আল্লাহর পথে ডাকার মতো চমৎকার রেকর্ডও রয়েছে, যেমনটি সূরা জ্বিনের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, একদল জ্বিন আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) সুললিত কণ্ঠের কুরআন তেলাওয়াত মনোযোগ দিয়ে শুনত এবং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ফিরে গিয়ে তার লোকদেরকে সতর্ক করতেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন:قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِّنَ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا ﴿١﴾ يَهْدِي إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ ۖ وَلَن نُّشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَدًا ﴿٢﴾অর্থঃ বল, ‘আমার প্রতি ওহী করা হয়েছে যে, নিশ্চয় জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শুনেছে। অতঃপর বলেছে, ‘আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি, যা সত্যের দিকে হিদায়াত করে; অতঃপর আমরা তাতে ঈমান এনেছি। আর আমরা কখনো আমাদের রবের সাথে কাউকে শরীক করব না’। (আল জ্বিন ৭২:১-২)وَإِذْ صَرَفْنَا إِلَيْكَ نَفَرًا مِّنَ الْجِنِّ يَسْتَمِعُونَ الْقُرْآنَ فَلَمَّا حَضَرُوهُ قَالُوا أَنصِتُوا ۖ فَلَمَّا قُضِيَ وَلَّوْا إِلَىٰ قَوْمِهِم مُّنذِرِينَ ﴿٢٩﴾অর্থঃ আর স্মরণ কর, যখন আমি জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তারা কুরআন পাঠ শুনছিল। যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হল, তখন তারা বলল, ‘চুপ করে শোন। তারপর যখন পাঠ শেষ হল তখন তারা তাদের কওমের কাছে সতর্ককারী হিসেবে ফিরে গেল। (আল-আহকাফ ৪৬:২৯) কিছু জ্বিন মানুষের চেয়েও অধিক আল্লাহভীরু ও ঈমানদার। কিছু জ্বিন অন্যদেরকে আল্লাহর পথে আহ্বান জানায়, আবার কিছু জ্বিনের রাসূল (ﷺ)-এর হাদীস সম্পর্কে রয়েছে ব্যাপক জ্ঞান। শায়খুল ইসলাম তক্বিউদ্দিন ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ) তার আল ফুরকান আল কাবির গ্রন্থে এ কথা বলেন।দূরবর্তী কোনো অঞ্চলের রাজা বা গভর্নর, অথবা কোনো কাফির যিনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন এবং তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছেন, মৃত্যুকে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছেন, তখন ওই ব্যক্তির কাছে এক জ্বিন আসবে মানুষের বেশ ধারণ করে। সে এসে তাকে পানি পান করাবে এবং তাকে ইসলামের পথে আহবান জানাবে। ফলে ওই ব্যক্তি মুসলিম হবে এবং ওই মানুষরূপী জ্বিনকে বলবে: “কে তুমি?” জবাবে সে বলবে: “আমি অমুক”।তিনি এ বর্ণনার সমর্থনে তার নিজের জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া আরেকটি গল্পের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:ঠিক এরকম একটি ঘটনা সিটাডেলে ঘটেছিল। আমি সিটাডেলে থাকাকালে পূর্বাঞ্চলে এক তুর্কি যুবরাজের জীবনে এরকমটি ঘটেছিল। এক ব্যক্তি এসে যুবরাজকে বলল: আমি ইবনে তাইমিয়্যাহ, আর যুবরাজও তার এ কথায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ করলেন না। মারাদীনের রাজাকে এ কথা জানানো হলে তিনি এ সংবাদ পাঠালেন মিসরে, তখন আমি একটি কূপে বন্দী ছিলাম। মিসরের লোকেরা এ কথা শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল, কারণ তারা আমাকে কূপ থেকে বের হয়ে যেতে দেখেনি। আসলে ওই ব্যক্তি ছিল জ্বিন, সে আমাদেরকে ভালোবাসত, আর সে কারণেই আমি তুর্কিদের জন্য যা যা করতাম সেও তাই করত। যখন তারা দামেস্কে আসত, আমি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতাম, এবং তাদের মধ্যে কেউ যদি শাহাদাতাইন উচ্চারণ করত, আমরা তাকে আমাদের সাধ্য মতো সবকিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করতাম। আমি যা যা করতাম, ওই জ্বিনটিও ঠিক তাই করত। অনেক লোক এসে আমাকে বলত: এরকম কি হতে পারে না যে, ওই লোকটি আসলে ফেরেশতা? আমি বললাম: না, কারণ একজন ফেরেশতা কখনো মিথ্যা বলতে পারে না, কিন্তু ওই জ্বিনটি ঠিকই বলেছে আমি ইবনে তাইমিয়্যাহ, মিথ্যা জানার পরও সে এ কথা বলেছে। [ইবনে মুফলিহ আল হাম্বলি, মাসাইব আল ইনসান মিন মাকাঈদুল শায়তান, ১৩২-১৩৩]

৪৭. মানুষের তুলনায় জ্বিনের অবস্থান কম মর্যাদাসম্পন্ন

মুসলিমদের বোঝা উচিত যে, মানুষের তুলনায় জ্বিনের অবস্থান নিচে এবং কম মর্যাদাসম্পন্ন, এমনকি জ্বিন যদি আল্লাহ‌ভীরুও হয়। শাইখ আবু বকর আল জাযাইর (রহ) বলেন: এমনকি আল্লাহ‌ভীরু ও সৎকর্মকারী জ্বিনরাও মর্যাদার দিক থেকে মানুষের থেকে নিচু অবস্থানে, কারণ স্রষ্টা স্বয়ং বলেছেন, মানুষ হল শ্ৰেষ্ঠ ও সম্মানিত জীব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের এক আয়াতে বলেন:وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا ﴿٧٠﴾অর্থঃ আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমি তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিয্ক। আর আমি যা সৃষ্টি করেছি তাদের থেকে অনেকের উপর আমি তাদেরকে অনেক মর্যাদা দিয়েছি। (আল ইসরা ১৭:৭০) আল্লাহর নাযিলকৃত অন্য কোনো কিতাবে বা কোনো রাসূলের ঠোঁটের মাধ্যমে আল্লাহ জ্বিনদের প্রতি এরকম কোনো সম্মান প্রদর্শন করেননি, যেমনটি তিনি দিয়েছেন মানুষকে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, মর্যাদার দিক দিয়ে জ্বিন থেকে মানুষের অবস্থান উপরে। এটা অবশ্য জ্বিনদের নিজস্ব অনুভূতি থেকেও প্রকাশিত হয়েছে, নিচু মর্যাদা এবং মানুষের সামনে তাদের দুর্বলতার অনুভূতি থেকেও এটা স্পষ্ট। মানুষ যখন তাদের কাছ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তখন তারা গর্ব অনুভব করে এবং নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, কারণ এর মানে হল, তাদেরকে সম্মান করা হচ্ছে, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হচ্ছে, যদিও সত্যিকার অর্থে তারা এর উপযুক্ত নন, এর ফলে তাদের (মানুষের) পাপ ও সীমালঙ্ঘনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়, তাদের মধ্যে মিথ্যা ও কুফরি বৃদ্ধি পায়। এটা থেকেও জ্বিনদের নিম্ন মর্যাদার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।আল্লাহ তা'আলা বলেন:وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِّنَ الْإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِّنَ الْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًا ﴿٦﴾অর্থঃ আর নিশ্চয় কতিপয় মানুষ কতিপয় জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা তাদের অহংকার বাড়িয়ে দিয়েছিল। (আল-জ্বিন ৭২:৬)যখন কোনো মানুষ জ্বিনদের কাছে সাহায্য কামনা করে অথবা তাদের নেতাদের নাম নেয়ার মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করে, তখন তারা ওই ব্যক্তির আহ্বানে সাড়া দেয় এবং তার প্রয়োজন পূরণ করে। এ ঘটনা থেকেই উপরোক্ত আয়াতে এ ধারণা দেয়া হয়েছে।আল্লাহ কর্তৃক সম্মানিত আদম সন্তানের সামনে জ্বিনরা নিজেদেরকে দুর্বল ও অগুরুত্বপূর্ণ মনে করে বলেই এসব ঘটনা ঘটে থাকে। আর আল্লাহ আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছেন এসব কারণে আদম আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তার ইবাদত করেছে, তার একত্ববাদ ও প্রভুত্বের ঘোষণা দিয়েছে, একমাত্র তাঁরই ইবাদত করেছে এবং তার নামসমূহ ও গুণাবলীর ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু মানুষের মাঝে যদি এ বিশ্বাস না থাকে, তাহলে আল্লাহ‌ভীরু ও সৎকর্মকারী জ্বিনরা আদম সন্তানদের মধ্যে যারা কাফের ও মুশরিক তাদের থেকে শ্রেষ্ঠ মর্যাদা লাভ করবে। [আবু বকর জাবির আল জাযাইরী (রহ), আকীদাতুল মুমিন, পৃ ২২৮]

৪৮. জ্বিন সম্পর্কিত গল্পের প্রচারের ক্ষেত্রে সতর্কতা

জ্বিন সম্পর্কিত গল্পের প্রচার বা অন্যদের কাছে ছড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। ভালো হয়, এসব বিষয়ে কথা না বলেই, বিশেষ করে সাধারণ মানুষ, নারী ও শিশুদের মাঝে এসব গল্প বলা যাবে না, কারণ এসব গল্প এমন এক জগতকে নিয়ে, যা আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। জ্বিনরাও অনেক মিথ্যা কথা বলে, তাই আমরাও নিশ্চিত হতে পারি না যে, আসলে জ্বিন সত্য বলছে না মিথ্যা বলছে। সুতরাং এসব গল্প মানুষের মাঝে না ছড়ানোই ভালো। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) মানুষের স্বপ্নের মাঝে মানুষকে নিয়ে শয়তান যে খেলা করে সে সম্পর্কেও কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন।জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা এক বেদুঈন আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) কাছে এসে বলল: হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমার মাথা কেটে আলাদা করে মাটিতে গড়িয়ে দেয়া হয়েছে, আর আমি আমার মাথার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছি। এ কথা শুনে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বেদুঈনকে বললেন:“তোমার এ স্বপ্নে শয়তান তোমার সঙ্গে যেভাবে খেলা করেছে সে কথা তুমি অন্য কারো কাছে প্রকাশ কর না।”এবং তিনি বললেন: আমি এক বক্তব্যে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে,“স্বপ্নের মাঝে শয়তান তোমাদের সঙ্গে যে খেলা করে, সে কথা কখনো অন্যের কাছে বলবে না।” [সহীহ মুসলিম, ২২৬৮]

৪৯. সুরক্ষার জন্য অভিভাবক হিসেবে ফেরেশতা রয়েছেন

মুসলমানদের আরো উপলব্ধি করা উচিত যে, আল্লাহ তা'আলা মানুষের সুরক্ষার জন্য অভিভাবক হিসেবে ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন। এ ফেরেশতারা মানুষকে দিবা-রাত্রি সর্বক্ষণ পাহারা দিয়ে জ্বিনদের অনিষ্ট এবং মানুষের অদৃশ্যমান অন্য যে কোনো ধরনের ক্ষয়-ক্ষতি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন:لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِّن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللَّهِঅর্থঃ মানুষের জন্য রয়েছে, সামনে ও পেছনে, একের পর এক আগমনকারী প্রহরী, যারা আল্লাহর নির্দেশে তাকে হেফাযত করে। (আর-রাদ ১৩:১১)এ পাহারার বিষয়ে স্কলারদের দুটি অভিমত রয়েছে:প্রথম অভিমত, আল্লাহ তা'আলা তাঁর অপরিসীম দয়া থেকে প্রত্যেক। মানুষের জন্য ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন, এ ফেরেশতার কাজ হলো মানুষকে বুনো প্রাণী ও জীবজন্তু এবং ক্ষতিকর বস্তু থেকে সুরক্ষা প্রদান করা। দ্বিতীয় অভিমত, তারা মানুষকে জ্বিনদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে। আল দাহ্হাক (রহ) বলেন: তারা মানুষকে জ্বিনদের কাছ থেকে রক্ষা করে, যদি না তার বিরুদ্ধে কোনো আদেশ জারি হয়ে থাকে।কা'ব (রহ) বলেন: আল্লাহ যদি তোমাকে তোমার খাদ্যে, তোমার পানীয়ে এবং তোমার আরওয়াহ্-তে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা না করতেন, তাহলে জ্বিনরা তোমার অনেক ক্ষতি করত। [আল-কুরতুবী, ৯/১৯২-১৯৩]আল্লাহ তা'আলা বলেন:وَيُرْسِلُ عَلَيْكُمْ حَفَظَةًঅর্থঃ আর তিনিই নিজ বান্দাদের উপর ক্ষমতাবান এবং তোমাদের উপর প্রেরণ করেন হিফাযতকারীদেরকে। (আল-আন'আম ৬:৬১)এ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ মানুষের জন্য দিনে ও রাতে আলাদা আলাদা ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন, তারা মানুষের কর্মসমূহ লিপিবদ্ধ করে এবং মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। [আল-কুরতুবী, ৭/৬]আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে আরো বলেন:إِن كُلُّ نَفْسٍ لَّمَّا عَلَيْهَا حَافِظٌ ﴿٤﴾অর্থঃ প্রত্যেক জীবের উপরই সংরক্ষক রয়েছে। (আত-তারিকু ৮৬:৪)আবূ উমামাহ (রাঃ) বলেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“একজন মুমিনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একশত ষাট জন ফেরেশতা নিয়োগ করা হয়, তাদের কাজ হল, তার জন্য যেসব বিষয়ের এখনো আদেশ হয়নি, সেসব বিষয় থেকে তাকে রক্ষা করা। যেমন, মুমিনের একটি চোখ সাতজন ফেরেশতা পাহারা দেয়, যেমনিভাবে মৌমাছিরা মৌচাকের মধু পাহারা দেয়। কাউকে যদি তার নিজ ফন্দি বা পরিকল্পনায় কিছু মুহূর্ত ফেলে রাখা হত, তাহলে শয়তান তার অনেক ক্ষতি করত। [তাফসীর কুরতুবী ২০/৪]

সেটিংস

বর্তমান ভাষা