পরিচ্ছেদ: জ্বীন আছরের ব্যাপারে ইসলাম কি বলে
১২. জ্বীনের পরিচয়
জ্বীন আল্লাহ তা'আলার একটি সৃষ্টি। যেমন তিনি ফিরিশতা, মানুষ সৃষ্টি করেছেন তেমনি সৃষ্টি করেছেন জ্বীন। তাদের বিবেক, বুদ্ধি, অনুভূতি শক্তি রয়েছে। তাদের আছে ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা। তাদের মধ্যে আছে ভাল জ্বীন ও মন্দ জ্বীন। আল কুরআনে জ্বীনদের বক্তব্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে:وَّ اَنَّا مِنَّا الصّٰلِحُوۡنَ وَ مِنَّا دُوۡنَ ذٰلِکَ ؕ کُنَّا طَرَآئِقَ قِدَدًا ﴿ۙ۱۱﴾অর্থঃ ‘আর নিশ্চয় আমাদের কতিপয় সৎকর্মশীল এবং কতিপয় এর ব্যতিক্রম। আমরা ছিলাম বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত’। (সূরা আল জ্বীন:১১)এ গােষ্ঠির নাম জ্বীন রাখা হয়েছে, কারণ জ্বীন শব্দের অর্থ গােপন। আরবী জ্বীন শব্দ থেকে ইজতিনান এর অর্থ হল ইসতেতার বা গােপন হওয়া। যেমন আল কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:فَلَمَّا جَنَّ عَلَیۡہِ الَّیۡلُঅর্থঃ অতঃপর যখন রাত তার উপর আচ্ছন্ন হল ... (সূরা আল আনআম: ৭৬)এখানে জান্না অর্থ হল, আচ্ছন হওয়া, ঢেকে যাওয়া, গােপন হওয়া। তারা মানুষের দৃষ্টি থেকে গােপন থাকে বলেই তাদের নাম রাখা হয়েছে জ্বীন। যেমন আল্লাহ রাব্দুল আলামীন বলেন:اِنَّہٗ یَرٰىکُمۡ ہُوَ وَ قَبِیۡلُہٗ مِنۡ حَیۡثُ لَا تَرَوۡنَہُمۡঅর্থঃ নিশ্চয় সে ও তার দলবল তােমাদেরকে দেখে যেখানে তােমরা তাদেরকে দেখ না। (সূরা আল আরাফ: ২৭)জ্বীনদের সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন দিয়ে। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বলেন:وَ الۡجَآنَّ خَلَقۡنٰہُ مِنۡ قَبۡلُ مِنۡ نَّارِ السَّمُوۡمِ ﴿۲۷﴾অর্থঃ আর ইতঃপূর্বে জ্বীনকে সৃষ্টি করেছি উত্তপ্ত অগ্নিশিখা থেকে। (সূরা আল হিজর: ২৭)এ আয়াত দ্বারা আমরা আরাে জানতে পারলাম যে, আল্লাহ রাব্দুল আলামীন মানুষ সৃষ্টি করার পূর্বে জ্বীন সৃষ্টি করেছেন। ইরশাদ হয়েছে:وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ صَلۡصَالٍ مِّنۡ حَمَاٍ مَّسۡنُوۡنٍ ﴿ۚ۲۶﴾ وَ الۡجَآنَّ خَلَقۡنٰہُ مِنۡ قَبۡلُ مِنۡ نَّارِ السَّمُوۡمِ ﴿۲۷﴾অর্থঃ আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুকনো ঠনঠনে, কালচে কাদামাটি থেকে। আর ইতঃপূর্বে জিনকে সৃষ্টি করেছি উত্তপ্ত অগ্নিশিখা থেকে। (সূরা আল হিজর: ২৬-২৭)আল্লাহ তাআলা যে উদ্দেশ্যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন সে-ই উদ্দেশ্যেই জ্বীনকে সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি বলেন:وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ ﴿۵۶﴾অর্থঃ আর জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদাত করবে। (সূরা আয যারিয়াত: ৫৬)জ্বীনদের কাছেও তিনি নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছিলেন। তিনি বলেন:یٰمَعۡشَرَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ اَلَمۡ یَاۡتِکُمۡ رُسُلٌ مِّنۡکُمۡ یَقُصُّوۡنَ عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِیۡ وَ یُنۡذِرُوۡنَکُمۡ لِقَآءَ یَوۡمِکُمۡ ہٰذَا ؕ قَالُوۡا شَہِدۡنَا عَلٰۤی اَنۡفُسِنَا وَ غَرَّتۡہُمُ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا وَ شَہِدُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ اَنَّہُمۡ کَانُوۡا کٰفِرِیۡنَ ﴿۱۳۰﴾অর্থঃ ‘হে জিন ও মানুষের দল, তোমাদের মধ্য থেকে কি তোমাদের নিকট রাসূলগণ আসেনি, যারা তোমাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ বর্ণনা করত এবং তোমাদের এই দিনের সাক্ষাতের ব্যাপারে তোমাদেরকে সতর্ক করত?’ তারা বলবে, ‘আমরা আমাদের নিজদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলাম।’ আর দুনিয়ার জীবন তাদেরকে প্রতারিত করেছে এবং তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে যে, তারা ছিল কাফির। (সূরা আল আনআম: ১৩০)এ আয়াত দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, বিচার দিবসে মানুষের যেমন বিচার হবে তেমনি জ্বীন জাতিকেও বিচার ও জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে।তারা বিবিধ রূপ ধারণ করতে পারে বলে হাদীসে এসেছে। এমনিভাবে দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে বলে আল কুরআনের সূরা আন নামলে উল্লেখ করা হয়েছে।আসমানী কিতাবে যারা বিশ্বাসী-ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমান- তারা সকলে জ্বীনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। তারা কেউ জ্বীনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে না। পৌত্তলিক, কতিপয় দার্শনিক, বস্তুবাদী গবেষকরা জ্বীনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে না। দার্শনিকদের একটি দল বলে থাকে, ফিরিশতা ও জ্বীন রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়। সুন্দর চরিত্রকে ফেরেশতা আর খারাপ চরিত্রকে জ্বীন বা শয়তান শব্দ দিয়ে বুঝানাে হয়। অবশ্য তাদের এ বক্তব্য কুরআন ও সুন্নাহর সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
১৩. জ্বীনের তিন প্রকার
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এ সম্পর্কে বলেছেন, জ্বীন তিন প্রকার-১. যারা শূন্যে উড়ে বেড়ায়। ২. কিছু সাপ ও কুকুর। ৩. মানুষের কাছে আসে ও চলে যায়।(সূত্র: তাবারানী। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন, সহীহ আল জামে আস সাগীর, হাদীস নং ৩১১৪, আবু সালাবা আল খাশানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত।) (মুজামু আলফাজ আল-আকীদাহ)জ্বীন বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধারণ করতে পারে। কিন্তু তাদের একটি গ্রুপ সর্বদা সাপ ও কুকুরের বেশ ধারণ করে চলাফেরা করে মানব সমাজে। এটা তাদের স্থায়ী রূপ।
১৪. জ্বীনের অস্তিত্বে বিশ্বাস ঈমানের দাবী
একজন মুসলিমকে অবশ্যই জ্বীনের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে। যদি সে জ্বীনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, তাহলে সে মুমিন থাকবে না। জ্বীনের অস্তিত্ব স্বীকার ঈমান বিল গাইব বা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনার অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল কুরআনের প্রায় পঞ্চাশ বার জ্বীনের আলােচনা করেছেন। জ্বীনজাতির সৃষ্টি, সৃষ্টির উদ্দেশ্য, তাদের ইসলাম গ্রহণ, মানুষের পূর্বে তাদের সৃষ্টি করা, ইবলীস জ্বীনের অন্তর্ভুক্ত, সূরা আর রাহমানে জ্বীন ও মানুষকে এক সাথে সম্বােধন, নবী সুলাইমান (আঃ) এর আমলে জ্বীনদের কাজ-কর্ম করা, তাদের মধ্যে রাজমিস্ত্রী ও ডুবুরী থাকার কথা, তাদের রােজ হাশরে বিচার শাস্তি ও পুরস্কারের সম্মুখীন হওয়া ইত্যাদি বহু তথ্য আল কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উল্লেখ করেছেন। তাদের সম্পর্কে বলতে যেয়ে সূরা আল-জ্বীন নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেছেন।তাই কোন মুসলমান জ্বীনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে আল্লাহর কালামকে অস্বীকার করার মত কাজ করতে পারে না। তেমনি জ্বীনকে রূপক অর্থে ব্যবহার করার কথাও ভাবতে পারে না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা এটাই। বিভ্রান্ত ও বিলুপ্ত মু'তাযিলা ও জাহমিয়্যা সম্প্রদায় জ্বীনের অস্তিত্ব স্বীকার করে না।
১৫. জ্বীন কি মানুষকে আছর করে?
এর উত্তর হল, অবশ্যই জ্বীন মানুষকে আছর করতে পারে। স্পর্শ দ্বারা পাগল করতে পারে। মানুষের উপর ভর করতে পারে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তার জীবনের স্বাভাবিক কাজ-কর্ম ব্যাহত করতে পারে। এটা বিশ্বাস করতে হয়। তবে এ বিষয়টি কেহ অবিশ্বাস করলে তাকে কাফের বলা যাবে না। সে ভুল করেছে, এটা বলা হবে। জ্বীন যে মানুষকে আছর করে তার কিছু প্রমাণ:আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:اَلَّذِیۡنَ یَاۡکُلُوۡنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوۡمُوۡنَ اِلَّا کَمَا یَقُوۡمُ الَّذِیۡ یَتَخَبَّطُہُ الشَّیۡطٰنُ مِنَ الۡمَسِّঅর্থঃ যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় দাড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। (সূরা আল বাকারা: ২৭৫)এ আয়াত দ্বারা যে সকল বিষয় স্পষ্টভাবে বুঝা যায়: এক, যারা সুদ খায় তাদের শাস্তির ধরণ সম্পর্কে ধারণা। দুই. শয়তান বা জ্বীন মানুষকে স্পর্শ দ্বারা পাগলের মত করতে পারে। তিন, মানুষের উপর শয়তান বা জ্বীনের স্পর্শ একটি সত্য বিষয়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। চার, জ্বীন-শয়তানের এ স্পর্শ দ্বারা মানুষ যেমন আধ্যাত্নিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি শারীরিক দিক দিয়েও অস্বাভাবিক হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন:وَ مَنۡ یَّعۡشُ عَنۡ ذِکۡرِ الرَّحۡمٰنِ نُقَیِّضۡ لَہٗ شَیۡطٰنًا فَہُوَ لَہٗ قَرِیۡنٌ ﴿۳۶﴾অর্থঃ আর যে পরম করুণাময়ের যিকির থেকে বিমুখ থাকে আমি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করি, ফলে সে হয়ে যায় তার সঙ্গী। (সূরা যুখরুফ: ৩৬)এ আয়াত দ্বারা যা স্পষ্ট হল: মহান রাহমান ও রহীম আল্লাহ তাআলার জিকির থেকে বিরত থাকা জ্বীন শয়তানের স্পর্শ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার একটি কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেন:وَاذۡکُرۡ عَبۡدَنَاۤ اَیُّوۡبَ ۘ اِذۡ نَادٰی رَبَّہٗۤ اَنِّیۡ مَسَّنِیَ الشَّیۡطٰنُ بِنُصۡبٍ وَّ عَذَابٍ ﴿ؕ۴۱﴾অর্থঃ আর স্মরণ কর আমার বান্দা আইউবকে, যখন সে তার রবকে ডেকে বলেছিল, ‘শয়তান তো আমাকে কষ্ট ও আযাবের ছোঁয়া দিয়েছে’। (সূরা সাদ: ৪১)এ আয়াত দ্বারা আমরা স্পষ্টভাবে বুঝলাম:১. শয়তান নবী আইউব (আঃ) স্পর্শ করে শারীরিক রােগ-কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছিল। ২. তিনি শয়তানের স্পর্শ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ তাআলার কাছেই প্রার্থনা করেছিলেন।আল্লাহ তা'আলা বলেন:اِنَّ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا اِذَا مَسَّہُمۡ طٰٓئِفٌ مِّنَ الشَّیۡطٰنِ تَذَکَّرُوۡا فَاِذَا ہُمۡ مُّبۡصِرُوۡنَ ﴿۲۰۱﴾ۚঅর্থঃ নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে যখন তাদেরকে শয়তানের পক্ষ থেকে কোন কুমন্ত্রণা স্পর্শ করে তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। তখনই তাদের দৃষ্টি খুলে যায়। (সূরা আল আরাফ: ২০১)এ আয়াত থেকে যা বুঝে আসে তা হল: এক, যারা মুত্তাকী বা আল্লাহ ভীরু তাদেরকেও জ্বীন বা শয়তান স্পর্শ করতে পারে। তারা মুত্তাকী হয়েও জ্বীন বা শয়তানের আছরে নিপতিত হতে পারে। দুই, যারা মুত্তাকী তাদের শয়তান বা জ্বীন স্পর্শ করলে তারা আল্লাহ-কেই স্মরণ করে। অন্য কোন কিছুর দ্বারস্থ হয় না।তিন. মুত্তাকীগণ জ্বীন বা শয়তান দ্বারা স্পর্শ হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করলে তাদের সত্যিকার দৃষ্টি খুলে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন:وَ اِمَّا یَنۡزَغَنَّکَ مِنَ الشَّیۡطٰنِ نَزۡغٌ فَاسۡتَعِذۡ بِاللّٰہِ ؕ اِنَّہٗ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ ﴿۲۰۰﴾অর্থঃ আর যদি শয়তানের পক্ষ হতে কোন প্ররোচনা তোমাকে প্ররোচিত করে, তবে তুমি আল্লাহর আশ্রয় চাও। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সূরা আল আরাফ: ২০০)এ আয়াতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল:১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কেও জ্বীন-শয়তান আছর করতে পারে। ২. জ্বীন আছর করলে বা শয়তানের কুমন্ত্রণা অনুভব করলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।তিন. সূরা আল ফালাক ও সূরা আন-নাস হল জ্বীন শয়তানের আছর থেকে আশ্রয় প্রার্থনার অতি মুল্যবান বাক্য। এ আয়াতের তাফসীর দ্বারা এটা প্রমাণিত।হাদীসে এসেছে-আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, অবশ্যই শয়তান মানুষের রক্তের শিরা উপশিরায় চলতে সক্ষম। (বর্ণনায়: বুখারী ও মুসলিম) হাদীসে আরাে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন বললেন,গত রাতে একটি শক্তিশালী জ্বীন আমার উপর চড়াও হতে চেয়েছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল আমার নামাজ নষ্ট করা। আল্লাহ তার বিরুদ্ধে আমাকে শক্তি দিলেন। (বর্ণনায়: বুখারী, সালাত অধ্যায়)ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত নাসায়ীর বর্ণনায় আরাে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমি তাকে ধরে ফেললাম। আছার দিলাম ও গলা চেপে ধরলাম। এমনকি তার জিহবার আদ্রতা আমার হাতে অনুভব করলাম। এ হাদীস থেকে আমরা যা জানতে পারলাম:১. জ্বীন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কেও আছর করতে চেয়েছিল।২. জ্বীনটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামাজ নষ্ট করার জন্য তার কাছে এসেছিল।৩. ইফরীত শব্দের বাংলা অর্থ হল ভূত। জ্বীনদের মধ্যে যারা দুষ্ট ও মাস্তান প্রকৃতির তাদের ইফরীত বলা হয়।৪. জ্বীন দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোন ভয় পাননি। তিনি তার সাথে লড়াই করে পরাস্ত করেছেন।৫. জ্বীনদের শরীর বা কাঠামাে আছে যদিও তা সাধারণত আমাদের দৃষ্টিগােচর হয় না।
১৬. জ্বীন ও ভূতের মধ্যে পার্থক্য
জ্বীন আরবী শব্দ। বাংলাতেও জ্বীন শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ভূত বাংলা শব্দ। এর আরবী হল ইফরীত, বহুবচনে আফারীত। আল কুরআনে সূরা আন-নামলের ৩৯ নং আয়াতে ইফরীত কথাটি এসেছে এভাবে:قَالَ عِفۡرِیۡتٌ مِّنَ الۡجِنِّ اَنَا اٰتِیۡکَ بِہٖ قَبۡلَ اَنۡ تَقُوۡمَ مِنۡ مَّقَامِکَ ۚ وَ اِنِّیۡ عَلَیۡہِ لَقَوِیٌّ اَمِیۡنٌ ﴿۳۹﴾অর্থঃ এক শক্তিশালী জ্বীন বলল, ‘আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বেই আমি তা এনে দেব। আমি নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে শক্তিমান, বিশ্বস্ত। (সুরা নামল: ৩৯)এ আয়াতে ইফরীতুম মিনাল জ্বীন অর্থাৎ জ্বীনদের মধ্যে থেকে এক ইফরীত বা ভুত .. কথাটি এসেছে। এমনিভাবে উপরে বর্ণিত হাদীসেও ইফরীতুম মিনাল জ্বীন কথাটি এসেছে। তাফসীরবিদগণ বলেছেন, জ্বীনদের মধ্যে যারা অবাধ্য, বেয়ারা, মাস্তান, দুষ্ট প্রকৃতির ও শক্তিশালী হয়ে থাকে তাদের ইফরীত বলা হয়। (আল মুফরাদাত ফী গারিবিল কুরআন)ইফরীত শব্দের অর্থ বাংলাতে ভুত।অতএব দেখা গেল ইফরীত বা ভূত, জ্বীন ছাড়া আর কিছু নয়। সব ভূতই জ্বীন তবে সব জ্বীন কিন্তু ভূত নয়।
১৭. মানসিক রােগী আর জ্বীনে ধরা রােগীর মধ্যে পার্থক্য
অনেক সময় আমরা এ সমস্যায় পড়ে যাই। ঠিক করতে পারি না রােগটা কি মানসিক না-কি পাগল, না কি জনিরে আছর থেকে রােগ দেখা দিয়েছে। অনেক সময় তাই আমরা মানসিক-রােগীকে জ্বীনে ধরা রােগী বলে থাকি। তেমনি জ্বীনে ধরা রােগীকে মানসিক রােগী বলে চালাতে চেষ্টা করি। বিশেষ করে ডাক্তার ও মনােরােগ বিশেষজ্ঞরা কোনভাবেই জ্বীনের আছরকে স্বীকার করতে চান না। তারা এ জাতীয় সকল রােগীকে মানসিক রােগী বলে সনাক্ত করে থাকেন। পাগলামী-কে আরবীতে বলা হয় জুনুন। আর পাগল-কে বলা হয় মাজনূন। আরবীতে এ জুনুন ও মাজনুন শব্দ দুটো কিন্তু জ্বীন শব্দ থেকেই এসেছে। যেমন আল কুরআনে এসেছে:إِنۡ هُوَ إِلَّا رَجُلُۢ بِهِۦ جِنَّةࣱ فَتَرَبَّصُوا۟ بِهِۦ حَتَّىٰ حِینࣲঅর্থঃ “সে কেবল এমন এক লােক, যার মধ্যে পাগলামী রয়েছে। অতএব তােমরা তার সম্পর্কে কিছুকাল অপেক্ষা কর।” [সূরা মুমিনুন ২৩ঃ২৫]এ কথাটি নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের লােকেরা তার সম্পর্কে বলেছিল। এ আয়াতে জ্বীন্নাতুন শব্দের অর্থ হল পাগলামী। কাজেই কাউকে পাগলামীর মত অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখলে সেটা যেমন জ্বীনের আছরের কারণে হতে পারে, আবার তা মানসিক রােগের কারণেও হতে পারে। তবে এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা অভিজ্ঞতার আলােকে কিছু বিষয় নির্ধারণ করেছেন, যার মাধ্যমে মানসিক রােগী আর জ্বীনে -ধরা রােগীর মধ্যে পার্থক্য করা যায়। এগুলাে হল: ১. জ্বীনে ধরা রােগী কিছুক্ষণের জন্য বেহুশ হয়ে যায়। মানসিক রােগী বেহুশ হয়ে পড়ে না। ২. কখনাে কখনাে জ্বীনে -ধরা রােগীর মুখ থেকে ফেনা বের হয়। দাতে খিল লেগে যায়। মানসিক রােগীর মুখ থেকে ফেনা বের হয় না। ৩. জ্বীনে ধরা রােগী প্রায়ই সপ্নে সাপ, কুকুর, বিচ্ছু, বানর, শিয়াল, ইদুর ইত্যাদি দেখে থাকে। কখনাে কখনাে সপ্নে দেখে সে অনেক উচু স্থান থেকে পড়ে যাচ্ছে। ৪. জ্বীনে ধরা রােগীর সর্বদা ভীতু ভাব থাকে। সর্বদা তার ভয় লাগে। মানসিক রােগীর তেমন ভয় থাকে না। ৫. জ্বীনে ধরা রােগী নামাজ পড়া, কুরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর যিকির ইত্যাদি পছন্দ করে না। বরং এগুলাে তার অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়। ৬. জ্বীনে ধরা রােগী কখনাে কখনাে ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন ভঙ্গিতে কথা বলে। ৭. জ্বীনে ধরা রােগী অধিকাংশ সময় স্বাভাবিক থাকে। মাঝে মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ করে। ৮. জ্বীনে ধরা রােগী থেকে অনেক সময় আশ্চর্যজনক বিষয় প্রকাশ হয়ে থাকে। যেমন অল্প সময়ে সে বহু দূরে চলে যায়। গাছে উঠে সরু ডালে বসে থাকে ইত্যাদি।৯. জ্বীনে ধরা রােগীর কাছে স্বামী, ঘর-সংসার, স্ত্রী-সন্তানদের ভাল লাগে না। ১০. জ্বীনে ধরা রােগীর উপর যখন জ্বীন চড়াও হয় তখন ক্যামেরা দিয়ে তার ছবি তুললে ছবি ধোয়ার মত অস্পষ্ট হয়। দেখা গেছে আশে পাশের সকলের ছবি স্পষ্টভাবে উঠেছে কিন্তু রােগীর ছবিটি ধোয়াচ্ছন্ন। এটা কারাে কারাে নিজস্ব অভিজ্ঞতা। মনে রাখতে হবে অভিজ্ঞতা সর্বদা এক রকম ফলাফল নাও দিতে পারে। কিন্তু বড় সমস্যা হবে তখন, যখন রােগীটি নিজেকে জ্বীনে ধরা বলে অভিনয় করে কিন্তু তাকে জ্বীনে ও আছর করেনি আর সে মানসিক রােগীও নয়। সে তার নিজস্ব একটি লক্ষ্য পূরণের জন্য জ্বীনে ধরার অভিনয় করছে। এ অবস্থায় অভিভাবকের করণীয় হল, তারা তাকে তার দাবী পুরণের আশ্বাস দেবে। তাহলে তার জ্বীন ছেড়ে যাবে। পরে তার দাবীটি যৌক্তিক হলে পূরণ করা হবে আর অযৌক্তিক হলে পূরণ করা হবে না। এরপর যদি সে আবার জ্বীনে ধরার অভিনয় করে তাহলে তাকে জ্বীনে ধরা রােগী বলে আর বিশ্বাস করার দরকার নেই। অনেক সময় শারিরিক শাস্তির ভয় দেখালে এ ধরনের বাতিল জ্বীন চলে যায়।
১৮. কি কারণে জ্বীন চড়াও হয়
কিছু বিষয় রয়েছে যার উপস্থিতির কারণে মানুষকে জ্বীনে আছর করে-১. প্রেম। কোন পুরুষ জ্বীন কোন নারীর প্রেমে পড়ে যায়, অথবা কোন নারী জ্বীন যদি কোন পুরুষের প্রেমে পড়ে তাহলে জ্বীন তার ঐ প্রিয় মানুষটির উপর আছর করে। ২. কোন মানুষ যদি কোন জ্বীনের প্রতি জুলুম-অত্যাচার করে বা কষ্ট দেয় তাহলে অত্যাচারিত জ্বীনটি সেই মানুষের উপর চড়াও হয়। যেমন জ্বীনের গায়ে আঘাত করলে, তার গায়ে গরম পানি নিক্ষেপ করলে, কিংবা তার খাদ্য-খাবার নষ্ট করে দিলে জ্বীন সেই মানুষটির উপর চড়াও হয়। ৩. জ্বীন খামােখা জুলুম-অত্যাচার করার জন্য মানুষের উপর চড়াও হয়। তবে এটি পাঁচটি কারণে হতে পারে: (ক) অতিরিক্ত রাগ(খ) অতিরিক্ত ভয়(গ) যৌন চাহিদা লােপ পাওয়া(ঘ) মাত্রাতিরিক্ত উদাসীনতা।(ঙ) নােংড়া ও অপবিত্র থাকা।কারাে মধ্যে এ স্বভাবগুলাে থাকলে জ্বীন তাকে আছর করে অত্যাচার করার সুযােগ পেয়ে যায়।
১৯. জ্বীনের আছরের প্রকারভেদ
মানুষের উপর জ্বীন চড়াও হওয়ার ধরনটি চার প্রকারের হতে পারে-১. জ্বীন মানুষের পুরাে শরীরে প্রভাব বিস্তার করে কিছু সময়ের জন্য। ২. আংশিকভাবে শরীরের এক বা একাধিক অংশে সে প্রভাব বিস্তার করে কিছু সময়ের জন্য। যেমন হাতে অথবা পায়ে কিংবা মুখে। ৩. স্থায়ীভাবে জ্বীন মানুষের শরীরে চড়াও হতে পারে। এর মেয়াদ হতে পারে অনেক দীর্ঘ। চার, মানুষের মনের উপর কিছু সময়ের জন্য প্রভাব বিস্তার করে। মানুষ যখন আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা শুরু করে তখন চলে যায়।