পরিচ্ছেদ: পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পর মোনাজাত
৪৫
আমাদের দেশে বলতে গেলে ভারতীয় উপমহাদেশে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর দোয়া-মোনাজাতের প্রচলন দেখা যায়। এ বিষয় এখন কিছু আলোচনা করার ইচ্ছা করছি।পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত শেষে দোয়া কবুল হওয়ার কথা বহু সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণিত। তাহলে এ নিয়ে বিতর্ক কেন? আসলে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পর দোয়া নিয়ে বিতর্ক নয়, বিতর্ক হলো এর পদ্ধতি নিয়ে। যে পদ্ধতিতে দোয়া করা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা তাঁর সাহাবায়ে কেরাম এভাবে দোয়া করেছিলেন কি-না? তাই আমি এখানে আলোচনা করব সে দোয়া-মোনাজাত নিয়ে যার মধ্যে নিম্নোক্ত সবকটি শর্ত বিদ্যমান:১. পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পর দোয়া করা।২. যে দোয়া-মোনাজাত জামাআতের সঙ্গে করা হয়।৩. প্রতিদিন প্রতি ফরয সালাত শেষে দোয়া-মুনাজাত করা।এ শর্তাবলী বিশিষ্ট দোয়া-মোনাজাত কতটুকু সুন্নাতসম্মত সেটাই এ অধ্যায়ের মূল আলোচ্য বিষয়।পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত আদায়ের পর প্রচলিত মোনাজাত করা না করার ব্যাপারে আমাদের দেশের লোকদের সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত দেখা যায়।১. যারা সালাম ফিরানোর পর বসে বসে কিছুক্ষণ যিকর-আযকার আদায় করেন, যা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।২. যারা সালাম ফিরানোর পর যিকির-আযকার না করে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যান সুন্নাত নামায আদায়ের জন্য।৩. যারা সালাম ফিরানোর পর সর্বদা ইমাম সাহেবের সঙ্গে একত্রে মোনাজাত করেন। এবং মোনাজাত শেষ হওয়ার পর সুন্নাত সালাত আদায় করেন।আর এ তিন ধরনের লোকদেরই এ সকল আমলের সমর্থনে কোনো না কোনো দলীল প্রমাণ রয়েছে। হোক তা শুদ্ধ বা অশুদ্ধ। স্পষ্ট বা অস্পষ্ট।প্রথম দলের দলীল-প্রমাণ স্পষ্ট। তাহল বুখারী ও মুসলিমসহ বহু হাদীসের কিতাবে সালাতের পর যিকির-আযকার অধ্যায়ে বিভিন্ন যিকিরের কথা সহীহ সনদে বর্ণিত আছে, যা আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ও তার সাহাবায়ে কেরাম আমল করেছেন। অনেক ইমাম ও উলামায়ে কেরাম এ যিকির-আযকার সম্পর্কে স্বতন্ত্র পুস্তক সংকলন করেছেন।আর দ্বিতীয় দলের প্রমাণ হলো এই হাদীস: ‘আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اًللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا سَلَّمَ لَمْ يَقْعُدْ إِلَّا مِقْدَارَ مَا يَقُولُ: «اًللَّهُمَّ أَنْتَ السَّلَامُ وَمِنْكَ السَّلَامُ، تَبَارَكْتَ يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ»“নবী (ﷺ) যখন সালাম ফিরাতেন তখন আল্লাহুম্মা আনতাচ্ছালাম ওয়ামিনকাচ্ছালাম তাবারাকতা ইয়া জালজালালি ওয়াল ইকরাম পড়তে যতটুকু সময় লাগে তার চেয়ে বেশি সময় বসতেন না”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৯২]তারা এ হাদীস দ্বারা বুঝে নিয়েছেন যে, এ যিকিরটুকু আদায় করতে যতটুকু সময় লাগে এর চেয়ে বেশি বসা ঠিক নয়। তাই তাড়াতাড়ি সুন্নাত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে যেতে হবে। আসলে এ হাদীস দ্বারা তারা যা বুঝেছেন তা সঠিক নয়।হাদীসটির ব্যাখ্যা হলো, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যেহেতু ইমাম ছিলেন তাই তিনি সালাম ফিরানোর পর এতটুকু সময় মাত্র কিবলামুখী হয়ে বসতেন এরপর তিনি মুসল্লীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন। আর তিনি যে প্রত্যেক ফরয সালাতের পর মুসল্লীদের দিকে মুখ করে বসতেন তা বহু সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। [মজমু আল-ফাতাওয়া: ইমাম ইবন তাইমিয়া]এ হাদীস দ্বারা কখনো প্রমাণিত হয় না যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাম ফিরিয়ে এ দোয়াটুকু পড়ে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যেতেন সুন্নাত সালাত আদায়ের জন্য। ফরয সালাত আদায়ের পর যিকির, তাছবীহ, তাহলীল বর্জন করে তাড়াতাড়ি সুন্নাত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া মোটেও সুন্নাত নয়। বরং সুন্নাত হলো সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যিকির, দোয়া, তাছবীহ, তাহলীল সাধ্যমত আদায় করে তারপর সুন্নাত আদায় করা।তৃতীয় দল যারা ফরয সালাতের পর সম্মিলিতভাবে (জামা‘আতের সঙ্গে) মোনাজাত করেন তাদের দলীল হলো ওই সকল হাদীস যাতে সালাত শেষে দোয়া কবুলের কথা বলা হয়েছে এবং দোয়া করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ সকল হাদীস ছাড়া তাদের এ কাজের সমর্থনে হাদীস থেকে সরাসরি কোনো প্রমাণ নেই। এমন কোনো হাদীস তারা পেশ করতে পারবেন না যাতে দেখা যাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যেক সালাত জামা‘আতের সঙ্গে আদায় শেষে সকলকে নিয়ে সর্বদা হাত তুলে মোনাজাত করেছেন।তারা যে সকল হাদীস প্রমাণ হিসেবে পেশ করতে চান তার শিরোনাম হলো: الدعاء عقيب الصلوات، الدعاء دبر الصلوات“তারা মনে করে নিয়েছেন আকীবাস সালাত ও দুবুরাস সালাত অর্থ সালাম ফিরানোর পর। আসলে তা নয়। এর অর্থ হলো সালাতের শেষ অংশে। এ সকল হাদীসে সালাতের শেষ অংশে অর্থাৎ শেষ বৈঠকে দুরূদ পাঠ করার পর সালাম ফিরানোর পূর্বে দোয়া করার কথা বলা হয়েছে। পরিভাষায় যা দোয়ায়ে মাছুরা হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। সালাত শেষে দোয়া কবুল সম্পর্কে যত হাদীস এসেছে তা সবগুলো দোয়া মাছুরা সম্পর্কে। যার সময় হলো সালাম ফিরানোর পূর্বে। আর দোয়া মাছুরা শুধু একটা নয়, অনেক। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সালাতের শেষে দোয়া সংক্রান্ত এ সকল হাদীসে বাদাস সালাত বলা হয়নি। হাদীস গ্রন্থে এ সকল দোয়াকে: «الأدعياء دبر الصلوات أو الدعاء عقيب الصلاة»(সালাত শেষের দোয়া) অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দুটো বিষয়; প্রথমটা হলো সালাত শেষের দোয়া। দ্বিতীয়টা হলো সালাত শেষের যিকির। প্রথমটির স্থান হলো সালাম ফিরানোর পূর্বে। আর দ্বিতীয়টির স্থান হলো সালাম ফিরানোর পর। ইমাম ইবন তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ ইবনুল কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ প্রমুখ উলামায়ে কেরামের মত এটাই।এ মতটা কুরআন ও হাদীসের আলোকে বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। বান্দা যখন সালাতে থাকে তখন সে আল্লাহর নিকটে অবস্থান করে। দোয়া মুনাজাতের সময় তখনই। যখন সালাতের সমাপ্তি ঘোষিত হলো তখন নয়। তখন সময় হলো আল্লাহর যিকিরের, যেমন আল্লাহ বলেন,﴿فَإِذَا قَضَيۡتُمُ ٱلصَّلَوٰةَ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ قِيَٰمٗا وَقُعُودٗا وَعَلَىٰ جُنُوبِكُمۡۚ﴾ [النساء: ١٠٣]‘“যখন তোমরা সালাত শেষ করলে তখন দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০২]এ সম্পর্কিত হাদীসগুলোর ভাষা এবং সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আমলসমূহ গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টিই বুঝে আসে সালাম ফিরানোর পরের সময়টা দোয়া করার সময় নয়, যিকির করার সময়।তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরয সালাতের পর কখনো কি দোয়া করেননি? হ্যা করেছেন। তবে তা সম্মিলিতভাবে নয়। যেমন হাদীসে এসেছে: বারা ইবন আযেব বলেন,«كُنَّا إِذَا صَلَّيْنَا خَلْفَ رَسُولِ اًللَّهِ صَلَّى اًللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَحْبَبْنَا أَنْ نَكُونَ عَنْ يَمِينِهِ، يُقْبِلُ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ، قَالَ: فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ: «رَبِّ قِنِي عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ- أَوْ تَجْمَعُ- عِبَادَكَ»“আমরা যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পেছনে সালাত আদায় করতাম, তিনি আমাদের দিকে মুখ করতেন, কখনো কখনো শুনতাম তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! আপনার শাস্তি থেকে আমাকে বাঁচান যেদিন আপনি আপনার বান্দাদের উঠাবেন। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭০৯]জামা‘আতের সঙ্গে তিনি মুসল্লীদের নিয়ে দোয়া করেছেন, এমন কোনো বর্ণনা নেই। যা আছে তা তার বিপরীত। যেমন, বর্ণিত হাদীসটির প্রতি লক্ষ্য করুন! সেখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একবচন শব্দ ব্যবহার করেছেন। বলেছেন আমাকে বাঁচান...। সকলকে সঙ্গে নিয়ে দোয়াটি করলে বলতেন আমাদেরকে বাঁচান।আরেকটি হাদীসের প্রতি লক্ষ্য করুন:«أُوصِيكَ يَا مُعَاذُ لَا تَدَعَنَّ فِي دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ تَقُولُ: اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ، وَشُكْرِكَ، وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ»“রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মু‘আজ ইবন জাবালকে বলেছেন, তুমি অবশ্যই প্রত্যেক সালাতের পর বলবে, হে আল্লাহ! আপনার যিকির, আপনার শোকর, আপনার জন্য উত্তম ইবাদত করতে আমাকে সাহায্য করুন”। [আবূ দাউদ, হাদীস নং ১৫২২; নাসাঈ, হাদীস নং ১৩০৩]দেখুন! প্রখ্যাত সাহাবী মু‘আয ইবন জাবাল (রাঃ) কওমের ইমাম ছিলেন। রাসূল তাঁকে ইয়েমেনের গভর্নর, শিক্ষক ও ইমাম হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সালাতে ইমামতী করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে এ দোয়াটি সকলকে নিয়ে করার নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা দেননি। তিনি তাঁকে একা একা দোয়াটি করার জন্য বলেছেন। হাদীসের ভাষাই তার প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাম ফিরনোর পর তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি) বলেছেন। তিনি যদি এটা সকলকে নিয়ে করতেন তাহলে নাস্তাগফিরুল্লাহ (আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি) বলতেন।যারা ফরয সালাত শেষে কোনো যিকির-আযকার না করে উঠে গেল তারা একটা সুন্নাত (মুস্তাহাব) ছেড়ে দিল। আবার যারা সালাত শেষে সম্মিলিতভাবে মোনাজাত করে উঠে গেল তারা একটা সুন্নাত বাদ দিয়ে সে স্থানে অন্য একটি বিদ‘আত আমল করল।তাই সারকথা হলো, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের পর সব সময় জামা‘আতের সঙ্গে মোনাজাত করা একটি বিদ‘আত। যা আল্লাহর রাসূল (ﷺ) করেন নি। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈ‘গণ করেছেন বলেও কোনো প্রমাণ নেই।তবে যদি কেউ জামা‘আতে সালাত আদায়ের পর একা একা দোয়া মোনাজাত করেন তা সুন্নাতের খেলাফ হবে না। এমনিভাবে ইমাম সাহেব যদি সকলকে নিয়ে বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে কোনো কোনো সময় দোয়া-মোনাজাত করেন তবে তা নাজায়েয হবে না।ইমাম ইবন তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়্যেম, মুফতীয়ে আযম ফয়জুল্লাহ রহ.সহ অনেক আলেম-উলামা এ মত ব্যক্ত করেছেন।