পরিচ্ছেদ: দোয়া কবুলের অনুকূল অবস্থা ও সময়

৩৩. আযানের সময় এবং যুদ্ধের ময়দানে যখন মুজাহিদগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান

কিছু সময় রয়েছে যাতে দোয়া কবুল করা হয়। এমনি মানুষের কিছু অবস্থা আছে যা দোয়া কবুলের উপযোগী বলে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনি কিছু সময়ের কথা নীচে আলোচনা করা হলো।হাদীসে এসেছে: সাহাল ইবন সা‘আদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:«ثِنْتَانِ لَا تُرَدَّانِ، أَوْ قَلَّمَا تُرَدَّانِ الدُّعَاءُ عِنْدَ النِّدَاءِ، وَعِنْدَ الْبَأْسِ حِينَ يُلْحِمُ بَعْضُهُمْ بَعْضًا»“দুটো সময় এমন যাতে দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না অথবা খুব কম ফেরত দেওয়া হয়। আযানের সময়ের দোয়া এবং যখন যুদ্ধের জন্য মুজাহিদগণ শক্রের মুখোমুখি হন”। [আবূ দাউদ, হাদীস নং ২৫৪০]

৩৪. আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:«إِنَّ الدُّعَاءَ لَا يُرَدُّ بَيْنَ الْأَذَانِ وَالْإِقَامَةِ، فَادْعُوا»“আযান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময়ে দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না। সুতরাং তোমরা দোয়া কর”। [মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১২৫৮৪; তিরমিযী, হাদীস নং ২১২]

৩৫. সাজদাহ’র মধ্যে

রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: «أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ، وَهُوَ سَاجِدٌ، فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ»“বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় যখন সে সাজদাহরত থাকে। সুতরাং তোমরা এ সময় বেশি করে দোয়া কর”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৮২]

৩৬. ফরয সালাতের শেষে

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করা হলো:أَيُّ الدُّعَاءِ أَسْمَعُ؟ قَالَ: «جَوْفَ اللَّيْلِ الآخِرِ، وَدُبُرَ الصَّلَوَاتِ المَكْتُوبَاتِ».“কোন দোয়া সবচেয়ে বেশি কবুল করা হয়? তিনি বললেন, শেষ রাতে এবং ফরয সালাতের শেষে”। [তিরমিযী, হাদীস নং ৩৪৯৯]

৩৭. জুমু‘আর দিনের শেষ অংশে

জাবের ইবন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,«يَوْمُ الْجُمُعَةِ اثْنَتَا عَشْرَةَ سَاعَةً، لَا يُوجَدُ فِيهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللَّهَ شَيْئًا إِلَّا آتَاهُ إِيَّاهُ، فَالْتَمِسُوهَا آخِرَ سَاعَةٍ بَعْدَ الْعَصْرِ».“জুমু‘আর দিন বারটি ঘন্টা। এর মধ্যে এমন একটি সময় আছে, সে সময় একজন মুসলিম বান্দা যা আল্লাহর কাছে চায়, তা-ই তিনি দিয়ে দেন। তোমরা সে সময়টি আছরের পর শেষ অংশে তালাশ কর”। [নাসাঈ, হাদীস নং ১৩৮৯]

৩৮. রাতের শেষ তৃতীয়াংশে

রাত এমন একটা সময় যখন প্রত্যেকে তার আপনজনের সঙ্গে অবস্থান করে। এ সময় একজন মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গভীরতর করার সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। আর এটা এমন এক সময় যখন দোয়া কবুল করার জন্য আল্লাহর ঘোষণা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: «إِنَّ فِي اللَّيْلِ لَسَاعَةً لَا يُوَافِقُهَا رَجُلٌ مُسْلِمٌ، يَسْأَلُ اًللَّهَ خَيْرًا مِنْ أَمْرِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، إِلَّا أَعْطَاهُ إِيَّاهُ، وَذَلِكَ كُلَّ لَيْلَةٍ»“রাতের এমন একটা অংশ আছে যখন মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখিরাতের যা কিছু চায় আল্লাহ তা দিয়ে দেন। আর এ সময়টা প্রতি রাতে”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৫৭]রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেন,«يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي، فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ»“আমাদের রব প্রতি রাতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন, যখন রাতের এক-তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে। তখন তিনি বলেন, কে আছে আমার কাছে দোয়া করবে আমি কবুল করব? কে আমার কাছে তার যা দরকার প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দিয়ে দেব? কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি ক্ষমা কেও দেব”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১১৪৫]

৩৯. দোয়া ইউনুস দ্বারা প্রার্থনা করলে

রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:«دَعْوَةُ ذِي النُّونِ إِذْ دَعَا بِهَا وَهُوَ فِي بَطْنِ الْحُوتِ: لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ، إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ، فَإِنَّهُ لَنْ يَدْعُوَ بِهَا مُسْلِمٌ فِي شَيْءٍ قَطُّ إِلَّا اسْتَجَابَ لَهُ»‘মাছওয়ালা (ইউনুস ‘আলাইহিস সালাম)-এর দোয়া হলো যা সে মাছের পেটে থাকা অবস্থায় করেছে; লাইলাহা ইল্লা আনতা ছুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জলিমীন। (আপনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, আপনি পবিত্র, সুমহান। আমিই তো অত্যাচারী”। [তিরমিযী, হাদীস নং ১০৪১৭]

৪০. মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোয়া করা

আল-কুরআনুল কারীম ও হাদীসে সকল মুসলিমের জন্য দোয়া করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিপদগ্রস্ত মুসলিমদের জন্য দোয়া করা আমাদের দায়িত্ব। হাদীসে এসেছে, আবূ দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতেন: «دَعْوَةُ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ لِأَخِيهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مُسْتَجَابَةٌ، عِنْدَ رَأْسِهِ مَلَكٌ مُوَكَّلٌ كُلَّمَا دَعَا لِأَخِيهِ بِخَيْرٍ، قَالَ الْمَلَكُ الْمُوَكَّلُ بِهِ: آمِينَ وَلَكَ بِمِثْلٍ»“মুসলিম ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের জন্য তার অনুপস্থিতিতে দোয়া করলে তা কবুল করা হয়। দোয়াকারীর মাথার কাছে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিরিশতা থাকে। যখনই তার ভাইয়ের জন্য কল্যাণের দোয়া করে, দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিরিশতা তার দোয়া শুনে আমীন বলতে থাকে এবং বলে তুমি যে কল্যাণের জন্য দোয়া করলে আল্লাহ অনুরূপ কল্যাণ তোমাকেও দান করুন”। [মুসলিম, হাদীস নং ২৭৩৩]এ হাদীস দ্বারা যেমন আমরা দোয়া কবুলের বিষয়টি বুঝেছি, এমনিভাবে অপর মুসলিম ভাইদের জন্য দোয়া করার বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়ার কথা শিখেছি। এতে যার জন্য দোয়া করা হবে তার যেমন কল্যাণ হবে, তেমনি যিনি দোয়া করবেন তিনি লাভবান হবেন দুদিক দিয়ে, প্রথমত তিনি দোয়া করার সওয়াব পাবেন। দ্বিতীয়ত তিনি যা দোয়া করবেন তা নিজের জন্যও লাভ করবেন।

৪১. সিয়ামপালনকারী, মুসাফির, মজলুমের দোয়া এবং সন্তানের বিরুদ্ধে মাতা-পিতার দোয়া

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:«ثَلَاثُ دَعَوَاتٍ مُسْتَجَابَاتٌ: دَعْوَةُ المَظْلُومِ، وَدَعْوَةُ المُسَافِرِ، وَدَعْوَةُ الوَالِدِ عَلَى وَلَدِهِ»“তিনটি দোয়া কবুল হবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই। সন্তানের বিপক্ষে মাতা-পিতার দোয়া, মুসাফিরের দোয়া এবং মযলুম বা অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া”। [তিরমিযী, হাদীস নং ৩৪৪৮]রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মু‘আয ইবন জাবালকে ইয়েমেনে গভর্নর করে পাঠান তখন তাকে কয়েকটি নির্দেশ দেন। তার একটি ছিল:«اتَّقِ دَعْوَةَ المَظْلُومِ، فَإِنَّهَا لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ»“সাবধান থাকবে মযলুম বা অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া হতে। জেনে রেখ! তার দোয়া ও আল্লাহর মধ্যে কোনো অন্তরায় নেই”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৪৪৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯]মযলুমের বদ দোয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে সর্বদা। এর অর্থ এটা নয় যে, মজলুমকে দোয়া করতে দেওয়া যাবে না। বরং রাসূলের বাণীর উদ্দেশ্য হলো, কখনো কাউকে সামান্যতম অত্যাচার করা যাবে না। নিজের কাজ-কর্ম, কথা দ্বারা কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এটার প্রতি সতর্ক থাকা হলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এ হাদীসের উদ্দেশ্য। যদি আমার দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে সে হবে মযলুম বা অত্যাচারিত। সে আমার বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তা অবশ্যই কবুল হবে। এটা ভয় করে চলতে পারলে এ হাদীস স্বার্থক হবে আমাদের জন্য।

৪২. ‘আরাফা দিবসের দোয়া

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:«خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ»“সর্বোত্তম দোয়া হলো ‘আরাফার দোয়া”। [তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৮৫]জিলহজ্ব মাসের নয় তারিখে যারা ‘আরফাতে অবস্থান করেন তাদের দোয়া কবুল হয়। এটা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বহু সংখ্যক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

৪৩. বিপদগ্রস্ত অসহায় ব্যক্তির দোয়া

বিপদগ্রস্ত অসহায় তথা আর্তের দোয়া কবুল করা হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যখন মুশরিক আর্ত মানুষের দোয়া কবুল করেন তখন মুসলমানের দোয়া কেন কবুল করবেন না। আবার যদি সে মুসলিম ঈমানদার ও মুত্তাকী হয় তখন তার দোয়া কবুলে বাধা কি হতে পারে?আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,﴿ أَمَّن يُجِيبُ ٱلۡمُضۡطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكۡشِفُ ٱلسُّوٓءَ ﴾ [النمل: ٦٢]“কে আর্তের প্রার্থনায় সাড়া দেয়? যখন সে তাঁকে ডাকে এবং কে বিপদাপদ দূর করেন”। [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬২]

৪৪. হজ ও উমরাকারীর দোয়া এবং আল্লাহর পথে জিহাদে অংশগ্রহণকারীর দোয়া

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:«الْغَازِي فِي سَبِيلِ اللَّهِ، وَالْحَاجُّ وَالْمُعْتَمِرُ، وَفْدُ اللَّهِ، دَعَاهُمْ، فَأَجَابُوهُ، وَسَأَلُوهُ، فَأَعْطَاهُمْ»“আল্লাহর পথে জিহাদকারী যোদ্ধা, হজ্বকারী এবং উমরাহকারী আল্লাহর প্রতিনিধি। তারা দোয়া করলে আল্লাহ কবুল করেন এবং প্রার্থনা করলে আল্লাহ দিয়ে থাকেন”। [ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৮৯৩]

সেটিংস

বর্তমান ভাষা