পরিচ্ছেদ: হিংসাকারীর বৈশিষ্ট্য জানা যাতে তাকে এড়িয়ে চলা যায়
৯০. ভূমিকা
বদনজরের মধ্যে সব ধরনের মানুষই অন্তর্ভুক্ত হবে। এমনকি যারা আল্লাহভীরু তারাও এর দ্বারা আক্রান্ত হবে যদি না তারা এর প্রতি সঠিক মনোযোগ প্রদান করে, যদিও হিংসার বিষয়টি নির্দিষ্ট কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। হিংসুক মানুষের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো দিয়ে তাকে চেনা যায়, অন্যদের থেকে তাকে আলাদা করা যায়। যেমন-তার তাকানো ও হাসির ধরণ, মুখের অভিব্যক্তি এবং তার কথা বলার ধরন দেখেই তাকে আলাদা করা যাবে। আর এসব বৈশিষ্ট্যই বলে দেবে তার মনে কী আছে। মানুষ যা কিছুই গোপন করুক না কেন তার বহিঃপ্রকাশ। তার চেহারায় ঘটবেই, মুখ ফসকে বের হয়ে যাবে তার মনের কুটিলতা। তার তাকানোর ধরন, তার হাসি এবং তার পুরো গতিবিধি থেকেই তার মনের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হবে।প্রজ্ঞাময় মহান আল্লাহ তাআলা মানুষের মুখমণ্ডলকে আয়না হিসেবে তৈরি করেছেন, এ আয়নায় তার মনের লুকানো চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। অসুস্থ মানুষের মুখে অসুস্থতার লক্ষণ ও চিহ্ন ফুটে ওঠে, বিষন্ন ও দুঃখী মানুষের মুখেও ফুটে ওঠে তার কষ্টের চিহ্ন, ঠিক একইভাবে সুস্থ-সবল। মানুষের মুখেও দেখা যায় সুস্থতার লক্ষণ। কোনো মানুষ যদি তার জীবনে সুখী ও পরিতৃপ্ত হয়, তবে তার মুখে তার গোপন চিন্তার ছাপ দেখা যায়। এবং কখনো কখনো সে মুখ ফসকে সে চিন্তা প্রকাশও করে দেয়। কোনো মুমিন যদি তার ঈমানের প্রতি সত্যবাদী ও আন্তরিক হন, পরম করুণাময়ের সামনে যদি তিনি বিনয়ী ও নম্র হন, নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করেন, তাহলে এ তেলাওয়াত ও ঈমানের আনন্দ এবং এর আভা তার মুখে ফুটে উঠবে। তার স্বভাব হবে খুবই নম্র ও সদয়, তার কথা হবে খুবই পরিশীলিত ও ভদ্র। এর বিপরীত চিত্রও সত্য: একজন অসৎ মানুষের যাবতীয় কুকর্ম ও অনৈতিক কর্মের প্রতিফলনও ঘটবে তার চেহারায়, বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাকে সৎ মনে হলেও মুখ ফসকে কোনো একসময় সে তার কুকীর্তির কথা বর্ণনা করবে। একইভাবে যে হিংসাকারী মানুষের ভালো জিনিসে অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং তার উপর থেকে যেন আল্লাহর রহমত চলে যায় সেই কামনা করে, সে মানসিকভাবে অসুস্থ এবং তার ঈমান নেই। সে তার ভেতরের ইচ্ছা বা ভাবনা যতই গোপন করার চেষ্টা করুক না কেন, শিগগিরই তার মনে পুষে রাখা হিংসা প্রকাশ পেয়ে যাবে।
৯১. হিংসুকের বৈশিষ্ট্যাবলী
১. হিংসাকারী সবসময় আল্লাহ তা'আলার আদেশ বা আদেশের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে।২. হিংসাকারী সবসময় অভিযোগ করে এবং কদাচিৎ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে, এমনকি যদি সে পুরো পৃথিবীর মালিকও হয়।৩. সে যাকে হিংসা করে তার ভুলকে অনুসরণ করে এবং সবসময় তার দোষ অনুসন্ধান করে, সেগুলোকে প্রকাশ করে এবং অন্যদের কাছে। সেগুলোকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করে।৪. সে সবসময় যাকে হিংসা করে তার ভালো ও স্বতন্ত্র গুণাবলি গোপন করে অথবা অবজ্ঞা করে অথবা এ গুণগুলোকে খাটো করে দেখে।৫. আপনি খেয়াল করে দেখবেন, হিংসাকারী যাকে হিংসা করে তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা বা রসিকতা ছাড়া কথা বলতে পারে না, কিন্তু তার। হৃদয় থাকে ঘৃণা ও অসন্তোষে পরিপূর্ণ, যা তার তাকানোর ধরনে প্রকাশ। পেয়ে যায়।৬. সে কোনো প্রমাণ ছাড়াই প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করে।৭. সে সবসময় সুযোগ সন্ধান করে এবং তার সবটুকু সুযোগ কাজে লাগায় যাকে সে হিংসা করে তার অথবা তার সম্পদের ক্ষতি করার পেছনে।৮. সর্বশেষ, হিংসাকারী আসলে একজন ঝামেলা পাকানো লোক, তার হৃদয়ে সবসময় অন্যের ভালোতে অসন্তোষ থাকার কারণে তার চেহারায় ফুটে ওঠে বিষন্নতা ও নিষ্প্রভতার ছাপ।
৯২. ইসলামের আলোকে হিংসার প্রতিকার
হিংসা একটি মারাত্মক ব্যাধি, যার পরিণাম খুবই ভয়াবহ, সামাজিক সম্পর্কের টানাপোড়েন ও মানুষের পারস্পরিক অশালীন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে বিকশিত হয় এ হিংসা-বিদ্বেষ। যা মানুষকে অজ্ঞতা ও পশ্চাৎপদতার সর্বনিম্ন স্তরে নিমজ্জিত করে।এ কারণেই ইসলাম এ মারাত্মক ব্যাধির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“তোমরা একে অন্যকে হিংসা কর না, অন্যের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন কর না, একে অপরকে ঘৃণা কর না, একজনকে আরেকজনের কাছ থেকে টেনে নিও না; হে আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা পরস্পর ভাইয়ের মতো আচরণ কর।”অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“তোমরা সতর্ক বা কৌশলী হয়ে লক্ষ্য অর্জন করার চেষ্টা করবে, কারণ যার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ থাকে, সেই হিংসার মুখে পতিত হয়।” [ইবনু আবিদ দুনইয়া ও তাবারানী মুয়ায (রা) হতে যঈফ সনদে বর্ণনা করেছেন]এ ভুল এড়িয়ে চলতে হলে একজন মুসলিমকে আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে, আচরণে শান্তশিষ্টতা থাকতে হবে। অন্য একজনের প্রতি আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ দেখে তার মতো নিজের জন্যও ওই বিশেষ অনুগ্রহ কামনা করা ইসলামে অনুমোদিত, তবে এক শর্তে, ওই ব্যক্তির অনুগ্রহ কেড়ে নেয়ার কামনা করা যাবে না এবং অন্য একজনের কেন এমন অনুগ্রহ হল সেজন্য অসন্তুষ্ট হওয়া যাবে না।হিংসা একটি মারাত্মক মানসিক রোগ, আর এ রোগের চিকিৎসা কেবল উপকারি জ্ঞান দিয়েই করা সম্ভব। হিংসা নামক ব্যাধির ক্ষেত্রে উপকারি জ্ঞান মানে এ উপলব্ধি হওয়া যে, এ পৃথিবীতে হিংসা তোমার জন্য ক্ষতি তো বয়ে আনবেই, পাশপাশি এতে তোমার গুণাহ হবে এবং এ গুণাহর ফলে কপালে শুধুই আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ জুটবে, আর অন্যদিকে শুধুই এ হিংসার পথ এড়িয়ে চলাই জান্নাতে প্রবেশের একটি মাধ্যম।আনাস বিহার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) সঙ্গে এক মজলিসে বসা ছিলাম, তখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেনঃ“এ পথে তোমাদের দিকে একজন জান্নাতের অধিবাসী আসবে।”অতঃপর আনসারদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি এলেন। তার দাড়ি থেকে ওযুর পানি টপ টপ করে পড়ছিল। বাম হাতে তার পায়ের স্যান্ডেল। তিনি এসে সবাইকে সালাম দিয়ে অভিবাদন জানালেন।পরের দিনও আল্লাহর রাসূল (ﷺ) একই কথা বললেন এবং সেই ব্যক্তি হাজির হলেন। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) চলে যাওয়ার পর আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস লোকটিকে অনুসরণ করলেন এবং তাকে বললেন: আমার পিতার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে এবং আমি শপথ করেছি আগামী তিনদিন তার সঙ্গে থাকব না। আপনি কি আমাকে এ তিনদিন থাকার সুযোগ দিতে পারবেন? তিনি বললেন: “হ্যা”। অতঃপর তিনি তার সঙ্গে তিন রাত্রি কাটালেন। কিন্তু তিনি তাকে রাতে কিয়াম করতে দেখলেন না, কিন্তু যখনই তিনি বিছানায় যেতেন আল্লাহকে স্মরণ করতেন। তিনি বললেন: তবে আমি তার মুখে ভালো ব্যতিত খারাপ কোনো কথা শুনিনি।তিনদিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমি তার কাজকর্ম নিয়ে খুব কমই ভাবলাম। আমি তাকে বললাম: হে আল্লাহর বান্দা, আমার সঙ্গে আমার পিতার কোনো ঝগড়া হয়নি, কিন্তু আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আপনার ব্যাপারে এ এ কথা বলতে শুনেছি এবং সেই কারণেই আমি জানতে চেয়েছিলাম যে, আসলে আপনি কী কী কাজ করেন। কিন্তু আমি আপনাকে বেশি কিছু করতে দেখলাম না, তারপরও আপনার এ মর্যাদা হল কিভাবে? তিনি বললেন: আপনি যা দেখেছেন আমি তার বেশি কিছু করি না। অতঃপর আমি যখন ফিরে আসতে চাইলাম তখন তিনি বললেন: আপনি যা দেখেছেন আমি তার বেশি কিছু করি না, কিন্তু আমি কখনো অন্যের কল্যাণে, অন্যকে দেয়া আল্লাহর অনুগ্রহে হিংসা বোধ করি না।” আবদুল্লাহ বললেন: আমি তাকে বললাম: এ কর্মই আপনাকে ওই মর্যাদা এনে দিয়েছে এবং এটাই আমরা করতে পারি না।অতএব এটা স্পষ্ট যে, হিংসার পথ পরিহার করে চলাও একটি মহৎ কাজ, কারণ এর জন্য আল্লাহ তা'আলা উত্তম প্রতিদান দেবেন।