পরিচ্ছেদ: বদনজর কাকে বলে ও তার প্রতিকার কি?

৮২. বদনজর সম্পর্কে বিস্তারিত

বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “আল-আইনু হাক্কুন” অর্থাৎ নজর দোষ একটি বাস্তব সত্য জিনিস। যদি কোন জিনিস অদৃশ্যের লিখন খন্ডন করতে পারত, তবে নজরদোষ তা খন্ডন করতে পারত। যখন (নজরদোষ হেতু) তােমাদেরকে কোন অঙ্গ ধৌত করার জন্য বলা হবে, তখন তােমরা তা ধৌত করে দাও।” (মুসলিম, মিশকাত ৩৮৮ পৃঃ)নজর দোষের প্রভাবশতঃ মানুষ, পশু, ধন-সম্পত্তি বাগান-ক্ষেত ইত্যাদিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। দুনিয়ার তাবৎ জিনিস আল্লাহর মীমাংসায় সংঘটিত হয়। আল্লাহর মীমাংসাকৃত কোন বিষয়ই খন্ডন করার কোন উপায় নেই। কিন্তু বদ-নজর এমন মারাত্মক জিনিস যে, যদি কোন জিনিসে উক্ত বিষয় খন্ডন করার মত কোন শক্তি থাকত, তাহলে বদ-নজরে তা থাকত। অর্থাৎ, বদ-নজর একটা বাস্তব সত্য জিনিস। এর কবলে পড়লে নজর গ্রস্থ ব্যাক্তি ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়। ঔষধ-পথ্যের মাধ্যমে এর কোন প্রতিকার ব্যাবস্থা নেই। কাজেই ঔষধ-পথ্য গ্রহণ করলেও কোন উপকার আসে না। এর থেকে আরােগ্য লাভের একটাই ব্যবস্থা আছে। আর সে ব্যবস্থা হচ্ছে, দোয়া বা মন্ত্র পাঠ করতঃ ঝাড়ফুঁকের ব্যবস্থা। এই অবস্থায় আল্লাহানুগ্রহে মানুষ উপকৃত হয়ে থাকে। উপরােক্ত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে নজরদোষ কাটাবার নিমিত্তে একটি পদ্ধতির উল্লেখ এসেছে। ঐ সময়ে আরবের প্রথা ছিল যে, যখন কারাে উপর বদ-নজর হতাে তখন যার নজর লেগেছে তার দুই হাত, দুই পা এবং নাভীর তলদেশ ধৌত করতঃ সেই পানি দ্বারা বদ-নজরগ্রস্ত ব্যক্তিকে গােসল দেওয়া হতাে। আর এই পদ্ধতিকে তার দোষমুক্তির একটা উপায় মনে করত। নবী (ﷺ)-এই পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দান করতঃ বলেছেন যে, “যার বদ-নজর লেগেছে তাকে যদি হাত-পা ইত্যাদি অঙ্গ ধৌত করার জন্য বলা হয়, তবে সে যেন তাতে আপত্তি না করে; বরং সে যেন অঙ্গ ধৌত করা পানি নজরদোষগ্রস্ত ব্যক্তিকে দিয়ে উপকৃত করে।এই প্রসঙ্গে আর একটি বিস্তৃত ঘটনা অন্য এক হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। পাঠকদের উপকারার্থে নিম্নে সেটি উদ্ধৃত করলাম।একদা আমের বিন রাবিয়াহ (রাঃ) সহল বিন হুনাইফকে (রাঃ)-কে গােসল করতে দেখে খুব মুগ্ধ হয়ে পড়লেন এবং মুখে বলতে লাগলেন, 'আল্লাহর কসম! সহলের মত অত সুন্দর রূপ-লাবণ্য আর কখনাে দেখি নি। এমন কি অন্দর মহলে অবস্থানরতা কোন রূপসী। নারীর ত্বক (চর্ম)ও অত সুন্দর আজ পর্যন্ত দেখতে পাই নি।'আমেরের এ কথা বলাও ছিল আর অমনি সহল জমির উপরে টলে পড়ে গেলেন। অর্থাৎ, এমনভাবে বদ-নজর লাগল যে, তিনি অজ্ঞান হয়ে ভূপতিত হয়ে পড়লেন। অতঃপর সহলকে উঠিয়ে হুযুর এক-এর সমীপে ধরাধরি করে আনা হলাে এবং অনুরােধ করে বলা হলাে, 'হে আল্লাহর রসূল (ﷺ) এঁকে সারানাে যায় কি করে? আল্লাহর কসম, ইনি যে মাথা তুলতে সক্ষম নন।'সহলের অবস্থা দেখে রাসূল (ﷺ) একি বললেন, “কারাে সম্পর্কে তােমাদের ধারণা আছে কি যে, তার বদ নজর এর প্রতি লেগেছে?”লােকেরা বলল, 'জী হা! আমাদের ধারণা হচ্ছে যে আমের বিন রাবীআর বদনজর ঐকে আক্রান্ত করেছে।' ইহা শ্রবণ করতঃ রসুলুল্লাহ (ﷺ) আমেরকে ডেকে পাঠালেন এবং কড়া-মিঠ স্বরে বললেন, “তােমরা তােমাদের কোন ভাইকে মারবার তালে কেন থাকো? তুমি সহলের রূপ-লাবণ্য দেখে যখন অভিভূত হয়েছিলে, তখন তুমি ওকে বরকতের দোয়া দাওনি কেন? অর্থাৎ, 'বা-রাকাল্লাহু ফীক' (তােমার প্রতি আল্লাহ বরকত দান করেন) বাক্য কেন পাঠ করাে নাই? তাহলে ওর উপর বদনজর লাগত না।”অতঃপর রাসূল (ﷺ) ঐ আমেরকে নির্দেশ দিলেন, “তুমি সহলের জন্য তােমার অঙ্গগুলি ধুয়ে ঐ পানি ওর উপরে বহে দাও।” এই নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে আমের (রাঃ) একটি পাত্রে নিজের মুখমন্ডল, হাত, কনুই, হাঁট, দুই পা ও পায়ের আঙ্গুলগুলি এবং নাভীর তলদেশ (লজ্জাস্থান) প্রভৃতি অঙ্গগুলি ধুয়ে দিলেন। অতঃপর সেই পানি সহলের উপরে ঢেলে দেওয়া হলাে। এইরূপ ব্যবস্থা অবলম্বনে সহল এক সঙ্গে সঙ্গে সেরে উঠলেন। চাঙ্গা হয়ে উঠে সকলের সঙ্গে এমনভাবে চলাফেরা করতে লাগলেন যেন মনে হচ্ছিল, ওর কিছুই হয় নি। (মা-লে, শরহে সুন্নাহ, মিশকাত ৩৯০ পৃঃ) বদ-নযরের প্রভাব দূর করার জন্য যেমন শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি ধৌত করতঃ সেই পানি বদ-নজরগ্রস্ত ব্যক্তির শরীরে ঢেলে দেওয়ার কথা এসেছে -তেমনি ওর থেকে অব্যাহতি পাবার দোয়াও আছে। আর সে দোয়া খুব কঠিন নয়; বরং খুব সহজ ও সকলের জানা। অর্থাৎ, সূরা ফালাক, ও সূরা নাস পাঠ করে ফুক দেওয়া।আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) জ্বিনদের আক্রমণ থেকে এবং মানুষের বদনজরের প্রভাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তারপর যখন ক্বুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক ও কুল আব্বযু বিরান্বিন্নাস সুরা দুটি অবতীর্ণ হলাে তখন তিনি ঐ সূরা দুটিই ধরে পড়লেন এবং ঐ দুটি ছাড়া অন্য সমস্ত দোয়া পরিত্যাগ করে দিলেন। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ৩৯০ পৃঃ) 'সিফরুস সাআদাহ’ গ্রন্থের লেখক হাদীসের বরাত দিয়ে লিখেছেন, কোন ব্যক্তি যখন নিজের অথবা অপরের সন্তান-সন্ততি, ধন-দৌলত ইত্যাদি দর্শন করে খুব মুগ্ধ হয়ে পড়বে, তখন সে ব্যক্তি যদি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করে তবে ওই সব জিনিসে তার বদনজর লাগবে না। আয়াতটি এই,مَا شَاءَ اللّٰهُ، لَا قُوَّةَ إلاَّ باللّٰه."মা- শা-আল্লাহ, লা ক্বুওয়্যাতা ইল্লা- বিল্লা-হ।' (মাযাহেরে হক জাদীদ চতুর্থ, খন্ড ১ম কিস্তি ১০ পৃষ্টা)বদ নজর যেমন মারাত্মক জিনিস, যাদু বিদ্যাও তেমনি সব ভয়ংকর বিষয়। এর ফলে মানুষের অনেক অঘটন ঘটে গিয়ে থাকে। ইসলামী শরীয়তে বহুবিধ বিদ্যাচর্চার অনুমতি আছে, কিন্তু যাদুবিদ্যার চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম ঘােষণা করা হয়েছে। এ মর্মে নিমের হাদীসটি প্রনিধান করুনঃইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জ্যোতিষবিদ্যার এমন কোন বিষয় আয়ত্ব করল (যার স্বীকৃতি আল্লাহ দেন নি), সে যেন যাদুবিদ্যার কিয়দংশ আয়ত্ব করল এবং সে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ-বক্তা গণক-ঠাকুর সমতুল্য। আর ভবিষৎ-বক্তা গণক যাদুকর সমতুল্য আর যাদুকর ব্যক্তি কাফের সমতুল্য। (মিশকাত ৩৯৪ পৃঃ) উপরােক্ত হাদীসের শেষােক্ত বাক্য (الساحر كافر) ‘আস-সা-হিরু কা-ফির’ অর্থাৎ, যাদুবিদ্যা চর্চাকারী কাফের, ঈমানের গন্ডী থেকে বহির্ভূত। অতএব ওর থেকে প্রত্যেক মুসলমানকে তফাতে থাকা দরকার।পক্ষান্তরে বদনজরের মত যাদু-মন্ত্রের কুফলজনিত মানুষের রকমারি অনিষ্ট সাধন হয়ে থাকে। এই অনিষ্টকর পরিস্থিতির মুকাবেলা করার মত ব্যবস্থা ঔষধপথ্যে অথবা কোন প্রক্রিয়ায় করা সম্ভব হয় না। এর প্রতিকার একমাত্র বিশুদ্ধ দোয়া বা ইসলামী মন্ত্র দ্বারা করা সম্ভব।এ প্রসঙ্গে হযরত রসুলে করীম (ﷺ) একটি ঘটনার উল্লেখ করা সুসঙ্গত হবে বলে মনে করি। ঘটনাটি প্রসিদ্ধ ও বহু জনশ্রুত ঘটনা। যথাঃখয়বর যুদ্ধের পর বড় বড় ইয়াহুদী দলপতিগণ লাবীদ বিন আসেম নামক প্রখ্যাত যাদুকরের নিকটে এসে বলল, 'আমরা মুহাম্মদের ধ্বংস-সাধনের জন্য অনেক যাদুমন্ত্র করলাম। কিন্তু কোন কিছু করা গেল না। আপনি আমাদের মধ্যে সব চেয়ে বড় যাদুবিদ। অতএব আপনি একবার যাদু-মন্ত্র দ্বারা তদবীর করে দেখুন। আপনাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। অতঃপর তাকে তিনটি স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করার কথা চুক্তি হলে সে তার তদবীর শুরু করে দিল। প্রথমতঃ সে একজন ইয়াহুদী ছেলেকে হাত করল। যে ছেলেটি নবী করীম (ﷺ)-এর খিদমত (সেবা) করত। চিরুনী করার সময় যে চুলগুলি দাড়ি ও মাথা থেকে চিরুনীতে লেগে বের হয়ে আসত, সেই চুল কিছু সংগ্রহ করল ঐ ছেলেটির হাত দিয়ে। তারপর সেই চুলে যাদু-মন্ত্র দ্বারা এগারােটা গিরা বেঁধে একটা কূপে পাথর চাপা দিয়ে রাখল। বাস, এই যাদুর কুফলে নবী (ﷺ) প্রায় এক বছর কাল আক্রান্ত থাকেন। এবং ভীষণ কষ্ট ভােগ করেন। পরে করুণাময় আল্লাহ রাসূল (ﷺ)-এর এই কষ্ট দূরীভূত করে দেন। যাদু-মন্ত্র কে করেছে, কোথায় কি ভাবে যাদু করেছে ইত্যাদি সমস্ত খবর রাসূল (ﷺ)-কে জ্ঞাত করানাে হলাে এবং ফালাক ও নাস সূরা দুটি অবতীর্ণ করা হলাে। সুতরাং রাসূল (ﷺ) আল্লাহর নির্দেশ মুতাবেক যাদুকৃত চুলগুলি প্রথমে উদ্ধার করলেন। তারপর একটি করে যাদুকৃত গিরা খুলে দিতে লাগলেন। যেহেতু যাদুকৃত গিরা সংখ্যা ছিল ১১টি, সেই হেতু দেখা যাচ্ছে উপরােক্ত সূরা দুটিতেও আয়াতের সংখ্যা মােট ১১টি। যখন আয়াতগুলি পাঠ করতঃ সব গিরা ক’টি খুলে দেওয়া হলাে তখন নবী করীম ও আরাম পেয়ে গেলেন। মনে হলাে যেন তাকে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এক্ষণে তিনি বন্ধনমুক্ত হয়ে নিজেকে খুব হালকা মনে করতে লাগলেন। (ফালিল্লাহিল হামদ) (বিস্তারিত বিবরণের জন্য তফসীর জালালাইনের ৫০৮ পৃষ্ঠায় তফসীর ও টীকা দ্রষ্টব্য)বদ-নজর, যাদু-মন্ত্র, জ্বিন-ভুতের আক্রমণাদি থেকে নিষ্কৃতি পাবার নিমিত্তে উত্তম ঝাড়ফুঁক হচ্ছে সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা। এই সূরা দুটি সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (ﷺ) একটি হাদীসে বলেন, “আজকের রাত্রে এমন কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যে, ঐ রকম আর কোন আয়াত (আশ্রয় প্রার্থনা মূলক) পরিদৃষ্ট হয় না। আর সে আয়াতগুলি হচ্ছে ‘ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিল ফালাক ও ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিন্না-স।” (মুসলিম, মিশকাত ১৮৬ পৃঃ)অন্যত্রে জননী আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ কে যখন রাত্রে শয্যা গ্রহণ করতেন তখন প্রত্যহ শােবার আগে তিনি দুই হাতের তালু দুটি একত্রিত করে তাতে নিম্নের সূরা তিনটি পড়ে ফুক দিতেন। তারপর হাত দুটি দেহে যতটা পারতেন ফিরিয়ে নিতেন। আরম্ভ করতেন মস্তক, মুখমন্ডল এবং শরীরের সম্মুখ ভাগ থেকে। এইভাবে তিনি তিনবার করে করতেন। সূরা তিনটি এই ১. কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ। ২. ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিল ফালাক্ব। ৩. ক্বুল আ'ঊযু বিরাব্বিন্না-স। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৮৬ পৃঃ)

৮৩. বদনজরে সৃষ্ট অসুস্থতার ধরন

বদনজরে আক্রান্ত হওয়ার প্রভাবকে দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারেঃ১. প্রাণঘাতি প্রভাব, যা দ্রুত ফলাফল নিয়ে আসে। যেমন: কোনো মানুষ অথবা গবাদিপশুকে হত্যা করা অথবা বাড়িঘর ও ফসল ধ্বংস করা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে কোনো প্রতিকার নেই। শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহ) রিয়াদের নিকটবর্তী গ্রামের এক লোকের ঘটনা বর্ণনা করেন। ওই লোকটি আরেক লোকের পালিত কিছু ভেড়ার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এসময় সে ভেড়াগুলোর প্রতি বদনজর দেয় এবং সবগুলো ভেড়া মারা যায়। ভেড়াগুলোর মালিক এসে তার সবগুলো ভেড়াই মারা গেছে দেখে তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পাশ দিয়ে কে গেছে? তার ছেলে বলল: তার ভেড়ার পালের পাশ দিয়ে অমুকের ছেলে অমুক ব্যতীত আর কেউ যায়নি। অতঃপর তিনি ওই লোকটির খোঁজে বের হন এবং তাকে গিয়ে তার (ওই লোকটির) নতুন ভবনের ছাদে পেলেন। তিনি তাকে। ডাকলেন, হে অমুক, তুমি আমার ভেড়ার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এ এ করেছ (বদনজর দিয়েছ) এখন তুমি এর বদলে হয় তোমার দেহ দান করবে অথবা তোমার এ নতুন ভবন দিয়ে দেবে। ভবনের মালিক বলল: আমি নিচে নেমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। লোকটি ছাদ থেকে নেমে আসার পরপরই হঠাৎ ভবনটি ধসে পড়ল। [রিয়াদের একটি কেন্দ্রীয় মসজিদের দেয়া বক্তব্য থেকে পৃ. ২০৫ নোট: ১]এ ধরনের বদনজর বিষাক্ত ও ধ্বংসাত্মক এবং এর কোনো প্রতিকার নেই।২. প্রাণঘাতী নয় এমন প্রভাব। এর প্রতিকারকে আবার তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়ঃ(ক) যে প্রতিকার ব্যবস্থা ঘটনা ঘটার আগেই বদনজরকে বাতিল করে দেয়। (খ) বদনজরে আক্রান্ত হওয়ার পর দ্রুত কার্যকরি প্রতিকার ব্যবস্থা। (গ) রুকিয়া ও আযকার পাঠের মাধ্যমে প্রতিকার।

৮৪. বদনজর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আগেই একে বাতিল করা

এটা করা হয় আল্লাহর অনুগ্রহ কামনার মাধ্যমে। যদি কোনো ব্যক্তি আরেকজনের উপর বদনজর দিয়ে আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করে তাহলে আল্লাহর রহমতে ওই বদনজরের প্রভাব বাতিল হয়ে যায় এবং সেটা আর কাজ করে না। আল্লাহ তাঁর নিজের আদেশের মাধ্যমে ওই লোকের আদেশ বাতিল করে দেন। সুতরাং বোঝা গেল, পুরো ব্যাপারটিই আল্লাহ তা'আলার নিয়ন্ত্রণে, সকল মহিমা ও গৌরব তাঁরই। এজন্যই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে আমাদের পছন্দনীয় সব অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:“যদি তোমাদের মধ্যে কেউ দেখে যে, তার ভাইয়ের কিছু অনুগ্রহ রয়েছে, তাহলে তাকে তার জন্য প্রার্থনা করতে দাও।”এবং তিনি আমীর বিন রাবিয়াহকে বললেনঃ“তুমি বরকত লাভের জন্য কেন প্রার্থনা করছ না?” সাহল বিন হানীফ (রঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:“যদি তোমাদের কেউ তার নিজের জন্য কোনো অনুগ্রহ পছন্দ করে, তাহলে তাকে এর জন্য প্রার্থনা করতে দাও, কারণ বদনজরের প্রভাব সত্য।” [ইবনে আল সুন্নি, ইমাম আহমাদ ও আল হাকিম কর্তৃক বর্ণিত]উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, বদনজর কোনো ক্ষতি করতে পারে না, যদি ওই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অনুগ্রহের প্রার্থনা করে; বরং এ বদনজর তখনই তার ক্ষতি করবে যখন তিনি আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য প্রার্থনা করবেন না।বিষয়টি কুরতুবিসহ অন্যান্যরা উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন: প্রত্যেক মুসলিমকেই তার পছন্দনীয় অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর কাছে। প্রার্থনা করতে হবে, কারণ অনুগ্রহের জন্য প্রার্থনা করা হলে এর কল্যাণে নিঃসন্দেহে সকল সম্ভাব্য ক্ষতির সম্ভাবনা দূরীভূত হয়ে যাবে।ইবনে হাজার (রহ) বলেন: যদি কেউ তার নিজের জন্য কোনো কিছু পছন্দ করেন, তাহলে তিনি যেন তার জন্য অতি দ্রুত আল্লাহ তাআলার কাছে হাত তুলে প্রার্থনা করেন এবং তার এ প্রার্থনা তার জন্য রুকিয়া হয়ে যাবে।আল্লাহর কাছে অনুগ্রহ ও বারাকাতের জন্য এভাবে প্রার্থনা করতে হবে: “বারিকাল্লাহু ফিহ্ (আল্লাহ এতে রহমত দিক) অথবা “আল্লাহুম্মা বারিক আলাইহি” (হে আল্লাহ আপনি বারকাত দান করুন)অথবা বলা যেতে পারে, মা শা আল্লাহ (আল্লাহ যা চান) যেভাবে নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছেঃوَلَوْلَا إِذْ دَخَلْتَ جَنَّتَكَ قُلْتَ مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ ۚ إِن تَرَنِ أَنَا أَقَلَّ مِنكَ مَالًا وَوَلَدًا ﴿٣٩﴾অর্থঃ ‘আর যখন তুমি তোমার বাগানে প্রবেশ করলে, তখন কেন তুমি বললে না, ‘মাশাআল্লাহ’! আল্লাহর তৌফিক ছাড়া কোন শক্তি নেই। তুমি যদি দেখ যে, আমি সম্পদে ও সন্তানে তোমার চেয়ে কম। (সূরা কাহফ ১৮: ৩৯)

৮৫. বদনজরে আক্রান্ত হওয়ার পরে এর প্রতিকার

যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কারো উপর বদনজর দেয় এবং বদনজর দেয়া ব্যক্তি যদি পরিচিত হয়, তাহলে তার গোসল অথবা অযুতে ব্যবহৃত পানি সংগ্রহ করে নিয়ে বদনজরে আক্রান্ত ব্যক্তির গায়ে ঢালতে হবে, এতে করে তার উপর থেকে বদনজরের সকল প্রভাব কেটে যাবে, অর্থাৎ ওই বদনজর বাতিল হয়ে যাবে।সাহল বিন হানিফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত উপরোক্ত হাদীসে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন:“কেন তোমরা তোমাদের একজন ভাইকে হত্যা করছ? কেন তোমরা তার জন্য বারকাতের প্রার্থনা করছ না? তার জন্য তোমার নিজেকে ধৌত কর।”রাসূলের (ﷺ) একথা শুনে আমীর তার মুখমণ্ডল, উভয় হাত কনুই পর্যন্ত, উভয় হাঁটু, দুই পায়ের পাশ এবং তার ইযারের ভেতর ধৌত করলেন এবং এ পানি সাহলের পেছন থেকে তার শরীরের উপর ঢেলে দেয়া হল এবং তিনি এতে সুস্থ হয়ে গেলেন। [মুয়াত্তা মালিক, ২/৯৩৮]অন্য এক হাদীসে এসেছে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “তুমি তার জন্য অযু কর।” অতঃপর আমীর অযু করলেন এবং সেই পানি পেছন দিক থেকে সাহলের গায়ে ঢেলে দেয়া হল। এরপরই সাহল আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) কাছে গেলেন এবং তখন তার শরীরের আর কোনো সমস্যা রইল না। ইমাম মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেনঃ“বদনজর ব্যাপারটি সত্য এবং আল্লাহর আদেশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো যদি কিছু থাকত তাহলে তা হত বদনজর। সুতরাং তোমাদের মধ্যে কাউকে যদি অযু বা শরীর ধৌত করতে বলা হয়, তাহলে তাকে তা করতে দাও।” [ইমাম মুসলিম, কিতাবুস সালাম, বাবুত তিব্ব ওয়াল মারাদ ওয়ার রুকা, ৫/৩২]সুনানে আবু দাউদে আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে:“যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কারো উপর বদনজর দেয় তাহলে বদনজর দেয়া ব্যক্তিকে অযু করার নির্দেশ দিতে হবে এবং তার অযুর সেই পানি দিয়ে আবার আক্রান্ত ব্যক্তিকে অযু করতে হবে। [সুনান বায়হাকী ৯/২৫২]

৮৬. বদ নজর ও হিংসার মধ্যে পার্থক্য

১. প্রত্যেক বদ নজরওয়ালা হিংসুক; কিন্তু প্রত্যেক হিংসুক বদ নজর ওয়ালা নয়। এজন্য সূরা ফালাকে হিংসাকারীর অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয়ের কথা বর্ণিত হয়েছে। যাতে হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আল্লাহ তায়ালার আশ্রয় প্রার্থনা করার ফলে সে বদ নজর থেকেও রক্ষা পায়। আর এটিই হলো কুরআনের ব্যাপকতা এবং তার মোজেযা ও অলংকারিত্ব।২. হিংসার মূল বিষয় হল বিদ্ধেষ এবং অপরের নেয়ামত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আকাক্ষা হয়ে থাকে। অন্যদিকে বদ নজরের মূল বিষয় হল অন্যের কোন কিছুকে খুব ভাল মনে করা।৩. হিংসা এবং বদ নজরের পরিণাম একই যার ফলে উভয়ই ক্ষতিসাধনের কারণ হয়ে থাকে; কিন্তু উভয়ের উৎসের পার্থক্য রয়েছেঃ হিংসার উৎস অন্তরের জ্বলন সৃষ্টি হওয়া এবং সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে। আর বদ নজরের উৎস চোখের দৃষ্টি শক্তির খারাপ প্রভাব এজন্য নজর দ্বারা এমন সব জিনিস ও প্রভাবিত হয় যার উপর হিংসার ক্ষেত্র নেই যেমন জড় পদার্থ, প্রাণীসমূহ, উদ্ভিদসমূহ এবং চাষাবাদ ও সম্পদ। আর কখনও নিজের নজর নিজেকেই লেগে যায়। কোন ব্যক্তি যখন কোন বস্তুকে আশ্চর্যের সাথে এবং গভীর দৃষ্টিতে দেখে এবং সাথে সাথে তার আত্মা ও অন্তর এক প্রকারের চাঞ্চল্যের অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন তা দ্বারা বদ নজর লেগে থাকে।৪. হিংসার প্রভাব ভবিষ্যতের কোন ভাল জিনিসের উপরও হয়ে থাকে আর বদ নজরের প্রভাব বর্তমান উপস্থিত বিষয়ের উপর হয়ে থাকে।৫. কোন ব্যক্তি নিজেকে এবং নিজের সম্পদকে হিংসার দৃষ্টিতে দেখে, তবে তার নিজের সম্পদসমূহে ও শরীরে নিজের বদনজর লেগে যেতে পারে।৬. হিংসা নিকৃষ্ট হৃদয়ের মানুষ থেকেই হয়। প্রকারান্তরে বদ নজর নেক ব্যক্তির দ্বারাও হয়ে থাকে। যখন সে কোন বস্তুকে খুব বেশী পছন্দ করে ফেলে অথচ সে সেটার ধ্বংস চায় না। এর উদাহরণ আমের বিন রাবীয়ার ঘটনা যখন সাহাল বিন হুনাইফকে তার নজর লেগে যায় অথচ আমের (রাঃ) প্রথম যুগের মুসলমান ও আহলে বদরের অন্তর্ভুক্ত।উপরোক্ত নজর ও হিংসার মধ্যে পার্থক্য যারা বর্ণনা করেছেন তারা হলেনঃ ইবনে জাওযী (রহঃ), ইবনে কাইয়্যিম (রহঃ), ইবনে হাজার, নববী (রহঃ) ও প্রমুখ। আল্লাহ তায়ালা তাদের সকলের প্রতি দয়া ও রহমত করুন।মুসলমানদের উচিত যখন কোন কিছু দেখে পছন্দ হয়ে যায়; তখন বরকতের দোয়া করা, সেই বস্তু নিজের হোক অথবা অন্যের কেননা নবী করীম (ﷺ) আমেরকে বলেছিলেন, তুমি তার জন্যে (সাহাল বিন হুনাইফের জন্যে) বরকতের দোয়া করনি? কেননা এই দোয়া বদ নজর থেকে সুরক্ষা হয়ে থাকে।

৮৭. জ্বিনের বদ নজর মানুষকে লাগতে পারে

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) জ্বিনের নজর থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন এবং এরপর মানুষের বদ নজর থেকেও পানাহ চাইতেন; সুতরাং যখন সূরা ফালাক ও নাস অবতীর্ণ হল তখন অন্য দোয়া ছেড়ে দিয়ে এই সূরাদ্বয় দিয়ে প্রার্থনা করতেন। (ইমাম তিরমিযী চিকিৎসা বিষয়ক অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেনঃ ২০৫৯, ইবনে মাযাহঃ ৩৫১১, আর আলবানী এটাকে সহীহ বলেছেন।)উম্মুল মু'মিনীন উম্মে সালামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) তার ঘরে একটি বালিকা দেখলেন, যার মুখমন্ডলে জ্বিনের বদনজরের কাল দাগ। তা দেখে তিনি বলেনঃ তাকে ঝাড়-ফুঁক কর কেননা তাকে জ্বিনের বদনজর লেগেছে।” (বুখারীঃ ২০১০/১৭১ ও মুসলিমঃ ২১৯৭)উপরোক্ত হাদীসদ্বয় হতে বুঝা যায়, মানুষ হতে যেমন বদনজর লাগে অনুরূপ জ্বিন হতেও লাগে। এজন্য প্রত্যেক মুসলমানের উচিত সে যখন পোশাক খুলবে, আয়না দেখবে বা সে যে কর্ম করবে তখন যেন দোয়াযিকির পড়ে যাতে সে নিজের, মানুষের ও জ্বিনের বদনজর বা অন্য কোন কষ্ট হতে নিরাপদ বা সংরক্ষিত থাকতে পারে।

৮৮. বদ নজরের চিকিৎসা

যে ব্যক্তি তার অন্য কোনো ভাইয়ের ওপর বদনজর দিয়েছে তার কাছে। একটি পাত্রে করে পানি নিয়ে আসতে হবে। অতঃপর ওই ব্যক্তি পানিতে হাত দেবে এবং পানি নিয়ে মুখ ধুয়ে পরে আবার কুলি করে সেই পানি পাত্রে ফেলবে। অতঃপর সে আবার এ পানি দিয়ে তার মুখমণ্ডল ধৌত করবে। এরপর সে তার ডান হাত পানিতে দিয়ে পানি নিয়ে বাম বাহুর উপর একবার ঢালবে। একইভাবে সে তার বাম হাত দিয়ে পানি নিয়ে ডান বাহুর উপর ঢালবে। অতঃপর সে তার বাম হাত পানিতে দেবে এবং পানি নিয়ে তার ডান হাতের কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত অংশে ঢালবে, একইভাবে সে তার ডান হাত দিয়ে পানি নিয়ে বাম হাতের কনুই থেকে কজি পর্যন্ত অংশে ঢালবে।অতঃপর সে আবার তার বাম হাত দিয়ে পানি নিয়ে ডান পা ধৌত করবে, একইভাবে সে তার ডান হাত দিয়ে পানি নিয়ে বাম পা ধৌত করবে। অতঃপর সে তার বাম হাত দিয়ে পানি নিয়ে ডান হাঁটুর উপর ঢালবে, একইভাবে সে তার ডান হাত দিয়ে পানি নিয়ে বাম হাটুর উপর ঢালবে। এ সবকিছুই করতে হবে পানির পাত্রে উপর, যাতে করে ব্যবহৃত পানি আবার পাত্রেই জমা হয়। অতঃপর সে তার ইযারের উপরের অংশ (ট্রাউজারের কোমরবন্ধনী) পানির পাত্রে রাখবে। পানির পাত্র মাটিতে রাখা যাবে না, এটি রাখতে হবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাথার উপর, এবং এ পানি পেছন দিক থেকে একবারে তার শরীরে ঢালতে হবে।' [সুনান বায়হাকী ৯/২৫২]কাউকে ধৌত করতে বলা হলে সেটা তার জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যাবেঅনেকেই বদনজর দেয়া ব্যক্তিকে তাদের জন্য অযু বা ধৌত করতে বলতে লজ্জা পান। কিন্তু তাদের এ ব্রিতবোধ আসলে ঠিক নয়। কারণ বদনজর অনেক সময় ধর্মভীরু ব্যক্তির পক্ষ থেকেও আসতে পারে। সে কারণেই অনেক স্কলার বলেছেন যে, যে ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির উপর বদনজর দেয়, তার জন্য অযু করা বাধ্যতামূলক।কারণ আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন:“যদি তোমাকে কেউ ধৌত করতে বলে, তাহলে তার জন্য তুমি তা করবে।”তিনি এ ধরনের ব্যক্তিকে ধৌত করার নির্দেশ দিয়েছেন, এবং তার নির্দেশ পালন করা বাধ্যতামূলক।

সেটিংস

বর্তমান ভাষা