পরিচ্ছেদ: মানসিক ও স্নায়বিক রোগের রুকিয়াহ

১০৬. মতিভ্রম

মতিভ্রম এক ধরনের মারাত্মক মানসিক রোগ। কেউ যদি মতিভ্রম দ্বারা পরাভূত হয়ে যায়,তাহলে তার পক্ষে এখান থেকে বের হয়ে আসা খুবই জটিল। কোনো মানুষই এটা থেকে মুক্ত নয়, মতিভ্রম প্রায়ই দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে জীবনে একটার পর একটা মতিভ্রম দেখা দেয়। এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তখন বাস্তবতার তুলনায় ব্যক্তির উপর মতিভ্রমের প্রভাবই বেশি পরিলক্ষিত হয়। কুরআনে নির্দেশিত পন্থায় চিকিৎসার ব্যাপক বিস্তৃতি এবং মানুষের স্নায়বিক রোগের পরিস্থিতি অবলোকন করা, এবং মানুষের মুখ থেকে অথবা বিভিন্ন বই পুস্তক থেকে এ ধরনের ঘটনার বহুল প্রসারের কারণে এ মতিভ্রম এখন অনেক মানুষের মনেই জীবনের একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে গেঁথে যাচ্ছে। এমনকি যারা আল্লাহ‌ভীরু এবং নিজেদের ধর্মীয় প্রতিশ্রুতিতে অটল,তারাও মতিভ্রম থেকে মুক্ত নয়।জ্বিন ও শয়তানের অনিষ্ট নিয়ে মানুষের মনে সবসময়ই ভয় কাজ করে, আর এ ভয়ই মতিভ্রম তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অধিকাংশ মানুষই একটি নির্দিষ্ট রোগ অথবা জীবনের কোনো একটি সমস্যা অথবা সাধারণ বৈবাহিক বিতর্ক অথবা নির্দিষ্ট ঘটনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে শুরু করে। অতঃপর তারা এসব সমস্যার পেছনের কারণ অনুসন্ধান শুরু করে এবং এক সময় সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, অমুক অমুক তার উপর বদনজর দিয়েছে।অথবা হয়ত একজন লোক পড়ে গেল, আর তখনই তার উপর কোনো জ্বিন আছর করে বসল, এমনও হতে পারে। এক্ষেত্রে সে তার অনুভূত লক্ষণগুলো খুলে বলবে।তবে প্রকৃত কথা হল, যদি মতিভ্রম কাউকে আক্রমণ করেই বসে তবে তা হবে তার জন্য খুবই মারাত্মক সমস্যা, কারণ জ্বিন আছর করলে তা কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে রুকিয়া করে সমাধান করা যেতে পারে, কিন্তু মতিভ্রম হল একটি দুষ্টচক্র। একইভাবে, কিছু কিছু লোক মনে মনে ভাবতে পারেন, তাদেরকে কেউ জাদুটোনা করেছে অথবা তাদের উপর কবচ করেছে, আর সে কারণেই তাদের মধ্যে এ এ সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাদের ভাবনা আসলে দ্বিধান্বিত এবং এ কারণে তাদের জীবনও বিশৃঙ্খলায় ভরে যায়। আর তারা বলেন যে, তাদেরকে জাদুটোনা করা হয়েছে।মতিভ্রম যদি জ্বিনের আক্রমণে অথবা জাদুটোনার কারণে হয় তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনায় দ্বিধাগ্রস্ততা দেখা যাবে এবং তার জীবন হবে বিশৃঙ্খলাময়; তার দেহের গ্রন্থিগুলো ঠিকভাবে কাজ করবে না, এবং জ্বিনে ধরা বা জাদুটোনার পূর্ণ লক্ষণ তার মাঝে ফুটে উঠবে। তার পেশীতে সংকোচন বা প্রবল আক্ষেপ শুরু হতে পারে অথবা অটোসাজেশনের ফলাফল হিসেবে রোগী জ্ঞান হারাতে পারে।উদ্বিগ্নতা ও প্রবল আতঙ্কে তার জীবন নিঃশেষ হতে শুরু করে। স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, হৃদপেশীতে প্রবল স্নায়বিক চাপ দেখা যায় এবং শারীরিক লক্ষণগুলো প্রকট আকার ধারণ করে। এতে অসুস্থ ব্যক্তি তার হৃদপিণ্ডে ব্যথা অনুভব করে এবং ভয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যথার তীব্রতাও বৃদ্ধি পায়। স্নায়ুতন্ত্র সঠিকভাবে কাজ না করার কারণে অন্যান্য লক্ষণও প্রকাশিত হতে শুরু করে, এবং একপর্যায়ে পুরো শরীর-ই আক্রান্ত হয়ে পড়ে।হৃদকম্পনের হার বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং কখনো কখনো অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে, রক্তচাপ বেড়ে যায়, পরিপাকতন্ত্র ঠিকভাবে কাজ করে না, পাকস্থলিতে ব্যথা শুরু হয় এবং রোগীর যৌন আকাঙ্ক্ষা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়, যার ফলে রোগী তার স্ত্রীর প্রতি তেমন কোনো আকর্ষণ অনুভব করে না; দেহের পেশীগুলোতে প্রবল স্নায়বিক চাপ শুরু হয় এবং মাথার পেশীর প্রসারণের ফলে মাইগ্রেনের সমস্যা দেখা দেয়।সত্যিকার অর্থে, যারা কুরআনিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করেন তাদের। কাছে যারা চিকিৎসা নেয়ার জন্য শরণাপন্ন হন তারা মূলতঃ মতিভ্রমের শিকার। যদিও তাদের মাঝে জ্বিনে ধরার লক্ষণ রয়েছে, কিন্তু প্রকৃতার্থে খুব অল্প কয়েকজনই জ্বিন দ্বারা আক্রান্ত। মনোবিজ্ঞানের তত্ত্বানুসারে। আসল সত্য হচ্ছে, চলমান উদ্বিগ্নতা তার মধ্যে সত্যিকারের শারীরিক অসুস্থতা তৈরি করে, যার ফলে রোগীর দেহে ব্যথা একটি শারীরিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়, সেটা কোনো দুশ্চিন্তা নয়। উদ্বিগ্নতা থেকে মানুষের শরীরে আলসার, বুকে তীব্র ব্যথাসহ অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, যা। একজনের জীবনকে পরিবর্তন করে দেয়, তার মধ্য থেকে উচ্চাভিলাষ দূর। হয়ে যায় এবং তিনি তার কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এটা তার বৈবাহিক জীবনেও বিঘ্ন ঘটায়, এবং তার জীবন মতিভ্রম ও ভয়ের কাছে বন্দী হয়ে থাকে।এ সমস্যার একটি বাস্তব সমাধান রয়েছে, যদি কোনো লোক দীর্ঘদিন যাবত মতিভ্রমে ভোগেন তাহলে তার সমাধান মনোবিজ্ঞানে রয়েছে। আর তার এ সমস্য যদি সম্প্রতি শুরু হয়ে থাকে, তাহলে তিনি এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠভাবে প্রার্থনা করবেন।

১০৭. স্নায়ুরোগ

স্নায়ুরোগের সংজ্ঞা: প্রবলভাবে পেশী সংকোচনসহ প্রচুর সংখ্যক ক্লিনিক্যাল প্রকাশ থাকায় চিকিৎসকরা স্নায়ুরোগের কোনো সমন্বিত ও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারেননি।এপিলেপটিক সিজার: চিকিৎসকরা এ শব্দ দ্বারা রোগীর শরীরে হঠাৎ আক্রমণকে নির্দেশ করে থাকেন, এ আক্রমণের ফলে দেহে খিচুনি ও কম্পনসহ প্রবল স্নায়বিক চাপ দেখা যায়। চিকিৎসকরা এ রোগকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। গ্রান্ড মল ও পেটিট মল। গ্রান্ডমল সিজার হলে রোগী অচেতন হয়ে যায়, আর অন্যদিকে পেটিটমল সিজার সংঘটিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে, রোগী অথবা তার আশেপাশের কেউ টের পায় না। এ সিজার তিন থেকে দশ সেকেন্ড স্থায়ী হয় এবং এক্ষেত্রে পেশীর সংকোচন দেখা যায় না। এটা হঠাৎ করে সংঘটিত হয়, যার ফলে রোগী হঠাৎ করে কিছুক্ষণের জন্য কথা বন্ধ করে দেয় এবং তারপর বিড়বিড় করে আবার পুরো বিস্তারিত কথা চালিয়ে যেতে থাকে, তবে তার কথার মধ্যে মনোযোগ দেখা যায় না অথবা রোগী তার মূল বিষয় থেকে দুরে সরে যায়। রোগী হঠাৎ করেই কোনো এক দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে, কিছুক্ষণ পরে আবার তার কাজে ফিরে যায়।

১০৮. স্নায়ুরোগের কারণ

এপিলেপটিক সিজারের পেছনে চিকিৎসকরা তিনটি ফ্যাক্টর দাঁড় করিয়েছেন,১. ব্যক্তিগত সম্ভাবনা ও বংশগত২. মস্তিষ্কে সমস্যা৩. নিউরোলজিক্যাল কর্মকাণ্ডে পরিবর্তনতবে এপিলেকটিক সিজারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো জ্বিনের আক্রমণ। কিন্তু এ কারণটি অনেক চিকিৎসকই স্বীকার করতে চান না, যদিও তারাই বলে থাকেন যে, কিছু স্নায়ুরোগের কারণ আধুনিক বিজ্ঞানও আবিষ্কার করতে সক্ষম নয়। আশ্চর্যের বিষয় হল, যারা এটা অস্বীকার করেন তাদের বেশিরভাগই আমাদের নিজেদের লোক, অথচ পাশ্চাত্যের কিছু চিকিৎসক জ্বিনের কারণে সংঘটিত স্নায়ুরোগের কথা স্বীকার করেছেন।শায়খ আবদুল রাযিক তার আলম আল জ্বিন ওয়া মালাইকা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, পাশ্চাত্যের অনেক বিজ্ঞানী এটা স্বীকার করেছেন, তাদের মধ্যে একজনের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, তিনি হলেন অ্যামেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর সাইকোলজিক্যাল রিসার্চ এর সদস্য ক্যারিংটন। ক্যারিংটন তার বই মডার্ন স্পিচুয়াল ফেনোমেনায় জ্বিনের আক্রমণের কথা উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন: জ্বিনে ধরার ঘটনা বিরল হলেও এর সত্যতা রয়েছে, এটি বাস্তব ঘটনা এবং এর সমর্থনে অনেক আশ্চর্যজনক ঘটনা। থাকার পরও বিজ্ঞান বিষয়টিকে অবজ্ঞা করতে পারে না। [আলমুল জ্বিন ওয়া মালাইকাহ, পৃ-৮২]ড. বেল তার অ্যানালাইসিস অব আনইউজুয়াল কেইসেস ইন দ্যা ট্রিটমেন্ট অব মেনটাল এন্ড নার্ভাস ইলনেস বইতে উল্লেখ করেছেন, আমাদের কিছু ঘটনা থাকে যা আমরা খোলাখুলিভাবে বলি বা আলোচনা করি, বিশেষ করে আত্মার আছর করার বিষয়ে, কারণ এটা মানসিক ও স্নায়বিক রোগের একটি কারণজনিত ফ্যাক্টর। আত্মার আছর করা পূর্বের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি জটিল। অতঃপর তিনি আরো বলেন: যখন অধ্যাত্মিক রক্বিরগণ আত্মায় আছর করা লোকের মধ্য থেকে শয়তানের মন্দ আত্মা বিতাড়িত ও অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা করার চেষ্টা করেন, তখন তারা চিকিৎসকদের কাছ থেকে এর জন্য ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য ছাড়া কিছুই পান না।” [আলমুল জ্বিন ওয়া মালাইকাহ, পৃ-৮৩]ড. জেমস হ্যালেসন তার বইয়ে জ্বিনের আছর করা সম্পর্কে বলেন, এটা হল মানুষের মনের উপর স্বাধীন ও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সত্ত্বা দ্বারা সংঘটিত একধরনের অস্বাভাবিক প্রভাব, সুতরাং কোনো সত্ত্বা দ্বারা মনের উপর সৃষ্ট প্রভাব তথা জ্বিনের আছর করার বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। মানুষের মনের উপর জ্বিনের প্রভাব বিস্তার করার বিষয়টি আরো যেসব চিকিৎসক স্বীকার করেছেন তারা হলেন-মিনিপলিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. কার্ল ওয়াকল্যান্ড ও ড. ব্যারজ, মেডিসিন ও সার্জারিতে নোবেল জয়ী ড, অ্যালেক্সিস ক্যারেল। [প্রাগুক্ত, পৃ-৮৩]প্রাচীনকালে স্নায়ুরোগকে বলা হত “ঐশ্বরিক অসুস্থতা” অথবা “পবিত্র অসুস্থতা”, কারণ তারা মনে করতেন এ ধরনের অসুস্থতার পেছনে রয়েছে বাহ্যিক শক্তি অথবা আত্মাদের (জ্বিনের) স্পর্শ। প্রাচীনকালের মানুষ এ রোগকে এর বিধ্বংসী ও হঠাৎ প্রকাশিত লক্ষণগুলো দিয়ে এভাবে ব্যাখ্যা করতেন যে, এ রোগ সংঘটিত হয় অশুভ আত্মার প্রভাবে, যা মানুষের দেহে অথবা মস্তিষ্কে প্রবেশ করে মুখ দিয়ে। অনেক সূত্র থেকে জানা গেছে। যে, গুহামানব ও ইনকা উপজাতির মানুষের মাথার খুলিতে যে ছিদ্র পাওয়া গেছে তা স্নায়ুরোগের (এপিলেপসি) ফল, কারণ এ চিকিৎসার উদ্দেশ্য ছিল মাথার এ ছিদ্র দিয়ে শয়তান বা অশুভ আত্মাকে বিতাড়িত করা। এছাড়াও প্রাচীনকালের মানুষ এ রোগের চিকিৎসার জন্য তাবিজ-কবচ, লিখিত মন্ত্র ব্যবহার করত। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যাজকরা এ রোগের চিকিৎসায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তারা অশুভ আত্মাদের নাম ধরে ধরে ডেকে তাদেরকে বশ করে রোগীর দেহ থেকে বিতাড়িত করতেন।অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে এবং দেখিয়েও দিয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে, এবং এতে সন্দেহের লেশ মাত্র নেই যে, স্নায়ুরোগের অনেক ক্ষেত্রেই তারা জ্বিনদের সঙ্গে কথা বলেছে, তাদের কাছ থেকে রোগীর দেহ ত্যাগ করার এবং কখনো ফিরে না আসার প্রতিশ্রুতি নিয়েছে, যখনই রোগী অচেতন অবস্থা থেকে জেগে উঠেছে তখন আর অসুস্থতার চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।এটা কোনো দ্বিধাবিভক্ত আচরণ নয়, যেভাবে অনেক সাইকোলজিস্ট পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। এর পক্ষে কুরআন ও হাদীসের প্রমাণই যথেষ্ট।

১০৯. শিশুদের স্নায়ুরোগ

শিশুদের মধ্যে যাদের স্নায়ুরোগ রয়েছে তাদের অধিকাংশই পেটিটমল সিজার, যা সাধারণত পাঁচ বছর বয়স থেকে শুরু হয় এবং ১২ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পেটিটমল সিজার পরবর্তীতে আবারো দেখা দিতে পারে অথবা বয়ঃসন্ধিকালে চলে যেতে পারে অথবা এটি গ্রান্ডমল সিজার দ্বারা। স্থলাভিষিক্ত হতে পারে।

১১০. ইলেক্ট্রনিক গেমস ও শিশুদের স্নায়ুরোগ

আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, অনেক শিশুদের মাঝে স্নায়ুরোগ হওয়ার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে ইলেক্ট্রনিক গেমস। মেডিক্যাল প্রতিবেদন থেকেও প্রমাণিত হয়েছে যে, অনেক শিশুর মস্তিষ্ক ইলেক্ট্রনিক গেম থেকে নিঃসরিত মিটমিটে আলোর প্রতি সংবেদনশীল। ব্রিটেনে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার শিশু স্নায়ুরোগে আক্রান্ত এবং এদের মধ্যে শতকরা ৫ জন অসুস্থ হয়েছে শুধু ইলেক্ট্রনিক গেমের কারণে। জাপানে ২০০ শিশুর উপর।পরিচালিত মেডিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে, তাদের আগে কখনো স্নায়ুরোগ ছিল না, কিন্তু ইলেক্ট্রনিক গেম খেলার কারণে তাদের মাঝে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। সম্প্রতি ফ্রান্সে ১০টি শিশু ইলেক্ট্রনিক গেমের কারণে স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। [মাজাল্লাতুল উলুম ওয়াল তানিয়াহ, আল বারনামায আল সানী, ১৭/১১/১৪১৩, ইয়াহ আল মামলাকাত আল আরাবিয়্যাহ আল সাউদিয়াহ]

১১১. যেসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে মেডিক্যাল এপিলেপসিকে আলাদা করা যায়

১. অন্যদের প্রতি রোগীর আক্রমণাত্মক মনোভাব রয়েছে।২. সে মনে করে একমাত্র তার মতামতই সঠিক এবং সে কখনো। অন্যের ভুলকে ক্ষমা করে না।৩. তার মেজাজ ও আবেগ খুবই নিষ্প্রভ এবং ধীরগতির।৪. অনেকসময় সে কোনো ধরনের যাচাই না করেই অকারণে রেগে ফেটে পড়ে।৫. সে প্রায়ই তার কথা ও কর্ম দ্বারা অন্যদেরকে প্রতারিত করে।৬. সে প্রত্যাশা করে অন্যরা তার প্রতি সদয় ও উপকারী হবে।৭. তার মেজাজ ভালোবাস ও ঘৃণা, আগ্রহ ও অনাগ্রহ, দয়ালু ও রুক্ষতার মাঝেই আবর্তিত হয়।৮. সে খুবই সংবেদনশীল হবে এবং সহজেই ভর্ৎসনার শিকার হয়।৯. সে সবসময় মনোঃকষ্টে ভোগে, কারণ তার মনে কোনো নিরাপত্তা ও শান্তি নেই।

১১২. স্নায়ুরোগের চিকিৎসা

মেডিক্যাল এপিলেপসির চিকিৎসার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞান প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে। চিকিৎসকরাও এপিলেপসি শনাক্ত করার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, তারা বেশ দক্ষতার সঙ্গে ব্রেইনের স্ক্যান ইমেজ বিশ্লেষণ করে তারপর নির্দেশ করেন রোগীর কোন ধরনের চিকিৎসা দরকার, তার জন্য কি ওষুধ না কি শৈল্যচিকিৎসা না কাউন্সেলিং দরকার এসব চিকিৎসকের মতামতের উপর নির্ভর করে। চিকিৎসকরা এপিলেপসি বা স্নায়ুরোগের ক্ষেত্রে সাধারণত যেসব পরামর্শ দিয়ে থাকেন সেগুলো আমি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি:১. স্নায়ুরোগীকে তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে এমনসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে হবে, যেমন: পানিতে সাঁতার কাটা, গাড়ি চালানো অথবা পর্বতারোহণ ইত্যাদি।২. সে মিটমিটে আলোর দিকে তাকাতে পারবে না, শিশুদের ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক গেম এবং বড়দের ক্ষেত্রে টেলিভিশন অথবা সিনেমার স্ক্রিনের দিকে তাকানো যাবে না।৩. রোগীর পরিবার রোগীকে নিয়ে অতিমাত্রায় চিন্তিত হয়ে পড়বেন , ঠিক একইভাবে আবার তার সমস্যাকে খুব খাটো করেও দেখবেন না।৪. রোগীর পরিবার রোগীর আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ভর্ৎসনা, বকাবকি, অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ ও ভয় দেখানোর পথ অবলম্বন করবেন না।৫. চিকিৎসকের পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে এবং যথাসময়ে তাকে ওষুধ খাওয়াতে হবে।৬. রোগীকে এমন কোনো খাবার ও পানীয় দেয়া যাবে না যাতে উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী উপাদান রয়েছে, যেমন ধুমপান ও উত্তপ্ত খাবার।অন্যান্য স্নায়ুরোগ অর্থাৎ যেগুলো জ্বিন দ্বারা সংঘটিত হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে সমাধান কেবলমাত্র তাদের কাছেই পাওয়া যাবে যারা কুরআনে নির্দেশিত পন্থায় চিকিৎসা করেন।

১১৩. বিষন্নতা

বিষন্নতা মানে হল তীব্র দুঃখবোধ। এটা বহুল বিস্তৃত মানসিক রোগ, অবশ্য একে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত মানসিক রোগরে মধ্যে অন্যতমও বলা চলে। মৃদু মাত্রার দুঃখবোধ অথবা বিষাদময় অনুভূতির একে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক আবেগ বলা যায়, যা খুব কম মানুষই এড়িয়ে চলতে পারে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মু'মিন ব্যক্তিরাও এটা এড়াতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন:إِنَّمَا النَّجْوَىٰ مِنَ الشَّيْطَانِ لِيَحْزُنَ الَّذِينَ آمَنُوঅর্থঃ গোপন পরামর্শ তো হল মুমিনরা যাতে দুঃখ পায় সে উদ্দেশ্যে কৃত শয়তানের কুমন্ত্রণা মাত্র। (আল মুযাদিলাহ ৫৮:১০)দুঃখবোধ যদি ক্রমেই বৃদ্ধি পায় এবং এক পর্যায়ে কোনো ব্যক্তিকে পরাভূত করে ফেলে তখন তা বিষন্নতায় পরিণত হয়।

১১৪. বিষন্নতার লক্ষণ ও কারণ

বিষন্নতার লক্ষণ:১. বিষাদ ও দুঃখ অনুভব করা।২. ক্ষুধামন্দা।৩. মনোযোগের অভাব ও ভুল করার প্রবণতা।৪. ঘুমে বিঘ্ন ঘটা ও ওজন কমে যাওয়া।৫. যৌন আকাঙ্ক্ষা না থাকা।বিষন্নতার কারণ:১. বাহ্যিক কারণ।২. অভ্যন্তরীণ কারণ।১. বাহ্যিক কারণবিষন্নতার বাহ্যিক কারণের মধ্যে রয়েছে, প্রিয়তম মানুষকে হারানো অথবা অর্থ-কড়ি অথবা সামাজিক অবস্থান হারানো। আর এ ব্যক্তির যদি তার ঈমানকে সুরক্ষিত করার কোনো ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সে বিষন্নতায় পড়ার আগে আরো কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করবে।২. অভ্যন্তরীণ কারণএগুলো সংঘটিত হয় মানুষের শারীরিক গঠনে আক্রমণ করার মাধ্যমে, যেমন: মস্তিষ্কের কোষে থাইরয়েড হরমোন অথবা নির্দিষ্ট কিছু ভিটামিনের অভাব।

১১৫. বিষন্নতার চিকিৎসা

যেহেতু বিষন্নতা একটি মানসিক রোগ, তাই এর চিকিৎসা করতে হবে কুরআনে দেখানো পদ্ধতি অনুসারে, বিশেষ করে বাহ্যিক কারণে বিষন্নতার ক্ষেত্রে। রোগীকে আল্লাহর যিকিরের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, তাকে আরো স্মরণ করিয়ে দিতে হবে আল্লাহর আদেশ (আল ক্বাদা ওয়াল কাদর) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং বিপদে ধৈৰ্য্যধারণকারীদের জন্য আল্লাহর পুরষ্কারের কথা। এক্ষেত্রে সাহাবাদের জীবন থেকে উত্তম দৃষ্টান্তগুলো তুলে ধরতে হবে। এছাড়াও আল্লাহর রাসূল (ﷺ) দুশ্চিন্তা, মনোকষ্ট ও বিষন্নতা থেকে বাঁচার জন্য যেসব দোয়া বর্ণনা করেছেন এবং দৈনন্দিনের নির্ধারিত যিকির তেলাওয়াত করার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। দোয়াগুলো হল:১. ইবনে আব্বাস বিশ্বকাপ থেকে বর্ণিত, মানসিক যন্ত্রণার সময় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এ দোয়া পাঠ করতেন:لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، الْعَظِيْمُ الْحَلِيْمُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، رَبُّ السَّمَاوَاتِ، وَرَبُّ الْأَرْضِ، وَرَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيْمِউচ্চারণঃ লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হুল আযীমুল হালীম, লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু রাব্বুল আরশিল আযীম, লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু রাব্বুস সামা-ওয়া-তি ওয়া রাব্বুল আরদ্বি ওয়া রাব্বুল আরশিল কারীমঅর্থঃ আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন প্রকৃত মাবুদ নেই, যিনি মহান, মহাধৈর্যশীল মহা বিচক্ষণ, আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন প্রকৃত মাবুদ নেই, যিনি মহান আরশের প্রভু, আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন প্রকৃত মাবুদ নেই, যিনি আসমানসমূহের, জমিনের ও সম্মানিত আরশের প্রভু।২. জামে আত্-তিরিমিযীতে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যখন কোনো কারণে মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করতেন, তখন এ দোয়া পাঠ করতেন-يَا حَيُّ يَا قَيُّوْمُ ، بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيْثُউচ্চারণঃ ইয়া- হাইউ ইয়া ক্বাইউমু, বিরা'হমাতিকা আসতাগীছঅর্থঃ হে চিরঞ্জীব সত্তা, হে সকল সৃষ্টির ধারক, আপনার রহমতের দোহাই দিয়ে সাহায্য চাইছি।৩. আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কোনো কারণে দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতেন তখন তিনি আসমানের। দিকে দুই হাত তুলে পাঠ করতেন:سُبْحَانَ اللَّهِ الْعَظِيْمِউচ্চারণঃ সুবহানাল্লাহিল আযীমঅর্থঃ সকল মহিমা আল্লাহ তা'আলার প্রতি, তিনি মহান।এবং কঠিন সংগ্রামের সময় তিনি দোয়া হিসেবে পাঠ করতেন-يَا حَيُّ يَا قَيُّومُউচ্চারণঃ “ইয়া হাইয়ু, ইয়া কাইয়ুম”অর্থঃ হে চিরঞ্জীব,হে চিরস্থায়ী।৪. সুনানে আবু দাউদে আবু বকর আল সিদ্দিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন: “যার মানসিক যন্ত্রণা রয়েছে তার জন্য প্রার্থনা হল-اَللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو فَلَا تَكِلْنِيْ إِلَى نَفْسِيْ طَرْفَةَ عَيْنٍ وَأَصْلِحْ لِي شَأْنِيْ كُلَّهُ لَا إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَউচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা রহ্‌মাতাকা আরজু ফালা- তাকিলনী ইলা- নাফসী ত্বারফাতা ‘আইনিন, ওয়া আসলিহ্ লী শা’নি কুল্লাহু, লা- ইলা-হা ইল্লা- আনতাঅর্থঃ হে আল্লাহ, আমি আপনার দয়ার আশা করছি, আপনি চোখের এক পলকের জন্যও আমাকে আমার নিজ দায়িত্বে ছেড়ে দেবেন না, এবং আমার জীবনের সবকিছুকে সোজা করে দিন, আপনি ছাড়া আর কোনো। ইলাহ্ নেই।৫. আসমা বিনতে উমাইস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমাকে বলেছেন:أَلَا أُعَلِّمُكِ كَلِمَاتٍ تَقُولِينَهُنَّ عِنْدَ الْكَرَبِ أَوْ فِى الْكَرْبِ اللَّهُ اللَّهُ رَبِّي لَا أُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا“আমি কি তোমাকে এমন কিছু কথা (দোয়া) শিখিয়ে দেব না, যেগুলো তুমি বিষন্নতার সময় পাঠ করবে? اَللَّهُ اَللَّهُ رَبِّي لَا أُشْرِكُ بِهِ شَيْئًاউচ্চারণঃ আল্লা-হু, আল্লা-হু রাব্বী, লা- উশরিকু বিহী শাইআনঅর্থঃ আল্লাহ্‌, আল্লাহ্‌ আমার রব, তার সাথে কাউকে শরীক করি না।অন্য এক হাদীসে এসেছে এ দোয়া সাতবার পাঠ করতে হবে।৬. ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন: “কোনো ব্যক্তি উদ্বিগ্নতা ও দুঃখ-কষ্টে ভোগবে না এবং তিনি বলেন:اَللّٰهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ وَابْنُ عَبْدِكَ وَابْنُ أَمَتِكَ، نَاصِيَتِي بِيَدِكَ، مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ، عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ، أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ، سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ، أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَبِكَ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ، أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيْعَ قَلْبِي، وَنُوْرَ بَصَرِيْ (وَنُورَ صَدْرِي)، وَجَلَاءَ حُزْنِيْ، وَذَهَابَ هَمِّيْউচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আবদুকা, ওয়াবনু আবদিকা ওয়াবনু আমাতিকা, না-সিয়াতি বিইয়াদিকা, মা-দিন ফিইয়্যা হুকমুকা, ‘আদলুন ফিইয়্যা ‘ক্বাদা-উকা, আসআলুকা বিকুল্লি ইসমিন হুআ লাকা, সাম্মাইতা বিহী নাফসাকা, আউ আনঝালতাহু ফী কিতা-বিকা, আউ ‘আল্লামতাহু আহাদান মিন খালক্বিকা, আউ ইসতাঅ্‌-ছারতা বিহী ফী ‘ইলমিল ‘গাইবি ‘ইনদাকা আন তাজ‘আলাল ক্বুরআ-না রাবী‘আ ক্বলবী, ওয়া নূরা বাসারী [অন্যান্য বর্ণনায়: নূরা বাসারীর পরিবর্তে: নূরা সাদ্‌রী], ওয়া জালা-আ 'হুঝনী, ওয়া যাহা-বা হাম্মীঅর্থঃ হে আল্লাহ্‌, আমি আপনার বান্দা, আপনার (একজন) বান্দার পুত্র, (একজন) বান্দীর পুত্র। আমার কপাল আপনার হাতে। আমার বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্ত কার্যকর। আমার বিষয়ে আপনার বিধান ন্যায়ানুগ। আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আপনার সকল নাম ধরে বা নামের ওসীলা দিয়ে, যে নামে আপনি নিজেকে ভূষিত করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কিতাবে নাযিল করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কোনো সৃষ্টিকে শিখিয়েছেন, অথবা যে নাম আপনি গাইবী জ্ঞানে আপনার একান্ত নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন (সকল নামের ওসীলায় আমি আপনার কাছে চাচ্ছি যে,) আপনি কুরআন কারীমকে আমার অন্তরের বসন্ত, চোখের আলো (অন্যান্য বর্ণনায় হৃদয়ের আলো), বেদনার অপসারণ ও দুশ্চিন্তার অপসারণ বানিয়ে দিন।তাহলে আল্লাহ তার দুঃখ ও মনোঃকষ্ট দুর করে দেবেন এবং তার যখন প্রয়োজন হবে তখন তাকে আনন্দ দান করবেন।৭. সুনান আত্ তিরমিযীতে সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:دَعْوَةُ ذِي النُّونِ إِذْ هُوَ فِي بَطْنِ الْحُوْتِ {لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنْ الظَّلِمِيْنَ} فَإِنَّهُ لَمْ يَدْعُ بِهَا مُسْلِمٌ رَبَّهُ فِي شَيْءٍ قَطُّ إِلَّا اسْتَجَابَ لَهُযুন নুন যখন মাছের পেটে ছিলেন তখন তিনি এ দোয়া পাঠ করেন: لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَنَউচ্চারণঃ লা- ইলা-হা ইল্লা- আনতা সুবহা-নাকা ইন্নী কুনতু মিনায-যা-লিমীনঅর্থঃ আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আপনি পবিত্র মহান। আমি তো জালিমদের একজন! (আল আম্বিয়াঃ ২১:৮৭) কোনো মুসলমান এ দোয়া পাঠ করে আল্লাহকে ডাকবে আর আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দেবেন না এমনটা হতে পারে না।” অন্য এক হাদীসে এসেছে,إِنِّيْ لَأَعْلَمُ كَلِمَةً لَا يَقُوْلُهَا مَكْرُوْبٌ إِلَّا فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ، كَلِمَةَ أَخِيْ يُوْنُسَ“আমি আমার ভাই ইউনুসের (আঃ) কথা ছাড়া আর কোনো কথা (দোয়া) জানি না, নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার সময় যা বললে আল্লাহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবেন।”৮. সুনানে আবূ দাউদে আবূ সাঈদ আল খুদরী (রহণ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ) একদিন মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং সেখানে আনসারদের একজনকে দেখতে পেলেন, তার নাম আবু উমামাহ। তিনি তাকে বললেন-يَا أَبَا أُمَامَةَ مَا لِيْ أَرَاكَ فِي الْمَسْجِدِ فِيْ غَيْرِ وَقْتِ الصَّلَاةِ“হে আবূ উমামাহ আমি তোমাকে এখন মসজিদে দেখছি কেন, এখন তো নামাজের সময় না?”তিনি বললেন: “দুশ্চিন্তা ও ঋণের বোঝায় আমি নুয়ে পড়ছি।” আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:أَلَا أُعَلِّمُكَ كَلَامًا إِذَا أَنْتَ قُلْتَهُ أَذْهَبَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ هَمَّكَ وَقَضَى عَنْكَ دَيْنَكَ“আমি কি তোমাকে এমন কিছু কথা শিখিয়ে দেব না পাঠ করার পর আল্লাহ তোমার দুশ্চিন্তা দূর করবেন এবং তোমাকে ঋণমুক্ত করবেন?তিনি বললেন: হ্যা আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তিনি বললেন: বল,اَللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِউচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল ‘হাঝানি ওয়াল ‘আজযি ওয়াল কাসালি, ওয়াল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া দালা’ইদ দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজা-লঅর্থঃ হে আল্লাহ্‌ আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি দুশ্চিন্তা, দুঃখ-বেদনা, মনোকষ্ট, অক্ষমতা, অলসতা, কৃপণতা, কাপুরুষতা, ঋণের বোঝা এবং মানুষের প্রাধান্য বা প্রভাবের অধীনতা থেকে।উমামাহ বললেন: এ দোয়া আমি পাঠ করলাম এবং এর পর আল্লাহ তা'আলা আমার দুশ্চিন্তা দূর করে দিলেন এবং আমাকে ঋণমুক্ত করলেন।৯. সুনানে আবু দাউদে ইবনে আব্বাস (আঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:مَنْ لَزِمَ الْاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا، وَمِنْ كُلِّ ضِيْقٍ مَخْرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ“যে ব্যক্তি অবিরত আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, আল্লাহ তার সকল দুশ্চিন্তা ও দুঃখ দূর করে দেবেন এবং তাকে এমন এক উৎস থেকে অনুগ্রহ দান করবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না।”১০. ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:مَنْ كَثُرَتْ هُمُوْمُهُ وَغُمُوْمُهُ فَلْيَكْثِرْ مِنْ قَوْلٍ: لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ“যার অনেক দুশ্চিন্তা ও মানসিক কষ্ট রয়েছে, সে যেন বার বার তেলাওয়াত করে: لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِউচ্চারণঃ লা- হাওলা ওয়ালা- ক্বুওয়্যাতা ইল্লা- বিল্লা-হঅর্থঃ আল্লাহ্‌ ছাড়া কারও কোনও শক্তি-সামর্থ্য নেই।বুখারী ও মুসলিম থেকে এটা প্রমাণিত যে, এ দোয়া বেহেশতের অন্যতম একটি কোষাগার। তিরমিযীতে বলা হয়েছে এটা জান্নাতের একটি দরজা।

১১৬. দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, দুঃখ ও বিষন্নতায় ভুগছেন এমন মানুষের জন্য চৌদ্দটি স্মারক

১. তাওহীদুল রুবুবিয়াহ (প্রতিপালকের একত্ববাদ)২. তাওহীদুল উলুহিয়াহ।৩. ঘোষণা করা যে, আল্লাহ তা'আলা তার বান্দার সঙ্গে ভুল আচরণ করা অথবা বান্দাহকে বান্দার পক্ষ থেকে কোনো কারণ ছাড়াই শাস্তি দেয়ার উর্ধে।৪. বান্দাহর নিজের পক্ষ থেকেই এ স্বীকৃতি দেয়া যে, সে অসৎকর্ম সম্পাদনকারী।৫. আল্লাহর সুন্দর ও প্রিয়তম নামসমূহ দিয়ে আল্লাহর কাছে সনির্বন্ধ প্রার্থনা করা। আল্লাহ তা'আলার সবচেয়ে সুন্দর অর্থবোধক ও গুণবাচক নামসমূহ হল-আল হাইয়ুন (চিরঞ্জীব), আল কাইউম (চিরস্থায়ী)৬. একমাত্র আল্লাহর সাহায্য কামনা করা। ৭. আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখা।৮. সম্পূর্ণ আস্থা আল্লাহর উপর রাখা এবং জীবনে সকল কিছু তাঁরই হাতে সোপর্দ করা, সবার জীবন একমাত্র তাঁরই হাতে এ ঘোষণা দেয়া, আল্লাহ তার ইচ্ছা অনুযায়ী একজনের জীবন পরিচালনা করেন, তাঁর আদেশ কার্যকর হবেই এবং তাঁর আদেশ বা আদেশ ন্যায়বিচারপূর্ণ এ কথার স্বীকৃতি দেয়া।৯. তার হৃদয়কে বিচরণ করতে দেয়া, যেন এটা সন্দেহ, অভিলাষ ও আকাক্ষার অন্ধকার দূর করার জন্য আলোর সন্ধানে কুরআনের বাগানে বিচরণ করছে।১০. আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করা। ১১. তাওবাহ করা। ১২. আল্লাহর পথে জিহাদ করা। ১৩. সালাত।১৪. এ কথা স্বীকার করা যে, কারো হাতে আদৌ কোনো শক্তি বা ক্ষমতা নেই, আর সব ক্ষমতা তাঁরই হাতে যার হাতে সবার প্রাণ, যিনি সবাইকে তার হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছেন।যেসব বিষন্নতার কারণ অভ্যন্তরীণ সেসব সমস্যার সমাধান চাইতে হবে মনোবিজ্ঞানীদের কাছে, বিশেষ করে মেডিক্যাল পরীক্ষায় যদি মস্তি ষ্কের কোষে কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে অথবা হরমোনের ঘাটতি দেখা যায়। আর যদি স্পষ্ট কোনো মেডিক্যাল কারণ না থাকে তাহলে এ সমস্যার জন্য রুকিয়া পাঠ করাতে কোনো দোষ নেই, কারণ বিষন্নতা হল জ্বিনে ধরার অন্যতম একটি লক্ষণ। শেষ কথা হল, কুরআনিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও মনোবিজ্ঞানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, সাংঘর্ষিকতা নেই।

১১৭. উদ্বেগ

উদ্বেগ মানে হল অস্থিরতা; এটা প্রশান্তি বা শান্ত শব্দের বিপরীত। উদ্বেগ এক ধরনের মনোবৈজ্ঞানিক তথা মানসিক রোগ, এর বৈশিষ্ট্য হলদুশ্চিন্তা, ভয় ও আতঙ্ক। তবে এটা নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না সেটা অস্পষ্ট। এটা ক্রনিকও হতে পারে।উদ্বেগ এমন একটি মানসিক ব্যাধি প্রত্যেককেই যার মুখোমুখি হতে হয়, বিশেষ করে যখন তারা বিশেষ বিশেষ কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন, তবে উদ্বেগের মোকাবিলা সবাইকে করতে হলেও এক্ষেত্রে আবার ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি ভেদ পরিলক্ষিত হয়, এটা নির্ভর করে তারা মনোবিজ্ঞানের ভিত্তিতে কতটা সুরক্ষিত এবং তাদের ব্যক্তিগত উদ্বেগউৎকণ্ঠার মাত্রা কতটুকু তার উপর। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও ঘটনাগুলোর মধ্যেও বেশ পার্থক্য দেখা যায়।

১১৮. উদ্বেগের লক্ষণ ও কারণ

উদ্বেগের লক্ষণ:১. হৃদপিণ্ডে ব্যথা;অনিয়মিত হৃদকম্পন। ২. মৃত্যু চিন্তা এবং ভারসাম্য হারানো।৩. অবিরাম তীব্র মাথা ব্যথা।৪. অনিদ্রা।৫. ক্ষীণ স্মৃতিশক্তি ও চিন্তায় জটিলতা।এছাড়াও উদ্বেগের আরো কিছু লক্ষণ রয়েছে।উদ্বেগের বেশ কিছু কারণ:১. তীব্র উৎকণ্ঠা অনুভব করা এবং বিভিন্ন বিষয়ে খারাপ লাগা।২. ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং যে দ্বন্দ্বের কারণে তার মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় না।৩. মানসিক অথবা শারীরিকভাবে চরম পরিশ্রান্তি; যা একটি আরেকটির সঙ্গে জড়িত।এ উদ্বেগ যত বেশি স্থায়ী হবে এটা ক্রনিক হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি, চরম পরিশ্রান্তির লক্ষণ প্রকাশিত হতে শুরু করবে এবং পাশাপাশি কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেবে যেমন:হৃদপিণ্ডে সমস্যা, উচ্চরক্তচাপ, পাকস্থলি ও অন্ত্রে আলসার এবং আরো কিছু শারীরিক রোগ দেখা দেবে।

১১৯. উদ্বেগের চিকিৎসা

উদ্বেগ হল প্রশান্তির বিপরীত, মহান আল্লাহ তা'আলার কিতাব এবং আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) হাদীসে এ রোগের প্রতিকার দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন:الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللَّـهِ ۗ أَلَا بِذِكْرِ اللَّـهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ﴿٢٨﴾অর্থঃ ‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়’। (সূরা আল-রা'দ ১৩:২৮)উদ্বেগের কারণ যদি হয় ভয় ও উৎকণ্ঠা তাহলে এর প্রতিকার ইসলামে রয়েছে। মানুষের ভয় তৈরি হয় তিনটি প্রধান ইস্যু থেকে: খাদ্যসংস্থান, মৃত্যু ও অভিশপ্ত অথবা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হওয়া। আল্লাহ তা'আলা এসব বিষয়ের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন, তিনি বলেন:وَكَأَيِّن مِّن دَابَّةٍ لَّا تَحْمِلُ رِزْقَهَا اللَّـهُ يَرْزُقُهَا وَإِيَّاكُمْ ۚ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ﴿٦٠﴾অর্থঃ আর এমন কত জীব-জন্তু রয়েছে, যারা নিজদের রিয্ক নিজেরা সঞ্চয় করে না, আল্লাহই তাদের রিয্ক দেন এবং তোমাদেরও। আর তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী। (সূরা আল আনকাবুত ২৯:৬০)إِنَّ اللَّـهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ ﴿٥٨﴾অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহই রিয্কদাতা, তিনি শক্তিধর, পরাক্রমশালী। (সূরা আয-যারিয়াত ৫১:৫৮)وَفِي السَّمَاءِ رِزْقُكُمْ وَمَا تُوعَدُونَ ﴿٢٢﴾অর্থঃ এবং আকাশে আছে তোমাদের রিয্‌ক আর আছে যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে। (সূরা আয-যারিয়াত ৫১:২২)মৃত্যু প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন:وَهُوَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ وَلَهُ اخْتِلَافُ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ ﴿٨٠﴾অর্থঃ আর তিনিই জীবন দেন ও মৃত্যু দেন এবং রাত ও দিনের পরিবর্তন তাঁরই অধিকারে। তবুও কি তোমরা বুঝবে না? (সূরা আল-মু'মিনুন ২৩:৮০) একইভাবে, অভিশপ্ত হওয়া অথবা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হওয়া, উপকার-ক্ষতি। সবই একমাত্র আল্লাহর হাতে এবং অবশ্য এগুলো মানুষ তার মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ই লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।আর উদ্বেগের কারণ যদি হয় মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, তাহলে আল কুরআন তাকে সত্যকে অনুসরণ করার দিকনির্দেশনা দিচ্ছে; এ পথ মানুষের ওইসব আকাক্ষাকে দমন করে, নিয়মানুবর্তি করে। মানুষের দেহ ও আত্মার যেসব আকাঙ্ক্ষা। ফিতরাত বা তার স্বভাবের উপর তৈরি হয় সেগুলোকে ইসলাম কখনোই। অবরুদ্ধ করে না। সহীহ হাদীসে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:إِنِّيْ أَنَامُ وَأَقُوْمُ وَأُفْطِرُ وَأَصُوْمُ وَأَنْكِحُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسِ مِنِّيْ“আমি ঘুমাই এবং আমি জাগ্রত হই (রাতের সালাতের জন্য), আমি রোযা রাখি (কিছু দিন) এবং আমি (কিছু দিন) রোযা রাখি না, এবং আমি নারীকে বিবাহ করেছি। যে ব্যক্তি আমার এ সুন্নাহ থেকে দূরে সরে যাবে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” কিন্তু সবকিছুই সঠিক ক্ষেত্রে সঠিক উপায়ে করতে হবে।একইভাবে সকল ‌ইবাদত যেমন: সালাত, আল্লাহর যিকির ও কুরআন তেলাওয়াত হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয় এবং এর মাধ্যমেই মহান।আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার সঙ্গে বান্দার সুন্দর সংযোগ ও সম্পর্ক তৈরি হয়। এ ‌ইবাদত মানুষকে আধ্যাত্মিক শক্তি প্রদান করে, তার মন থেকে সকল ভয়-আতঙ্ক দূর করে এবং তাকে একাকিত্ব থেকে মুক্তি দেয়, কারণ। ‌ইবাদতের মাধ্যমেই বান্দার সঙ্গে সেই সৃষ্টি কর্তা ও প্রতিপালকের সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হয় যার হাতে রয়েছে তার প্রাণ। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যদি কোনো কারণে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতেন তাহলে বলতেন:أَرِحْنَا بِالصَّلَاةِ يَا بِلَالُ“হে বেলাল, চল আমরা সালাতের মধ্যে স্বস্তি খুঁজে নেই।”এবং তিনি বলতেনঃجُعِلَتْ قُرَّةُ عَيْنِىَ فِى الصَّلَاةِ“সালাতেই আমার আনন্দ।”অর্থাৎ সালাতের মাঝেই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর স্বস্তি ও আনন্দ ছিল।কুরআন ও সুন্নাহ হল পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, এতে রয়েছে অসুস্থতার এমন প্রতিরক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা যা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে দূরীভূত করে দেয়।

১২০. নিঃসঙ্গতার সময় যা বলতে হবে

আল ওয়ালিদ বিন আল ওয়ালিদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি নিঃসঙ্গতা বোধ করছি। তিনি বললেন: যখন তুমি ঘুমাতে যাবে তখন বলবে:أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ مِنْ غَضَبِهِ وَعِقَابِهِ وَمِنْ شَرِّ عِبَادِهِ وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِيْنِ وَأَنْ يَحْضُرُوْنِউচ্চারণঃ আ‘ঊযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত তা-ম্মাতি মিন ‘গাদ্বাবিহী ওয়া ‘ইক্বা-বিহী ওয়া মিন শার্‌রি ‘ইবা-দিহী, ওয়া মিন হামাযা-তিশ শায়া-তীনি ওয়া আন ইয়া’হদ্বুরূন”অর্থঃ আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি আল্লাহ্‌র পরিপূর্ণ বাক্যাবলির, তাঁর গযব-ক্রোধ থেকে, তার শাস্তি থেকে, তাঁর সৃষ্টির অকল্যাণ থেকে, শয়তানের তাড়না বা প্ররোচনা থেকে এবং আমার কাছে তাদের উপস্থিতি থেকে। [ইবনে আল সুন্নী: মা ইয়াকুল ইযা আখাযা মাদজাআ'হু, পৃ-২০১, নং-৭০৫, হাসান। তিরমিযিঃ ৩৫২৮]আল বারাআ' বিন আযীব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার এক লোক আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) কাছে এসে তার নিঃসঙ্গতার কথা খুলে বলল। তিনি বললেন: বার বার এ দোয়া পাঠ করবেঃسُبْحَانَ الْمَلِكِ الْقُدُّوسِ، رَبِّ الْمَلَائِكَةِ، وَالرُّوحِ، جَلَّلْتَ السَّمَاوَاتِ بِالْعِزَّةِ وَالْجَبَرُوْتِউচ্চারণঃ “সুবহানাল মালিকিল কুদ্দুসি, রব্বিল মালাইকাতি ওয়ার রূহ, জাল্লালতাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা বিল ই’যযাতি ওয়াল জাবারূত।”অর্থঃ সকল মহিমা সার্বভৌম আল্লাহ তা'আলার, তিনি মহান, ফেরেশতাগণ ও আত্মাদের (রূহ) তিনি প্রতিপালক, (হে আল্লাহ) আপনি আপনার ক্ষমতা ও শক্তি দিয়ে আসমান ও জমীন পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন।”লোকটি এ দোয়া পাঠ করল এবং তার একাকীত্ব ঘুচে গেল। নিঃসঙ্গতার সময়ে সর্বোত্তম দোয়া হল,أَعُوذُ بِاللَّهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِউচ্চারণঃ আ‘ঊযু বিল্লা-হিস্‌ সামি‘ইল-‘আলীমি মিনাশ শাইত্বা-নির রাজীমঅর্থঃ আমি সর্বজ্ঞাতা, সর্বশ্রোতা মহান আল্লাহ তা'আলার কাছে অভিশপ্ত শয়তানের হাত থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।আল্লাহ বলছেন:وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ ۖ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ﴿٣٦﴾অর্থঃ আর যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোন কুমন্ত্রণা কখনো তোমাকে প্ররোচিত করে, তাহলে তুমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাত। (আল ফুসসিলাতঃ ৪১:৩৬)আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:يَأْتِي الشَّيْطَانُ أَحَدَكُمْ فَيَقُولُ مَنْ خَلَقَ كَذَا مَنْ خَلَقَ كَذَا حَتَّى يَقُولَ مَنْ خَلَقَ رَبَّكَ فَإِذَا بَلَغَهُ فَلْيَسْتَعِذْ بِاللَّهِ وَلْيَنْتَهِ“শয়তান তোমাদের কাছে এসে বলবে: “এটা, ওটা, এগুলো কে সৃষ্টি করেছে?” এভাবে বলতে বলতে এক পর্যায়ে সে বলবে: “তোমার সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে?” যখনই শয়তান এ চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেবে, তখনই সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং এ চিন্তা মাথা থেকে বাদ দেবে।” আল-সহীহগ্রন্থে বর্ণিত এ হাদীসের আরেক সংস্করণে এসেছে,لَا يَزَالُ النَّاسُ يَتَسَاءَلُوْنَ حَتَّى يُقَالَ هٰذَا خَلَقَ اللَّهُ الْخَلْقَ فَمَنْ خَلَقَ اللَّهَ؟ فَمَنْ وَجَدَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَلْيَقُلْ آمَنْتُ بِاللَّهِ“মানুষ তোমাকে প্রশ্ন করতে থাকবে, এটা আল্লাহর সৃষ্টি, কিন্তু আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছে?' যদি কোনো ব্যক্তিকে তোমরা এটা বলতে শোন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলে দেবে, আমি আল্লাহ তা'আলা ও তার রাসূলের (সহী) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি।” [ফাতহুল বারী, বাব সিফাতি ইবলিস, ৪/১৪৯]আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন:مَنْ وَجَدَ مِنْ هَذَا الْوَسْوَاسِ فَلْيَقُلْ: آمَنْتُ بِاللَّهِ وَرَسُوْلِهِ (ثَلَاثًا) فَإِنَّ ذَلِكَ يُذْهَبُ عَنْهُ“যে ব্যক্তি এ ধরনের ওয়াসওয়াসা দেখবে বা প্রত্যক্ষ করবে, সে যেন ওই ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে তিনবার বলে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি, তাহলে এ চিন্তা তোমার মাথা থেকে দূর হয়ে যাবে।” [ইবনে আল সুন্নি, বাব মা ইয়াকুল মান উবতুলিয়াহ বিল ওয়াসওয়াসা, পৃ১৮১, নং-৬২৬]উসমান বিন আবুল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বললেন, আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) শয়তান আমার ও আমার সালাত এবং তেলাওয়াতের মাঝে হস্তক্ষেপ করেছে এবং এর মাধ্যমে আমাকে বিভ্রান্ত করেছে।” আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেনঃذَاكَ الشَّيْطَانُ يُقَالُ لَهُ خِنْزَبٌ فَإِذَا أَحْسَسْتَهُ فَتَعَوَّذْ بِاللَّهِ مِنهُ، وَاتْفُلْ عَنْ يَّسَارِكَ ثَلَاثًا“এটাকে (শয়তান) বলে খিজাব। তুমি যখন এর মুখোমুখি হবে তখন তার হাত থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং তোমার বাম দিকে তিনবার থু থু নিক্ষেপ করবে।”অতঃপর আমি এটা করলাম এবং আল্লাহ আমার নিঃসঙ্গতা দূর করে দিলেন। [সহীহ মুসলিম, কিতাবুস সালাম,বাবুত তাওয়াউয মিনাশ শায়তানুল ওয়াসওয়াসা ফিল সালাহ, ৪/১৭২৮, নং-৬৮]আবূ জামেল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি ইবনে আব্বাসকে (রাঃ) বললাম: “আমি আমার হৃদয়ে কিছু একটা অনুভব করছি।” তিনি। বললেন: “কী সেটা?” আমি বললাম: আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছিনা। তিনি বললেন: এটা কি কোনো ধরনের সন্দেহ?' তিনি স্মিত হাসলেন এবং বললেন: আল্লাহ তা'আলা নিম্নোক্ত এ আয়াত নাযিল করা পর্যন্ত কেউই এটা থেকে মুক্ত হতে পারত না।فَإِن كُنتَ فِي شَكٍّ مِّمَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ فَاسْأَلِ الَّذِينَ يَقْرَءُونَ الْكِتَابَ مِن قَبْلِكَ ۚ لَقَدْ جَاءَكَ الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ ﴿٩٤﴾অর্থঃ আমি তোমার নিকট যা নাযিল করেছি, তা নিয়ে তুমি যদি সন্দেহে থাক, তাহলে যারা তোমার পূর্ব থেকেই কিতাব পাঠ করছে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর। অবশ্যই তোমার নিকট তোমার রবের পক্ষ থেকে সত্য এসেছে। সুতরাং তুমি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। (সূরা ইউনুস ১০:৯৪)তিনি আমাকে আরো বললেন, যখনই তুমি তোমার হৃদয়ে কিছু অনুভব করবে তখনই বলবেهُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ ۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ﴿٣﴾অর্থঃ তিনিই প্রথম ও শেষ এবং প্রকাশ্য ও গোপন; আর তিনি সকল বিষয়ে সম্যক অবগত। (সূরা আল হাদীদ ৫৭:৩) সহীহ মুসলিমে আবুল কাশিম আল কুশাইরির পত্রে ইমাম মুসলিমের সনদে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আহমাদ বিন আতা আল রাওযাবারী। আল সাইয়িদ আল জালীল আমাকে বলেন: পবিত্রতার বিষয়ে আমি ওয়াসওয়াসা অনুভব করছি; এক রাত্রে আমি এত বেশি পানি ব্যবহার। করলাম যে, আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম, এবং আমার হৃদয়ে কোনো। প্রশান্তি ছিল না, কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছিল। তখন আমি বললাম: হে প্রতিপালক, আপনার ক্ষমা, আপনার ক্ষমা চাচ্ছি। তখন আমি একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, কেঁদে কেঁদে বলছে, জ্ঞানের মাঝেই ক্ষমা রয়েছে। অতঃপর আমার সেই চিন্তা দূর হয়ে গেল।আলিমগণের মধ্যে একজন বলেছেন যে, যখন কারো অযু অথবা সালাতের বিষয়ে ওয়াসওয়াসা অনুভব হবে, তখন তার জন্য “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' (আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই) এ যিকির করা মুস্তাহাব, কারণ শয়তান আল্লাহর যিকির শোনামাত্রই নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে পালায়। আর “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’হল সর্বোত্তম যিকির।এছাড়াও আলিমগণ (স্কলারগণ) বলেছেন, ওয়াসওয়াসা দূর করার জন্য সর্বোত্তম ও সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল বেশি বেশি করে আল্লাহর যিকির করা।ইমামদের মধ্য থেকে একজন বলেছেন, যাদের ঈমান বেশি খাঁটি তাদেরকেই ওয়াসওয়াসা দিয়ে পরীক্ষা করা হয়, কারণ চোর কখনো জীর্ণকুটির টার্গেট করে না।আল সাইয়িদ আল জালীল আহমাদ বিন আবুল হাওয়ারি বলেন: আমি আবু সুলাইমান আল দারানির কাছে ওয়াসওয়াসার বিষয়ে অভিযোগ করলাম, তিনি বললেন: তুমি যদি এটা বন্ধ করতে চাও তাহলে যখনই এর মুখোমুখি হবে তুমি এটা উপভোগ করবে, এটা উপভোগ করতে শুরু করলেই এটা বন্ধ হয়ে যাবে, কারণ শয়তানের কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর ও কষ্টকর বিষয় হল মু'মিনের সুখ, মু'মিনের আনন্দ।

সেটিংস

বর্তমান ভাষা