পরিচ্ছেদ: ফেরেশতারা যাদের অভিশাপ দেন

১৪৩. সাহাবাদের বিরুদ্ধে খারাপ মন্তব্যকারীগণ

যে সকল হতভাগাদেরকে ফেরেশতারা অভিশাপ করে তাদের প্রথম শ্রেণী হলো ঐ সকল লোক যারা নবীগণের সরদার মুহাম্মদ (ﷺ)-এর সাহাবাগণকে গালি দেয়।ইমাম তাবারানী (র) আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“যে ব্যক্তি আমার সাহাবীগণকে গালি দিল তার ওপর আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা ও সকল মানুষের অভিশাপ।” (আল মুজামুল কাবীর হাদীস নং ১২৭০৯, ১২/১১০-১১১, শায়খ আলবানী এ হাদীসকে ‘হাসান' বলেছেন। দেখুন: সহীহ হাদীস সিরিজ ২৩৪০, ৫/৪৪৬-৪৪৭, সহীহ জামেস সাগীর হাদীস নং ৬১৬১, ৫/২৯৯)এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা মানাবী (র) বলেন, سَبَّهُمْ অর্থাৎ যে তাদেরকে গালি দিলো—فَعَلَيْهُ لَعْنَةُ اللَّهِ والْمَلائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَআল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সৎলোকদের দল থেকে বের করে দেন, এবং সৃষ্টিজীব তাদের জন্য বদদোয়া করে থাকে। (ফায়যুল কাদীর ৬/১৪৬-১৪৭)এছাড়াও নবী (ﷺ) তাঁর সাহাবীদেরকে গাল-মন্দের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করা থেকে স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। ইমাম মুসলিম (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“তোমরা আমার সাহাবীগনকে গালি দিও না। তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিও না। যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ!, তোমাদের মাঝে কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ দান করে, আমার সাহাবীগণের এক মুদ বা অর্ধ মুদ পরিমাণ (শস্য) দানের সমান সওয়াব পাবে না। (এক সা অর্থাৎ: পৌনে তিন কিলোগ্রাম এর চার ভাগের এক ভাগ। দেখুন: আন নিহায়াহ ফি গারীবিল হাদীস ওয়াল আসার ৪/৩০৮) (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ২২১ (৩৫৪০) ৪/১৯৬৭, ইমাম ৬২ বুখারী এ হাদীসকে আবু সাইদ খুদরী (রা) হতে বর্ণনা করেন, দেখুন: সহীহ বুখারী হাদীস নং ৩৬৭৩, ৭/২১)ইমাম তাইবী (র) নবী (ﷺ)-এর উপরোক্ত বাণীর ব্যাখ্যায় বলেন, সাহাবীগণের মধ্য হতে কোন ব্যক্তি এক বা অর্ধ মুদ দান করে তাদের এখলাস, নিয়তের পরিপূর্ণতা এবং পূর্ণ ব্যক্তিত্বের কারণে তারা যে সওয়াব অর্জন করেছে, তোমাদের কেউ উহুদ পাহাড় সমতুল্য স্বর্ণ দান করলেও তাদের সমতুল্য হবে না। (৩. শারহু তাইবী ১২/৩৮৪১)নবী (ﷺ) তাঁর সাহাবীগণকে গালির কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করা থেকে শুধু নিষেধই করেননি; বরং যে ব্যক্তি তাদেরকে গালি দিবে তাদেরকে তিনি অভিশাপ করেছেন।ইমাম তাবারানী আয়েশা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—-“তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিও না। যে ব্যক্তি তাদেরকে গালি দিবে তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ।” (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, কিতাবুল মানাকিব, ১০/২১, হা: হাইসামী (রা) এই হাদীসের ব্যাপারে বলেন, তাবারানী হাদীসটিকে আল আউসাতে বর্ণনা করেছেন, এবং আলী বিন সাহাল ব্যতীত সবাই সহীহ বর্ণনাকারীদের অন্তর্ভুক্ত। আর তিনিও বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী (কিতাবুল মানাকিব: ১০/২১) ইমাম তাবারানী ইবনে উমার (রা) হতে বর্ণনা করেন, নবী (ﷺ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির অভিশাপ করেন, যে আমার সহাবীগণকে গালি দেয়। দেখুন: সহীহ আল জামে আস সাগীর হাদীস নং ৪৯৮৭, ৫/২৩, শায়খ আলবানী এ হাদীসকে হাসান বলেছেন।)আল্লামা মুনাবী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, দ্বীনের সাহায্যে সাহাবীগণের খেদমতের পরিপ্রেক্ষিতেই যে তাদেরকে গালি দিবে, নবী (ﷺ) তাদেরকে বদদোয়া করেছেন। সাহাবীগণকে গালি দেয়া কবীরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত এবং ভয়ানক অপরাধ।কতিপয় আলেমের অভিমত হলো, আবু বকর সিদ্দীক (রা) ও উমর ফারুক (রা) কে গালি দাতাকে হত্যা করা উচিত। (ফায়যুল কাদীর ৫/২৭৪)সাহাবীগণকে গালি দেয়াকে সালাফে-সালেহীন ও মুসলিম মনীষীগণ কঠোর সমালোচনা করেছেন। নিম্নে এ ব্যাপারে তাদের একটি ঘটনা ও কতিপয় উক্তি উল্লেখ করা হলো—ক. কায়েস বিন রাবী' ওয়ায়েল বিন বাহাই হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, উবায়দুল্লাহ বিন উমার এবং মেকদাদ (রা)-এর মাঝে ঝগড়া হলে উবায়দুল্লাহ বিন উমার (রা) মেকদাদ (রা)-কে গালি দিয়ে বসে, উমর (রা) এ কথা শুনার পর বললেন, তোমরা কামারটিকে (উবায়দুল্লাহকে) আমার কাছে নিয়ে আস, আমি তার জিহ্বাকে কেটে নেব, যাতে সে নবী (ﷺ)-এর কোন সাহাবাকে আর কোন দিন গালি দিতে না পারে।এক বর্ণনায় এসেছে, উমর (রা) উবায়দুল্লাহ (রা)-এর জিহ্বা কাটার ইচ্ছা পোষণের পর নবী (ﷺ)-এর অন্যান্য সাহাবীগণ তার সঙ্গে আলোচনা (ক্ষমার জন্য সুপারিশ) করছিল, তিনি তখন বললেন, আমার ছেলের জিহ্বা কাটতে দাও, যাতে করে অন্য কেউ নবী (ﷺ)-এর কোন সাহাবীকে গালি দেয়ার সাহস না করে।শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (র) এ ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন, উমর (রা) সম্ভবত সাহাবীগণের সুপারিশের কারণেই তার জিহ্বা কাটা থেকে বিরত ছিলেন, তারা সত্যের ওপরই ছিলেন এবং সম্ভবত মেকদাদ (রা)ও সুপারিশকারীদের একজন ছিলেন। (আস সারেমুল মাসল ৫৮৫ পৃঃ)খ. ইমাম মুসলিম (র) উরওয়া (র) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আয়েশা (রা) আমাকে বলেছেন, হে ভাগ্নে। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন নবী-এর সাহাবীগণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আর তারা তা না করে তাদেরকে গালির কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করেছে। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ১৫ (৩০২২), ৪/২৩১৭)গ. আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা) বলেন, তোমরা নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর সাহাবীগণকে গালি দিও না। কেননা তাদের একটি কাজ তোমাদের সারা জীবনের আমল থেকে উত্তম। (আস সারেমুল মাসলুল হতে গৃহীত ৫৮০ পৃ:)ঘ. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (র) বলেন, সাহাবীগণের কারো সম্পর্কে কটুক্তি বা তাঁদের প্রতি অপবাদ দেয়া কারো জন্যই বৈধ নয়। যদি কেউ এমন আচরণে লিপ্ত হয়, তবে বিচারকের কর্তব্য হলো, তিনি যেন সে সময় তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেন এবং শাস্তি প্রদান করেন। পক্ষান্তরে বিচারকের তাকে ক্ষমা করে দেয়া বৈধ হবে না। বরং তার ওপর গুরু দায়িত্ব হলো তিনি যেন তাকে শাস্তি প্রদান করেন ও তওবা করান। যদি তওবা করে, তবে তা যেন গ্রহণ করে নেন আর যদি সে খারাপ মন্তব্যের ওপর অটুট থাকে; তবে বিচারক তাকে পুনরায় শাস্তি প্রদান করবেন। স্থায়ীভাবে তাকে জেলে বন্দী করে রাখবেন। তওবা বা মৃত্যুর পরেই তাকে জেল হতে মুক্ত করবে। (৩. আস সারেমুল মাসল ৫৬৮ পৃ:)ঙ. তিনি আরো বলেন। যখন তোমরা কাউকে নবী (ﷺ)-এর সাহাবীগণের কটুক্তি করতে দেখবে তখন সে মুসলমান আছে কিনা তা যাচাই করে দেখ। (আস সারেমুল মাসল ৫৬৮ পৃ:)চ. ইমাম নববী বলেন: সাহাবীগণকে গালি দেয়া হারাম এবং তা কবীরা গোনাহর অন্তর্ভুক্ত, চাই সে সমস্ত সাহাবী ফিতনায় জড়িয়ে পড়েন বা বিরত থাকেন। কেননা তাদের পরস্পরে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ ছিল তাদের এজতেহাদী ভুল। (শারহু নববী ১৬/৯৩)ছ. শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (র) সাহাবীগণের সাথে শত্রুতা করা নিষেধ- এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করার পর বলেন, যারা সাহাবীগণকে গালি দেয়, তারা তাদের সাথে শত্রুতা রাখার চেয়ে বেশী অপরাধী। এমন ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস না রাখা মুনাফিকদের ন্যায়। (আস সারেমুল মাসল ৫৮১ পৃঃ)হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এমন বদ নসীব লোকদের অন্তর্ভুক্ত করবেন না, যারা নবী (ﷺ)-এর সাহাবীগণকে গালি দিয়ে ফেরেশতা ও কূল মাখলুকাতের অভিশাপের উপযুক্ত হয়ে পড়ে। আমীন।

১৪৪. মদীনাতে বিদয়াতকারী অথবা বিদয়াতীকে আশ্রয়দানকারীগণ

যে সমস্ত অধম ব্যক্তিদেরকে ফেরেশতারা অভিশাপ করে থাকে, তাদের দ্বিতীয় প্রকার হলো যারা মদীনাতে বিদয়াতে লিপ্ত অথবা বিদয়াতকারীকে আশ্রয় দেয়। ইমাম মুসলিম (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, নবী (ﷺ) এরশাদ করেন—“মদীনা হলো হারাম। যে ব্যক্তি সেখানে বিদয়াত প্রবর্তন করবে বা বিদয়াতীকে আশ্রয় দিবে তার ওপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল ও সমস্ত মানুষের অভিশাপ। কিয়ামতে তাদের ফরজ, নফল কোন আমলই গ্রহণ করা হবে না।” [সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৪৬৯ (১৩৭১), ২/৯৯৯, এ বিষয়ে আরো হাদীস বর্ণনা করেন ইমাম বুখারী ও মুসলিম, আলী (রা) ও আনাস বিন মালেক (রা) হতে, দেখুন: সহীহ বুখারী হাদীস নং ১৮৬৭, ১৮৭০, ৪/৮১, সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৪৬৩ (১৩৬৬) ও ৪৬৭ (১৩৭০) ২/৯৯৪]এ ক্ষেত্রে পাঠকমণ্ডলী নিম্নের কথাগুলির প্রতি মনোনিবেশ করুন:১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী: مَنْ اَحْدَثَ فِي الْمَدِيْنَةِ حَدَثًاএর ব্যাখ্যায় কাজী ইয়াজ (র) লিখেছেন, এর অর্থ হলো, যে কোন প্রকার গোনাহ করা। (শারহু নববী ৯/১৪০)আল্লামা ইবনে আসীর (র) বলেন, الْحَدَثُ এর অর্থ হলো, এমন নব প্রথা উদ্ভাবন করা যা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। (আন নিহায়াহ ফিল গারিবিল হাদীস ওয়াল আসার ১/৩৫১)মোল্লা আলী কারী (র) উল্লেখিত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, যে ব্যক্তি মদীনাতে খারাপ কর্ম এবং বিদায়াত প্রচলন ঘটালো- এর অর্থ হলো, প্রত্যেক ঐ বিষয় যা কুরআন ও সুন্নাতের বিরোধী। (মিরকাতুল মাফাতিহ ৫/৬০৮)২. নবী (ﷺ) এর এরশাদ اَوْ اَوٰى مُحْدِثَا -এর ব্যাখ্যায় কাজী ইয়াজ (র) লিখেছেন, পাপকারীকে আশ্রয় দান করল ও তাকে নিজের স্থানে ঠাই দিল ও তার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করল। (শারহু নববী ৯/১৪০)আল্লামা ইবনে আসীর (র) লিখেছেন, الْمُحْدِثُ দাল অক্ষরে যবর ও জের উভয় অবস্থায় পড়া বৈধ। দালে যদি যের দিয়ে পড়া হয়, তবে অর্থ হবে সে সীমালনকারীকে সাহায্য করল অথবা তাকে আশ্রয় দিল, তার প্রতিপক্ষ হতে রক্ষার ব্যবস্থা করল এবং তার প্রতি দণ্ড বিধি প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল।আর দালে যবর দিয়ে পড়লে অর্থ হবে নতুন কুপ্রথাকে আশ্রয় দিল এমন কাজকে মেনে নিল ও পছন্দ করল। কেননা বিদয়াতকে মেনে নেয়া এবং বিদয়াতীকে সমালোচনাসূচক জিজ্ঞাসা ব্যতীত ছেড়ে দেয়া বিদয়াতীকে আশ্রয় দেয়ার সমতুল্য। (আন নিহায়াহ ফি গারিবিল হাদীস ওয়াল আসার ১/৫১)মোল্লা আলী কারী (র) লিখেছেন, مُحْدِثًا সঠিক বর্ণনা মতে দালে যের দিয়েই পড়তে হবে। এর অর্থ বিদয়াতী ব্যক্তি। আর এও বলা হয়েছে যে, এর অর্থ হলো সীমালঙ্নকারী এবং তাকে আশ্রয় দেয়ার অর্থ হলো তার ওপর ইসলামী দণ্ডবিধি প্রয়োগে বাধা দান করা।দালে যবর দিয়ে পড়ার ব্যাপারেও এক বর্ণনা এসেছে এর অর্থ হবে: বিদয়াত, এবং বিদয়াতকে আশ্রয় দেয়ার অর্থ হবে: বিদয়াতকে মেনে নেয়া ও তাতে সন্তুষ্ট থাকা। (মেরকাতুল মাফাতিহ ৫/৬০৮)৩. ইমাম নববী বলেন, নবী (ﷺ)-এর বাণী عَلَيْهِ لَعَنَةُ إِلٰى اٰخِرِهِ এর মধ্যে এ ধরনের কাজ সম্পাদনকারীর জন্য কঠোর সাজার হুশিয়ারী দেয়া হয়েছে।কাজী ইয়াজ (র) বলেন, এ হাদীস হতে এ কথা প্রমাণ করা হয়েছে যে, এ কাজ (মদীনাতে বিদয়াত ও বিদয়াতকে আশ্রয় দেয়া) কবীরা গোনাহ। কেননা অভিশাপ কবীরা গোনাতেই হয়ে থাকে।আর নবী (ﷺ)-এর বাণীর অর্থ হলো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা এরূপ লোকের ওপর অভিশাপ করে থাকেন। অনুরূপ ফেরেশতারা ও সকল মানুষ তার ওপর অভিশাপ করে থাকে। এর অর্থ আল্লাহ তায়ালার দয়া থেকে বহু দূর হওয়ার কথাও রয়েছে। কেননা এতে لَعَنَ শব্দ রয়েছে যার অর্থ হলো দূর করা ও দূরে সরিয়ে দেয়া। (শারহু নববী ৯/১৪০-১৪১)মোল্লা আলী কারী (র) লিখেছেন, فَعَلَيْهِ তথা বিদয়াতী ও তাকে আশ্রয় দানকারীর ওপর لَعْنَةُ اللّٰهِ আল্লাহর রহমত থেকে দূর করা وَالْمَلَآئِكَةُ ফেরেশতা কর্তৃক আল্লাহর রহমত থেকে দূর করার জন্য বদদোয়ার অর্থে এসেছে। (মেরকাতুল মাফাতিহ ৫/৬০৮)৪. নবী (ﷺ)-এর বাণীঃ لَا يَقْبَلُ مِنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَدْلٌ صَرَفٌসম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজার (র) লিখেছেন: عَدْلٌ وَصَرَفٌ এর ব্যাখ্যায় উলামাগণ বিভিন্ন মতপ্রকাশ করেছেন, তবে জমহুর উলামার মতানুসারে সারফ অর্থ ফরজ ইবাদত আর আদল এর অর্থ হলো, নফল ইবাদত। (ফাতহুল বারী ৪/৬৮, শারই নববী ১/১৪১)উপরোল্লেখিত আলোচনা হতে এ কথা স্পষ্ট হলো যে, মদীনাতে খারাপ কর্ম সম্পাদন করা এবং বিদয়াত প্রথা চালু করা মহাপাপ। এভাবেই সেখানে খারাপ কর্ম সম্পাদনকারীকে আশ্রয় দেয়া, দ্বীন ইসলামে নব প্রথা চালুকারীকে সাহায্য করা, ইসলামী দণ্ডবিধি প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, বিদয়াতীকে আশ্রয় দেয়া এবং সেখানে বিদয়াত প্রবর্তনকে মেনে নেয়া ও তাতে সন্তুষ্ট থাকা এবং তা খতম করার জন্য চেষ্টা না করা মহাপাপ। এমন গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাঁর রহমত হতে দূরে সরিয়ে দেন এবং ফেরেশতাকুল ও সকল মানুষও আল্লাহর রহমত হতে তাকে দূর করার জন্য আল্লাহর সমীপে দোয়া করে থাকে। এমনকি তার ফরজ ও নফল কোন ইবাদতই গ্রহণ করা হয় না। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এ ধরনের গোনাহ থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

১৪৫. মদীনাবাসীর ওপর অত্যাচারকারী অথবা তাদেরকে ভয় প্রদর্শনকারীগণ

যে সমস্ত অধম ও বঞ্চিতদের জন্য ফেরেশতারা অভিশাপ করে থাকে তাদের তৃতীয় শ্রেণী হলো, ঐ সকল লোক যারা নবী (ﷺ)-এর শহর মদীনাবাসীর ওপর অত্যাচার করে থাকে এবং তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করে। নিম্নের হাদীসগুলি তার প্রমাণ।১. ইমাম তাবারানী (র) উবাদা বিন সামেত (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি মদীনাবাসীর ওপর অত্যাচার করল ও তাদেরকে ভয় দেখাল তাকে তুমিও ভয় দেখাও। আর তার ওপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল ও সকল মানুষের অভিশাপ। তার ফরজ ও নফল কোন ইবাদতই গ্রহণ হবে না।” (মাজমাউজ যাওয়ায়েদ ৩/৩০৬ বর্ণনা সহীহ)২. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, নাসায়ী ও তাবারানী (র) সায়েব বিন খাল্লাদ (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“যে ব্যক্তি মদীনাবাসীকে ভয় দেখাল, আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে ভয় দেখান। আর তার ওপর আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাকুল ও সকল মানুষের অভিশাপ, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত দিবসে তার ফরজ ও নফল কোন ইবাদতই গ্রহণ করবেন না।” (আল মুসনাদ হাদীস নং ১৬৫৫৯, ২৭/৯৪, কিতাব সুনানুল কুবরা ৪২৬৫, ১, ২/৪৮৩, আল মুজামুল কাবীর হাদীস নং ৬৬৩১, ৭/১৪৩, শায়খ শুয়াইব আরনাউত এর সনদকে সহীহ সাব্যস্ত করেন। আল মুসনাদের টিকা দ্রঃ ২৭/৯৪)৩. ইমাম ইবনে আবী শায়বা (র) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“যে ব্যক্তি মদীনাবাসীকে ভয় দেখাবে তার ওপর আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাকুল ও সকল মানুষের অভিশাপ এমনকি তার ফরজ ও নফল কোন ইবাদতই গ্রহণ করা হবে না।” (আল মুসান্নাফ ২৪৭৩, ১২/১৮০-১৮১, শায়খ শুয়াঈব আরনাউত এর সনদকে সহীহ সাব্যস্ত করেন। আল মুসনাদের টিকা দ্রঃ ২৩/১২১)এছাড়া আরো অনেক হাদীস রয়েছে, যা মদীনাবাসীকে ভয় দেখানোর ভয়াবহ পরিণতি প্রমাণ করে। তন্মধ্যে দুটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো:ইমাম আহমদ (র) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণনা করেন, ফেতনাবাজ আমীরদের একজন মদীনাতে আগমন করল এবং সে সময় জাবের (রা) এর দৃষ্টিশক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাকে বলা হলো আপনি যদি এ আমীর থেকে দূরে থাকতেন (তা আপনার জন্য ভাল হতো) জাবের (রা) তার দুই ছেলের সাথে বের হলেন, রাস্তায় কোন কিছুর সাথে টক্কর লাগায় তিনি বলে উঠলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ভয় দেখানো ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা অপমানিত ও অপদস্ত করুন।তার দুই ছেলের একজন বলল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তো মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে কিভাবে ভয় দেখাল।তিনি উত্তরে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি— “যে ব্যক্তি মদীনাবাসীকে ভয় দেখাল, সে যেন আমাকেই ভয় দেখাল।” (আল মুসনাদ হাদীস নং ৪৮১৮, ২৩/১২১, হা: হাইসামী হাদীসটির ব্যাপারে লিখেন, “এটি আহমদ (র) বর্ণনা করেন, আর তার বর্ণনাকারী সবাই সহীহ বর্ণনাকারী” মাজমাউজ যাওয়ায়েদা ৩/৩০৬, শায়খ শুয়াইব আরনাউত হাদীসটিকে সহীহ সাব্যস্ত করেন। আল মুসনাদের টিকা দ্র: ২৩/১২১)মদীনাবাসীকে ভয় প্রদর্শন করতঃ আল্লাহর প্রিয় হাবীব মহানবী (ﷺ) (স)-কে ভয় দেখানো জঘন্যতম অপরাধ এবং এ অপরাধে অপরাধীরা জঘন্যতম অধম ও বদ নসীব। আল্লাহ তায়ালা এরকম অপরাধ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন। আমীন।৪. ইমাম মুসলিম (র) সা'দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“যে ব্যক্তি মদীনাবাসীর সাথে খারাপ আচরণ করার ইচ্ছা করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে এমনভাবে গলিয়ে দিবেন যেমন লবণ পানিতে গলে যায়।” (সহীহ মুসলিম ৪৯৪ (১৩৭৮) ২/১০০৮)হে আমার প্রতিপালক! আমাদেরকে সেই অধমদের অন্তর্ভুক্ত করবেন না, যারা মদীনাবাসীদের বিরোধিতা করে। হে আমাদের দয়ালু প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে ঐ সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা নবী (ﷺ) ও মদীনাবাসীকে ভালবাসে। আমীন।

১৪৬. পিতা বা মাতাকে ছেড়ে অন্যের দিকে নিজের সম্বন্ধকারীগণ

যে সকল অধমদের ওপর ফেরেশতারা অভিশাপ করে থাকে তাদের ৪র্থ শ্ৰেণী হলো, ঐ সকল লোক যারা স্বীয় পিতা বা স্বীয় মনিবকে ছেড়ে অন্যের দিকে সম্বন্ধ করে। যে জন্মদাতা পিতাকে বাদ দিয়ে অন্যকে পিতা বলে স্বীকার করে নেয়। অনুরূপভাবে কোন দাস তার আসল মালিককে বাদ দিয়ে অন্যকে তার আসল মালিক বলে দাবি করে।ইমাম মুসলিম (র) আলী (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“যে ব্যক্তি জন্মদাতা পিতাকে ছেড়ে অন্যকে পিতা বলে দাবী করবে অথবা নিজের মালিককে ছেড়ে অন্যকে মালিক বলে সম্বন্ধ করবে, তার ওপর আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাকুল ও সকল মানুষের অভিশাপ। কেয়ামত দিবসে তার ফরজ ও নফল কোন ইবাদতই গ্রহণ করা হবে না।” (সহীহ মুসলিম ৪৬৭ (১৩৮৭) ৪৯৯৮, সহীহ বুখারীতে অন্যভাবে বর্ণিত হয়েছে, দেখুন: হাদীস নং ১৮৭৭, ৪৯৪)ইমাম নববী (র) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, এ হাদীস হতে এ কথা প্রমাণ হয় যে, নিজের পিতা বা নিজের মালিককে ছেড়ে অন্যকে পিতা ও মালিক বলে দাবী করা হারাম। কেননা এতে নেয়ামতের না শোকরী, উত্তরাধিকার সূত্র, অভিভাবকত্ব, হত্যাকারীর ওপর ধার্যকৃত ক্ষতিপূরণ বা রক্তপণ ইত্যাদী অধিকারসমূহ খর্ব হয়। অনুরূপভাবে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন ও পিতামাতার প্রতি অবাধ্যতাও প্রমাণ করে। (শারহু নববী ৯/১৪৪)সহীহ বুখারীর একটি বর্ণনায় এসেছে— “যে দাস তার মনিবের অনুমতি ছাড়াই অন্যের সাথে দাসত্ব চুক্তি করল, তার ওপর আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাকুল ও সকল মানুষের অভিশাপ, কেয়ামত দিবসে তার ফরজ ও নফল কোন আমলই গ্রহণ করা হবে না।” (সহীহ বুখারী ৬৭৫৫, ১২৪২)ইমাম বুখারী ও হাদীসটিকে নিম্নের অধ্যায়ে উল্লেখ করেন— “দাস কর্তৃক মালিকের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার গুনাহ সম্পর্কিত অধ্যায়।” (সহীহ বুখারী ১২/৪১)নবী (ﷺ)-এর বাণী مَنْ وَالٰى قَوْمًا এর ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী (র) লিখেছেন, এর পদ্ধতি হলো কোন স্বাধীন করে দেয়া দাস নিজের আজাদকারী মনিবকে বাদ দিয়ে অন্যকে বলে যে, তুমি আমার মনিব। (মেরকাতুল মাফাকিহ ৫/৬০৯)অনেক সময় দেখা যায়, অনেকেই বলে থাকে আমি অমুক গোষ্ঠির লোক প্রকৃতপক্ষে সে গোষ্ঠির সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই। এমন কাজ করা শরীয়ত বিরোধী এবং এর পরিণতি হলো ভয়াবহ।উপরোক্ত হাদীসে উল্লেখিত ব্যক্তিদের মিথ্যা দাবীর কারণে আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাকুল ও সকল মানুষের অভিশাপের উপযুক্ত বা হকদার এবং তাদের কোন প্রকার ফরজ ও নফল ইবাদত গ্রহণ হবে না।স্বীয় পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা বলে দাবী করা হারাম সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়- তন্মধ্যে তিনটি প্রমাণ নিম্নে পেশ করা হলো—১. আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন—وَمَا جَعَلَ أَزْوَاجَكُمُ اللَّائِي تُظَاهِرُونَ مِنْهُنَّ أُمَّهَاتِكُمْ ۚ وَمَا جَعَلَ أَدْعِيَاءَكُمْ أَبْنَاءَكُمْ ۚ ذَٰلِكُمْ قَوْلُكُم بِأَفْوَاهِكُمْ ۖ وَاللَّهُ يَقُولُ الْحَقَّ وَهُوَ يَهْدِي السَّبِيلَ ﴿٤﴾ ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِندَ اللَّهِ.অর্থঃ “তোমাদের মুখে বলা পুত্রদেরকে তোমাদের প্রকৃত পুত্র করেননি, এগুলো তোমাদের মুখের কথা। আল্লাহ সত্য কথাই বলেন এবং তিনিই সরল পথ নির্দেশ করেন। “তোমরা তাদেরকে ডাক তাদের পিতৃ-পরিচয়ে; আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা অধিক ন্যায়সঙ্গত।” (সূরা আহযাব: ৪-৫)খ. নবী-এরশাদ করেন— “তোমরা নিজের পিতা থেকে বিমুখ হয়ো না। যে ব্যক্তি নিজের পিতা থেকে বিমুখ হলো সে কুফরী করল।” (সহীহ বুখারী ৬৭৬৮, ১২/৫৪)গ. নবী-এরশাদ করেন— “যে ব্যক্তি জানা সত্ত্বেও নিজের পিতাকে ছেড়ে অন্যকে পিতা বলে দাবী। করবে তার জন্য জান্নাত হারাম।” (সহীহ বুখারী ৬৭৬৬, ১২/৫৪)দয়ালু দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এমন গোনাহ থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

১৪৭. মুসলমানদের সাথে অঙ্গীকার ও সন্ধি ভঙ্গকারীগণ

ফেরেশতাদের বদদোয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিদের পঞ্চম শ্রেণী হলো ঐ সকল লোক যারা মুসলমানদের সাথে সন্ধি ও চুক্তিকে ভঙ্গ করে।ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) হযরত আলী (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) এরশাদ করেছেন— “সকল মুসলমানদের সন্ধি ও চুক্তি এক। সবচেয়ে নিচু শ্রেণীর একজন মুসলমান সন্ধি ও চুক্তি করতে পারে। যে ব্যক্তি মুসলমানদের সাথে সন্ধি ও চুক্তিকে ভঙ্গ করবে তার ওপর আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাকুল ও সকল মুসলমানদের অভিশাপ। কেয়ামত দিবসে তার ফরজ, নফল কোন ইবাদতই গ্রহণ করা হবে না।” (সহীহ বুখারী ৬৭৫৫, ১২/৪২ সহীহ মুসলিম ৪৬৭, (১৩৭০) ৪৬৮, ১৯৫,-৯৯৯)এ ক্ষেত্রে নিম্নের কথাগুলির প্রতি পাঠকমণ্ডলীর মনোযোগ আকর্ষণ করছিঃ১. হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (র) উল্লেখিত হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, এর অর্থ হলো সকল মুসলমানদের কৃত চুক্তি সমপর্যায়ের। সে চুক্তি এক ব্যক্তিই করে থাকুক বা অনেক ব্যক্তিই করে থাকুক। অনুরূপভাবে উচ্চ পদস্থ মুসলমান কোন অমুসলিমকে নিরাপত্তা দেয়া বা কোন নিচু পর্যায়ের সাধারণ মুসলমানকে নিরাপত্তা দেয়া সবই সমান। সে নিরাপত্তা ভঙ্গ করা কোন মুসলমানের জন্য বৈধ হবে না। নিরাপত্তা দেয়ার ব্যাপারে পুরুষ-মহিলা স্বাধীন দাস সবাই সমান। কেননা মুসলিম জাতি এক দেহের সমতুল্য। (ফাতহুল বারী ৪/৮৬)২. সালফে সালেহগণ রাসূল (ﷺ)-এর বাণী ذِمَّةُ الْمُسْلِمِيْنَ وَاحِدَةً -এর বাস্তবায়ন করে যে কোন মুসলমানের দেয়া নিরাপত্তাকে রক্ষা করতেন। ইসলামী ইতিহাস একথার অনেক সাক্ষ্য বহন করে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ইমাম আব্দুর রাজ্জাক ফুযাইল বিন রাক্কাশী হতে বর্ণনা করেন, পারস্যের এক বসতি নাম শাহারতা” অবরোধের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা একমাস ব্যাপী সে বসতিকে অবরোধ করে রাখি। একদিন আমরা পিছনে হটে গেলাম এজন্য যে আগামী কাল সকালে আক্রমণ করব।আমাদের এক ক্রীতদাস সেখানে থেকে গেল এবং গ্রামবাসী তার কাছ থেকে নিরাপত্তা কামনা করল, সে এক তীরের উপর নিরাপত্তা বাণী লিখে তাদের দিকে নিক্ষেপ করে দিল।আমরা যখন তাদের দিকে অগ্রসর হলাম তখন দেখি তারা অস্ত্র ছেড়ে সাধারণ বেশে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে আমরা তাদেরকে বললাম, ব্যাপার কি? তারা বলল, “তোমরা আমাদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছ।”তারা সাথে সাথে আমাদেরকে সে তীর বের করে দেখাল, যাতে তাদের নিরাপত্তা দেয়ার ব্যাপারে লেখা ছিল। আমরা বললাম, এ নিরাপত্তা একজন ক্রীতদাসের পক্ষ থেকে লেখা। প্রকৃতপক্ষে ক্রীতদাসের নিরাপত্তা দেয়ার কোন অধিকার নেই।তারা উত্তর দিল, আমরা তো তোমাদের স্বাধীন ও দাসের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে বলে জানি না এবং নিরাপত্তার ওপর ভরসা করেই আমরা গ্রাম থেকে বাইরে এসেছি।আমরা বললাম, তোমরা নিরাপদে ফিরে যাও। তারা বলল, আমরা কখনই ফিরে যাব না।আমরা এ বিষয়টা উমর (রা)-এর নিকট লিখে পাঠালাম। তিনি উত্তরে লিখলেন, নিশ্চয় মুসলমানদের ক্রীতদাস মুসলমানের অন্তর্ভুক্ত এবং তার দেয়া নিরাপত্তাও প্রকৃত নিরাপত্তা।বর্ণনাকারী বলেন, সেখানে গনীমতের মাল অর্জনের যে একটি সুযোগ আমাদের সামনে এসেছিল তা আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। (আল মুসান্নাফ ৯৪০৩, ৫/২২২-২২৩)ইমাম সাঈদ ইবনে মানসুর কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, তিনি তথা উমর ফারুক (রা) লিখেছেন, নিশ্চয় মুসলিম ক্রীতদাস মুসলমানদেরই একজন তার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দেয়ার অঙ্গীকার মানেই হলো তোমাদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি। (সুনানে সাঈদ বিন মানসুর ২৬০৮, ২/২৩৩)ইমাম তাবারানী (র) বর্ণনা করেছেন, তিনি (উমর ফারুক রা) তাদেরকে লিখেছিলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করার মহাগুরুত্ব দান করেছেন। অঙ্গীকার পূর্ণ করার মাধ্যমেই তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণের প্রতীক বিবেচিত হবে। সন্দেহ হলেও তাদেরকে দেয়া অঙ্গীকার অটুট রাখো এবং তাদেরকে নিরাপত্তা দান করো।মুসলিম বাহিনী তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করল এবং সেখান থেকে ফিরে আসল। (তারিখুল তাবারী ৪/৯৪)৩. আজকের মুসলমানরা সন্ধি ও অঙ্গিকারকে বানচাল করার জন্য কত রকম বাহানা করে। অনেকে এমনও আছে যারা অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে কারো সাথে লেন-দেন চুক্তি করার পর যদি কোন দিন নিজের স্বার্থের বিপরীত দেখে, তবে তখনই সে চুক্তিকে বানচাল করে দেয় এবং বলে আমাদের এ অংশীদারের চুক্তি করার কোন এখতিয়ারই নেই। কোন পিতা যদি কারো সাথে কোন চুক্তি করে বসে আর ছেলে যদি তা নিজের জন্য সুবিধা মনে না করে তাহলে ছেলে বলেই ফেলে যে, পিতা বহু দিন পূর্বে কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। দোকান বা ফ্যাক্টরীতে তার যাওয়া আসা শুধু বরকতের জন্যই, ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেন-দেনের সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই।আর ছেলে যদি কোন চুক্তি করে এবং তা যদি পিতা বানচাল করতে চায় তাহলে সে যুক্তি পেশ করে যে, ব্যবসা তো আমার, এ হলো আমার দিবা-রাত্রি মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পরিশ্রমের ফল। ছেলের এই ব্যবসার ক্ষেত্রে তো মাত্র এক কর্মচারির ভূমিকা, এ ধরনের চুক্তি করা তার ইখতিয়ার বহির্ভূত।নিজেকে যারা বুদ্ধিমান ও পণ্ডিত মনে করে এমন লোক যেন আল্লাহ তায়ালার নিম্নের আয়াতের প্রতি খেয়াল করে—يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ ﴿٩﴾অর্থঃ “তারা আল্লাহকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে। অথচ তারা নিজদেরকেই ধোঁকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না।” (সূরা বাকারা: ৯)আল্লাহ্ তায়ালা যেন দয়া করে আমাদেরকে অনুরূপ লোকদের অন্তর্ভুক্ত না, করেন। আমীন।

১৪৮. সৎ কাজে, দান-খয়রাতে বাধা প্রদানকারীগণ

যে সমস্ত হতভাগাদের ওপর ফেরেশতারা বদদোয়া করে থাকে তার শ্ৰেণী হলো ঐ সকল লোক যারা স্বীয় সম্পদ সৎপথে ব্যয় করে না। বিভিন্ন হাদীসে নবী (ﷺ) তার উম্মতকে এ ব্যাপারে অবহিত করেছেন। তন্মধ্যে তিনটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো—ক. ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“প্রতিদিন সকালে দু'জন ফেরেশতা অবতরণ করে, একজন বলে, হে আল্লাহ! দানকারীর সম্পদ বাড়িয়ে দাও এবং অপরজন বলে, হে আল্লাহ! যে দান করে না তার সম্পদকে ধ্বংস করে দাও।” (বুখারী হাদীস নং ১৪৪২, ৩/৩০৪, মুসলিম হাদীস নং ৫৭ (১০১০), ২/৭০০)হাফেজ ইবনে হাজার এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, সম্পদ ব্যয় না করার কারণে ধ্বংসের বদদোয়ার মর্ম হলো সৎপথে যে সম্পদ খরচ না করা হয় তাই ধ্বংস হওয়া বা সম্পদশালীর নিজেই ধ্বংস হওয়া। আর সম্পদশালীর ধ্বংস হওয়ার অর্থ হলো তার অন্যান্য কাজ কর্মে এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া যেন সে তার সৎকর্মের দিকে কোন ভ্রুক্ষেপই করতে না পারে। (ফাতহুল বারী ৩/৩০৫)খ. ইমাম আহমাদ, ইবনে হিব্বান ও হাকেম (র) আবুদ দারদা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“প্রত্যেক দিন সূর্য উদয়ের সময় তার দুই পার্শ্বে দুই ফেরেশতাকে প্রেরণ করা হয়, তারা উচ্চ কণ্ঠে বলতে থাকে, হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রভুর দিকে অগ্রসর হও, পরিতৃপ্তকারী অল্প সম্পদ উদাসীনকারী অধিক সম্পদ হতে উত্তম। তাদের কথা মানুষ ও জিন ব্যতীত সবাই শুনতে পায় এবং সূর্য ডুবার সময় তার উভয় পার্শ্বে দুই ফেরেশতা প্রেরণ করা হয়। তারা বলতে থাকে, হে আল্লাহ! দানকারীদের সম্পদ বৃদ্ধি করে দাও এবং যারা দান করে না তাদের সম্পদকে ধ্বংস করে দাও। তাদের কথা মানুষ ও জিন ব্যতীত সবাই শুনতে পায়।” (আল মুসনাদ ৫/১৯৭, আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৩৩২৯, ৮/১২১-১২২, আল মুসতাদরাকে আলাস সহীহায়ন। ২/৪৪৫, ইমাম হাকেম এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন, শায়খ আলবানীও এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। দেখুন; সহীহ হাদীস সিরিজ হাদীস নং ৪৪৪ ও সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ১/৪৫৬)গ. ইমাম আহমদ ও ইবনে হিব্বান (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“নিশ্চয় একজন ফেরেশতা জান্নাতের এক দরজার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে বলে, যে ব্যক্তি আজ ঋণ (আল্লাহর রাস্তায় দান করবে) দিবে তার প্রতিদান পাবে আগামীকাল (কেয়ামত দিবসে) আর অন্য দরজায় এক ফেরেশতা দাঁড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহ! দানকারীদের সম্পদ বৃদ্ধি করে দাও এবং যারা দান করে না তাদের সম্পদকে ধ্বংস করে দাও।” (আল মুসনাদ ২/৩০৫-৩০৬, আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৩৩৩৩, ৮/১২৪)হে আমাদের দয়ালু দয়াময় প্রভু! আপনি আমাদেরকে সৌভাগ্যবান লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা সৎপথে বেশী ব্যয় করে এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য প্রার্থনা করে। হে আমাদের দয়ালু দয়াময় প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে সেই সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করবেন না, যারা সৎপথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে না এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য বদদোয়া করে থাকে। আমীন।

১৪৯. তিন প্রকার লোকের ক্ষেত্রে জিবরাঈল (আ)-এর বদদোয়া

তিন শ্রেণীর লোক এমন যাদের জন্য জিবরাঈল (আ) বদদোয়া করেছেন ও তার সমর্থনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমীন বলেছেন। নিম্নে সেই তিন শ্রেণীর বর্ণনা করা হলো-ক. যে সকল লোক রমযান মাসকে পাওয়ার পরও নিজের গোনাহ ক্ষমা করাতে পারল না।খ. যারা নিজের পিতামাতাকে জীবিতাবস্থায় পাওয়ার পর তাদের সাথে সদ্ব্যবহার না করে জাহান্নামে প্রবেশ করল।গ. যে সকল লোক তাদের সামনে নবী (ﷺ)-এর নাম উল্লেখ হওয়ার পর তার ওপর দরূদ পড়ে না।উপরোল্লেখিত বিষয় তিনটির প্রমাণ স্বরূপ দুইটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো:১. ইমাম ইবনে হিব্বান (র) মালেক বিন হুয়াইরিস (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বারে উঠার সময় প্রথম যখন সিড়িতে উঠে, বললেন আমীন।অতপর দ্বিতীয় সিড়িতে উঠে বললেন: আমীন অতঃপর তৃতীয় সিঁড়িতে উঠে বললেন: আমীন।অতঃপর বললেন, আমার নিকট জিবরাঈল (আ) এসে বললেন, হে মুহাম্মদ! যে ব্যক্তি রমযান মাসে উপনীত হওয়ার পরও তার জীবনের গোনাহকে ক্ষমা করাতে পারল না, আল্লাহ তাকে রহমত থেকে দূরে রাখুন।আমি তা শুনে আমীন বলেছি।তারপর বলেন, যে ব্যক্তি তার পিতামাতাকে অথবা তাদের একজনকে পেল, অথচ (তাদের সাথে সদ্ব্যবহার না করে) জাহান্নামে প্রবেশ করল, আল্লাহ তায়ালা তাকেও তার রহমত থেকে দূরে রাখুন। আমি তাতেও আমীন বললাম।অতপর বললেন, যে ব্যক্তির সামনে আপনার নাম উল্লেখ হওয়ার পর আপনার ওপর দুরূদ পাঠ করল না সেও আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে দূরে থাকুক। আমি তাতেও আমীন বললাম। (আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৪০৯, ২/১৪০, শায়খ শুয়াইব আরনাউত লিখেন: “হাদীসটি সহীহ লিগায়রিহি, যদিও সূত্রটি দুর্বল” (আল ইহসান টিকা:২/১৪০, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১০/১২২, হ: হাইসামী হাদীসটির ব্যাপারে বলেন, হাদীসটি বারানী বর্ণনা করেন, এর মধ্যে একজন বর্ণনাকারী হলো ইমরান ইবনে আবান, ইবনে হিব্বান তাকে বিশ্বস্ত সাব্যস্ত করেন; কিন্তু কতিপয় তাকে দুর্বল বলেন, অন্যান্য বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। ইবনে হিব্বান এ সূত্রেই স্বীয় সহীহ গ্রন্থে হাদীসটিকে বর্ণনা করেন।)২. ইমাম তাবারানী (র) কা'ব বিন আজারাহ (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন- “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদা মিম্বারের দিকে যান, যখন তিনি প্রথম সিঁড়িতে উঠলেন, বললেন: আমীন।অতপর দ্বিতীয় সিড়িতে উঠে বললেন: আমীন অতপর তৃতীয় সিঁড়িতে উঠে বললেন: আমীন।তিনি যখন মিম্বার থেকে অবতরণ করে অবসর হলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার নিকট থেকে আজ এক (নতুন) কথা (আমীন) শুনলাম।তিনি বলেন, তোমরা কি তা শুনেছ? সাহাবীগণ বললেন, হ্যা।তিনি বলেন, আমি প্রথম সিঁড়িতে উঠার সময় জিবরাঈল (আ) এসে বললেনযে ব্যক্তি পিতামাতা বা তাদের একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পাওয়ার পরও (তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না, সে দূর হোক। তাতে আমি আমীন বলেছি যাদের সামনে আপনার নাম উল্লেখ করার পরও দরূদ পাঠ করল না, তাতে আমি আমীন বলেছি এবং তিনি বলেন, যারা রমযান মাসে উপনীত হওয়ার পরও তার জীবনের গোনাহ ক্ষমা করাতে পারল না, সে আল্লাহর রহমত হতে দূর হোক, তাতেও আমি আমীন বলেছি।” (মাজমাউজ যাওয়ায়েদ ১০/১৬৬, হাঃ হাইসামী বলেন: হাদীসটি বারানী বর্ণনা করেন এবং এর সমস্ত বর্ণনাকারীই নির্ভরযোগ্য।)উপরোল্লেখিত তিন শ্রেণীর মানুষ এমন বদনসীব যাদের জন্য জিবরাঈল (আ) বদদোয়া করেছেন এবং সে দোয়া কবুল হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমীন বলেছেন।ইমাম তায়বী (র) হাদীসে উল্লেখিত তিন শ্রেণীর ওপর বদদোয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি দুরূদ পড়া হলো তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি দিক এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার রাসূল ও বন্ধু (ﷺ)-কে সম্মান করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা দান করবেন। আর যে ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-কে সম্মান করবে না আল্লাহ তাকে অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করবেন।অনুরূপ রমযান মাস হলো- মহান আল্লাহ তায়ালার এক মহিমান্বিত মাস। যে সম্পর্কে তিনি এরশাদ করেছেন—شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِঅর্থঃ “রমযান মাস, যার মধ্যে বিশ্বমানবের জন্য পথ প্রদর্শক এবং সুপথের উজ্জ্বল নিদর্শন ও প্রভেদকারী কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।” (সূরা বাকারা: ১৮৫)যে ব্যক্তি এ মাসে উপনীত হয়ে তাকে সম্মান করার সুযোগ পেয়ে পূর্ণ ঈমান ও সওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করল আল্লাহ তাকে সম্মানিত করবেন এবং যে ব্যক্তি রমযান মাসকে সম্মান করবে না আল্লাহ তায়ালা তাকে অপমানিত করবেন।যেখানে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা, আল্লাহর সম্মানের সাথে সম্পৃক্ত, এজন্যই আল্লাহ পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের কথা তাওহীদ ও আল্লাহর ইবাদতের কথার সাথেই উল্লেখ করেছেন। তিনি এরশাদ করেন—“তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ২৩)এজন্যই যে ব্যক্তি পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের সুযোগ পায় বিশেষ করে তাদের বৃদ্ধাবস্থায় যখন সে ব্যতীত আর এমন কোন লোক থাকে না, যে তাদের দেখাশুনা করবে। এমতাবস্থায় সে যদি সুযোগ গ্রহণ করে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে, তবে সে ব্যক্তিকে পরিণতি স্বরূপ ধিকৃত, অপমানিত ও অপদস্ত করা হবে। (শারহুত তাইবী ৩/১০৪৪)দয়াময়ের কাছে প্রার্থনা, আমাদেরকে যেন এমন তিন শ্রেণীর হতভাগাদের অন্তর্ভুক্ত না করেন। আমীন।

১৫০. মুসলমানদেরকে অস্ত্র প্রদর্শনকারীগণ

যে সকল লোকদেরকে ফেরেশতারা অভিশাপ করে থাকে তাদের ১০ম শ্রেণী হলো ঐ সকল লোক যারা নিজ মুসলিম ভাইদেরকে অস্ত্র প্রদর্শন করে।ইমাম মুসলিম (র) আবু হুরাইরা (র) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আবুল কাসেম-নবী (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের দিকে কোন লোহা দিয়ে ইশারা করল তার ওপর ফেরেশতারা অভিশাপ করে থাকে, যদিও সে তার সহোদর ভাইয়ের দিকে ইশারা করে।” (সহীহ মুসলিম, ১২৫ (২৬১৬), ৪/২০২০)নবী করীম (ﷺ)-এর বাণী—وَإِنْ كَانَ اَخَاهُ لِاَبِيْهِ وَاُمِّهِএর অর্থ হলো, কোন মানুষের দিকে অস্ত্র দিয়ে ইশারা যেন না করা হয়, তার সাথে দুশমনির অভিযোগ থাকুক বা না থাকুক। অনুরূপ কারো সাথে হাসি-ঠাট্টা করে হোক বা বাস্তবেই হোক। এছাড়াও ফেরেশতাদের অভিশাপ করাই প্রমাণ করে যে, ইশারা করা হারাম। (শারহু নববী ১৬/১৭০)নিম্নের হাদীসে নবী (ﷺ) অনুরূপ ইশারা না করার কারণ বর্ণনা করেন— ইমাম মুসলিম (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন— “তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের দিকে অস্ত্র দিয়ে ইশারা না করে, হতে পারে শয়তান তার হাত থেকে খুলে, যার ফলে সে জাহান্নামে পতিত হবে।” (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ১২৬ (২৬১৭), ৪/২০)ইমাম নববী (র) তার স্বীয় গ্রন্থ রিয়াদুস সালেহীনে উল্লেখিত হাদীসের আওতায় নিম্নের অধ্যায় রচনা করেছেন- “মুসলমানদের দিকে অস্ত্র দিয়ে ইশারা করা হারাম, তা হাসি-ঠাট্টা করে হোক বা বাস্তবেই হোক। অনুরূপ খাপ বিহীন অস্ত্র ধারণ করাও হারাম।” (রিয়াদুস সালেহীন ৫২০ পৃ:)এক্ষেত্রে পাঠকবৃন্দ দুটি কথার প্রতি মনোনিবেশ করুন—১. নবী (ﷺ) কর্তৃক মুসলমান ভাইদের দিকে অস্ত্র দিয়ে ইশারা করা থেকে নিষেধ করাটা মারামারির পথ বন্ধ করার জন্যই অর্থাৎ মুসলিম জাতি যেন এ কাজ থেকে একেবারেই বিরত থাকে, যা তাদের মাঝে মারামারি ঝগড়া-ফাসাদের সোপান। এজন্য দ্বীন ইসলামে এ কাজ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিরত রাখা হয়েছে, যা মানুষকে হারাম কাজের দিকে পৌছিয়ে দেয়।এ সম্পর্কে আরো জানতে হলে নিম্নের কিতাবগুলি দেখুন—ক. আত তাদাবীরুল ওয়াকিয়াহ মিনাল মুখার্দিরাত ফিল ইসলাম, ড. ফয়সাল বিন জাফার।খ. আত তাদাবীরুল ওয়াকিয়াহ মিনাল মুখার্দিরাত ফিল ইসলাম, ড. ফয়সাল বিন জাফার।গ. আত তাদাবীরুল ওয়াকিয়াহ মিনাজ জিনা ফিল ফিকহিল ইসলামী।ঘ. আত তাদাবীরুল ওয়াকিয়াহ মিনাল রিবা ফিল ফিকহিল ইসলামী।২. মুসলিম ভাইয়ের দিকে অস্ত্র দিয়ে ইশারা করাতে ফেরেশতাদের অভিশাপ অনিবার্য হয়। তাই কোন মুসলিম ভাইকে কষ্ট দেয়া অথবা তাকে আঘাত করা তাকে আহত করা বা হত্যা করা কত বড় পাপের কাজ।আল্লাহ তায়ালা তার দয়ায় আমাদেরকে যেন সর্বদায় এমন কর্ম থেকে রক্ষা করেন। আমীন।

১৫১. ইসলামী দণ্ডবিধি প্রয়োগে বাধা প্রদানকারীগণ

যে হতভাগা বঞ্চিত লোকদেরকে ফেরেশতারা অভিশাপ করে থাকে তাদের ১১তম ব্যক্তিরা হলো ঐ সকল লোক যারা ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীর উপর হত্যার বিচার প্রয়োগে বাধা দান করে থাকে।ইমাম আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইমাম মাজাহ (র) ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“যে ব্যক্তি অজান্তে হত্যা হলো বা পাথর, চাবুক বা লাঠি নিক্ষেপের কারণে মারা গেল, এর জন্য ভুল করে হত্যার জরিমানা / দিয়্যাত দিতে হবে। কিন্তু যাকে ইচ্ছাকৃতভাব হত্যা করা হবে তাতে দণ্ডবিধি প্রযোজ্য হবে এবং যে ব্যক্তি এ দণ্ডবিধি প্রয়োগে বাধা দান করবে তার ওপর আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাকুল ও সকল মানুষের অভিশাপ। আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার ফরজ, নফল কোন ইবাদতই গ্রহণ করবেন না।” (হত্যা কিভাবে হলো বা কে হত্যা করল সে সম্পর্কে জানা যায় না। দেখুন: শারহুত তায়াবী ৮/২৪১৭ ও শারহুম সুন্নাহ ১০/২২০) (সুনানে আবু দাউদ ৪৫২৮, ১২/১৮২, সুনানে নাসায়ী ৮/৪০, সুনানে ইবনে মাজাহ ২৬৬৭, ২.১০২, হাফেজ ইবনে হাজার হাদীসটির সনদ শক্তিশালী বলে সাব্যস্ত করেন, দেখুন: বুলুগুল মায়ান- ২৪৯ পৃঃ। শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ সাব্যস্ত করেন; দেখুনঃ সহীহ সুনানে আবু দাউদ ৩/৬৭ প্রভৃতি উল্লিখিত শব্দগুলি নাসায়ীর।)আল্লাহ তায়ালা দয়াপরবশ হয়ে এ জাতির ওপর দণ্ডবিধি নির্ধারণ করেছেন। কেননা এতে রয়েছে মানুষের জীবন (জীবনের নিরাপত্তা) আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন—وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿١٧٩﴾অর্থঃ “হে বিবেকবান লোক সকল! কিসাসের (ইসলামী দণ্ডবিধি) মধ্যে তোমাদের জীবন রয়েছে।” (সূরা বাকারা: ১৭৯)কাজী আবু দাউদ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন, কিসাসের বিধানের বৈশিষ্ট্যকে অতুলনীয়ভাবে বর্ণনা করতঃ একটি বিষয়কে তার বিপরীত নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।অত্র আয়াতে কারীমায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিসাসকেই জীবন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।অতঃপর এখানে আল্লাহ তায়ালা কিসাস শব্দটিকে নির্দিষ্ট বাচক ও حياة তথা জীবন শব্দকে অনির্দিষ্ট হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।আয়াতে শব্দের ব্যবহারেই সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, কিসাসের বিধান বাস্তবায়নের মাধ্যমেই জীবনের মহত্বও নিহিত। কেননা কিসাস ভীতিই ঘাতককে হত্যা হতে বিরত রাখে। আর এভাবেই দুটি জীবন রক্ষা পায়। একটি ঘাতকের ও অপরটি যাকে হত্যা করা হয়।জাহেলিয়াতের অজ্ঞতার যুগে লোকেরা ঘাতকের সাথে অন্যান্যদেরকেও হত্যা করত। শুধু তাই নয়, নিহত ব্যক্তির বদলায় মানুষের একটি দলকেও হত্যা করে ফেলত। আর এভাবেই সমাজে ফিতনা বেড়ে যেতো। অতএব যখন হত্যাকারী থেকে প্রতিশোধ নেয়া হয়ে যায় তখন তা অন্যান্যদের হায়াতের কারণে পরিণত হয়। (তাফসীরে আবি দাউদ ১/১৯৬, তাফসীরুল কাইয়্যিম ১৪৩-১৪৪ তাফসীরে বায়জার ১/১০৩)আল্লাহ তায়ালা আয়াতের শুরুতেই, وَلَكُمْ (আর তোমাদের জন্য) কথাটি উল্লেখ করেছেন। ফেরেশতাদের দোয়া ইমাম ইবনে কাইয়্যেম (র) এর রহস্য উল্লেখ করে লিখেছেন। অত্র আয়াতের শুরুতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন وَلَكُمْ শব্দ উল্লেখ করেছেন এবং এ কথার মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছেন যে, কিসাসের বিধান বাস্তবায়নের মধ্যে তোমাদেরই কল্যাণ নিহিত। এর বরকতে উপকৃত হবে। কিসাসের বিধান আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ। এতে তোমাদেরই কল্যাণ ও উপকার রয়েছে। (তাফসীরুল কাইয়্যিম ১৪৪ পৃ:)কিসাস বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী মানবতাকে কল্যাণ ও শান্তির পরশ থেকে বঞ্চিত করে ধ্বংস, অকল্যাণ ও নৈরাজ্যের মধ্যে পতিত করার কারণ হয়ে থাকে। এরূপ ব্যক্তির পাপ গুরুতর।আর এ কারণেই উক্ত ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত হবে। ফেরেশতা ও সমগ্র মানবজাতি তার জন্য বদদোয়া করে এবং তার ফরজ, নফলসহ কোন প্রকার ইবাদত কবুল করা হয় না।শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) শাস্তির বিধান প্রতিষ্ঠা অথবা আল্লাহ ও মানুষের জন্য সাব্যস্ত কোন অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীর অপরাধের ভয়াবহতা উল্লেখ করে লিখেছেন, যে কোন ব্যক্তি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, চোর, হত্যাকারী অথবা এরূপ কোন লোককে আশ্রয় দিবে, যার ওপর কিসাসের শাস্তি আবশ্যক হয়ে গেছে অথবা যার জিম্মায় আল্লাহ তায়লা অথবা কোন মানুষের অধিকার সুসাব্যস্ত হয়ে গেছে এবং সাব্যস্ত অধিকার স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠায় বাধা দান করবে, সেই ব্যক্তি অপরাধী ব্যক্তির মতই অপরাধী সাব্যস্ত হবে। রাসূল (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির ওপর অভিশাপ করেন যে (বিদয়াত করে) অথবা কোন অপরাধিকে (বিদয়াতীকে) আশ্রয় দান করে।”অসৎ-অপরাধী ব্যক্তিকে আশ্রয় দানকারী যখন পাওয়া যাবে তখন তাকে বলা হবে, এক্ষেত্রে সে যদি তা পালন না করে তবে তাকে জেলে বন্দী করে মাঝে মাঝে পিটানো হবে এবং তার এ পিটানো উক্ত অপরাধীকে ধরিয়ে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত চালু থাকবে। এ আশ্রয় প্রদানকারী ব্যক্তিকে ঠিক অনুরূপ শাস্তি প্রদান করা হবে, যেমন কোন ব্যক্তির জিম্মায় কোন মাল আদায় করার দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও সে তা আদায় করে না। অতএব যে ব্যক্তিদের বা মালের উপস্থিত হওয়া প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় আর কেউ যদি তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তবে তাকে শাস্তি দেয়া হবে। (মাজমাউল ফাতাওয়া ২৮/৩২৩) আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখুন। আমীন।

১৫২. স্বামীর বিছানা থেকে দূরে অবস্থানকারী মহিলারা

যে সকল মানুষের ওপর ফেরেশতামণ্ডলী অভিশাপ করে থাকে তাদের ১২তম শ্ৰেণী হলো ঐ সকল মহিলা যারা তাদের স্বামীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতঃ পৃথক বিছানায় রাত্রি যাপন করে। এ সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কতিপয় উল্লেখ করা হলো—১. ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“যখন কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে আপন বিছানায় আহ্বান করে, অতঃপর স্ত্রী যদি তার স্বামীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে, তবে তার ওপর প্রভাত অবধি ফেরেশতারা অভিশাপ করতে থাকে।” (সহীহ বুখারী, ৫১৯৩, ৯/২৯৩-২৯৪, সহীহ মুসলিম ১২২ (১৪৩৬) ২/১০৬০, হাদীসের শব্দগুলি বুখারীর।)২. ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“যখন কোন মহিলা তার স্বামীর বিছানা থেকে পৃথক রাত্রি যাপন করে, প্রভাত অবধি ফেরেশতারা ঐ মহিলার ওপর অভিশাপ করতে থাকে।” (সহীহ বুখারী ৯/২৯৪, সহীহ মুসলিম ২/১০৫৯, হাদীসটির শব্দগুলি মুসলিমের)অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে যে, حَتّٰ تَرْجِعُ তথা যতক্ষণ তার বিছানায় ফিরে আসে ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতারা তার উপর অভিশাপ দিতে থাকে। (সহীহ বুখারী ৯/২৯৪ ও সহীহ মুসলিম ২/১০৬০)ইমাম নববী (র) অত্র হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, শরয়ী ওযর ব্যতীত কোন মহিলা তার স্বামীর বিছানায় থাকতে অস্বীকার করা হারাম। অত্র হাদীসটি একথারই প্রমাণ বহন করে।মহিলাদের ঋতুবতী অবস্থায়ও আপন স্বামীর বিছানায় রাত্রি যাপন করতে অস্বীকার করা শরীয়তের কোন ওযর নয়। কেননা সে অবস্থায়ও স্ত্রীর পোশাকের ওপর দিয়ে তার সাথে জড়াজড়ির অধিকার রয়েছে। (শারহ নববী ১০/৭-৮)উপরোক্ত হাদীস দুটিতে অনেক উপকারিতা রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নে ২টি উল্লেখ করা হলো—১. স্বামীর বিছানা হতে পৃথকভাবে অবস্থানকারী মহিলার ওপর ফেরেশতাদের অভিশাপ ততক্ষণ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে যতক্ষণ মহিলা উক্ত পাপে অবশিষ্ট থাকে এবং এ গুনাহ ফজর উদয়ের সময় শেষ হয়ে যায়। কারণ তখন পুরুষের মহিলার প্রতি আকর্ষণ শেষ হয়ে যায়। অথবা মহিলার তওবা করতঃ তার স্বামীর বিছানায় ফেরত আসাতেও ফেরেশতাদের অভিশাপ শেষ হয়ে যায়। (শারহ নববী ১০/৮)২. ইমাম ইবনে আবী জামরাহ এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, অত্র হাদীসে মহানবী (ﷺ) স্বয়ং মহিলাদেরকে ফেরেশতাদের অভিশাপ হতে ভীতি প্রদর্শনে বুঝা যায় যে, ফেরেশতাদের ভালমন্দ সকল দোয়াই আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। (ফাতহুল বারী ৯/২৯৪)মহিলাদের স্বামীর বিছানা থেকে পৃথক রাত্রি যাপনের জঘন্যতা ও ভয়াবহতার ব্যাপারে আরো অনেক হাদীস রয়েছে। তন্মধ্যে ২টি নিম্নে উল্লেখ করা হলো—১. ইমাম তাবারানী (র) আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ-এরশাদ করেছেন—“দুই প্রকারের লোক যাদের নামায তাদের মাথা থেকে উপরে) অতিক্রম করে না।”ক. পলাতক গোলাম যতক্ষণ না তার মালিকের কাছে ফিরে আসে।খ. স্বামীর অবাধ্য স্ত্রী যতক্ষণ না সে তার স্বামীর কাছে ফিরে আসে। (মাজমাউজ যাওয়ায়েদ ৪/৩১৩)এ হাদীস হতে সুস্পষ্ট বুঝা যায়, পলাতক দাস তার পলাতক থাকা অবস্থায় এবং স্ত্রী তার স্বামীর অবাধ্য থাকা অবস্থায় তাদের নামায আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় না।২. অন্য হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, উপরোক্ত দুই প্রকার লোকসহ নেশাগ্রস্থ লোকের কোন সৎ আমল গৃহীত হয় না।ইমাম তাবারানী (র) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন— “তিন প্রকার লোকের নামায কবুল হয় না এবং তাদের কোন সৎ আমল আল্লাহর দিকে উঠে না।১. নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না তার জ্ঞান ফিরে আসে।২. এমন স্ত্রী যার স্বামী তার ওপর অসন্তুষ্ট। ৩. পলাতক দাস যতক্ষণ না সে ফিরে এসে তার মালিকের হাতে হাত মিলায়। (মালিকের কাছে নিজেকে সোপর্দ না করে।” (মাজমাউজ যাওয়ায়েদ ৪/৩১৩, বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য।)দুটি সতর্কীকরণ এখানে দুটি কথার দিকে সুপ্রিয় পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করছি -১. স্ত্রী তার স্বামী হতে পৃথক অবস্থান করা হারাম, যদি তার কোন শরীয়ত সম্মত ওযর না থাকে; তবে শরয়ী ওর অবস্থায় হারাম নয়।ইমাম নববী (র) উক্ত কথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। (শারহন নববী ১০/৭-৮) আর স্বামীরও উচিত স্ত্রীর সার্বিক অবস্থা উপলব্ধি করা।শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) বলেছেন, স্বামীর স্বাধীনতা রযেছে, যখনই সে ইচ্ছা করবে তখনই সে তার স্ত্রীর ওপর অধিকার রাখে কিন্তু এক্ষেত্রে শর্ত এই যে, স্ত্রী যাতে কোন প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন না হয় অথবা স্ত্রীর ফরজ আদায়ের ক্ষেত্রে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়।আর স্ত্রীরও স্বামীর চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করা উচিত। (আস সিয়াসাতুল শারয়িয়াহ ফি ইসলাহির রায়ী ওয়ার রায়িয়াহ ১৬৩ পৃঃ)২. স্বামীর বিছানা হতে স্ত্রীদের পৃথক থাকা হারাম বিষয়টি ইসলামী বিবাহের মূলনীতিসমূহের একটি, যার মূল উদ্দেশ্য হলো বিবাহের লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে পূর্ণতা দান করা, যাতে বিবাহ বন্ধন সৃষ্টির পবিত্রতা ও লজ্জাস্থান সংরক্ষণের কারণ হয়। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: আত তাদাবিরুল ওয়াকিয়াহ মিনাজ জিনা ফিল ফিকহিল ইসলামী ১৪৫-১৪৬ পৃ:)

১৫৩. কুরাইশ বংশের যে লোক দ্বীনি শিক্ষা থেকে বিরত থাকে

যে সকল বদনসীব ও বঞ্চিতদের ওপর ফেরেশতারা অভিশাপ করে থাকে তাদের ১৩তম হলো ঐ সকল কুরাইশ বংশীয় লোক যারা ইসলামী শিক্ষা থেকে দূরে থাকে। নিম্নে নবী (ﷺ)-এর হাদীসমূহ হতে দুটি হাদীস উদ্ধৃত হলো—১. ইমাম আহমাদ, আবু ইয়ালা, তাবারানী ও বাযযার (র) আনাস (রা) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—“নেতা হবে কুরাইশদের মধ্য হতে। নিঃসন্দেহে তোমাদের ওপর আমার অধিকার রয়েছে এবং তাদের ওপরও তোমাদের তেমনি অধিকার রয়েছে। যখনই তাদের কাছে অনুগ্রহ চাওয়া হবে, অনুগ্রহ করবে। অঙ্গীকার হলে পূরণ করতে হবে। বিচার ফয়সালা করলে ইনসাফ করতে হবে। যে ব্যক্তি এরূপ করবে তার ওপর আল্লাহ, সমস্ত ফেরেশতামণ্ডলী ও সমস্ত মানুষের অভিশাপ।” (মাজমাউজ যাওয়ায়েদ, হাঃ হাইসামী বর্ণনা করেনঃ হাদীসটিকে আহমাদ, আবু ইয়ালা, তবারানী ও বাযযার বর্ণনা করেন, তবে বাযযারের বর্ণনায় কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, আর আহমাদের হাদীসের বর্ণনাকারীগণ নিরযোগ্য, দেখুন উক্ত গ্রন্থের ৫/১৯২)২. ইমাম আহমাদ আবু ইয়ালা, বাযযার প্রমুখ ইমামগণ আৰু বার আসলামী (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি নবী (ﷺ) হতে হাদীসটি বর্ণনা করেন—“নেতা হবে কুরাইশদের মধ্য হতে, যখন অনুগ্রহ কামনা করা হবে তখন যেন তারা অনুগ্রহ করে ও অঙ্গীকার করলে তা পূর্ণ করবে এবং বিচার কার্য সম্পাদনে ইনসাফ বজায় রাখবে।”তাদের মধ্য হতে যে এরূপ করবে না, আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতামণ্ডলী ও সমস্ত মানুষের অভিশাপ তার ওপর বর্ষিত হবে।” (আল মুসনাদ ৫/১৯৩, হা: ৮৭ হাইসামী হাদীসটির বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ করেন। দেখুন: মাজমাউজ যাওয়ায়েদ; ৫/১৯৩)উপরোক্ত দুটি হাদীস দ্বারা যা বুঝা যায় তন্মধ্যে দুটি কথা উল্লেখ করা হলো—১. কুরাইশ হতে খেলাফতের অধিকারী হওয়ার জন্য তিনটি গুণাবলী বিদ্যমান থাকা জরুরী। যথা—ক. মানুষের প্রতি অনুগ্রহ ও সহমর্মিতা প্রদর্শন। খ. মানুষের সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করা। গ. রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম ন্যায় ও ইনসাফের সাথে পরিচালনা।২. উপরোক্ত গুণাবলী হতে বিমুখ হওয়ার প্রেক্ষিতে কুরাইশ সম্প্রদায় আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতামলী ও সমস্ত মানুষের অভিশাপের যোগ্য হবে।অতএব কুরাইশদের মহাসম্মান থাকা সত্তেও তাদের মধ্যে উপরিক্ত গুণাবলী বিদ্যমান না থাকলে তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে, তবে উপরোক্ত গুণাবলী শূন্য কুরাইশ ব্যতীত অন্যান্য সম্মানিত ব্যক্তিরা উক্ত আযাব থেকে পরিত্রান পাওয়ার কোন সুযোগ নেই।হে আল্লাহ! ইসলামী উম্মাহর সকল রাষ্ট্রনায়ককে উপরোক্ত তিনটি গুণাবলীতে গুণান্বিত করুন এবং তাদেরকে আপনার, ফেরেশতামণ্ডলী ও সমস্ত মানুষের অভিশাপ হতে নিষ্কৃতি দান করুন। আমীন।

১৫৪. কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীগণ

যে সকল হতভাগ্য ব্যক্তির ওপর ফেরেশতাদের অভিশাপ দেয় তাদের ১৪তম প্রকার হচ্ছে ঐ সব লোক, যারা কুফরী মতবাদ গ্রহণ করে সে অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেছে।إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَٰئِكَ عَلَيْهِمْ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ ﴿١٦١﴾ خَالِدِينَ فِيهَا ۖ لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنظَرُونَ ﴿١٦٢﴾অর্থঃ “নিশ্চয়ই যারা কুফরী করেছে এবং কুফরী অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের ওপর আল্লাহ, ফেরেশতামণ্ডলী, সমগ্র মানবতার অভিশাপ। তারা উক্ত অবস্থায়ই জাহান্নামে চিরকাল অবস্থান করবে। কখনো তাদের আযাব হ্রাস করা হবে না এবং নিষ্কৃতি দেয়া হবে না।” (সূরা আল-বাকারা: ১৬১-১৬২)হাফেজ ইবনে কাসীর (র) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, যারা কুফরী করেছে এবং সে অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ, ফেরেশতামণ্ডলী ও সমগ্র মানবতার অভিশাপ তাদের ওপর।এ আযাব কেয়ামত অবধি চলতে থাকবে এবং এ অবস্থাতেই তারা জাহান্নামে নিপতিত হবে।তাদের এ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি কখনো হ্রাস করা হবে না এবং তাদেরকে এ থেকে কখনো অব্যাহতি দেয়া হবে না এবং স্থায়ীভাবে এ শাস্তি অনন্তকাল অব্যাহত থাকবে।আমরা এরূপ কঠিন শাস্তি হতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে পরিত্রাণ চাই। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/২১৪)এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সম্মানিত পাঠকবৃন্দের মনোযোগ আকর্ষণ করছি-১. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফেরদের অভিশপ্ত ও শাস্তির যোগ্য হওয়ার জন্য কুফরী অবস্থায় মৃত্যুকে শর্ত করেছেন।হাফেজ ইবনে জাওযী (র) উক্ত শর্তারোপের অন্তর্নিহিত কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, মৃত্যু অবস্থায় কুফরীর শর্ত এ জন্যই আরোপ করা হয়েছে যে, কারো ব্যাপারে কুফরীর বিধান আরোপ তার মৃত্যু কুফরীর অবস্থায় হওয়ার কারণেই সাব্যস্ত হবে। (যাদুল মাসির ১/১৬৬)এ প্রসঙ্গে শায়খ মুহাম্মাদ রশীদ রেজা বলেছেন, চিরস্থায়ী অভিশাপের শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য যার পরিণতিতে স্থায়ী অপমান ও লাঞ্ছনার আবাস জাহান্নামে অবস্থান করতে হবে, এমন শর্তারোপ করা হয়েছে যে, তার মৃত্যু কুফরের ওপর হবে।এ ধরনের মানুষের ওপর স্থায়ী অভিশাপ হবে এবং এ অবস্থায় কোন প্রকার শাফায়াত-সুপারিশ অথবা কোন মাধ্যম তাদের কোন উপকারে আসবে না। (তাফসীরুল মানার ২/৫২-৫৩)২. কোন কোন উলামার অভিমত, ঐ সকল লোকদের ওপর এ অভিশাপ কিয়ামতের দিন প্রযোজ্য হবে।ইমাম বাগাবী (র) লিখেছেন, ইমাম আবু আলিয়া বলেছেন, ঐ সকল লোকদের অভিশাপ কেয়ামতের দিন প্রযোজ্য হবে। কাফেরকে দাঁড় করানো হবে, তারপর তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা অভিশাপ দিবেন, অতঃপর ফেরেশতামণ্ডলী অতঃপর সমগ্র মানব জাতি তাদেরকে অভিশাপ দিবে। এ ব্যাপারে আল্লাহই ভাল জানেন। (তাফসীরে বাগাবী ১/১৩৪)৩. আল্লাহর বাণী: خَلِدِيْنَ فِيْهَا (তারা তথায় চিরকাল অবস্থান করবে)-এর অবস্থিত সর্বনামের সম্বন্ধ সম্পর্কে মুফাসসিরীনে কেরাম দুটি অভিমত পেশ করেছেন। যথা—হাফেজ ইবনে জাওযী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার বাণী: خَلِدِيْنَ فِيْهَا -এর মধ্যে ها সর্বনামের ব্যাপারে দুটি মতামত পরিলক্ষিত হয়। যথা—ক. সর্বনামটি اللَّعْنَةُ (লা'নত) শব্দের দিকে প্রত্যাবর্তিত। এ মতটি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) ও মুকাতেল (রা)-এর।তাদের মতানুযায়ী উক্ত বাক্যটির অর্থ দাঁড়াবে, তারা (কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীরা) চিরকাল অভিশাপের মধ্যে থাকবে।খ. উক্ত শব্দটির সর্বনামের সম্বন্ধ জাহান্নামের দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে। যদিও আয়াতে কারীমায় প্রথমে জাহান্নামের কথা উল্লেখ হয়নি। তবুও পূর্বাপর শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ্য করলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়।দ্বিতীয় মত অনুযায়ী আয়াতের অর্থ হবে, তারা (কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী) জাহান্নামের অগ্নিতে চিরকাল অবস্থান করবে। (যাদুল মাসির ১/১৬৭, তাফসীরে বাগাৰী ১/১৩৪, মুহাররারুল ওয়াজিজ ২/৩৩ ও তাফসীরে বায়জাবী ১/৯৭)৪. অত্র আয়াতের ভিত্তিতে হয়তো বা কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, কারো লাঞ্ছনা ও অপমানের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অভিশাপই তো যথেষ্ট, তবে এক্ষেত্রে ফেরেশতামণ্ডলী ও সমগ্র মানবতার অভিশাপ বর্ষণের অন্তর্নিহিত কারণ কি?জনাব শায়খ মুহাম্মদ রশী রেজা উক্ত প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন, কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীদের অপমান ও লাঞ্ছনার ক্ষেত্রে আল্লাহর অভিশাপ যথেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ফেরেশতা ও মানবমণ্ডলীর অভিশাপের উল্লেখ করার পিছনে রহস্য হলো উধ্ব জগত ও নিম্ন জগতে যারাই তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার এ অভিশাপের বিষয়টি অবগত হবে (তখন তারাও তাদের উপর অভিশাপ করবে) এবং তারা যে এ শাস্তির যোগ্য সে মতামতই প্রকাশ করবে। এর ফলে তাদের এ আশাও শেষ হয়ে যাবে যে, আল্লাহ ব্যতীত তাদের প্রতি কেউ করুণার দৃষ্টিতে দেখবে এবং তাদের জন্য কেউ সুপারিশ করবে। কেননা সে তো প্রত্যেক জ্ঞানসম্পন্ন ও অনুভূতিশীলদের নিকটেই অভিশাপের উপযুক্ত সাব্যস্ত।যখন কোন ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানী ও দয়া থেকে বঞ্চিত সাব্যস্ত হয় তখন সে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের পক্ষ থেকে কিইবা আশা করতে পারে। (তাফসীরে মানার ২/৪৩)হে মহিয়ান দয়ালু প্রভু-আল্লাহ! আমাদেরকে তুমি অনুরূপ লোকদের অন্তর্ভুক্ত করো না। আমীন।

১৫৫. ঈমান আনয়ন ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সততার সাক্ষ্য প্রদান করে এবং স্পষ্ট প্রমাণাদী পাওয়ার পর কুফরীকারীগণ

ফেরেশতা যাদের প্রতি অভিশাপ করে তাদের পঞ্চদশ প্রকার হচ্ছে যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে রাসূলকে সত্য বলে জেনে এবং ইসলামের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও প্রমাণাদি পৌছার পরও কুফরী মতবাদ গ্রহণ করে।এ সকল লোকদের সম্পর্কেই আল্লাহ ঘোষণা করেছেন—كَيْفَ يَهْدِي اللَّهُ قَوْمًا كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ وَشَهِدُوا أَنَّ الرَّسُولَ حَقٌّ وَجَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ ۚ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ ﴿٨٦﴾ أُولَٰئِكَ جَزَاؤُهُمْ أَنَّ عَلَيْهِمْ لَعْنَةَ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ ﴿٨٧﴾ خَالِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنظَرُونَ ﴿٨٨﴾ إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ ﴿٨٩﴾ অর্থঃ (৮৬) কেমন করে আল্লাহ সে কওমকে হিদায়াত দেবেন, যারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে, আর তারা সাক্ষ্য দিয়েছে যে, নিশ্চয় রাসূল সত্য এবং তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ এসেছে। আর আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত দেন না। (৮৭) এরাই তারা, যাদের প্রতিদান হল, নিশ্চয় তাদের উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের লা’নত। (৮৮) তারা তাতে স্থায়ী হবে, তাদের থেকে আযাব শিথিল করা হবে না এবং তাদেরকে অবকাশও দেয়া হবে না। (৮৯) কিন্তু তারা ছাড়া যারা এরপরে তাওবা করেছে এবং শুধরে নিয়েছে তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আলে ইমরান: ৮৬-৮৯)ইমাম তাবারী (র) অন্যান্য মুফাসসিরীনে কেরামের উক্তি উদ্ধৃত করে লিখেছেন- আয়াতের তাফসীর হচ্ছে— كَيْفَ يَهْدِي اللَّهُ قَوْمًاঅর্থাৎ, এ কিভাবে সম্ভব যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এক সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করবেন ও তাদেরকে ঈমানের তাওফীক দিবেন, যারা মুহাম্মদ -এর নবুওয়াতকে অস্বীকার করে?بَعْدَ إِيمَانِهِمْ অর্থাৎ, তারা মুহাম্মদ (ﷺ)-এর নবুওয়াতের স্বীকৃতি দান ও প্রভুর পক্ষ হতে আনীত দ্বীনকে স্বীকার করার পর (তারা কুফরী অবলম্বন করেছে)وَشَهِدُوا أَنَّ الرَّسُولَ حَقٌّঅর্থাৎ, আর এরপর তারা আল্লাহর রাসূলের সততার— নিশ্চিত স্বীকৃতি দেয়।“আর তার সমর্থনে তাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে দলীল ও প্রমাণ এসে গেছে।”“আল্লাহ তায়ালা জালেম সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। তারা ঐসব লোক যারা সত্যকে বাতিলের দ্বারা পরিবর্তন এবং কুফরকে ঈমানের ওপর প্রাধান্য দেয়।”“ঐ সকল লোকের প্রতিদান হচ্ছে তারা আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত এবং ফেরেশতামণ্ডলী, সমগ্র মানুষের অভিশাপ ও বদদোয়া, যেন তারা কষ্ট আর শান্তিতে পতিত হয়।”“তারা আল্লাহ তায়ালার শাস্তিতে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে।” “তাদের উক্ত শাস্তি কোনভাবেই হ্রাস করা যাবে না এবং অবকাশ দেয়া হবে না।” “তাদেরকে কোন প্রকার ওজর পেশ করার সুযোগ দেয়া হবে না।”উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত সকল উক্তিই আখেরাতে চিরস্থায়ী শান্তিতে অবস্থানের প্রমাণ বহন করে। [তাফসীরে তাবারী ৬/৫৭৬-৫৭৭ (সংক্ষিপ্তাকারে)]হে করুণাময় মহাপ্রভু! যারা কুফরীর কারণে তোমার ফেরেশতামণ্ডলী ও সমগ্র মানুষের অভিশাপের অধিকারী হয়েছে তুমি আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করো। আমীন।

সেটিংস

বর্তমান ভাষা