পরিচ্ছেদ: ফেরেশতারা যাদের জন্য দোয়া করেন

১২৪. অজু অবস্থায় ঘুমানো ব্যক্তিগণ

যে সকল সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের জন্য ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে, অজু অবস্থায় ঘুমানো ব্যক্তি তাদের অন্তর্ভুক্ত। যারা রাতে ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাওয়ার সময় অজু অবস্থায় থাকে, আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োজিত ফেরেশতার সাথে রাত্রি যাপন করে এবং রাতে যখনই পার্শ্ব পরিবর্তন করে তখনই আল্লাহর সমীপে সে ফেরেশতা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।ইমাম তাবারানী (র) ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন— “তোমাদের শরীরকে পবিত্র রাখ, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে পবিত্র করবেন। যে ব্যক্তি পবিত্রাবস্থায় (অজু অবস্থায়) রাত্রি যাপন করবে, অবশ্যই একজন ফেরেশতা তার সাথে রাত্রি যাপন করবে, রাতে যখনই সে পার্শ্ব পরিবর্তন করে তখনই আল্লাহর সমীপে সে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতঃ বলে, হে আল্লাহ! আপনার এ বান্দাকে ক্ষমা করুন। কেননা সে পবিত্রাবস্থায় (অজু অবস্থায়) ঘুমিয়েছে।” (আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, কিতাবুন নাওয়াফেল ১/৪০৮-৪০৯ সনদ ‘জায়েদ’)বি: দ্র: উপরোক্ত টিকা ১/২০৯ হাফেজ ইবনে হাজার (র)-ও (জায়েদ) বলে আখ্যায়িত করেছেন। (ফাতহুল বারী ১১/১০৯)এছাড়াও এমন ব্যক্তি যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হয় তখনও সে ফেরেশতা ভার। জন্য আল্লাহর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হিব্বান আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন— “যে ব্যক্তি পবিত্রাবস্থায় (অজু অবস্থায়) ঘুমায় তার সাথে একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকে। অতঃপর সে ব্যক্তি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথেই আল্লাহর সমীপে ফেরেশতাটি প্রার্থনায় বলে থাকে, হে আল্লাহ! তোমার অমুক বান্দাকে ক্ষমা করে দাও, কেননা সে পবিত্রাবস্থায় ঘুমিয়েছিল।” (আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান ৩/৩২৮-৩২৯। শায়খ আলবানী এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। সহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব ১/৩১৭, সহীহ হাদীস সিরিজ ৬খ; প্রথম ৮৯-৯২)ইমাম ইবনে হিব্বান তার হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করে পবিত্রাবস্থায়, ঘুমানো ব্যক্তি জাগ্রত হলে ফেরেশতা কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনা” নামক অধ্যায় বেঁধেছেন। (আল ইহসান ফি করিব সহীহ ইবনে হিববান ৩/৩২৮)উল্লেখিত হাদীসদ্বয় থেকে পবিত্র অবস্থায় ঘুমানো ব্যক্তি সম্পর্কে দুটি বিষয় জানা যায়। যথা—১. ফেরেশতা তার সাথে রাত্রি যাপন করে থাকে। আর ফেরেশতাদের সাথী হওয়াটা বড় সম্মান এবং আল্লাহ কর্তৃক মহা অনুগ্রহ পাওয়ার ব্যাপার। পবিত্রাবস্থায় ঘুমানো ব্যক্তির জন্য এ ব্যতীত যদি আর কোন ফযিলত না থাকে, তবুও এ আমলের মহত্বের ওপর এই এক ফযিলতই যথেষ্ঠ।২. রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় পার্শ্ব পরিবর্তন করার সময় ও ঘুম থেকে জাগ্রত হলে আল্লাহ কর্তৃক নিয়োজিত ফেরেশতা আল্লাহর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে।পবিত্রাবস্থায় ঘুমানোর শুধু এ ফযিলতই নয়; বরং অন্য হাদীসে আরো ফযিলত বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমাদ এবং ইমাম আবু দাউদ মুয়াজ বিন জাবাল (রা) হতে বর্ণনা করেন, নবী (ﷺ) এরশাদ করেন— “পবিত্রাবস্থায় জিক্‌র করতে করতে ঘুমানো ব্যক্তি রাতে জাগ্রত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতে মঙ্গলের জন্য আল্লাহর কাছে যা চাইবে আল্লাহ তাকে তা দান করবেন।” (আল মুসনাদ ৫/২৩৫, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৫০৩২, ১৩/২৬২ শায়খ আলবানী এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন, সুনান আবু দাউদ ৩/৯১৫ দ্র:)এ হাদীস থেকে আরো একটি বিষয় জানা গেল যে, দোয়া কবুলের শর্তের মধ্যে এটিও একটি শর্ত যে, পবিত্রাবস্থায় বান্দা জিকির করতে করতে ঘুমাবে এবং রাতে জাগ্রত হয়ে সে আল্লাহর সমীপে প্রার্থনা করবে। কেননা এ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) তার উম্মতকে অবহিত করেছেন। আর জানা কথা যে, রাসূল (ﷺ) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত হয়েই দ্বীনের ব্যাপারে উম্মতকে অবহিত করতেন।এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন—وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ ﴿٣﴾ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ ﴿٤﴾অর্থঃ “আর তিনি কথা বলেন না, যা তার কাছে নাযিল করা হয় তা ওহী ছাড়া আর কিছুই নয়।” (সূরা আন-নাজমঃ ৩-৪)হে আল্লাহ! আমাদেরকে সেই লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যারা পবিত্রাবস্থায় রাতে ঘুমায় এবং আমাদেরকে তাদের মতই সওয়াবের অংশীদার করুন। আমীন, হে বিশ্বপ্রতিপালক আমাদের নেক বাসনা কবুল করুন।

১২৫. নামাযের অপেক্ষায় মসজিদে অবস্থানকারীগণ

যে সকল সৌভাগ্যবান ব্যক্তির জন্য ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হলো অজু অবস্থায় নামাযের অপেক্ষায় বসে থাকা ব্যক্তিগণ।ইমাম মুসলিম (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন— “তোমাদের মাঝে কোন ব্যক্তি যখন অজু অবস্থায় নামাযের অপেক্ষায় বসে থাকে, সে যেন নামাযেই রত। তার জন্য ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে, হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা কর, হে আল্লাহ! তুমি তার ওপর দয়া কর।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬১৯, ১/৪৬০)ইমাম ইবনে খুযায়মা তার সংকলিত সহীহ ইবনে খুযাইমাতে উপরের হাদীসের কাছাকাছি শব্দে এক অধ্যায় বর্ণনা করেছেন এবং অধ্যায়ের নামকরণ করেন— “নামাযের অপেক্ষায় বসে থাকার ফযিলত এবং সেখানে বসে থাকা ব্যক্তির জন্য ফেরেশতা কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনার বর্ণনা যতক্ষণ পর্যন্ত অপরকে কষ্ট না দেয়া হয় বা অজু ভঙ্গ না হয়।” (সহীহ ইবনে খুযায়মা ২/৩৭৯)আল্লাহু আকবার। এমন আমল করা কত সহজ। আর তার প্রতিদান কত অধিক। বান্দা অজু অবস্থায় নামাযের অপেক্ষায় বসে আছে, আর তার আমলনামায় নামাযের সওয়াব লেখা হচ্ছে এবং ফেরেশতা সে বান্দার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও তার জন্য আল্লাহ তায়ালার সমীপে রহমতের দোয়া করে।সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা এরূপ মহৎ কাজের প্রতি গুরুত্ব দিতেন এবং দয়াময় আল্লাহর দয়ায় এখনো করে যাচ্ছেন।এ সম্পর্কে এমন একটি ঘটনা যা ইমাম ইবনে মুবারাক (র) আত্বা বিন সায়েব (র) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদা আমরা আব্দুর রহমান সুখ (যার নাম ছিল আব্দুল্লাহ বিন হাবীব) এর নিকট গেলাম। আর তিনি তখন মৃত্যু আসন্ন অবস্থায় মসজিদে অবস্থান ছিলেন, আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যদি বাড়ীতে চলে যান; তবে আপনার জন্য তা আরামদায়ক হবে।তিনি উত্তরে বললেন, আমাকে জনৈক ব্যক্তি নবী (ﷺ) হাদীস শুনিয়েছেন, তিনি ইরশাদ করেন— “তোমাদের মাঝে কোন ব্যক্তি যখন মুসাল্লায় নামাযের অপেক্ষায় থাকে তখন সে (যেন) নামাযেই থাকে।”আর ইমাম ইবনে সায়াদের বর্ণনায় আছে, নবী (ﷺ) এরশাদ করেন— আর ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকে “হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা কর এবং তার ওপর দয়া কর।” (কিতাবুয যুহদ, হাদীস নং ৪২০ ১৪১-১৪২)তারপর আবু আব্দুর রহমান সুলামী বলেন— অতপর আমি চাই যে, আমি মসজিদে (নামাযের অপেক্ষায় থেকেই) মৃত্যুবরণ করি।” (আত তাবাকাতুল কুবরা ৬/১৭৪-১৭৫)হে দয়াময়! আপনি সেই বান্দাদের ওপর অগণিত রহমত বর্ষণ করুন এবং এ অধমদেরকেও সেই মহৎ কাজের আগ্রহ দান করুন। হে বিশ্ব প্রতিপালক! আপনি কবুল করুন। আমীন।এছাড়াও আমাদের নবী (ﷺ) তাঁর উম্মতের জন্য একটি উপকারী কথা বলেছেন, যার ফলে মসজিদে নামাযের জন্য অপেক্ষাকারীগণ আল্লাহর রহমতে অতি সহজে উপকৃত হতে পারেন।ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইবনে খুযায়মা এবং যিয়াউদ্দীন মাকদাসী, সাহাবী (রা) হতে বর্ণনা করেছেন, নবী (ﷺ) এরশাদ করেন—“নিশ্চয়ই আযান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময় দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। অতএব তোমরা (এ সময়) দোয়া কর।” (আর মুসনাদ, হাদীস নং ১৩৬৬৮, ২১/২৩৭, সহীহ ইবনে খুযায়মা হাদীস নং ৪২৭, ১২২২, আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ১৬৯৬, ৪/৫৯৩-৯৪, আল-আহাদীস মুখতার, মুসনাদ আনাস বিন মালেক (র) হাদীস নং ১৫৬২, ৪৩২-৩৯৩)ইমাম ইবনে খুযায়মা (র) নিমের অধ্যায়ের আওতায় এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন— “আযান ও ইকামাতের মাঝে দোয়া প্রত্যাখ্যান হয় না এ প্রত্যাশায় দোয়া করা মুস্তাহাব।” (সহীহ ইবনে খুযায়মা: ১/২২২)হে দয়াবান! আমাদেরকে আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ে বেশী বেশী দোয়া করার তাওফীক দান করুন এবং আমাদের প্রার্থনা কবুল করুন। আমীন, ইয়া যালজালালে ওয়াল ইকরাম।

১২৬. প্রথম কাতারের নামাযীবৃন্দ

ফেরেশতা কর্তৃক দোয়াপ্রাপ্ত ধন্য ব্যক্তিদের তৃতীয় শ্রেণী ঐ সকল লোক যারা প্রথম কাতারে জামাতের সাথে নামায আদায় করে। এ সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো, প্রথম কাতারের নামাযীর জন্য ফেরেশতা কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনা সম্পর্কে ইমাম ইবনে হিব্বান (র) সাহাবী বারা’ (রা) হতে বর্ণনা করেন— “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতেন, প্রথম কাতারের মুসল্লিদেরকে নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করেন ও ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।” (আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ২১৫৭, ৫/৫৩০-৫৩১ শায়খ শোয়াইব আরনাউত হাদীসটিকে সহীহ সাব্যস্ত করেন। (দেখুন: হাশীয়া আল ইহসান ৫/৫৩১)ইমাম ইবনে হিব্বান (র) এ হাদীসটির ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় রচনা করেন—প্রথম কাতারের নামাযীর প্রতি আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা ও ফেরেশতা কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনা বর্ণনা।” (উপরোক্ত টিকা দ্র: ৫/৫৩০)এ হাদীসে নিজের দুটি বিষয় ফুটে উঠে-১. হাদীসের শব্দ-كَانَ رَسُوْلُ اللَّهِ (ﷺ) يَقُوْلُঅর্থঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতেন।এ থেকে বুঝা যায়, রাসূল (ﷺ)-উপরিউক্ত কথা একবারই বলেননি: বরং তিনি বার বার বলতেন কেননা এতে চলমান অতীতকালের كَانَ শব্দ ব্যবহার করেছেন অর্থাৎ (তিনি বলতেন) যাতে চলমানের অর্থ পাওয়া যায় এবং এটাও জানা প্রয়োজন যে, কোন কথাকে রাসূল (ﷺ) একবার বললেই তার সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। এরপরও তিনি যেহেতু এ কথাকে বারবার বলেছেন, যেহেতু এর গুরুত্ব ও তাকিদ, বলাই বাহুল্য।রাসূল (ﷺ) সাহাবীগণকে একথা বারবার বলাতে তার এমন গ্রহ প্রকাশ পায় যে, তাঁর উম্মতরা যেন প্রথম কাতারের সওয়াব থেকে বঞ্চিত না হয়।২. নবী (ﷺ) কথার প্রারম্ভেই اِنَّ অব্যয় ব্যবহার করেছেন এর অর্থ হলো বাক্যের মাঝে গুরুত্ব ও তাকিদ বুঝানো এবং নবী (ﷺ) এতো সত্যবাদী তার কথা তাকিদ ছাড়া বললেও তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। তারপরও যখন তিনি তাকিদের অব্যয় ব্যবহার করেছেন, বিধান তা অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাকিদপূর্ণ।প্রথম কাতারের সাথে দ্বিতীয় কাতারের নামাযীর জন্য ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করে। সে সম্পর্কে একটি হাদীস ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (র) আবু উমামা (রা) হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—“নিশ্চয়ই প্রথম কাতারের নামাযীকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করেন এবং তার ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! দ্বিতীয় কাতারের নামাযীদের ওপর। রাসূলুল্লাহ বলেন। নিশ্চয়ই প্রথম কাতারের নামাযীকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! দ্বিতীয় কাতারের নামাযীদের জন্য। তিনি বললেন, দ্বিতীয় কাতারের নামাযীদের জন্যও।” (আল মুসনাদ ৫/২৬২, আত-তারগীব ওয়াত-তারহিব ১/৩১৮ শায়খ আলবানী এ হাদীসকে হাসান বলেছেন। দেখুন সহীহ আত-তারহীব ১/২৬৯)এ হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয়, দ্বিতীয় কাতারের নামাযীদের ওপর আল্লাহ তায়ালা দয়া করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। এর দ্বারা আরো স্পষ্ট হল যে, দ্বিতীয় কাতার অপেক্ষা প্রথম কাতারের ফযিলত ও মর্যাদা অনেক বেশী। কেননা নবী (ﷺ) আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক দয়া ও ফেরেশতা কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনার কথা দুই বার উল্লেখ করেছেন।এ সম্পর্কে শায়খ আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আল-বান্না বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রথম কাতারের নামাযীদের ওপর আল্লাহর দয়া ও ফেরেশতা কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনার কথা দুইবার উল্লেখ করা থেকে এ কথা বুঝা যায় যে, প্রথম কাতারের মর্যাদা ও ফযিলত দ্বিতীয় কাতারের চেয়ে অনেক বেশী এজন্য যে ব্যক্তি প্রথম কাতারে জায়গা পাওয়ার পরও দ্বিতীয় কাতারে দাঁড়ায় সে ব্যক্তি প্রথম কাতারের মহা সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়। অতএব নিজের আমলের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। (বুলুগুল আমানী ৫/৩২০, ও মেরকাতুল মাফাতিহ ৩/১৭৮)প্রথম কাতার ও দ্বিতীয় কাতারের নামাযীদের সাথে প্রথম দিকের কাতারগুলোর নামাযীর জন্যও আল্লাহ দয়া করেন ও ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এ সম্পর্কেও একটি হাদীস ইমাম আবু দাউদ (র) এবং ইমাম ইবনে খুযায়মা (র) বারা বিন আজেব (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—“নিশ্চয়ই প্রথম কাতারগুলোর নামাযীর ওপর আল্লাহ তায়ালা দয়া করেন ও ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করে।” (সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ৬৬০, ২/২৫৭, সহীহ ইবনে খুযায়মা ১৫৫৭, ৩/২৬ ইমাম নববী এ হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। দেখুন রিয়াদুস সালেহীন ৪৪৬ পৃ: শায়খ আলবানী এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। দেখুন সহীহ সুনানে আবু দাউদ ১/১৩০)ইমাম ইবনে খুযায়মা (র) তার স্বীয় গ্রন্থে এ হাদীসের ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় স্থাপন করেন— “প্রথম কাতারগুলোর নামাযীর জন্য আল্লাহর দয়া ও ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনা অধ্যায়।” (সহীহ ইবনে খুযায়মা ৩/২৬)সুনানে নাসায়ীর বর্ণনায় এসেছেঃ “সামনের কাতারসমূহের নামাযীর ওপর আল্লাহ তায়ালা দয়া করেন ও ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করে।” (সুনানে নাসায়ী, ২/৯০, শায়খ আলবানী এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সহীহ সুনানে নাসায়ী ১/১৭৫)মোটকথা, প্রথম, দ্বিতীয় ও সামনের কাতারের নামাযীর ওপর আল্লাহ তায়ালা দয়া করেন ও ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে, তবে প্রথম কাতারের ওপর আল্লাহ তায়ালা বেশী দয়া করেন ও ফেরেশতারাও বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে।দয়াবান আল্লাহ্ আমাদেরকে প্রথম কাতারে শামিল হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।প্রথম কাতারের নামাযীদের সম্পর্কে এ ছাড়া আরো হাদীস বর্ণিত হয়েছে।তন্মধ্যে একটি হলো: যে হাদীসটি ইমাম বুখারী আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন— “যদি লোকেরা আযান দেয়া ও প্রথম কাতারে নামায আদায় করার সওয়াব সম্পর্কে অবগত হতো, তবে তাতে লটারী দেয়া ছাড়া কেউ সুযোগ পেত না।” (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৬১৫, ২/৯৬)

১২৭. কাতারের ডান পার্শ্বের মুসল্লিবৃন্দ

ফেরেশতা কর্তৃক দোয়া পেয়ে ধন্য ব্যক্তিদের চতুর্থ শ্রেণী হলো, যারা নামাযে কাতারের ডান পার্শ্বে দাঁড়ায়। এর দলীল হলো, আবু দাউদ ইবনে খুযায়মা ও ইবনে হিব্বান (র) এর আয়েশা (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা দয়া করেন এবং ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে নামাযে ডান পার্শ্বে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের ওপর।” (সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ৬৭২, ২/২৬৩, সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং ৯৯১, ১/১৮০-১৮১, আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ২১৬০, ৫/৫৩৩-৫৩৪, আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব ১/৩২০ হাফেয ইবনে হাজার এ হাদীসকে হাসান বলেছেন। দেখুন: ফাতহুল বারী ২/২১৩)ইমাম ইবনে মাজাহ (র) এ হাদীসের ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় স্থাপন করেছেন—“নামাযে ডান পার্শ্বে দাঁড়ানোর ফযিলত অধ্যায়।” (সুনানে ইবনে মাজাহ ১/১৮০) ইমাম ইবনে হিব্বান এ হাদীসটির ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় রচনা করেছেন— “নামাযে কাতারের ডান পার্শ্বে দাঁড়ানো ব্যক্তির জন্য আল্লাহর ক্ষমা ও ফেরেশতা কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনা অধ্যায়।” (আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৫/৫৩৩)সাহাবীগণ নবী (ﷺ)-এর সাথে নামায আদায়ের সময় কাতারের ডান পার্শ্বে দাঁড়ানো বেশী পছন্দ করতেন। ইমাম মুসলিম বারা ইবনে আজেব (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিছনে নামায আদায় করতাম তখন তার ডান পার্শ্বে দাঁড়ানো পছন্দ করতাম। আর আমরা এটাও পছন্দ করতাম যে, তিনি যেন নামায শেষে আমাদের দিকে মুখ ফিরান। (সহীহ মুসলিম বর্ণনা নং ৫২ (৭০৯), ১/৪৯২) ইমাম নববী এ হাদীসের ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় স্থাপন করেছেন— ইমাম সাহেবের ডানে দাঁড়ানো মুস্তাহাব অধ্যায়। (পূর্বের টিকা দ্র:১/৪৯)মোল্লা আলী কারী শায়খ ইবনে মালেক (র) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি এ হাদীস সম্পর্কে বলেন, এ হাদীস কাতারের ডানে দাঁড়ানোর ফযিলত প্রমাণ করে। (মেরকাতুল মাফাতিহ ৩/১৭৬, আওনুল মা'বূদ ২/২৬৩)

১২৮. কাতারে পরস্পরে মিলিতভাবে দাঁড়ানো ব্যক্তিগণ

ফেরেশতা কর্তৃক দোয়া পেয়ে উপকৃত ব্যক্তিদের পঞ্চম শ্রেণী হলো ঐ সকল ব্যক্তি যারা জামাতের সাথে নামায আদায় করার সময় কাতারে অপরের সাথে মিলিত হয়ে দাঁড়ায় এবং তার ও অপরের মাঝে কোন প্রকার ফাক রাখে না। এ বিষয়ে বহু হাদীসের মধ্যে দুটি হাদীস বর্ণনা করা যেতে পারে। যেমন—ক. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান ও হাকেম (র) আয়েশা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা দয়া করেন এবং ফেরেশতাগণ ক্ষমা প্রার্থনা করে, যারা কাতার মিলিত করে (নামাযে একে অপরের সাথে মিলিয়ে দাঁড়ায়)” আল মুসনাদ ৬/৬৭, সুনানে ইবনে মাজাহ ৯৮১, ১/১৭৯, সহীহ ইবনে খুযায়মা ৩/২৩ আল ইহসান ফি করিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ২১৬৩, ৫/৫৩৬, আল-মুসতাদরাক আলাস-সাহিহায়ন ১/২১৪, হা: জাহবী এটিকে সমর্থন করেছেন। দেখুন; আত তালখীস: ১/২১৪ ও শায়খ আলবানী এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব ১/২৭২ দ্রঃ)ইমাম ইবনে খুযায়মা এ হাদীসটির ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় রচনা করেছেন— “নামাযের কাতারে মিলিতভাবে দাঁড়ানো ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালার দয়া এবং ফেরেশতা কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনা অধ্যায়।” (সহীহ ইবনে খুযায়মা ৩/২৩)খ. ইমাম ইবনে খুযায়মা (র) বারা ইবনে আজেব (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ নামাযের কাতারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সবার সীনায় ও কাধে হাত লাগিয়ে কাতার সোজা করতেন এবং বলতেন—“তোমরা পৃথক পৃথক হয়ে দাঁড়াইও না। কেননা তোমাদের অন্তর পৃথক হয়ে যাবে।” (আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৫/৫৩৬)বারা’ ইবনে আজেব (রা) বলেন— “আর রাসূল (ﷺ) বলতেন, যারা সামনের কাতারে মিলে মিশে দাঁড়ায় তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা দয়া করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।” (সহীহ ইবনে খুযায়মা ৩/২৬, শায়খ আলবানী ও এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব ১/২৭২ দ্র:)ইমাম ইবনে খুযায়মা (র) এ হাদীসটির ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় রচনা করেনঃ “সামনের কাতারসমূহের মিলিতকারীদের ওপর আল্লাহ তায়ালার দয়া এবং ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনার বর্ণনা।” (সহীহ ইবনে খুযায়মা ৩/২৬)এক্ষেত্রে পাঠকবৃন্দের দুটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যথাঃ১. উপরিউক্ত হাদীসসমূহ নবী (ﷺ) তার বাণীর প্রারম্ভেই اِنَّ অব্যয় ব্যবহার করেছেন। এ অব্যয় বাক্যের মাঝে ব্যবহার হলে তা নিশ্চয়ই এবং অবশ্যই অর্থ বুঝায়।২. দ্বিতীয় হাদীসে বারা ইবনে আজেব (রা) বর্ণনা করতে গিয়ে كَانَ يَقُوْلُ ব্যবহার করেছেন এর অর্থ হল তিনি বলতেন। এর দ্বারা বুঝা যায়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ কথা অনেক বারই বলেছেন এবং এর দ্বারা হাদীসে বর্ণিত বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা স্পষ্ট বুঝা যায়।এছাড়াও সাহাবায়ে কেরাম জামাতের সাথে নামায আদায়ের সময় একে অপরের সাথে মিলে দাঁড়ানোর প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতেন। এ সম্পর্কে নিম্নে দুটি প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে—১. ইমাম বুখারী (র) আনাস (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন নবী (ﷺ) এরশাদ করেন— “তোমরা তোমাদের কাতারকে সোজা কর। কারণ আমি আমার পিছনেও দেখতে পাই।”“আমাদের সবাই নামাযে একে অপরের কাঁধের সাথে কাধ এবং পায়ের সাথে পা মিলাত।” (সহীহ বুখারী কিতাবুল আযান, কাতারে কাঁধের সাথে কাঁধ ও পায়ের সাথে পা মিলাননা অধ্যায় হাদীস নং ৭২৫, ২/২১১)২. ইমাম আবু দাউদ (র) নুমান ইবনে বাশীর (রা) হতে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে এরশাদ করেন—“তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর, তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর, তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কাতারকে সোজা কর, নইলে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অন্তরের মাঝে বক্রতা সৃষ্টি করে দিবেন।”বর্ণনাকারী বলেন, “আমি দেখি ব্যক্তি তার নিজের কাঁধ অপরের কাঁধের সাথে, হাটু অপরের হাটুর সাথে এবং পা অপরের পায়ের সাথে মিলায়ে দাঁড়ায়।” (সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ৬৫৮, ২/২৫৫-২৫৬, শায়খ আলবানী এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন, সহীহ সুনানে আবু দাউদ ১/১৩০ দ্র.)আল্লাহু আকবার! সাহাবীগণ কাতার মিলানোর ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন আর আমাদের অনেক নামাযী ভাই তাদের বিপরীত আমল করে এবং এ ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণরূপে উদাসীন।আল্লামা মুহাম্মদ শামসুল হক আজীমাবাদী (র) বলেন এ হাদীসগুলি প্রমাণ করে যে, নামাযে কাতার সোজা করার ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন এবং কাতার সোজা করা নামায পূর্ণ হওয়ার অন্তর্ভুক্ত অতএব নামাযী যেন কাতার থেকে আগে বা পিছে না দাঁড়ায় বরং অপরের কাঁধের সাথে কাঁধ, পায়ের সাথে পা, ও হাঁটুর সাথে হাঁটু মিলিয়ে দাঁড়ায়।কিন্তু আজ এ সুন্নাতকে সাধারণভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এমনকি এ সুন্নাতের ওপর গুরুত্ব দেয়া হলে লোকেরা জংলী গাধার মত গর্জে উঠবে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) (আত তা’লিক আলা সুনানে দারকুতনী ১/২৮৩-২৮৪)দয়ালু, দাতা প্রভু যেন আমাদেরকে সে সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত না করেন। আমাদেরকে তিনি সেই সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যারা নামাযের কাতারকে সোজা করে আল্লাহর দয়া ও ফেরেশতা কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনা লাভ করে ধন্য হয়। আমীন।

১২৯. ইমাম সূরা ফাতিহা শেষ করার সময় জামায়াতে উপস্থিত নামাযীগণ

বহু সহীহ হাদীস হতে স্পষ্ট প্রমাণিত যখন ইমাম সূরা ফাতিহা শেষ করেন, তখন ফেরেশতারা আমীন বলে থাকে। এ সম্পর্কে নিয়ে দুটি হাদীস উল্লেখ করা হলো- ক. ইমাম বুখারী (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—“যখন ইমাম—(غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ)বলবে তখন তোমরা আমীন বল। কেননা যার আমীন বলা ফেরেশতাদের আমীনের সাথে মিলে যাবে (অর্থাৎ মানুষের আমীন বলা ও ফেরেশতাদের আমীন বলা যদি একই সময়ে হয়। দেখুন, নববীর ব্যাখ্যা ৪/১৩০) তার অতীত জীবনের গোনাহগুলিকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭৮২, ২২৬৬)খ. ইমাম বুখারী (র) ও ইমাম মুসলিম (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—“যখন তোমাদের কেউ আমীন বলে আর ফেরেশতারাও আকাশে আমীন বলে, তখন উভয়ের আমীন বলা যদি মিলে যায়, তবে আমীন বলা ব্যক্তির অতীত জীবনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” (বুখারী হাদীস নং ৭৮১, ২/২৬৬ ও মুসলিম হাদীস নং ৭২ (৪১০) ১/৩০৭ শব্দগুলি বুখারী)উপরোল্লেখিত হাদীস দু'টি দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হলো যে, ইমামের সূরা ফাতিহা শেষ করার পর ফেরেশতারা আমীন বলে এবং তাদের আমীন বলার অর্থ হলো, হে আল্লাহ! তুমি তোমার বান্দার দোয়াকে কবুল করে নাও। এ সম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজার বলেন: اٰمِيْنَ শব্দটি صَهٍ শব্দের ন্যায় اَسْمَاءُ اَفْعَالٍ -এর অন্তর্ভুক্ত। জমহুর ওলামাদের অভিমত অনুসারে এর অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনি কবুল করুন।امين -এর অর্থ সম্পর্কে আরো অনেক অভিমত রয়েছে, তবে সবগুলির সারমর্ম এটাই। (ফাতহুল বারী ২/২৬২)ইমাম বুখারী (র) আতা (র) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমীনের অর্থ হলো প্রার্থনা। (বুখারী ২/২৬২)উপরোল্লেখিত আলোচনা সারমর্ম নিম্নরূপঃইমাম সূরা ফাতিহা শেষ করার পর ফেরেশতারা উপস্থিত নামাযীদের জন্য আমীন বলে সুপারিশ করে থাকে যার অর্থ হলো হে আল্লাহ! আপনি নামাযীদের দোয়াকে কবুল করুন।হে আমাদের প্রতিপালক দয়ালু দাতা! আমাদেরকে সেই সৌভাগ্যবান লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন।

১৩০. নামাযান্তে নামাযের স্থানে বসে থাকা ব্যক্তিগণ

ফেরেশতাদের দোয়া পাওয়া সৌভাগ্যবানদের সপ্তম শ্রেণী হলেন: যারা ফরজ নামায আদায় করে স্বস্থানে বসে থাকেন। এর প্রমাণ স্বরূপ তিনটি হাদীস নিয়ে পেশ করা হলো- ক. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—“তোমাদের মাঝে যারা নামাযের পর স্বস্থানে বসে থাকে, তাদের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত তার অজু ভঙ্গ না হবে, হে আল্লাহ! আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং হে আল্লাহ! আপনি তাদের ওপর দয়া করুন।” (আল মুসনাদ হাদীস নং ৮১০৬, ১৬/৩২ শায়খ আহমাদ শাকের এ হাদীসকে সহীহ' বলেছেন। দেখুন আল-মুসনাদের টিকা ১৬/৩২)খ. ইমাম আহমাদ (র) আবু আবদুর রহমান (র) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি আলী (রা)-কে বর্ণনা করতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—“যখন কোন বান্দা নামাযের পর স্বস্থানে বসে থাকে তখন ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর ফেরেশতাদের দোয়া হলো হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন, আপনি তাকে দয়া করুন।”“যদি সে নামাযের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে তখন ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর তার জন্য ফেরেশতাদের দোয়া হলো হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন, হে আল্লাহ! আপনি তাকে দয়া করুন।” (আল-মুসনাদ হাদীস নং ১২১৮, ২/২৯২ শায়খ আহমাদ শাকের এ হাদীসকে হাসান বলেছেন। দেখুন আল-মুসনাদের টিকা ২২৯২)গ. ইমাম আহমাদ (র) আত্বা বিন সায়েব (র) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি আবু আব্দুর রহমান সুলামী এর নিকট গেলাম। তিনি ফজর নামাযান্তে নামাযের জায়গায় অপেক্ষা করছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যদি বাড়ীতে চলে যেতেন তবে আপনার জন্য তা আরামদায়ক হতো। তিনি উত্তরে বললেন, আমি আলী (রা) হতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি এরশাদ করেন—“যে ব্যক্তি নামাযের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর ফেরেশতার দোয়া হলো হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি তাকে দয়া করুন।” (আল মুসনাদ হাদীস নং ১২৫০, ২/৩০৫-৩০৬ শায়খ আহমাদ শাকের এ হাদীসকে হাসান বলেছেন। দেখুন আল-মুসনাদের টিকা ২৩-৫)শায়খ আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আল বান্না শেষ হাদীস দুটির ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় রচনা করেন— “নামাযী ব্যক্তি নামাযের পর স্বস্থানে বসে থাকার ফযিলত এর অধ্যায়।” (আল-ফাতহুর রব্বানী ফি তারতীবে মুসনাদ ইমাম আহমাদ ৪/৫২)তিনি উক্ত অধ্যায়ে হাদীস বর্ণনা করে মন্তব্য করেন, এ অধ্যায়ে উল্লেখিত হাদীস প্রমাণ করে যে, বান্দা যদি অন্য কোন কাজে লিপ্ত না হয়, তবে তার জন্য উত্তম হলো, সে যেন স্বস্থানেই অন্য নামাযের অপেক্ষা করে, অথবা কাজে ব্যস্ত হওয়ার পূর্বে যেন তার নামাযের জায়গায় বসে নির্ধারিত দোয়া-জিকর করতে থাকে। যেমন অন্য হাদীসে এসেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার নামাযের জায়গায় অজু অবস্থায় থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতা তার জন্য ক্ষমা ও রহমতের দোয়া করতে থাকে। (বুলুগুল মাআনী ৪/৫৩)শায়খ আল বান্না (র) এখানে নিজে এক প্রশ্ন উত্থাপন করে নিজেই তার উত্তর দেন।তিনি বলেন, উপরোল্লেখিত ফযিলত কি শুধু ফজর নামাযের সাথেই সম্পৃক্ত যেমন হাদীসের দিকে লক্ষ্য করলে বাহ্যিকভাবে তাই বুঝা যায়?আমি বলি, অন্যান্য ব্যাপক হাদীসের আলোকে বুঝা যায় যে এ ফযিলত অন্যান্য নামাযের পর স্বস্থানে বসে থাকলেও। কতিপয় হাদীসে ফজর ও এশার নামাযের ফযিলতের বর্ণনা তার অতিরিক্ত মর্যাদাকে আরো স্পষ্ট করেছে। আর তা আল্লাহ তায়ালার নিম্নোক্ত বাণীর অনুরূপ—حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَىٰঅর্থঃ “তোমরা সালাতসমূহ ও মধ্যবর্তী সালাতের হিফাযত কর।” (সূরা বাকারা: ২৩৮)আয়াতটিকে আমরা ব্যাপক বর্ণনার পর নির্ধারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। (বুলুগুল মাআনী ৪/৫৩)মূলকথা হলো, যে ব্যক্তি নামাযান্তে স্বস্থানে অজু অবস্থায় বসে থাকে, ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকে।হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার দয়ায় আমাদেরকে সেই সৌভাগ্যবান লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন।উক্ত আমলের উল্লেখিত ফযিলত ছাড়াও আমাদের নবী (ﷺ) বলেন, নামাযান্তে স্বস্থানে বসে থাকা এমন তিন আমলের একটি যার ফযিলত নিম্নে বর্ণনা করা হলো—১. সম্মানিত ও আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত ফেরেশতারা এ আমলগুলিকে লেখা এবং আকাশের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।২. এ আমলগুলির নাম হলো ‘কাফফারা’ অর্থাৎ গোনাহ মোচনকারী।৩. এ আমলগুলি বাস্তবায়নকারী যত দিন বেঁচে থাকবে তত দিন শান্তিতে থাকবে এবং তার মৃত্যুও শান্তিতে হবে।৪. এ আমলকারীরা তার গোনাহ থেকে এমন পবিত্র হবে, যেমন সে মায়ের গর্ভ থেকে নিস্পাপ হয়ে ভূমিষ্ট হয়েছিল।উল্লেখিত ফযিলতের বর্ণনা রয়েছে, ইমাম তিরমিযী কর্তৃক ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত হাদীসে, তিনি বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন— “রাতে আমার প্রতিপালক উত্তম আকৃতিতে আমার সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন।বর্ণনাকারী বলেন, আমার ধারণা যে, এ ঘটনা ছিল স্বপ্নে। (এ ঘটনা ছিল স্বপ্নে অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল স্বপ্নে।)আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুহাম্মদ! আপনি কি জানেন, শ্রেষ্ঠ ফেরেশতারা কি বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে থাকে?আমি বললাম, হ্যা! তারা কাফফারা সম্পর্কে ঝগড়া করে থাকে। আর কাফফারা হলো নামাযের পর মসজিদে অবস্থান করা, নামাযের জামায়াতের জন্য পায়ে হেঁটে যাওয়া কষ্টের (শীতের) সময়ও পূর্ণভাবে অজু করা। যে ব্যক্তি এ আমলগুলি করবে সে সুখে-শান্তিতে জীবন-যাপন করবে এবং মৃত্যু শান্তিতেই হবে এবং স্বীয় পাপ হতে এমন পবিত্র হবে যেমন নবজাত শিশু গোনাহ থেকে পবিত্র থাকে।” (জামে তিরমিজী ৪/১৭৩-১৭৪, শায়খ আলবানী এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সহীহ সুনানে তিরমিজী ৩/৯৮ ও সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ১/১৯৪)আল্লাহু আকবর! এ তিন প্রকার আমলের সওয়াব ও বিনিময় কত মহান। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এ আমলগুলিকে হেফাজতকারী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন।এ ক্ষেত্রে সম্মানিত পাঠকমণ্ডলির দুটি প্রশ্নোত্তরের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করছি, আশা করি তাদের জন্য তা উপকারী হবে।প্রথম প্রশ্নঃ ফেরেশতাদের দোয়ায় উপকৃত হওয়ার জন্য কি মসজিদে নামাযান্তে স্বস্থানে বসে থাকা আবশ্যক নাকি আপন জায়গা হতে সরে গিয়ে যে কোন জায়গায় বসলেও ফেরেশতাদের দোয়া পাওয়া যাবে?এ প্রশ্নের উত্তরে ইবনে হাজার (র)-এর বর্ণনা হলো— নামায আদায় করার পর যতক্ষণ পর্যন্ত নামাযের স্থানে অবস্থান করবে ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করে। হাদীসের অংশ বিশেষের ব্যাখ্যায় যা উল্লেখ করেছেন তা উদ্ধৃতি- তিনি লিখেন, নবী (ﷺ) বলেছেন فِي مُصَلَّاه (নামাযের স্থানে) বুঝা যায়, তা মসজিদের সেই জায়গা, যাতে সে নামায আদায় করেছে। এ কথা সাধারণভাবে বলা হয়েছে। তবে যদি কোন ব্যক্তি নামায শেষ করে নিয়ত ঠিক রেখে মসজিদেই অন্য জায়গায় বসে অন্য নামাযের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে তার জন্যও সে সওয়াব অবধারিত। (ফাতহুল বারী ২/১৩৬)আল্লামা আইনী (র) উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় এ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন। (উমদাতুল কারী ৫/১৬৭)দ্বিতীয় প্রশ্নঃ বাড়ীতে নামায আদায় করে নামাযের স্থানে বসে থাকা মহিলারাও কি ফেরেশতাদের উক্ত দোয়া পাবে?আল্লাহ তায়ালার সমীপে আশা রাখি, তিনি এ রকম মহিলাদেরকেও উক্ত মর্যাদা দান করবেন। কেননা মসজিদে এসে নামায আদায় করা তাদের জন্য জরুরী নয়; বরং ঘরে নামায আদায় করাই তাদের জন্য উত্তম ও বেশী সওয়াব। অনুরূপ নামাযান্তে মসজিদে বসে থাকার চেয়ে বাড়ীতে বসে থাকাটাই মহিলাদের জন্য উত্তম। আল্লাহই সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।সৌদী আরবের সাবেক প্রধান মুফতী মহামান্য শায়খ আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (র)-এর একটি ফতওয়া উল্লেখ করা হচ্ছে, যা তিনি অনুরূপ প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন- ফজর নামাযান্তে ঘরে বসে কুরআন তেলাওয়াত করার। রাকাত নামায পড়া কি মসজিদে করা ঐ আমলের সমান সওয়াব?উত্তরঃ এ আমল অত্যন্ত ভাল এবং সওয়াবের কাজ। কিন্তু হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, এ ফযিলত মসজিদে নামাযান্তে স্বস্থানে বসে থাকার জন্যই। তবে যদি কোন ব্যক্তি অসুস্থতার কারণে অথবা ভয়ের কারণে ফজর নামায ঘরে আদায়ের পর সূর্য উঠা পর্যন্ত নামাযের স্থানে বসে জিকির অথবা কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকে এবং সূর্য উঠার পর দুই রাকাত নামায আদায় করে, তবে সে হাদীসে উল্লেখিত সওয়াব পাবে ইনশাআল্লাহ। কেননা সে শরয়ী ওজরেই ঘরে নামায আদায় করেছে।অনুরূপ যদি কোন মহিলা আপন ঘরে ফজরের নামায আদায় করার পর নামাযের স্থানে বসে আল্লাহর জিকির অথবা কুরআন তেলাওয়াতে লিপ্ত থাকে পরে দুই রাকাত নামায আদায় করে সে মহিলাও হাদীসে বর্ণিত সওয়াব পাবে। (শায়খ বিন বায (র) এর মাজমু ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত (সালাত এর দ্বিতীয় ভাগ) ১১/৪০৩-৪০৪)

১৩১. জামাতের সাথে ফজর ও আসর নামায আদায়কারীগণ

ফেরেশতাদের দোয়া পেয়ে সৌভাগ্যবানদের অষ্টম প্রকার হলো ঐ সকল লোক যারা ফজর ও আসরের নামায জামাতের সাথে আদায় করে।ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইবনে খুযায়মা এবং ইবনে হিব্বান (র) আবু হুরাইরা (রা) এতে বর্ণনা করেন, নবী (ﷺ) এরশাদ করেন—“রাতের ও দিনের ফেরেশতারা ফজর ও আসর নামাযে একত্রিত হয়। ফজর নামাযে রাতের ফেরেশতারা উপরে উঠে যায় এবং দিনের ফেরেশতা মানুষের নিকট থেকে যায় এবং আসর নামাযে একত্রিত হয়ে দিনের ফেরেশতারা চলে যায় এবং রাতের ফেরেশতারা থেকে যায়। তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা আমার বান্দাদেরকে কোন অবস্থায় ছেড়ে এসেছ?ফেরেশতারা উত্তর দেয়, আমরা যখন তাদের নিকট উপস্থিত হয়েছিলাম তখন তাদেরকে নামাযে রত অবস্থায় পেয়েছিলাম এবং যখন আমরা তাদের ছেড়ে এসেছি তখনও তাদেরকে নামাযের অবস্থায় ছেড়ে এসেছি। অতএব আপনি তাদেরকে কিয়ামত দিবসে ক্ষমা করবেন।” (আল মুসনাদ হাদীস নং ৯৪১৯, ১৭/১৫৪, সহীহ ইবনে খুযায়মা হাদীস নং ৩২২, ১/১৬৫ আল ইহসান ফি করিব সহীহ হিব্বান হাদীস নং ২০৬১, ৫/৪০৯-৪১০, শায়খ আহমাদ শাকের এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: আল মুসনাদের টিকা ১৭/১৪৫)ইমাম ইবনে খুযায়মা (র) এ হাদীসটি নিম্নের অধ্যায় রচনা করেন—“ফজর ও আসর নামাযে ফেরেশতাদের উপস্থিতি এবং এ দুই নামায জামাতের সাথে আদায়কারীর জন্য তাদের দোয়া।” (সহীহ ইবনে খুযায়মা ১/১৬৫)ইমাম ইবনে হিব্বান (র) তার স্বীয় গ্রন্থে এ হাদীসের ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় রচনা করেন— “ফজর ও আসরের নামায জামাতের সাথে আদায়কারীর জন্য ফেরেশতাদের দোয়া।” (আল ইহসান ফি করিব সহীহ ইবনে হিব্বান ৫/৪০৯)শায়খ আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আল-বান্না ফেরেশতাদের দোয়া: فَاغْفِرْلَهُمْ يَوْمَ الدِّيْنِ-এর ব্যাখ্যায় বলেন, এমন ব্যক্তির জন্য ফেরেশতারা কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তায়ালার সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। (বুলুগুল মাআনী ২/২৬০-২৬১)হে আমার দয়ালু প্রভু! আপনার দয়ায় আমাদেরকে সে লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন।

১৩২. কুরআন খতমকারীগণ

যে সকল লোকের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করে থাকে তাদের নবম শ্রেণী হলো ঐ সকল লোক যারা কুরআন খতম করেন। ইমাম দারেমী (র) সাআ'দ (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন—“কুরআন খতম যদি রাত্রির প্রথম ভাগে হয় তবে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতারা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। অনেক সময় আমাদের মাঝে অল্প কিছু বাকী থাকত তা আমরা সকাল বা সন্ধ্যা পর্যন্ত বিলম্বিত করতাম।” (সুনানু দারেমী ৩৪৮৬, ২/৩৩৭ ইমাম নববী এ হাদীসকে 'হাসান' বলেছেন।)সম্মানিত পাঠক এ ক্ষেত্রে দুটি লক্ষণীয় বিষয়ক. উপরোল্লেখিত বর্ণনায় সাআদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা) কুরআন খতমকারীদের জন্য ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনা করার হাদীস যদিও নবী (ﷺ)-এর দিকে সম্পর্কিত করেননি, তবুও হাদীস বিশারদগণের নীতিমালা অনুযায়ী এমন বর্ণনাকে মারফু’র বিধানই লাগানো হয়ে থাকে। কেননা কোন সওয়াব ও শাস্তির ব্যাপারে সাহাবাগণ কোন কথা নিজের মনগড়া বলতেন না; এবং নবী (ﷺ) থেকে শিক্ষা পেয়েই তারা অপরকে অভিহিত করতেন। (শারহু নুখবাতুল ফিকর, ও ড: মুহাম্মদ আদীব সালেহ লিখিত: লামহাত ফি উসুলিল হাদীস ২১৬ পৃঃ)খ. উপরোল্লেখিত বর্ণনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হলো যে, সাহাবাগণের কুরআন তেলাওয়াত দিনে বা রাতের মাঝামাঝি সময় যদি শেষ হবার উপক্রম হতো, তারা তা দিনের শেষ বা রাতের শেষভাগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। যাতে করে রাতের প্রথম ভাগে খতম করার ফলে সকাল পর্যন্ত অথবা দিনের প্রথম ভাগে শেষ করার ফলে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফেরেশতাদের দোয়া পায়।সাআদ (রা) ছাড়াও অন্যান্য সালফে সালেহীনরাও কুরআন খতমকারীদের জন্য ফেরেশতা কর্তৃক দোয়ার ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন। ইমাম দারেমী (র) আবদাহ (আবদাহ বিন আবু লুবাবাহ ছিলেন তাবেয়ী। ইমাম আওযায়ী তার সম্পর্কে বলেন, আমার মতে ইরাক ভূখণ্ডে আবদাহ বিন আবু লাবাবাহ ও হাসান বিন হারব অপেক্ষা উত্তম মানুষ কেউ আসেনি। দেখুন: তাহজিব আত-তাহজীব ৬/৪৬১-৪৬২) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন—“যখন কোন ব্যক্তি দিনের বেলায় কুরআন খতম করে, ফেরেশতারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকে এবং যদি রাতে খতম করে তবে ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে।" (সুনানে দারেমী ৩৪৭৮, ১৩৩৭)হে আল্লাহ দাতা দয়ালু। আপনি আমাদেরকে বেশী বেশী কুরআন খতম করার তাওফীক দান করুন এবং ফেরেশতাদের দোয়া নসীব করুন। আমীন!

১৩৩. নবী (ﷺ)-এর ওপর দরূদ পাঠকারীগণ

ফেরেশতাদের দোয়ায় ধন্য ব্যক্তিদের দশম শ্রেণী ঐ সকল লোক যারা রাসূল (ﷺ)-এর ওপর দরূদ পাঠ করে থাকেন। এর প্রমাণ হলো ইমাম আহমাদ (র)-এর আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন—“যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওপর একবার দরূদ শরীফ পাঠ করবে আল্লাহ তায়ালা তার ওপর সত্তর বার দয়া করেন ও তার ফেরেশতারা তার জন্য সত্তর বার ক্ষমা প্রার্থনা করবে। অতএব বান্দারা অল্প দরূদ পাঠ করুক বা অধিক দরূদ পাঠ করুক (এটা তার ব্যাপার)”। (আল মুসনাদ, হাদীস নং ৬৬০৫, ১০/১০৬-১০৭, হাফেয মুনযিরি, হাফেয হায়সামী; আল্লামা সাখাবী এবং শায়খ আহমাদ শাকের এ হাদীসকে ‘হাসান বলেছেন। (দেখুন: আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব ২/৪৯৭, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১০/১৬০, আল কাউলুল বাদী ১৫৩, আল মুসনাদের টিকা ১০/১০৬)আল্লাহু আকবার! কতই না সহজ আমল আর তার প্রতিদান কতই না মহান।বান্দা মাটির মানুষ রাসূল (ﷺ)-এর ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে, যার ফলে সমস্ত বিশ্বজগতের সৃষ্টিকারী, রিযিকদাতা তার জন্য সত্তর বার রহমত দান করবেন এবং ফেরেশতারাও তার ওপর সত্তর বার ক্ষমা প্রার্থনা করবে।কাবার রবের শপথ, যদি কোন আমলের ফলে বিশ্ব প্রতিপালকের রহমত একবার হয়, তবেই সে আমলের মর্যাদা প্রমাণ হওয়ার জন্য যথেষ্ট, অথচ এ আমলের প্রতিদান স্বরূপ আল্লাহ তায়ালা সত্তর বার দয়া এবং ফেরেশতাদের সত্তর বার দোয়া পাওয়া যায়, তাহলে এর মর্যাদা কত বেশী হতে পারে সহজেই তা অনুমেয়।উল্লেখিত হাদীস যদিও আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা)-এর বাণী, কিন্তু হাদীস বিশারদদের মতানুসারে সাহাবীগণের কথাও নবী (ﷺ)-এর বাণীর মতই। কেননা নবী (ﷺ)-এর সাহাবীগণ নিজের পক্ষ থেকে কোন কথা বলতেন না; বরং তারা নবী (ﷺ) এর নিকট থেকে শুনার পরই অপরকে বলতেন।আল্লামা সাখাবী (র) আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা)-এর বাণী সম্পর্কে বলেন, তার কথা নবী (ﷺ)-এর বাণীর পর্যায়ে। কেননা এর মাঝে ব্যক্তিগত মতামতের কোন প্রশ্নই আসতে পারে না। (আল কাউলুল বাদী ফিস সালাতে আলাল হাবীব (ﷺ) ১৫৩ পৃ:)শায়খ আহমদ বিন আব্দুর রহমান আল-বান্না (র) বলেন: এটা হলো, আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা)-এর বাণী, তবে এটা মারফু হাদীস পর্যায়ের। কেননা এমন সংবাদের মাঝে ব্যক্তিগত মতামতের কোন স্থানই নেই। (বুলুগুল মাআনী ১৪/৩১০)হে আল্লাহ! আপনি আপনার দয়ায় আমাদের নবী (ﷺ)-এর উপর বেশী বেশী দরূদ পাঠ করার তাওফীক দান করুন এবং আমাদেরকে আপনার দয়া ও ফেরেশতাদের দোয়া পাওয়ার সৌভাগ্য প্রদান করুন। আমীন।এছাড়াও নাবী (ﷺ) তার উপর বেশী বেশী দরূদ পাঠের উৎসাহ প্রদান করেছেন। ইমাম তিরমিজী (র) উবাই বিন কা'ব (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ“আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার উপর বেশী বেশী দরূদ পাঠ করতে চাই, তবে আমি আমার দোয়ার কত অংশ আপনার দরূদের জন্য নির্দিষ্ট করব? তিনি বলেন, তোমার ইচ্ছানুযায়ী। আমি বললাম, এক চতর্থাংশ? তিনি বললেন: তুমি যা চাও, তবে যদি এর চেয়ে বেশী অংশ দরূদ পড় তা তোমার জন্যই ভাল।আমি আরজ করলাম: হে আল্লাহ রাসূল! আমি কি অর্ধাংশ দরূদ পড়ব? তিনি বললেন: তুমি যা চাও, তবে যদি বেশী পড় তা তোমার জন্যই ভাল। আমি বললাম: এক তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন তুমি যা চাও তবে যদি এর চাইতে বেশী অংশ দরূদ পড় তবে তোমার জন্য উত্তম। আমি আরজ করলাম: হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি দোয়ার সম্পূর্ণই শুধু আপনার উপর দরূদ পাঠ করব?তিনি এরশাদ করলেন: যদি তাই কর, তবে তোমার চিন্তা মুক্তি ও পাপসমূহ ক্ষমার জন্য যথেষ্ট। (জামে তিরমিজী, হাদীস নং ২৫৭৪, ৭/১২৯-১৩০, ইমাম তিরমিজী এ হাদীসকে ‘হাসান বলেছেন, শায়খ আলবানীও এ হাদীসকে ‘হাসান বলেছেন। (দেখুন: সহীহ সুনানে তিরমিজী ২/২৯৯)এ হাদীস হতে বুঝা গেল, যে ব্যক্তি নিজের জন্য দোয়া না করে শুধু রাসূল (ﷺ) এর উপর দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তাকে দু'টি বস্তু দান করবেন।ক. দুনিয়া ও আখেরাতে চিন্তা মুক্ত করবেন।খ. তার গোনাহকে ক্ষমা করে দিবেন।আরও একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (র) উবায় বিন কাব (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন— “এক ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-এর সমীপে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল! (ﷺ) আমি নিজের জন্য দোয়া করার পরিবর্তে শুধু আপনার উপর দরূদ পাঠ করতে চাই এ সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?”তিনি উত্তরে বলেন, এর জন্য তো দুনিয়া ও আখেরাতে তোমার চিন্তাসমূহের ক্ষেত্রে আল্লাহই যথেষ্ট হবে।” (আল মুসনাদ ৫/১৩৬ হাফেয মুনযিরি এ হাদীসের সনদকে যায়েদ বলেছেন। দেখুন: আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ২/৫০১)ইমাম তায়বী (র) إِذَا تُكْفٰى هَمَّكَ -এর ব্যাখ্যায় বলেন। এর অর্থ হলো- দুনিয়া ও আখেরাতের যে বিষয় তোমার চিন্তার কারণ হতে পারে আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য সে ক্ষেত্রে যথেষ্ট। আর এর এত বেশী ফযীলতের কারণ হলো, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওপর দরূদ পড়াতে আল্লাহর জিকির রয়েছে এবং রাসূল (ﷺ)-এর সম্মান, মর্যাদা এবং তার অধিকার আদায় করার উদ্দেশ্যে স্বীয় স্বার্থ উপেক্ষা এবং নিজের জন্য দোয়ার পরিবর্তে তার জন্য দোয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।” (শারহু তায়বী ৩/১০৪৬; রাসূল (ﷺ) সাঃ-এর ওপর দরূদ ও ফযীলত সম্পর্কে আরো জানতে হলে পড়ন ইমাম ইবনে কাইয়্যিম (র) প্রণীত” জালাউল আফহাম ফি ফাযলেস সালামে ওয়াস সালাতে আলা মুহাম্মাদ শেখায়রুল আনাম” গ্রন্থটি।)হে দয়ালু দয়াময়, আপনি আমাদের মত অধমদেরকে সে সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা এমন আমল দ্বারা সৌভাগ্যবান হয়েছে। আমীন।

১৩৪. অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দোয়াকারীগণ

ফেরেশতাদের দোয়ায় উপকৃত ও সৌভাগ্যবানদের এগারোতম ব্যক্তি হলো ঐ সকল লোক যাদের অনুপস্থিতিতে অন্য মুসলিম ভাই তাদের জন্য দোয়া করে। আর বারোতম সৌভাগ্যবান ঐ সকল লোক যে ব্যক্তি অনুপস্থিত মুসলিম ভাইয়ের জন্য দোয়া করে। উক্ত দুই বিষয়ের দলীল নিম্নে উপস্থাপন করা হলো—ইমাম মুসলিম (র) সাফওয়ান (র) হতে বর্ণনা করেন এবং তিনি আব্দুল্লাহ বিন সাফওয়ানের ছেলে ও দারদার স্বামী ছিলেন, তিনি বর্ণনা করেন, সন্ধ্যা উপনীত হলে আমি আবু দারদার ঘরে উপস্থিত হলাম। কিন্তু আমি তাকে ঘরে পেলাম না। উম্মুদ দারদা (র)-এর সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনি বললেন, এ বছর তোমার কি হজ্জ করার ইচ্ছা আছে আমি বললাম, হ্যা। তিনি বললেন, আমাদের কল্যাণের জন্য দোয়া করবে। কারণ নবী (ﷺ)-এরশাদ করেছেন—“কোন মুসলিম তার অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দোয়া করলে তা কবুল করা হয় এবং তার মাথার কাছে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। যখনই সে আমীন অর্থাৎ হে আল্লাহ! কবুল করুন এবং তোমার জন্য অনুরূপ।” (তোমার ভায়ের জন্য যা চাইলে আল্লাহ তোমাকেও তাই দান করুক।)সাফওয়ান বলেন, তারপর আমি বাজারে গেলাম, সেখানে গিয়ে আবু দারদা (রা) এর সাক্ষাৎ পেলাম, তিনিও নবী (ﷺ) ও হতে একই রকম হাদীস শুনালেন। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৮৮ (২৭৩৩), ৪/২০৯৪)এ হাদীস সম্পর্কে পাঠকবৃন্দের দুটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি—১. উম্মুদ দারদা (রা) বর্ণনা করেন— “নবী (ﷺ) বলতেন যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে চলমান অতীতকালের শব্দ ব্যবহার করেছেনঃ كَانَ يَقُوْلُ এর অর্থ হলো নবী (ﷺ) এ কথাকে বারবার বলতেন।”২. এ হাদীসের আলোকে বুঝা যায় যে, দুই প্রকার লোকের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করে থাকে। যথা:প্রথমত: ঐ সকল লোক, যাদের অনুপস্থিতিতে কোন মুসলিম ব্যক্তি দোয়া করে থাকে। কেননা এমন দোয়ার জন্য নির্দিষ্ট ফেরেশতা বলে থাকে ‘আমীন অর্থাৎ হে আল্লাহ তার অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দোয়া কবুল করুন।দ্বিতীয়: ঐ সকল লোক যারা কোন অনুপস্থিত মুসলিম ভাইয়ের জন্য দোয়া করে। কেননা দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট ফেরেশতা তার দোয়া সম্পর্কে বলে, হে আল্লাহ তার দোয়াকে কবুল করুন এবং وَلَكَ بِمِشْلِهِ আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সেই বস্তু দান করুন যা তুমি তোমার অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য প্রার্থনা করেছ।ইমাম ইবনে হিব্বান (র) স্বীয় সহীহ ইবনে হিব্বানে এ অধ্যায় রচনা করেন—“উভয়ের দোয়া কবুল হওয়ার আশায় অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য বেশী বেশী দোয়া করা মুস্তাহাব হওয়ার বর্ণনা।” (আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান ৩/২৬৮)ইমাম নওয়াবী (র) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন- এ হাদীস দ্বারা অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দোয়ার ফযিলত প্রমাণিত হয়। যদি মুসলমানদের কোন দলের জন্য দোয়া করা হয় তবুও এ ফযিলত পাওয়া যাবে এবং হাদীসের বাহ্যিকতায় বুঝা যায় যে, সমস্ত মুসলমানদের জন্য এ দোয়া করলে তাতেও এ ফযিলত পাওয়া যাবে। (শারহু নববী ১৭/৪৯)ফেরেশতাদের দোয়া পাওয়ার প্রত্যাশায় অতীত যামানায় মনীষীগণ অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্য দোয়া করা অনেক গুরুত্ব দিতেন এবং আল্লাহ্ তায়ালার অনুগ্রহে বর্তমানেও দিচ্ছেন।কাযী ইয়াজ (র) বলেন, সালফে সালেহীনগণ যখন নিজের জন্য দোয়া করার ইচ্ছা পোষণ করতেন তখন তারা অনুপস্থিত মুসলিম ভাইয়ের জন্য দোয়া করতেন। কেননা এমন দোয়া কবুল হয়ে যায় এবং দোয়াকারীর জন্য ফেরেশতারা ঐ দোয়াই করে থাকে। (শারহু নববী ১৭/৪৯, শরহ আত-তায়বী ৫/১৭৯৭)হাফেজ জাহাবী (র) উমুদ দারদা (র)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন যে, আবুদ দারদা (রা)-এর তিনশত ষাটজন বন্ধু ছিল, নামাযে তাদের জন্য দোয়া করতেন। এ সম্পর্কে তার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করলে তদুত্তরে বলেন—“আমি কি চাইব না যে, ফেরেশতারা আমার জন্য দোয়া করুক?” (সিয়ার আলামুন নুবালা ২/৩৫১)কুরআন মাজীদ সেই সকল মুমিনদের প্রশংসা করেছে যারা অতীত মুমিনদের জন্য দোয়া করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন—وَالَّذِينَ جَاءُوا مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ ﴿١٠﴾অর্থঃ “যারা তাদের পরে আগমন করেছে, তারা বলে যে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভ্রাতাদেরকে ক্ষমা করুন এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি দয়ালু ও পরম করুণাময়।” (সূরা হাশর: ১০)শায়খ মুহাম্মদ আল্লান সিদ্দিকী (র) এ আয়াত সম্পর্কে লিখেছেন, আল্লাহ তায়ালা অনুপস্থিত মুসলিম ভাইয়ের জন্য দোয়া করার জন্য তাদের প্রশংসা করেছেন। (দলীলুল ফাতিহীন লি তুরুক রিয়াদুস সালেহীন ৪/৩০৭)হে বিশ্ব পরিচালক, দাতা দয়ালু! আপনি আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন।

১৩৫. কল্যাণের পথে ব্যয়কারীগণ

যে সৌভাগ্যবান লোকদের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করে তাদের তেরোতম হলো ঐ সকল লোক যারা কল্যাণের পথে ব্যয় করে থাকে। এর প্রমাণ বহনকারী হাদীসসমূহের মধ্যে নিম্নে তিনটি হাদীস উল্লেখ করা হলো—১. ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) এরশাদ করেন—“প্রতিদিন সকালে দু'জন ফেরেশতা অবতরণ করেন, একজন বলেন, হে আল্লাহ! দানকারীর সম্পদ বাড়িয়ে দাও। আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! যে দান করে না তার সম্পদকে বিনাশ করে দাও।” [বুখারী হাদীস নং ১৪৪২, ৩/৩০৪, মুসলিম হাদীস নং ৫৭ (১০১০), ২৭০০]এ হাদীসে নবী (ﷺ) তাঁর উম্মতকে এ সংবাদ প্রদান করেছেন যে, ভাল পথে ব্যয়কারীর জন্য ফেরেশতারা দোয়া করে থাকে, “আল্লাহ্ তাদের খরচকৃত সম্পদের প্রতিদান দান করুন।”আল্লামা আয়নী (র) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন: ফেরেশতাদের দোয়ার অর্থ হলো: সৎ পথে ব্যয় করার দরুন যে সম্পদ তোমাদের হাত ছাড়া হলো আল্লাহ তায়ালা তার বিনিময় দান করবেন। (উমদাতুল কারী ৮/৩০৭)মোল্লা আলী কারী (র) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ফেরেশতাদের দোয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত خلفا শব্দের অর্থ হলো মহাপুরস্কার। (মেরকাতুল মাফাতিহ ৪/৩৬৬)হাফেজ ইবনে হাজার (র) এ হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি চমৎকার কথা বলেছেন, ফেরেশতাদের দোয়ায় সৎপথে ব্যয় করার পুরস্কার নির্দিষ্ট নয়। কেননা এর তাৎপর্য হলো, যাতে করে এতে সম্পদ, সাওয়াব ও অন্যান্য জিনিসও শামিল হয়। সৎপথে ব্যয়কারীদের অনেকেই উক্ত সম্পদ ব্যয়ের প্রতিদান পাওয়ার পূর্বেই ইন্তেকাল করেন এবং তার প্রতিদান নেকীর আকারে পরকালে অবধারিত হয় অথবা উক্ত খরচের বিনিময়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে যাওয়ার মাধ্যম হয়ে থাকে। (ফাতহুল বারী ৩/২০৫)২. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, ইমাম ইবনে হিব্বান ও ইমাম হাকেম (র) আবুদ দারদা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—“প্রতিদিন সূর্য উদয়ের সময় তার দুই পার্শ্বে দুই ফেরেশতাকে প্রেরণ করা হয়। তারা বলতে থাকে, হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রভুর দিকে অগ্রসর হও। পরিতৃপ্তকারী অল্প সম্পদ, উদাসীনকারী অধিক সম্পদ হতে উত্তম। তাদের কথা মানুষ ও জিন ব্যতীত সবাই শুনতে পায়।অনুরূপ সূর্য ডুবার সময় তার পার্শ্বে দুই ফেরেশতা প্রেরণ করা হয়, তারা বলতে থাকে, হে আল্লাহ! দানকারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে দাও এবং যারা দান করে না তাদের সম্পদকে ধ্বংস করে দাও। তাদের কথা মানুষ ও জ্বিন ব্যতীত সবাই শুনতে পায়।” (আল মুসনাদ ৫/১৯৭, আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৩৩২৯, ৮/১২১-১২২, আল মুসতাদরাক আলাস সহীহায়ন ২/৪৪৫, ইমাম হাকেম এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন, শায়খ আলবানীও এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সহীহ হাদীস সিরিজ হাদীস নং ৪৪৪ ও সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ১/৪৫৬)৩. ইমাম আহমাদ ও ইবনে হিব্বান (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূল (ﷺ) হতে বর্ণনা করেন, তিনি এরশাদ করেন—“জান্নাতের দরজার পার্শ্বে এক ফেরেশতা দাঁড়িয়ে বলেন, যে ব্যক্তি আজ ঋণ (আল্লাহর রাস্তায় দান করবে) দিবে, তার প্রতিদান পাবে আগামীকাল (কিয়ামত দিবসে।)”আর অন্য দরজায় এক ফেরেশতা দাড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহ! দানকারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে দাও এবং যারা দান করে না তাদের সম্পদকে ধ্বংস করে দাও। (আল মুসনাদ ২/৩০৫-৩০৬, আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৩৩৩৩, ৮/১২৪) ইমাম ইবনে হিব্বান (র) এ হাদীসটির ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় রচনা করেন—“খরচকারীদের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য ফেরেশতাদের দোয়া এবং যারা দান করে না তাদের সম্পদ ধ্বংসের জন্য ফেরেশতাদের বদ দোয়ার বর্ণনা।” (আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৮/১২৪)হে দয়াময় আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে খরচকারীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করুন, যাদের প্রতিদানের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করে থাকে। আমীন।

১৩৬. রোযার সাহরী ভক্ষণকারীগণ

ফেরেশতাদের দোয়াপ্রাপ্ত সৌভাগ্যবানদের ১৪তম হলো ঐ সকল ব্যক্তি যারা রোযা রাখার নিয়তে সাহরী খায়। এর প্রমাণ স্বরূপ নিম্নে দু'টি হাদীস উল্লেখ করা হলো- ১. ইমাম ইবনে হিব্বান এবং তাবারানী (র) আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সাহরী ভক্ষণকারীদের জন্য দয়া করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন।” (আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৩৪৬৭, ৮/২৪৬, শায়খ আলবানী এ হাদীসকে সহীহ' বলেছেন- দেখুন: সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ১/৫১৯)ইমাম ইবনে হিব্বান (র) হাদীসটির ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় রচনা করেন— “সাহরী ভক্ষণকারীদের জন্য আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা ও ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনার বর্ণনা অধ্যায়।” (আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৮/২৪৫)“সাহরী খাওয়াতে বরকত রয়েছে, সাহরী কখনো ছাড়বে না যদিও এক ঢোক পানি পান করেও হয়। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সাহরী গ্রহণকারীদের ওপর দয়া করেন এবং তাদের জন্য ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন।” (আল মুসনাদ ৩/১২)এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, রাসূল (ﷺ) তার উম্মত সাহরী খেয়ে আল্লাহর রহমত ও ফেরেশতাদের দোয়ায় ধন্য হোক-এ কামনায় যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। এ জন্য মুসলিমদেরকে উৎসাহ দান করেছেন, তারা যদি কোন খাদ্য নাও খেতে পায় কমপক্ষে যেন এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরী গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। (বুলুগুল মাআনী ১০/১৬)শায়খ আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আল-বান্না এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন। আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক দরূদ এর অর্থ হলো, তিনি সাহরী গ্রহণকারীর ওপর তার রহমত অবতীর্ণ করেন এবং ফেরেশতাদের দরূদ হলো, তারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আর যারা সাহরী খায় না তারা আল্লাহর রহমত ও ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনা থেকে বঞ্চিত হয়। (পূর্বের টিকা দ্র:১০/১৬)হে আমাদের দয়াময় প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে আপনার রহমত ও ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনা হতে বঞ্চিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করবেন না। আপনি কবুল করুন, হে প্রার্থনা শ্রবণকারী।এছাড়াও অন্যান্য হাদীসেও নবী (ﷺ) এই সাহরী খাওয়ার প্রতি উৎসাহ দান করেছেন, তার মধ্য হতে চারটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো:১. ইমাম মুসলিম (র) আমর ইবনুল আস (রা) হতে বর্ণনা করেন, নবী (ﷺ) এরশাদ করেন— “আমাদের ও ইহুদী খ্রিষ্টানদের রোযার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরী খাওয়া।” (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৪৬ (১০৯৬) ২/৭৭০-৭৭১)ইমাম নওয়াবী (র) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, আমাদের রোযা ও ইহূদী ও খ্রিষ্টানদের রোযার মাঝে চুড়ান্ত পার্থক্যকারী বিষয়টি হলো সাহরী খাওয়া। কেননা তারা সাহরী খায় না এবং আমাদের জন্য সাহরী খাওয়া হলো মুস্তাহাব। (শারহু নববী ৭/২০৭)২. ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) আনাস (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) এরশাদ করেন—“তোমরা সাহরী খাও কেননা সাহরী খাওয়াতে বরকত রয়েছে।” [(বুখারী হাদীস নং ১৯২৩, ৪/১৩৯, সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৪৫ (১০৯৫৩ ২/৭৭০)]৩. ইমাম নাসায়ী (র) মেকদাদ বিন মাদিকারেব (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি। বলেন, নবী (ﷺ) এরশাদ করেন—“তোমরা অবশ্যই সাহরী খাবে কেননা তা বরকতময় খাদ্য। (সুনানে নাসায়ী ৪/১৪৬, শায়খ আলবানী এ হাদীসের সনদকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সহীহ সুনানে নাসায়ী ২/৪৬৬)৪. ইমাম নাসায়ী (র) এরবাজ বিন সারিয়াহ (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—অর্থাৎ, “তোমরা বরকতময় খাদ্যের দিকে ধাবমান হও।” (সুনানে নাসায়ী ৪/১৪৫, শায়খ আলবানী এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। দেখুন সহীহ সুনানে নাসায়ী ২/৪৬৫-৪৬৬)সালফে সালেহীনগণ সাহরী খাওয়ার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। এ ব্যাপারে ইমাম দারেমী আমর ইবনুল আস (রা)-এর দাস আবু কায়েস হতে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমর বিন আস (রা) সাহরী খানা তৈরির নির্দেশ দিতেন, তবে তিনি তা হতে বেশী খেতেন না। আমি তাকে বললাম, আপনি তো আমাকে খাদ্য তৈরির নির্দেশ দেন, কিন্তু তা আপনি অল্প আহার করে থাকেন।তিনি উত্তর দিলেন— “খাওয়ার প্রতি লিপ্সায় আমি তোমাকে নির্দেশ দেই না; বরং আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, আমাদের রোযা ও ইহুদী খ্রিষ্টানদের রোযার মাঝে পার্থক্য হলো সাহরী খাওয়া।” (সুনানে দারেমী হাদীস নং ১৭০৪, ১৩৩৮-৩৩৯)হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এমন বরকতময় খাদ্য খাওয়ান এবং তা হতে বরকত হাসল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

১৩৭. এমন রোযাদার যাদের সম্মুখে পানাহার করা হয়

ফেরেশতাদের দোয়ায় ধন্য ব্যক্তিদের ১৫তম ব্যক্তিরা হলো ঐ সকল রোযাদার ব্যক্তি, যাদের সামনে পানাহার করা হয় আর তারা আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টির নিমিত্তে পানাহার করা থেকে বিরত থেকে রোযাকে পূর্ণ করে।ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল ও ইবনে মাজাহ (র) উম্মে আম্মারাহ (রা) হতে বর্ণনা করেন, একদা তাঁর নিকট নবীর আগমন করলেন, বর্ণনাকারী বলেন, তাদের গোষ্ঠির কয়েকজন লোক তার ঘরে একত্রিত হলো, তিনি তাদের সবার জন্য খেজুর নিয়ে আসলেন, সবাই খেজুর খাওয়া আরম্ভ করল, কিন্তু এক ব্যক্তি খাওয়া হতে বিরত থাকল, তা দেখে নবী (ﷺ) তাঁকে বললেন— “ব্যাপার কি সে খাচ্ছে না কেন? সে বলল, আমি রোযা রেখেছি।অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন— রোযাদারের সামনে যতক্ষণ পর্যন্ত খানা খাওয়া হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতারা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে।”(আল মুসনাদ ৭/৩৭০, সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং ১৭৫২, ১/৩২০-৩২১, শায়খ আহমদ আলবান্না এ হাদীসের সনদকে ‘জায়েদ বলেছেন। দেখুন: বুলুগুল আমানী ৯/২১৭)অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, যা ইমাম আহমাদ, তিরমিজী ইমাম, খুযায়মা এবং ইবনে হিব্বান (র) উম্মে আম্মারাহ (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—“যখন রোযাদারের সামনে খাওয়া হয়, নিশ্চয়ই তখন ফেরেশতারা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে তাদের শেষ হওয়া পর্যন্ত।” (আল মুসনাদ ৭/৪৩৯, জামে তিরমিজী ৪/৬৭, সহীহ ইবনে খুযায়মা হাদীস নং ২১৩৮, ৩/৩০৭ আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ২৪৩০, ৮/২১৬-২০১৭)ইমাম ইবনে খুযায়মা এ হাদীসটি নিম্নের অধ্যায়ে রচনা করেন- রোযাদারের সামনে রোযাদার ব্যক্তিরা খাদ্য খাওয়ার সময় রোযাদারের জন্য ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনা। (সহীহ ইবনে খুযায়মা ৩/৩০৭)ইমাম ইবনে হিব্বান (র) এ হাদীসটি নিম্নের অধ্যায়ে রচনা করেন রোযাদারের সামনে রোযাদার ব্যক্তিরা খাদ্য খাওয়ার সময় রোযাদারের জন্য ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনা। (আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ হিব্বান হাদীস নং ৮/২১৬)শায়খ আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আল-বান্না রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী صَلَّتْ عَلَيْهِ الْمَلَائِكَتةُ -এর ব্যাখ্যায় বলেন, খাওয়ার সুযোগ পাওয়ার পরও ক্ষুধায় ধৈর্যধারণ করার জন্য ফেরেশতারা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। বিশেষ করে যখন তার মন খেতে চায় ও রোযা রাখা তার ওপর কষ্টসাধ্য হয়। (বুলুগুল মাআনী ৯/২১৭, মেরকাতুল মাফাতিহ ৪/৫৭৮, তুহফাতুল আহওয়াযী ২/৬৭)হে দয়ালু দয়াময় প্রতিপালক! আপনি দয়া করে আমাদেরকে সেই লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন।

১৩৮. যারা রোগী পরিদর্শনে যায়

ফেরেশতাদের দোয়া পেয়ে সৌভাগ্যবানদের ১৬তম ব্যক্তিরা হলো ঐ সকল লোক যারা তার কোন মুসলিম রোগী ভাইকে দেখতে যায়। ইমাম আহমাদ ও ইবনে হিব্বান (র) আলী (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি—“যে কোন মুসলিম তার অপর মুসলমান রোগী ভাইকে দেখতে যায়, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করেন, তারা দিনের যে সময় সে দেখতে যায় সে সময় থেকে দিনের শেষ পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং সে রাতের যে সময় দেখতে যায় সে সময় থেকে রাতের শেষ পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে।” (আল মুসনাদ হাদীস নং ৭৫৪, ২/১১০ আল ইহসান ফি করিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ২৯৫৮, ৭/২২৪-২২৫, শায়খ আহমাদ শাকের হাদীসটির সনদকে সহীহ সাব্যস্ত করেন। দেখুন: আল মুসনাদের টিকা ২/১১০)ইমাম ইবনে হিব্বান (র) এ হাদীসটির ভিত্তিতে নিম্নের অধ্যায় স্থাপন করেনরোগী পরিদর্শনকারীর জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা ও সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনার বর্ণনা। (আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৭/২২৪)শায়খ আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আল-বান্না এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন ফেরেশতা কর্তৃক মানুষের জন্য দরূদ পাঠ করার অর্থ হলো, তাদের জন্য রহমত ও ক্ষমার জন্য দোয়া করা।আর নবী (ﷺ)-এর বাণী—مِنْ اَىِّ سَاعَاتِ النَّهَارِএর অর্থ হলো, যদি রোগীর পরিদর্শন দিনে হয়, তবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ফেরেশতারা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। এজন্য যারা রোগীকে দেখতে যাবে, তাদের উচিত তারা যেন দিনে বা রাতের প্রথম দিকে দেখতে যায়, যাতে করে ফেরেশতাদের দোয়া বেশীক্ষণ ধরে চলতে থাকে। (বুলুগুল আমানী ৮/১৬)অন্য একটি বর্ণনাতে রোগীদের পরিদর্শনকারীর জন্য ফেরেশতাদের দরূদ এর অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে এবং এও বলা হয়েছে যে, তাদের জন্য জান্নাতে একটি বাগান তৈরি করা হয়।ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (র) আলী (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ কে বলতে শুনেছি—“যে ব্যক্তি সকাল বেলা কোন রোগীকে দেখতে গেল তার সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা যায় এবং তারা সবাই সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান নির্ধারণ করা হয়। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় কোন রোগীকে দেখতে গেল, তার সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা যায় এবং তারা সবাই সকাল পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান নির্ধারণ করা হয়।” (আল মুসনাদ হাদীস নং ৯৭৫, ২/২০৬, শায়খ আহমদ শাকের এ হাদীসের সনদকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: মুসনাদের টিকা ২২০৬)আল্লাহু আকবার! এ আমলটি কতই না সহজ এবং এর সওয়াব ও প্রতিদান কতই না মহান। হে আমার দয়ালু দয়াময় পালনকর্তা! আপনি এ অধমকে এ কাজগুলি করার তাওফীক দান করুন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।রোগী দেখতে যাওয়ার সওয়াব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ তাঁর উম্মতদের জন্য অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন, যা হতে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো—১. যখন কেউ রোগী দেখার জন্য বাড়ী হতে বের হয় তখন আল্লাহর রহমতে আচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং যখন সে রোগী দেখতে গিয়ে রোগীর কাছে বসে সে আল্লাহর রহমতের মাঝে ডুবে যায়।ইমাম আহমদ (র) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন—“যে ব্যক্তি রোগী দেখতে গেল, সে ফিরে আসা পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে আচ্ছন্ন থাকল এবং যখন সে রোগীর কাছে বসে তখন সে রহমতের ভিতর ডুবে থাকে।” (আল মুসনাদ ৩/৩০৪, শায়খ আলবানী হাদীসটির অধিক শাহেদের জন্য সহীহ সাব্যস্ত করেন। দেখুন: মিশকাতুল মাসাবীর টিকা ১/৪৯৮)আল্লামা মোল্লা আলী কারী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন— রোগী দেখার নিয়তে নিজ বাড়ী থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর রহমতে প্রবেশ করে থাকে।যখন সে রোগীর কাছে বসে তখন আল্লাহর রহমতে ডুবে যায়।অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে- রহমতের মাঝে সে ডুবে হাবুডুবু খেতে থাকে। (মেরকাতুল মাফাতিহ ৪/৫২)২. রোগী দর্শনের জন্য যাওয়ার সময়ই শুধু রহমতে আচ্ছন্ন হয় না; বরং বাড়ীতে ফেরার সময়ও তাকে আল্লাহ রহমত দ্বারা আচ্ছন্ন করেন। উপরোল্লেখিত হাদীসের শব্দ— বাড়ী ফেরা পর্যন্ত রহমতে প্রবেশ করে প্রমাণ করে।এছাড়া আরো একটি বর্ণনায় এসেছে— যখন সে রোগীর কাছ থেকে রওয়ানা হয় আল্লাহর রহমত তাকে ঢেকে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত যেখানে থেকে সে এসেছে সেখানে না ফিরে। (মাজমাউয যাওয়ায়েদাহ ২/২৯৭)৩. রোগী দর্শনকারী রোগীর নিকট পৌছা মাত্রই দয়ালু দয়াময় আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব পেয়ে যায় এবং তার সন্তুষ্টি অর্জন করে।ইমাম মুসলিম (র) আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন— “কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তায়ালা বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি রোগে আক্রান্ত ছিলাম, তুমি আমার দর্শন-সেবা করনি।সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আপনি সারা বিশ্বের প্রতিপালক, আমি আপনার কেমনে সেবা করব?তিনি বললেন: তুমি কি জাননা, আমার অমুক বান্দা রোগাক্রান্ত ছিল? তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে সেখানেই আমাকে পেতে? (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩, (২৫৬৯) ৪/১৯৯০)ইমাম নববী (র) لَوَجَدَّتَنِيْ عِنْدَهُ ব্যাখ্যায় বলেন, সেখানে আমার সওয়াব ও সম্মান পেতে। (শারহু নববী ১৬/১২৬)আল্লামা মোল্লা আলী কারী (র) এর ব্যাখ্যায় বলেন, সেখানেই আমার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারতে। (মেরকাতুল মাফাতিহ ৪/১০)আল্লাহু আকবার! রোগী পরিদর্শন করা কতই না বড় প্রতিদান ও সওয়াবের কাজ।রাসূল (ﷺ) রোগীদের পরিদর্শন করার ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব দিতেন। তিনি মুসলমান রোগীদেরই শুধু দেখতে যেতেন না বরং তিনি ইয়াহুদী খৃষ্টান ও মুনাফিকদেরকেও দেখতে যেতেন। নিম্নে প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ সুনানে আবু দাউদের কয়েকটি অধ্যায় উল্লেখ করা হচ্ছে—ক. মহিলা রোগী পরিদর্শন সংক্রান্ত অধ্যায়। খ. রোগী পরিদর্শন সংক্রান্ত অধ্যায়। গ. জিম্মি রোগী পরিদর্শ সংক্রান্ত অধ্যায়। ঘ. হেঁটে রোগী পরিদর্শন করতে যাওয়া সংক্রান্ত অধ্যায়। ঙ. বার বার রোগী দেখতে যাওয়া সংক্রান্ত অধ্যায়। চ. চোখের রোগীকে দেখতে যাওয়া সংক্রান্ত অধ্যায়। ছ. রোগী দেখার সময় তার সুস্থতার জন্য দোয়া করা সংক্রান্ত অধ্যায়।উপরোল্লেখিত অধ্যায়ের বিষয়বস্তুর দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ রোগী পরিদর্শনের ব্যাপারে কত গুরুত্ব দিতেন। এ বিষয়টি সমাপ্ত করার পূর্বে নবী (ﷺ) কর্তৃক ইহূদী রোগী পরিদর্শন সম্পর্কে একটি ঘটনা নিম্নে বর্ণনা। করা হচ্ছে—“আনাস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ইহুদী বালক নবী (ﷺ)-এর খেদমত করত। সে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ায় নবী (ﷺ) তাকে দেখতে গেলেন। তার মাথার নিকটে বসে তাকে বললেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। সে তার কাছে উপস্থিত পিতার দিকে দৃষ্টিপাত করল। তার পিতা তাকে বলল, আবুল কাশেম (ﷺ)-যা বলে তা মেনে নাও।অতঃপর সে ইসলাম কবুল করল, তারপর নবী (ﷺ) আর তার কাছ থেকে বের হওয়ার সময় বলতে লাগলেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য, যিনি এ বালকটিকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করলেন।” (সহীহ বুখারী হাদীস নং ১৩৬, ৩/২১৯)

১৩৯. যারা রোগী ও মৃত ব্যক্তির নিকট উত্তম কথা বলে

যে কথাগুলি কবুল হওয়ার জন্য ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে তন্মধ্যে রোগী ও মৃত ব্যক্তির নিকট যা বলা হয়।ইমাম আহমাদ, মুসলিম, তরমিজী ও বায়হাকী (র) উম্মে সালামাহ (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন—“তোমরা যখন কোন রোগী বা মৃত ব্যক্তির নিকট উপস্থিত হবে তখন ভাল দোয়া করবে। কেননা ফেরেশতারা তা কবুল হওয়ার জন্য আমীন বলে থাকে।” (আল মুসনাদে ৬/৩২২, সহীহ মুসলিম ৬ (৯১৯) ২/৬৩৩, জামে তিরমিজী হাদীস নং ৯৮৪, ৪/৪৬, সুনানে কুবরা লিল বায়হাকী হাদীস নং ৭১২৪, ৪/১০৭ শব্দগুলি মুসলিমের।)হাদীসে উল্লেখিত اَلْمَيِتُ শব্দের দুটি অর্থ হতে পারে। যথা- (ক) মুমূর্ষ ব্যক্তি (খ) মৃত ব্যক্তি।যদি প্রথম অর্থ মেনে নেয়া হয়, তবে হাদীসের শব্দ اَلْمَرِيْضُ اَوِ الْمَيِّتُ -এর মাঝে اَوْ অব্যয়টিতে বর্ণনাকারী সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, হাদীসে اَلْمَرِيْضُ রোগী অথবা الْمَيِّتُ মৃত ব্যক্তি। যার অর্থ দাঁড়ায় মুমূর্ষ ব্যক্তি।যদি দ্বিতীয় অর্থ নেয়া হয়, তবে اَلْمَرِيْضُ اَوِ الْمَيْتُ এর অর্থ দাঁড়ায় তোমরা যখন রোগীর নিকটে যাও বা মৃত ব্যক্তির নিকটে যাও উভয় স্থানেই গুরুত্ব অবলম্বন করে ভাল উক্তি কর।রোগীর নিকটে গেলে আল্লাহ্ তায়ালার সমীপে তার জন্য রোগ মুক্তির দোয়া করো এবং মৃত ব্যক্তির নিকট গেলে তার ক্ষমার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করবে। অনুরূপ যে জায়গায় যাও নিজের জন্য ভাল কথাই বলবে। (মেরকাতুল মাফাতিহ ৪/৮৪)ইমাম নববী (র) বলেন, এ হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে যে, এ ধরনের স্থানে যেন উত্তম কথা বলা হয়। আল্লাহ তায়ালার নিকট তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় এবং তার প্রতি যেন মেহেরবানী, সহজ ও নরম ব্যবহার করা হয় সে জন্য দোয়া করা হয়। এ হাদীস হতে এও জানা গেল যে, এ রকম জায়গা ফেরেশতারা উপস্থিত হয় এবং যে ব্যক্তি যে উক্তি করে তা কবুল হওয়ার জন্য তারা আমীন বলে থাকে। (শারহু নববী ৬/২২২)যেহেতু এ হাদীসে রোগী ও মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে ভাল উক্তিকারীর উক্তিকে কবুল হওয়ার জন্য আমীন বলার সুসংবাদ রয়েছে। অতএব এমন স্থানে খারাপ উক্তি প্রকাশ করার ব্যাপারেও বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। কেননা তাও কবুল হওয়ার জন্য ফেরেশতারা আমীন বলে থাকে।হে আল্লাহ দয়ালু দয়াবান! আপনি উল্লিখিত দুই স্থানেই আমাদেরকে উত্তম কথা বলার তাওফীক দান করুন। আমীন।

১৪০. যারা লোকদেরকে উত্তম কথা শিক্ষা দেয়

ফেরেশতাদের দোয়ায় ধন্য ব্যক্তিদের উনিশতম ব্যক্তিরা হলো ঐ সকল সৌভাগ্যবান যারা মানুষকে ভাল কথা শিক্ষা দিয়ে থাকে।ইমাম তিরমিজী (র) আবু উমামা বাহেলী (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সামনে দুই ব্যক্তি সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হলো, যাদের একজন আলেম, অপরজন আবেদ তথা ইবাদতকারী। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করলেন—“আবেদের তুলনায় আলেমের মর্যাদা হলো, যেমন- তোমাদের সর্বনিম্ন লোকের তুলনায় আমার মর্যাদা।” (এর অর্থ ঐ ইবাদতকারী ব্যক্তি যে, শরীয়তের জরুরী বিষয়ে অবগত। দেখুন: মেরকাতুল মাফাতিহ: ১/৪৭২)(এখানে আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তি বলতে বুঝায় শরীয়ত সম্পর্কে জ্ঞাত আলেম বা জ্ঞানী ও সে অনুযায়ী আমলকারী। দেখুন: মেরকাতুল মাফাতিহ ১/৪৭২)তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন— “নিশ্চয় মানুষকে ভাল কথা শিক্ষা প্রদানকারীর প্রতি আল্লাহ্ তায়ালা দয়া করে থাকেন এবং ফেরেশতারা, 'আসমান ও জমিনের অধিবাসীরা এমন কি গর্তের পিপিলিকা ও পানির মৎসও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন।” (জামে তিরমিজী, হাদীস নং ২৮২৫, ৭/৩৭৯-৩৮০, শায়খ আলবানী এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সহীহ সুনানে তিরমিজী ২/৩৪৩)হাদীসে মানুষকে উত্তম কথা শিক্ষা দেয়ার অর্থের ব্যাপারে মোল্লা আলী কারী (র) বর্ণনা করেছে, দ্বীনি শিক্ষা এবং এমন শিক্ষা যার সাথে মানুষের মুক্তি জড়িত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য ক্ষমার উল্লেখ করেননি; বরং مُعَلِّمُ النّاسِ الخَيْرِ অর্থাৎ, মানুষের উত্তম শিক্ষা দাতার কথা বলেছেন। যেন তার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উক্ত ক্ষমার উপযুক্ত ঐ শিক্ষক যিনি মানুষকে কল্যাণের পথে পৌছার জন্য ইলম শিক্ষা প্রদান করে থাকেন। (মেরকাতুল মাফাতিহ ১/৪৭৩)আল্লাহু আকবার! দ্বীন শিক্ষাদাতার সওয়াব কতই না মহান। হে আল্লাহ্! এ অধমদেরকে ঐ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করবেন না। আমীন।সুশিক্ষাদাতাদের এ মহাসওয়াবের রহস্য বর্ণনা করে ইমাম ইবনে কাইয়্যিম বলেন: যেহেতু তার দ্বীনি শিক্ষা-সুশিক্ষা প্রদান মানুষের জন্য মুক্তি ও সৌভাগ্যের কারণ, এবং এজন্যে তাদের আত্মিক পবিত্রতাও অর্জন হয়, যেহেতু আল্লাহ তায়ালা তার জন্য অনুরূপ প্রতিদান ঘোষণা করেন, যা তাকে ফেরেশতা ও বিশ্ববাসীর দোয়ার অধিকারী বানিয়েছেন এবং তার মুক্তি, সৌভাগ্য ও সফলতার কারণ সাব্যস্ত হয়েছে।এছাড়াও যখন সৎ শিক্ষা প্রদানকারী আল্লাহ্ তায়ালার দ্বীন ও বিধি-বিধানকে মানুষের সামনে ফুটিয়ে তোলে এবং তার নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে লোকদেরকে সচেতন করে তখন আল্লাহ্ তায়ালাও তার প্রতিদান হিসেবে স্বীয় ক্ষমা প্রদান ও বিশ্ববাসীর দোয়ার মাধ্যমে তার মর্যাদার চর্চা ও তার প্রশংসা আকাশ ও পৃথিবীবাসীর সম্মুখে করেন। (মেফতাহ দারুস সায়াদাহ ১/৬৩ উক্ত বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: “ফযলুদ দাওয়াহ ইলাল্লাহ তায়ালা” নামক গ্রন্থেও ৫৬/৬০ পৃঃ)

১৪১. মুমিন ও তাদের সৎকর্মশীল আত্মীয়গণ

কিছু এমন সৌভাগ্যবান লোক আছে, যাদের জন্য আল্লাহ্ তায়ালার আরশ বহনকারী ও তাদের পার্শ্ববর্তী সম্মানিত ফেরেশতারা দোয়া করে থাকে। এ মহাসত্যের বর্ণনা নিম্নের আয়াতগুলিতে রয়েছে—الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَّحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ ﴿٧﴾ رَبَّنَا وَأَدْخِلْهُمْ جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدتَّهُمْ وَمَن صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿٨﴾ وَقِهِمُ السَّيِّئَاتِ ۚ وَمَن تَقِ السَّيِّئَاتِ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمْتَهُ ۚ وَذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ﴿٩﴾অর্থঃ (৭) যারা আরশকে ধারণ করে এবং যারা এর চারপাশে রয়েছে, তারা তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করে এবং তাঁর প্রতি ঈমান রাখে। আর মুমিনদের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলে যে, ‘হে আমাদের রব, আপনি রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সব কিছুকে পরিব্যপ্ত করে রয়েছেন। অতএব যারা তাওবা করে এবং আপনার পথ অনুসরণ করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আর জাহান্নামের আযাব থেকে আপনি তাদেরকে রক্ষা করুন’। (৮) ‘হে আমাদের রব, আর আপনি তাদেরকে স্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করান, যার ওয়াদা আপনি তাদেরকে দিয়েছেন। আর তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নি ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম সম্পাদন করেছে তাদেরকেও। নিশ্চয় আপনি মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রজ্ঞাময়।’ (৯) ‘আর আপনি তাদের অপরাধের আযাব হতে রক্ষা করুন এবং সেদিন আপনি যাকে অপরাধের আযাব থেকে রক্ষা করবেন, অবশ্যই তাকে অনুগ্রহ করবেন। আর এটিই মহাসাফল্য।’ (সূরা মুমিনঃ ৭-৯)এখানে নিম্নের বিষয়গুলি উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি—১. আল্লাহ তায়ালার আরশ বহনকারী ও তাদের পার্শ্ববর্তী ফেরেশতারা মুমিনদের জন্য দোয়া করে থাকে। সে ফেরেশতাদের সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী (র) বলেন: তারা হলো উচ্চ মর্যাদাবান ও সম্মানিত ফেরেশতামণ্ডলী। (তাফসীরে কুরতুবী ১৫/২৯৪, আল মুহাররার আল ওয়াজিজ ও ১৪/১১৬, তাফসীরে বায়জাবী ৪/৩৩৫)শায়খ সাদী (র) ঐ সকল ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলেন, যে সকল ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালা আরশ বহনের দায়িত্ব দিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তারা সবার চেয়ে উচ্চ মর্যাদান ও শক্তিশালী ফেরেশতা। তাদেরকে আল্লাহর আরশ বহণের দায়িত্ব অর্পণ এবং অগ্রে তাদের নাম উল্লেখ এবং আল্লাহর নিকটে অবস্থানই প্রমাণ করে যে, তারা উচ্চ মর্যাদাবান ও সম্মানিত ফেরেশতা। (তাফসীরে সা'দী ৮০০ পৃ:)২. যাদের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করে থাকে উল্লেখিত আয়াতে তাদের তিনটি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। যথা:ক. ঈমানঃ এ গুণের বর্ণনা আল্লাহ্ তায়ালার উল্লেখিত বাণীতে রয়েছে, وَيَسْتَغْفِرُوْنَ لِلَّذِيْنَ اٰمَنُوْاঅর্থঃ মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।শায়খ সাদী (র) স্বীয় তাফসীরে সা’দীতে বলেন, ঈমানের অনেক উপকার ও ফযিলত রয়েছে। তন্মধ্যে আল্লাহ তায়ালার ওপর বিশ্বাসীদের জন্য ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। ঈমানদারের এ মহা সৌভাগ্যটি ঈমানের বদৌলতে অর্জন হয়ে থাকে। (তাফসীরে সাদী পৃঃ ৮০০, তাফসীরে বায়জাবী ২/৩৩৫ ও তাফসীরে কাসেমী ১৪/২২৫)খ. তাওবা: এ গুণের বর্ণনা আল্লাহ তায়ালার উল্লেখিত বাণীতে রয়েছে فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا অর্থাৎ, যারা তওবা করে তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। (তাফসীরে কুরতুবী ১৫/২৯৫ ও তাফসীরে সা’দী ৮০১ পৃ:)ইমাম কুরতুবী (র) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, তারা শিরক ও অন্যান্য গুনাহ হতে তওবা করে।গ. আল্লাহর রাস্তার অনুসরণ: এ গুণের বর্ণনা আল্লাহ তায়ালার উল্লেখিত বাণীতে রয়েছে, فَاتَّبِعُوْا سَبِيْلَكَ অর্থাৎ, অতঃপর তোমার পথ অবলম্বন করে। (তাফসীরে কুরতুবী ১৫/২৯৫, তাফসীরে বাগাবী ৪/৯৩ যাদুল মাসির ৭/২০২ ও ফাতহুল কাদীর ৪/২৮৬)ইমাম কুরতুবী (র) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, তারা দ্বীনে ইসলামের অনুসরণ করে।৩. উপরোল্লিখিত গুণে গুণান্বিত ঈমানদারদের জন্য ফেরেশতারা আল্লাহর সমীপে নিমের পাঁচটি বস্তু প্রার্থনা করে থাকে—ক. তাদের গোনাহ মাফের জন্য দোয়াঃ তা আল্লাহর তায়ালার নিম্নের আয়াতে উল্লেখ রয়েছে—“আর তাদেরকে মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। অতএব যারা তওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বন করে তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর।”খ. তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির জন্য দোয়াঃ যা আল্লাহ তায়ালা নিম্নের আয়াতে বর্ণনা করেছেন— “আর জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা কর।”গ. তাদেরকে সর্বাবস্থায় জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য দোয়া ও যা দয়াময় আল্লাহ তায়ালার এ আয়াতে উল্লেখ করেছেন— “হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তাদেরকে দাখিল কর স্থায়ী জান্নাতে, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদেরকে দিয়েছ।”ঘ. সৎ আমলকারীর পিতা পিতামহ, বিবি-বাচ্চাদেরকে সর্বাবস্থায় জান্নাতে প্রবেশ করানোর দোয়া ও যা আল্লাহ তায়ালার নিম্নের আয়াতে প্রকাশ পেয়েছে— “তাদের পিতামাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরকেও।এ দোয়ার অর্থ হলো, এ তিন প্রকার লোকদের তাদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করানো এবং তা এ জন্যই যে, যদি খুশির সময় নিজের জ্ঞাতি সম্পৰ্কীয় লোক সাথে থাকে কতই না আনন্দদায়ক হয়। (আত-তাফসীরুল কাবীর ২৭/৩৭)ঙ. তাদেরকে বিপদ-আপদ ও মন্দ থেকে বাঁচাবার জন্য দোয়াঃ তা আল্লাহ তায়ালার নিম্নের আয়াতে উল্লেখ রয়েছে—“আর তুমি তাদেরকে শাস্তি হতে রক্ষা কর। সে দিন তুমি যাকে শাস্তি হতে রক্ষা করবে তাকে তো অনুগ্রহই করবে।”শায়খ সা'দী (র) এ অংশের তাফসীরে বলেন, এর অর্থ হলো হে আল্লাহ! অসৎ আমল ও তার শাস্তি থেকে বাঁচান। (তাফসীরে সা’দী ৮০১ পৃ:, তাফসীর ইবনে কাসীর ৪/৭৬ ফাতহুল কাদীর ৪/৬৮৭)৪. ফেরেশতাদের উল্লেখিত দোয়া পাওয়া কত বড় প্রতিদান। যে ব্যক্তি তা পাবে সে কত বড়ই না ভাগ্যবান।ইয়াহইয়া বিন মুয়াজ (র) এ আয়াত সম্পর্কে তার সঙ্গীদের বলেন, জান্নাতের আশা প্রদানকারী এর চেয়ে আর বড় কথা হতে পারে না।যদি একজন ফেরেশতা সারা বিশ্বের ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তায়ালা সবাইকে ক্ষমা করে দিবেন। সুতরাং সমস্ত ফেরেশতা এমনকি আরশ বহনকারী ফেরেশতারা পর্যন্ত মুমিনদের জন্য দোয়া করবে তারপরও কি আল্লাহ ক্ষমা করবেন না? (তাফসীরে কুরতুবী ১৫/২৯৫)শায়খ মুহাম্মদ জামাল উদ্দীন কাসেমী (র) বলেন, ফেরেশতাদের তাসবীহ ও তাহমীদ পাঠ করা (যা তাদের জন্য ফরজ) ও ঈমানের সাথে তাদের উল্লেখ এবং মুমিনদের জন্য তাদের ক্ষমা প্রার্থনায় এ কথার দিকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, তারা মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং আল্লাহ্ তায়ালা তাদের দোয়া কবুল করে নেন। (তাফসীরে কাসেমী ১৪/২২৫)কারী খলফ বিন হিশাম (র) বর্ণনা করেন, আমি সেলিম বিন ঈসা (র)-এর নিকট কুরআন তেলাওয়াত করছিলাম, আমি যখন এ আয়াত পাঠ করলাম—وَيَسْتَغْفِرُوْنَ لِلَّذِيْنَ اٰمَنُوْاতখন তিনি বললেন, হে খলফ আল্লাহর নিকট মুমিনদের কত মর্যাদা, সে নিজের বিছানায় শুয়ে থাকে আর ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। (তাফসীরে কুরতুবী ১৫/২৯৫)মুতরাফ বিন খাইর (র) বলেন, আমি অনেক গবেষণার পর এ ফলাফলে উপনীত হয়েছি যে, মানবজাতির জন্য সমস্ত সৃষ্টি জীবের মাঝে সবচেয়ে বেশী একনিষ্ঠ ও হিতাকাক্ষী হলো ফেরেশতারা এবং মানবজাতির জন্য সমস্ত সৃষ্টি জীবের মধ্যে সর্বাধিক ধোকাবাজ হলো শয়তান। (আল মুহাররার আল ওয়াজিজ ১৪/১১৭, তাফসীরে বাগাবী ৪/৯৩, তাফসীরে কুরতুবী ১৫/২৯৫ ও তাফসীরে ইবনে কাসীর.৪/৭৬)কাজী ইবনে আতীয়া (র) বলেন, আমার নিকট এ সংবাদ পৌছেছে যে, এক ব্যক্তি জনৈক সৎলোককে বলল, আপনি আমার জন্য দোয়া করুন, আপনি আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। সে সৎ লোকটি উত্তর দিল, তুমি তওবা কর, আল্লাহর রাস্তায় চলো, তবে তারা (ফেরেশতারা) তোমার জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে যারা আমার চেয়ে উত্তম। তারপর তিনি উল্লেখিত আয়াত পাঠ করে শুনালেন। (আল মুহাররার আল ওয়াজিজ ১৪/১১৭)হে আমার দয়াময় প্রতিপালক! আপনি আমাদের মতো এ অধমদেরকে সেই সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যারা আপনার উপর ঈমান আনয়ন করে, তওবা করে এবং আপনার রাস্তায় চলে তাদের ওপর ফেরেশতারা তাদের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করে। আমীন!

১৪২. পূর্ব-পর বিশ্ব নেতা আমাদের নবী (ﷺ)

ফেরেশতা কর্তৃক দরূদ ও দোয়া প্রাপ্তদের মধ্যে সবার উর্ধ্বে, সর্বোচ্চ মর্যাদা, সর্বশ্রেষ্ঠ, সুমহান ও পরিপূর্ণতার অধিকারী হলেন, আমাদের নবী (ﷺ) মুহাম্মদ এবং এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন—إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ ۚ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ﴿٥٦﴾অর্থঃ “নিশ্চয় আল্লাহ (ঊর্ধ্ব জগতে ফেরেশতাদের মধ্যে) নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর জন্য দো‘আ করে। হে মুমিনগণ, তোমরাও নবীর উপর দরূদ পাঠ কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।” (সূরা আহযাব: ৫৬)হাফেজ ইবনে কাসীর (র) এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন, “এ আয়াতের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তায়ালা সুউচ্চে তাঁর বান্দা ও নবী (ﷺ)-এর মর্যাদা এবং সম্মান সম্পর্কে বর্ণনা দেন যে, তিনি তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের সামনে তার ওপর অনুগ্রহ করেন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার লোকদেরকেও তাঁর ওপর সালাম জানানোর নির্দেশ দিলেন, যাতে করে দুই জগতবাসীর (ঊর্ধ্ব জগত ও দুনিয়ার জগত) কাছেই তার প্রশংসা একত্রিত হয়। (তাফসীর ইবনে কাসীর ৩/৫৫৭, আত-তাফসীরুল কাবীর ২৫/২২৭, ফাতহুল কাদীর ৪/৪৫৭ ও তাফসীরে সা’দী ৭৩১)উপরোল্লেখিত আয়াত সম্পর্কে নিম্নের বিষয়গুলির প্রতি পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি—১. আয়াতটি إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ দিয়ে আরম্ভ হয়েছে যা নামবাচক বাক্য, এবং তা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তায়ালা নবীর ওপর সার্বক্ষণিক অনুগ্রহ করছেন এবং তাঁর ফেরেশতারাও তাঁর ওপর দরূদ পাঠ করছে। আর আয়াতের দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে, يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ যা ক্রিয়াবাচক এবং প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীর ওপর অনুগ্রহ এবং ফেরেশতারা তাঁর জন্য বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন।আল্লামা আলুসী (রা) এ সম্পর্কে লিখেছেন, সার্বক্ষণিকতা প্রমাণের জন্যই নামবাচক বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে।এটাও বর্ণনা করা হয়েছে যে,إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّবাক্যের প্রথমাংশের দিক দিয়ে সার্বক্ষণিকতা প্রমাণ করে। কেননা প্রথম ভাগ নামবাচক বাক্য এবং এর দ্বিতীয় ভাগ, বারবার দরূদ পাঠানো অর্থই প্রমাণ করে। কারণ দ্বিতীয় ভাগ হলো ক্রিয়াবাচক বাক্য। সমষ্টিগতভাবে বাক্যটি থেকে বুঝা যায় যে, নবী (ﷺ)-এর প্রতি আল্লাহর দয়া ও ফেরেশতাদের দোয়া সার্বক্ষণিক, অনবরত ও বারংবার হয়ে থাকে। (রুহুল মাআনী ২২/৭৫)২. বাক্যের প্রথমে إِنَّ অব্যয় ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ হলো নিশ্চয়ই অর্থাৎ তাকিদপূর্ণ।এ সম্পর্কে আল্লামা আলুসী (র) বলেন, إِنَّ অব্যয় কোন বাক্যে ব্যবহার হলে বাক্যে বর্ণিত বিষয়টি তাকিদপূর্ণ ও সে বিষয়ের প্রতি গুরুত্বই বুঝায়। (রুহুল মাআনী ২২/৭৫)আমাদের দয়ালু প্রতিপালকের প্রতিটি কথাই সন্দেহাতীত ও সন্দেহ মুক্ত। তারপরও তার কথায় তাকিদ অব্যয় ব্যবহৃত হয় তা কত বড় অকাট্য ও শক্ত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।৩. আয়াতে নবী (ﷺ)-এর নাম উল্লেখ না করে তার বিশেষণ উল্লেখ করা হয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে আল্লাহ তায়ালার নিকট তার কত বড় মর্যাদা।আল্লামা আলুসী (র)-এর ব্যাখ্যায় বলেন, সাধারণভাবে আল্লাহ্ তায়ালা অন্যান্য নবীদের নামই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আমাদের নবী (ﷺ)-এর নাম উল্লেখ না করে, তার বিশেষণ উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা আল্লাহ্ তায়ালার নিকট আমাদের নবীর সুউচ্চ মর্যাদা ও মহাসম্মানই প্রমাণিত হয়।তারপরও শব্দটির পূর্বে আলিফ লাম দিয়ে আরেক তাগিদ বুঝিয়েছেন النَّبِيِّ (The Prophet) শব্দটি দ্বারা। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, এ বিশেষণ আমাদের নবী (ﷺ)-এর জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত। (রুহুল মাআনী ২২/৭৫-৭৬)৪. নবী (ﷺ)-এর প্রতি ফেরেশতাদের দরূদের বর্ণনার ক্ষেত্রে তাদের সম্বন্ধ আল্লাহর দিকে করা হয়েছে। আয়াতে ব্যবহৃত مَلَائِكَتَهُ (আল্লাহ তায়ালার ফেরেশতা) রহস্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লামা আলুসী (র) লিখেন, আল্লাহ্ তায়ালার দিকে ফেরেশতাদের সম্বন্ধ ব্যাপকতা বুঝানোর জন্য। অর্থাৎ সমস্ত ফেরেশতাই নবী (ﷺ)-এর প্রতি দরূদ পড়ে।আরো বলা হয় যে, আল্লাহ তায়ালা اَلْمَلَائِكَةُ এর পরিবর্তে مَلَائِكَتَهُ (আল্লাহ তায়ালার ফেরেশতা) বলেন। অর্থাৎ তাদের সম্বন্ধ নিজের দিকে করেন। আর এ সম্বন্ধ ফেরেশতাদের মহিমা ও বড় মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। এর দ্বারাও নবী (ﷺ)-এর মহত্ত ও মর্যাদার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে যায়। কেননা সম্মানিত ফেরেশতাদের প্রেরিত দরূদও তো অত্যন্ত মূল্যবান হবে। (রুহুল মাআনী ২৭৬)আল্লামা আব্দুসী আরো বলেন, এর মধ্যে ফেরেশতাদের আধিক্যের প্রতিও ইঙ্গিত রয়েছে। ফেরেশতাদের সংখ্যা এত বেশী যে, তা নিরূপণ একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। যারা নবী (ﷺ)-এর প্রতি সার্বক্ষণিক ও ধারাবাহিকতার সাথে প্রত্যেক দিন, সব সময় দরূদ পড়ে। যার মধ্যে নবী (ﷺ)-এর পরিপুর্ণ পবিত্রতা, মহিমা ও মহাসম্মানই প্রকাশিত হয়। (রুহুল মাআনী ২২/৭৬)

সেটিংস

বর্তমান ভাষা